নীরবে নিভৃতে পর্ব-০৩

0
138

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

পূর্ব আকাশে সূর্যের দেখা মিলেছে। পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হচ্ছে জঙ্গল। কতো রকমের গাছপালায় ঘেরা এই সুন্দর জায়গা! হরেক রকমের গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সবকিছু নিয়ে এই জায়গা। সারারাত ঘুম আসেনি মেহেকের। কীভাবে এখান থেকে বের হবে সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেছে। তা-ও ফজরের ওয়াক্তের পরে একটু চোখ লেগে এসেছিল। কিন্তু সকাল হতেই প্রকৃতির সৌন্দর্য, মিষ্টি পাখিগুলোর ডাকে ঘুম ভাঙে। ওদের কিচিরমিচির আওয়াজে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও মন ভালো লাগছিল মেহেকের। গতকাল রাতে রোশন আর কোনো অসভ্যতা করেনি। ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরেই হয়তো চলে গিয়েছিল। ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল মেহেক। তা-ও ভালো এরা জোর করে কিছু করবে না। শোয়া থেকে বসে দিনের আলোয় ভালো করে ঘরটা দেখছে ও। কী নোংরা সবকিছু! ঘরের মেঝেতে যতপ্রকার ময়লা আবর্জনা সবই আছে। ঠিকঠাক মতো ঝাড়ু পর্যন্ত দেয়না ওরা। অবশ্য নিজেরাই এতে নোংরা যে ঘরের এই নোংরা ওদের কাছে কিছু না। ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা জানালা আছে। মেহেক বসা থেকে উঠে সেদিকে এগোয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে যতদূর নজর যায় শুধু গাছপালা। এই জঙ্গল শেষ হলেও নদী না পেরিয়ে গ্রামে যাওয়া যাবে না। অদ্ভুতভাবে জঙ্গলটার দুইদিকে নদী। তা-ও বেশ বড়সড় যে সাঁতরে পার হওয়া যাবে না।
” এই যে মেয়ে, এই নাও তোমার পোশাক আর খাবার।”
হঠাৎ কোনো মেয়েদের কণ্ঠ শুনে ভীষণভাবে চমকায় মেহেক। এখানে আবার মেয়েও আছে? মেহেক কৌতূহল মেটাতে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে চায় কী এসেছে ঘরে। দেখতে বেশ স্মার্ট একটা মেয়ে, তবে মেহেকের থেকে বড়ো হবে হয়তো। এতটুকু ধারণা করে মেয়েটির দিকে এগোলো মেহেক। মেয়েটি রোবটের মতো বিনা কথায় দাঁড়িয়ে আছে।
” আপনি কে? আপনি কি এখানের বাসিন্দা? ”
মেহেকের চোখেমুখে বিস্ময় স্পষ্ট। মেয়েটি বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,
” আমি মিরা। এখানে রান্নাবান্নার কাজ করি। আর…”
” আর?”
” নাহ কিছু না। তুমি খেয়ে নাও বরং।”

