নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
162

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৩৬]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“বুঝলে তুমি আমার এমনি একজন যে কিনা রূপক কর্মধারয় সমাসের মতন। তোমায় দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না কেবল অনুভব করা যায়। তুমি রয়েছ, হৃদয়ের মধ্যেখানি রয়েছ।” (বিষাদ মিশ্রিত কণ্ঠে)

আদিতের বিষাদমাখা কণ্ঠস্বর শুনে মুচকি হাসলো ইলা। গত একটা মাস ইলা আদিতের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। ইশ, একমাস অর্থাৎ ত্রিশ দিন। জোড়া কবুতরের কাছে এই ত্রিশ দিনও ত্রিশ বছরের মতো লাগছে। ইলা মুচকি হেসে বললো,,

“হয়তো খুব শীঘ্রই আমায় দেখতে পারবেন, ছুঁতে পারবেন। আমি জানি আমি আজীবন আপনার হৃদয়ের মধ্যেখানি থাকবো। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দ্রুতই আমি আপনার নিকট ফিরে আসছি। আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। (মুচকি হেসে)
আদিত নিশ্চুপ থাকলো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,,

“কেমন আছো?” (মৃদু স্বরে)

ইলা প্রতিউত্তরে কি বলবে খুঁজে পেলোনা! সে তো ভালো নেই! মিথ্যে বলবে? কিন্তু সে তো জানে মিথ্যে বললেও আদিত বুঝে ফেলবে সে যে ভালো নেই। মিথ্যে তবুও ইলা বললো,,

“ভালো আছি, আপনি?”

“মিথ্যে বলছো কেন? আমি তো জানি আমার ইলা ভালো নেই। আন্টি আঙ্কেলকে অনেক মনে পড়ছে তাইনা?”

“উহু, একটুও মনে করছিনা।”

“মিথ্যে যতই বলো, আদিত তোমায় জানে, চেনে। তুমি যে এক আকাশসম যাতনায় আছো তার খবর আদিত জানে। তুমি তাঁদের যতই ঘৃণা করোনা কেন তোমার অদৃশ্য সত্ত্বা তাঁদের ভালোবাসে কারণ ওনারা তোমার মা বাবা। অনেক গুলো বসন্ত তাঁদের সাথে পেরিয়েছো। তাঁদের ভালোবাসা পেয়েছো, তুমিও ভালোবেসেছো।” (ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে)

ইলা কীয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বিষাদমিশ্রিত কণ্ঠে বললো,,

“জানেন আদিত, মানুষ পাপ যখনই করুক না কেন। আজ নাহয় পঁচিশ বা চল্লিশ বছর পর হলেও এর শাস্তি পায়। পাপ সংঘঠিত হবে এবং সংঘঠনকারী শাস্তি পাবেনা এমনটা পৃথিবীতে হতেই পারেনা। পাপ করার শাস্তি একটা না একটা সময় মানুষ পাবেই পাবে। মা বাবাও ওনাদের করা পাপের শাস্তি পেয়েছে। এইযে দেখুন না পঁচিশটা বছর পর যেদিন ওনাদের দ্বারা করা পাপ সবার সামনে এসেছে সেদিনই ওনারা শাস্তি পেয়েছেন।” (নিস্তেজ স্বরে)

আদিতের ভীষণ খারাপ লাগলো ইলার প্রতি। তবু কি করার, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়। হয় খুশি দিয়ে, দুঃখ দিয়ে অথবা মৃ’ত্যু দিয়ে। একমাস আগে, সেদিন সন্ধ্যায় কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরী নিজেদের গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রমীলা চৌধুরী গাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, কৌশিক চৌধুরী গাড়ি ড্রাইভিং করছিলেন কারণ মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে শুনে উত্তেজিত হয়ে উনি এবং প্রমীলা চৌধুরী ড্রাইভারবিহীন রায় বাড়িতে গিয়েছিলেন। এদিকে স্ত্রীয়ের এমন কান্না, রায় বাড়িতে ঘটা ঘটনা, এতগুলো বছর পর ফেলে আসা স্ত্রী, ছেলের সাথে হুট করে আবার দেখা। নিজের মেয়ের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া, ডিভোর্স পেপারে সাইন করা সব মিলিয়ে কৌশিক চৌধুরী ভ্রমের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং ড্রাইভিং কন্ট্রোললেস হয়ে পড়েছিলেন যার ফলে গাড়ির সাথে একটি বড় জিনিসপত্র বহনকারী ট্রাকের মারাত্মক ভাবে সংঘর্ষণ ঘটে এবং সেখানেই কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরীর মৃ’ত্যু হয়। যার বাজে প্রভাব ইলার মস্তিষ্কে পড়েছে। যত দিন যাচ্ছিলো ইলা মানসিক ভাবে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। এদিকে ইলার মায়ের জেঠাতো বোন প্রমীলা চৌধুরী ও কৌশিক চৌধুরী এহেন মৃ’ত্যুর কথা শুনে ইলার সাথে স্বামীসহ দেখা করতে আসেন। ওনারা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেন। প্রমীলা চৌধুরীর বাবার বাড়ির লোকজন যখন জানতে পেরেছিলেন প্রমীলা একজন বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করেছেন তখন ওনারা ওনাকে তেজ্য করেছিলেন। যার ফলে ওনার মৃত্যুর খবর শুনেও কেউ আসেননি, একমাত্র ইলার আন্টি ও আঙ্কেল এসেছিলেন। ওনারা ইলার এহেন অবস্থা দেখে ইলাকে জোড়াজুড়ি করে ওনাদের সাথে আমেরিকায় নিয়ে যান।

“আচ্ছা, রাখছি। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।”

“আরে শুনো, সারু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।”

“ওহ, ভালো তো। কেমন আছে ও?”(নিষ্প্রভ কণ্ঠে)

“ভালো আছে।”(শান্ত স্বরে)

“ঠিকাছে তাহলে রাখছি।”

ইলা দ্রুত ফোন কেটে দিলো। আদিত ফোন কান থেকে নামিয়ে ফোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো “আমার আলু” দিয়ে সেভ করা ইলার নাম্বারের দিকে। মেয়েটা অনেকটা পাল্টে গেছে, আগের মতো আর হাসেনা। গম্ভীর, থমথমে মুখ করে থাকে, হেসে কথা বলে খুব কমই। আজকে কিভাবে যেন হেসে কথা বললো। ইলার পরিবর্তনের মূল কারণ হয়তো মা বাবার এমন মৃত্যু মেনে নিয়েও মেনে নিতে পারছেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদিত।


“কিছু বললে বলেন, নাহয় আমি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি।” (মিনমিনে স্বরে)

স্নিগ্ধার কথা শুনে নজর সামনে থেকে ঘুরিয়ে উৎস স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,,

“আমার শশুর বাড়ির সামনে কি এখন আমি দাঁড়াতেও পারবোনা আশ্চর্য! আর কি বলবো? কিছু বললেও তো খ্যাক করে উঠো।” (গম্ভীর কণ্ঠে)

স্নিগ্ধা চোখ বড় করে উৎসের দিকে তাকালো। কি অদ্ভুত সে কবে, কিভাবে উৎসর কথায় খ্যাক করে উঠেছে! হ্যা সে মানে প্রথমে একটু কটু কথা বলতো উৎসকে কিন্তু তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে সে বলে ফেলেছে। কিন্তু এখন! এখনের পরিস্থিতি ভিন্ন আর তার যতদূর মনে পড়ছে সে এ অব্দি উৎসর কথায় খ্যাক করে উঠেনি!

“আপনার শশুর বাড়ি এখনও হয়নি, হলে দাঁড়িয়ে থেকেন রাত দিন তখনও কিছু বলবোনা, আর আমি কবে আপনার কথায় খ্যাক করে উঠলাম?” (অবাক স্বরে)

“ভনিতা না করে বললেই তো পারো আমার মুখে ভালোবাসি শুনতে চাও! ‘কিছু বললে বলেন, নাহয় আমি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি’ এটা আবার কি?” (গম্ভীর কণ্ঠে)

স্নিগ্ধা পড়লো বিপাকে। এভাবে রাস্তার ধারে এভাবে এই লোক তাকে প্যাঁচের মধ্যে ফেলছে। স্নিগ্ধা কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে লাগলো। উৎস ভ্রু কুঁচকে নাক ফুলিয়ে বলে উঠলো,,

“ভালোবাসি তোমায়, হ্যা যাও যাও বৌদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, বাড়িতে অনেক মিষ্টি আনা হয়েছে ওসব একসাথে সব গালের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবে ঐজন্যই এতো বাড়ি যাওয়ার তাড়া!” (নাক ফুলিয়ে)

স্নিগ্ধা হতচকিত হয়ে দ্রুত চোখ বড় বড় করে পেছন ফিরে তাকালো। এরপর পাশে তাকিয়ে দেখলো খানিকটা দূরেই ফুলগাছের কাছে বিপুল রায় দাঁড়িয়ে আছেন তার দিকে তাকিয়ে। মনে মনে নিজের কপালে নিজে দুটো থা’প্প’ড় মা’রলো স্নিগ্ধা। এই লোকের কি, লোকটা কিছু বলেই দপাদপ পা ফেলে চলে যাবে আর আশেপাশের লোকজন সেসব শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এই যেমন তার বাবাই তার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। আর এদিকে জনাব তো উল্টো ঘুরে দপাদপ পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসে কেটে পড়েছেন। স্নিগ্ধার কি হবে এই লোকের সাথে বিয়ে হলে। বয়সে এতো বড়, কার্ডিয়াক সার্জন হয়েও একমাত্র তার বেলাতেই যেখানে সেখানে ন্যাকামি মার্কা বোম ছুঁড়ে পগারপার হয়ে যায়! আর সবার সাথে এমন ভাবে কথা বলে যেন পৃথিবীতে ওনার মতো ম্যাচিউর পার্সন আর একটাও নেই। শুধু তার বেলাতেই এমন বোম ছুড়াছুড়ি!
স্নিগ্ধা একনজর বাবার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পদে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। এদিকে বিপুল রায় মেয়ের এহেন কান্ড দেখে মৃদু হাসলেন।
ইশ চারদিকে কত খুশি, খুশিটা আরও বৃদ্ধি পেতো যদি ইলা থাকতো। তাহলে ইলা আর আদিতের বিয়ে দিয়ে খুশিটা বৃদ্ধি হতো। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। এই এক মাসে কতকিছুই ঘটে গেলো জীবনে।


“আমার মন বলছে কি জানো? আমাদের না একটা ছোট সারিম হবে। তাই আজকে থেকে আমি তোমায় সারিমের মাম্মা বলে ডাকবো।” (মৃদু হেসে)

সারু আড়চোখে শেরহামকে দেখলো তারপর আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে বললো,,

“নাম ভালোই রেখেছেন তবে সারিম হবে নাকি নীরু হবে এটা এখনও ঠিক হয়নি। তাই এখন ডেকে আমায় সবার সামনে লজ্জায় ফেলবেন না।”

শেরহাম ভ্রু কুঁচকালো। সারুর হাত থেকে আইসক্রিমের বাটি কেড়ে নিয়ে বললো,

“সারিমের মাম্মা ডাকবো এটাই ফাইনাল। বেশি বলবে তো আইসক্রিম খেতে দেবোনা।” (ভ্রু কুঁচকে)

সারুও কম যায়না, ফুস করে উঠে নাক ফুলিয়ে বলে উঠলো,,

“আপনি কি লেদু? কথায় কথায় এটা খেতে দেবোনা ওটা খেতে দেবোনা বলে খাবার নিয়ে টানাটানি করেন কেন? নিজ থেকে এনে দিয়ে আবার নিজ থেকেই টানাটানি করেন। আরেকবার এমন করবেন তো আপনাকে নিয়ে সালিশ বসাবো। দিন, ফেরত দিন আমার আইসক্রিম।” (নাক ফুলিয়ে)

শেরহাম ভ্রু কুঁচকে চেয়েই রইলো। পরক্ষণেই চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,,

“ইদানিং তুমি কথায় কথায় শুধু সালিশ বসাবে, কোর্টে চালান দিবে এসব বলো কেন? দিন দিন কি কল্যাণী রায় টু পয়েন্ট জিরো হয়ে যাচ্ছো নাকি?” (চিন্তিত স্বরে)

সারু দেখিয়ে দেখিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বললো,,

“আজ্ঞে হ্যা, সঠিক ধরতে পেরেছেন জনাব। দ্রুতই আমার জন্য আরেক বক্স আইসক্রিম নিয়ে আসুন অন্যথায় আপনাকে আয়নাঘরে পাঠাতে কোর্টে আপিল করে বসবো হুহ।” (ভাব নিয়ে)

“এমনিতেও আমার মনকে তো সারু নামক আয়নাঘরে পাঠিয়েই দিয়েছেন জনাবা! নতুন করে আর কোন আয়নাঘরে পাঠাবেন?” (ঠোঁট চেপে হেসে)

সারু মুখ ভেংচি দিলো। আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগী হলো আর শেরহাম সারুকে দেখায়। প্রেগন্যান্সির ছয় মাস চলছে সারুর, পেট উঁচু হয়েছে অনেকটা। পাশাপাশি আগের চেয়ে একটু স্বাস্থ্যবান হয়েছে। গাল দুটো ফুলো ফুলো হয়ে উঠেছে। শেরহামের কাছে ভালোই লাগে দেখতে, ইচ্ছে করতে গাল টেনে দিতে। কিন্তু দেয়না, আলতো অধর স্পর্শ করায়। ইশ, কত্ত ভালো লাগে। শেরহাম ভেবেই মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। জীবনে আর যতগুলো বসন্ত অপেক্ষিত, সবগুলো বসন্তই শেরহাম এই মানবীটির সাথে অতিবাহিত করতে মা’রা’ত্ম’ক ভাবে ইচ্ছুক।
শেরহাম মৃদু স্বরে সারুর উদ্দেশ্যে বললো,,

“আমি আজন্ম তোমায় ভালোবাসি সারু, এমন ভালোবাসি যে আমার অপেক্ষিত যতগুলো বসন্ত আছে সবটা তোমার নামে, তোমার সাথে অতিবাহিত করতে মা’রা’ত্ম’ক ভাবে ইচ্ছুক।” (মৃদু স্বরে)

“আমিও আপনায় ভালোবাসি সারিমের বাবা। আমার ভালোবাসা, গোটা আমিটাই আপনার হয়ে আপনার সাথে থেকে যেতে চায় আজীবন। প্রচুর ভালোবাসি আপনায়।” (মুচকি হেসে)


দু বছর পর,,

“সারিম, এটা কি ধরনের কান্ড? পিসিমণি মাত্র পার্লার থেকে সেজে এসেছে সুন্দর করে আর তুমি এভাবে তার কোলে লাফ ঝাঁপ দিয়ে তার সাজ নষ্ট করছো! এটা কিন্তু ঠিক নয়।” (গম্ভীর কণ্ঠে)

সারিম দুহাত মুখের মধ্যে দিয়ে আবার বের করে হাতে তালি দিতে লাগলো আর নিজের অস্পষ্ট ভাষায় সারুকে বুঝ দিতে লাগলো। যার অর্থ সে কিছুতেই স্নিগ্ধার কোল ছেড়ে নিচে নামবেনা।
সারু চোখ ছোট ছোট করে সারিমকে স্নিগ্ধার কোল থেকে নিয়ে নিতেই সারিম চেঁচামেচি শুরু করতেই সারু ধমকে বলে উঠলো,,

“তোমার এই হিব্রু ভাষাতে আ আ, আই আই করে টালবাহানা দেওয়া বন্ধ করো সারিম। পিসিমণির কিছুক্ষন পর বিয়ে আর তুমি তার সাজ নষ্ট করছো।” (ধমক দিয়ে)

স্নিগ্ধা এতক্ষন মা ছেলের রেশারেশি দেখছিলো মুচকি হেসে। কিন্তু সারুর ধমকে উঠায় স্নিগ্ধা বলে উঠলো,,

“বৌদি ধমক দিও নাতো ওকে। বাচ্চা এখনও, ও কি এসব বুঝে নাকি? আর সাজ নষ্ট হলেও সমস্যা নেই। যে আমায় বিয়ে করছে সে সাজ সুন্দর হলেও বিয়ে করবে, সাজ নষ্ট হলেও বিয়ে করবে। মানে তার আমাকে বিয়ে করতেই হবে সেটা যেকোনো মূল্যে।” (ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে)

স্নিগ্ধার এহেন এক্সপ্রেশনের সহিত বলা কথা শুনে সারু বেশ মজা পেলো, ঠোঁট চেপে হাসলো। ইশ, দু দুটো বসন্ত পেরিয়ে গেছে। অবশেষে, অবশেষে স্নিগ্ধা নামক নারীটি প্রাপ্তবয়স্কতে পরিণত হয়ে অতঃপর বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। এই দু বছর এদের কত পাগলামি, খুনশুটি দেখেছে সবাই। অবশেষে স্নিগ্ধা আর উৎসের বিয়ে হচ্ছে। তারা এক হচ্ছে।

“বরযাত্রী চলে এসেছে, আর তোমরা এখনো এখানে আছো। যাও, স্নিগ্ধাকে নিয়ে মণ্ডপে যাও। এখন উৎসের আর স্নিগ্ধার কাপল ফটোশুট করা হবে অতঃপর বিয়ে।” (মৃদু স্বরে)

ইলার কণ্ঠস্বর শুনে কক্ষে থাকা স্নিগ্ধা, সারু সহ অন্যান্য মেয়েরা সবাই ইলার দিকে তাকালো। ইলার প্রেগন্যান্সির আজ আট মাস, মেরুন রঙের শাড়িতে উঁচু পেটে কতটা সুন্দর লাগছে ইলাকে তা যদি ইলা জানতো তাহলে নিশ্চয়ই লজ্জায় নুইয়ে যেত।

“আরে ইলা বৌদি, তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে। দাভাই দেখলে নিশ্চিত এতো লোকের মাঝে বুকে হাত দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবে। বিয়ে আমার কিন্তু সবাই এটেনশন তোমার দিকে দিবে, হায় কারো নজর না লাগে আমার সুইটি বৌদির।” (একগাল হেসে)

স্নিগ্ধার এহেন কথা শুনে ইলা মুচকি হাসলো। ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে একটা চেয়ারে বসলো।

“এতো মানুষের এটেনশনের প্রয়োজন নেই, তোমার দাভাইয়ের এটেনশন পেলেই হলো। তাছাড়া আমার থেকে তোমায় বেশি সুন্দরী লাগছে স্নিগ্ধা। বধূসাজে তোমায় এতো সুন্দর লাগছে যে বেচারা তোমার কার্ডিয়াক সার্জন তোমায় দেখা মাত্রই তার হার্ট বিট করা বন্ধ করে দিবে।” (দাঁত দেখিয়ে হেসে)

স্নিগ্ধা লজ্জা পেলো সেই সাথে কক্ষ জুড়ে হাসি প্রতিফলিত হলো।

“সে যাহোক, চলো এখন।”

স্নিগ্ধাকে নিয়ে সবাই এগোলো মণ্ডপের দিকে। আর সারু সারিমকে কোলে করে ইলার সাথে ধীরে ধীরে বের হলো। ইলাকে কাছে পেয়ে সারিম বেজায় খুশি। সে জেঠিমণির কোলে উঠবে এই আশায় দু হাত ইলার দিকে করে নাড়াতে শুরু করলো। ইলা মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে সারিমকে নিতে যাবে অমনি সারু বলে উঠলো,,

“উহু, একদম নয়। তুমি ওকে কোলে নিওনা ইলাদি। জানোই তো এই বাচ্চা ঝাঁপাঝাঁপি বেশি করে, পরে পেটে ব্যথা দিয়ে বসবে। এখন তোমায় অনেক কেয়ারফুল থাকতে হবে। তাই সারিম আমার কোলেই থাকুক।” (দ্রুত কণ্ঠে)

ইলা মৃদু হাসলো, বাড়ির সবাই কত কেয়ার করে তার। এমনকি উৎসের মাও। এইতো দুদিন আগেও এবাড়িতে এসেছিলেন তিনি উৎসের সাথে। কতই না আদর করেছিলেন, মায়ের মতো মনে হয় ওনাকে। যদিও পৃথিবীতে মায়ের অবস্থান কেউ নিতে পারেনা। তবুও ইলার সাথে আদিতের বিয়ে অতঃপর প্রেগন্যান্সি সবকিছুতেই উনি মায়ের ভূমিকা রেখেছিলেন। উৎসও একদম ইলার আপন ভাইয়ের মতোই ইলার খেয়াল রাখে। বাড়ি এসে দেখে যায়, কতকি আনে। আপন ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। ইলা কানন দেবীকে মা আর উৎসকে দাভাই বলে ডাকে। না ডেকে উপায় আছে? একদম যে মা আর দাভাইয়ের মতো আচরণ করে।
ভেবে ফোঁস করে শ্বাস ফেললো ইলা। মুচকি হেসে সারুর সাথে বিয়ের মণ্ডপের দিকে গিয়ে গেলো।
মণ্ডপের থেকে একটু দূরেই একটা স্টেজ করা হয়েছে ফুল দিয়ে। সেখানটাতেই স্নিগ্ধা আর উৎসের কাপল ফটোশুট করা হচ্ছে। ইশ কি খুশিটাই না লাগছে দুজনকে। উৎসের মুখটা এতটাই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যে যেকেউ দেখলে বলবে ভালোবাসার পূর্ণতায় দিশেহারা হওয়ার মতো খুশি হয়েছে উৎস।
আশেপাশের উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন তা দেখেই মিটমিটিয়ে হাসছে। হাসবে নাই বা কেন? এই পরিবারের ছেলে মেয়ের গুলো ভালোবাসার পূর্ণতা এতো সুন্দর ভাবে, একরাশ খুশির সহিত পূর্ণতা পায় যে এই খুশিতে না মুচকি হেসে উপায় নেই।

সারু সারিমকে নিয়ে মৃদু ধমকা ধমকি করতে করতে ইলার সাথে এগিয়ে আসছে বিয়ের মণ্ডপের দিকে। ইলা চারদিকে তাকিয়ে কাঙ্খিত ব্যাক্তিটাকে খুঁজছে যে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেছে যে একবার এসে তার সাজগোছ অব্দি দেখেনি। যাকে দেখানর জন্য সাধারণ ভাবে সেজেছে ইলা সেই মানুষটাকেই সে দেখতে পারছেনা। এর মাঝেই সে দেখতে পেলো মহাশয় বোনের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছতে ব্যস্ত। ইলা হাসলো মৃদু, মানুষটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে। সবার প্রতি দায়িত্বশীল, শ্রদ্ধা করে, পূর্বের সকল প্রকার কাজ অর্থাৎ হিটম্যানের পরিচয় সবটাই বিসর্জন দিয়েছে, তাকে ভীষণ ভালোবেসে আসছে এবং ভবিষ্যৎ এও বাসবে। নিজের পেটে হাত দিয়ে ইলা বিড়বিড় করে বললো,,

“দেখো উষ্ণতা, তুমি খুব ভালো একটা বাবা পেতে যাচ্ছো, দ্রুত চলে আসো বুঝেছো। আমি আর তোমার বাবা তোমার অপেক্ষায়। জানো?সে তোমাকে, আমাকে, পরিবারের সবাইকে কতটা ভালোবাসে। এই দেখো বুক ফাটছে তবু সামনাসামনি প্রকাশ করছেনা। ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমার পিসিমণির দিকে চেয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।” (বিড়বিড় করে)

ইলা চেয়ে রইলো আদিতের দিকে। এক পর্যায়ে আদিতের নজর তার উপর পড়লো। আদিত মৃদু হাসলো ইলাকে দেখে। ইশারায় বুঝাল ইলাকে সুন্দর লাগছে খুব। ইলা মুচকি হাসলো।

এদিকে সারু শেরহামকে খুজছে। অতঃপর সারুর নজর শেরহামের দিকে গেলো যে কিনা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে তাকাতেই শেরহাম হেসে দিয়েছে। এদিকে সারিমও বাবাকে দেখতেই চেঁচানো শুরু করে দিয়েছে বাবার কাছে যাবে বলে। শেরহাম আত্মীয়-স্বজনদের থেকে ক্ষনিকের বিদায় নিয়ে সারুর কাছে আসলো। সারিমকে কোলে নেওয়ার সময় সারুর কানে কানে মৃদু স্বরে বললো,,

“সারিম মনে হয় একা একা থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে, এখন সে আমার কাছে একটা বোনের জন্য আপিল করছে। দেখো আমায় দেখলেই চেঁচিয়ে উঠছে।”

সারু চোখ বড় করে শেরহামের দিকে তাকালো। শেরহাম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে সারিমকে নিয়ে স্টেজের ওদিকে যেতে লাগলো। সারিম বাবাকে পেয়ে যেন পূর্ণিমার চাঁদ পেয়েছে। এমন ভাবে হাল্লা চিল্লা করছে যেন উনি এখানকার রাজা। সবাইকে হুকুম করেই যাচ্ছে সামনে থেকে সরে যেতে।


বিয়ের পর্ব চুকিয়ে একধাপ কান্নাকাটির পর ভোর পাঁচটার দিকে উৎস স্নিগ্ধাকে নিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। কল্যাণী, মিতালি বাড়ির একমাত্র ছোট মেয়েটাকে বিদায় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। মেয়েটা বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো। সবার সাথে কতটা হাসি খুশি ছিল। সবার সাথে সাথে যেন বাড়ির প্রতিটা কোনা, দেয়াল, জানালা পর্দা সবাই স্নিগ্ধাকে ভীষণ মনে করছে। সব কেমন থমথমে মনে হচ্ছে।
বাড়িতে এখন শেরহামের ছোট ও বড় পিসি, ওনাদের স্বামী বাচ্চা, গুটিকয়েক আত্মীয়-স্বজন বাকিরা বিয়ে শেষ হতেই চলে গিয়েছেন।
কয়েক প্রহর আগেও যে বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশ ছিল সে বাড়িতে এখন কান্নার ছাপ। নেহাল রায়, বিপুল রায় স্ত্রীদের বুঝ দিচ্ছেন স্নিগ্ধা তো আসবে এখানে যদিও ওনাদের নিজেদের ভীষণ খারাপ লাগছে।
আদিত আর শেরহাম প্রথমে স্নিগ্ধার জন্য অনেকটা মন খারাপ, কান্না করলেও তারা এখন খুশি যে একজন ভালো মানুষের সাথেই স্নিগ্ধার বিয়ে হয়েছে যে কিনা সব বিপদ থেকে স্নিগ্ধাকে আগলে রাখবে। স্নিগ্ধার রে’ই’প হওয়ার পর যে পুরুষ স্নিগ্ধাকে আগলে রাখতে চেয়েছে সে অবশ্যই ভীষণ ভালোবাসে স্নিগ্ধাকে। নয়তো আগলাতো না। সব ভেবে দুজন খুশি।
এখন বাড়িটায় দুঃখের ছাপ থাকলেও প্রকৃত পক্ষে বাড়িটা ভীষণ খুশি। সব দিক দিয়েই পরিপূর্ণ বাড়িটা। সবাই ভীষণ, ভীষণ খুশি।
শেরহামের মনে হয় যেন সব বিপদ আপদ, কষ্ট ছাড়িয়ে তারা বর্তমানে #নীরদ_ক্লেশের_অন্ত নামক অধ্যায়ে পদার্পন করছে। ইশ, কি মিষ্টি পরিবেশ চারদিকের। বাড়িতে নতুন মেহমান আসতে চলেছে আদিত আর ইলার সন্তান। সারু আর শেরহামের ছেলে হয়েছে যার নাম সারিম। স্নিগ্ধার সাথে উৎসের বিয়ে হয়েছে। বাড়ির সবাই কত খুশি। শেরহাম চায় সবসময় তাঁদের এই খুশিটা জীবিত থাকুক। সুখ দুঃখ মিলিয়েই মানব জীবন, এখানে কখনো দুঃখকে গুনতে নেই। দুঃখ গুনতে থাকা মানেই সুখের দেখা না পাওয়া। সবসময় মানবজীবনে সুখী থাকতে হবে যেন দুঃখ আসলেও সুখী থাকতে পারে। এছাড়াও #নীরদ_ক্লেশের_অন্ত তে একরাশ ভালোবাসাই থাকে সবসময়। যে ভালোবাসা রায় পরিবার বর্তমানে উপভোগ করছে। সারু-শেরহাম, আদিত-ইলা, স্নিগ্ধা-উৎস রায় পরিবারের সকলে সব দুঃখ কাটিয়ে অবশেষে একরাশ ভালোবাসা পেয়েছে যে ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে না যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে তারা। তাঁদের পাশাপাশি নামীরা অন্তিকাও প্রার্থনা করে তারা যেন সবসময় খুশি, সুখী হয়ে একসাথে অনেকগুলো বসন্ত অতিবাহিত করতে পারে।

সমাপ্ত।