মিরা কালক্ষেপণ করলোনা। দ্রুত গতিতে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দরজা খুলে রেখেই গেছে সে। হঠাৎ দরজা খোলা পেয়ে উত্তেজনা বশত ঘর থেকে বেরোলো মেহেক। ঘরের সামনে ছোটো উঠোনের মতোই জায়গা। তবে এখানকার গাছপালা কেটেই যে এমন তৈরি করা হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। মেহেক আশেপাশে নজর বুলাতে চেষ্টা করলো। ছোটো উঠোনের মতো ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে কয়েকটা তাঁবু দেখতে পাচ্ছে। আর দুইপাশে ছোটো দু’টি ঘর, রান্নার জন্য খোলা আকাশের নিচে ইটের তৈরি চুলো। সূর্যের অবস্থান দেখে সময় হিসেব করার চেষ্টা করলো মেহেক। যতদূর মনে হচ্ছে সকাল ছয়টা কিংবা সাড়ে ছয়টা বেজেছে। যেহেতু ছেলেগুলো অনেক রাত করে ঘুমায় তাই নিশ্চয়ই দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে! কীভাবে নদী পার হবে জানে না মেহেক কিন্তু এখান থেকে পালাতে হবে। মনপ্রাণে এই কথা গেঁথে নিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগলো মেয়েটা। তবে কিছুটা পথ দৌড়াতে আচমকা কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় সে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই মেহেক বুঝতে পারে ওর সামনে কোনো জড় পদার্থ নয় বরং আস্ত একটা মনুষ্য প্রাণী। শুকনো ঢোক গিলে মাথা উঁচিয়ে তাকাতেই রোশনের ঠোঁট কামড়ে হাসি দেওয়া মুখটা দেখলো মেহেক। ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে এমন করে হাসছে দেখে রাগে আগুন জ্বলছে।
” যতদূর যাও না কেনো মেহেক রাণী, ফিরে আমার কাছে আসতে হবে। কেনোনা এই গোটা এরিয়া আমার। তুমি চাইলেও নদীর ওপারে পৌঁছাতে পারবেনা। ”
ঘাড় কাত করে সিগারেটে সুখটান দিয়ে বললো রোশন। বিতৃষ্ণায় চোখমুখ কুঁচকে অন্য দিকে ফিরে তাকিয়ে রইলো মেহেক। কোনো লাভ নেই এরসাথে তর্ক করে। বরং তারচে চুপ করে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
” ঘরে চলো।”
রোশন সিগারেট মাটিতে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে ফেলে বললো। মেহেক কিছু বলতেই যাবে এমন সময় হুট করে কোলে তুলে নিলো ওকে।
” ছাড়ুন বলছি। ভালো হবে না কিন্তু…. ”
মেহেকের এমন কথায় হো হো করে হেসে উঠে রোশন। বোকা মেয়ে একটা! ঝুঁকে মেহেকের ঠোঁটে আলতো করে কামড়ে দেয় রোশন। ব্যথায় আহ করে উঠে মেয়েটা। এমনিতেই ঠোঁট কেটে গেছে। তার উপর এখন এসব!
” চুপ! আর একটা কথা বললে আরো কিছু হবে। ”

মেহেক চুপ করে যায়। এদের সাথে শক্তি দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়ে বাজিমাত করতে হবে। মিনিট পাঁচেক পরে মেহেকের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরের সামনে এসে থামলো রোশন। এরমধ্যে কিছু ছেলে এগিয়ে এসেছে ওদের দেখে। মেহেককে কোল থেকে নামিয়ে রেখেছে রোশন।
” ভাই কাজ কি হয়ে গেছে? তাহলে আমরা নিয়ে যাই?”
” রকি! তোদের বড্ড তাড়াহুড়ো রে। সারাদিন এসব নিয়ে না ভেবে পরের মিশন কীভাবে সাকসেসফুলি করতে পারবো সেটা চিন্তা কর। মেয়ে তে আছেই। ”

রকির সাথে ফয়সালও এসেছিল। কিন্তু রোশনের কথায় সব আশায় জল পড়লো তাদের। মেহেক ওদের কথাবার্তা শুনতে না পেরে আবারো ঘরের মধ্যে চলে যায় এবং গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আঁটকে ফেলে।
” ঠিক আছে। ভাই আমাদের পরবর্তী কাজ হচ্ছে পাশের শহর থেকে ব্যংক ডাকাতি করা। আমি এরমধ্যে সেখানে আমাদের গুপ্তচরকে পাঠিয়ে দিয়েছি। ও আসার পর আমরা শত্রু সম্পর্কে সবকিছু জেনে ফেলবো। সেই অনুযায়ী প্লাণ করে আমরা এগোবো।”
” ওকে। এখন যা তোরা,আমিও আসছি।”
সবাই একে একে সবাই নিজের কাজে চলে যায় কেবল রোশন ব্যতীত। সে জানালা দিয়ে মেহেকের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে নিশ্চত হয় সে ঘরেই আছে। মেয়েটা তাহলে আবার জানালা দিয়ে পালায়নি।

” দুটো দিন কেটে গেছে তা-ও মেয়েটার কোনো খোঁজ দিতে পারলেন না স্যার? ”
মুখোমুখি পুলিশ অফিসার ফারুক ওয়াসিফের সামনে বসে আছে সিদ্দিক আহমেদ। মেয়ের খোঁজ নিতে এসেছেন তিনি।

” আপনি নিজেও ভালো করে জানেন,ওই জঙ্গলে আমাদের পক্ষে পৌঁছানো অসম্ভব। ওদের এরিয়ায় আজ পর্যন্ত পুলিশ ঢুকে কিছু করতে পারেনি। এতটাই ভয়ংকর ওরা। আমরা প্রশাসনের লোক হলেও দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আপনার মেয়েকে নিশ্চয়ই এতক্ষণ জীবিত রাখেনি ওরা। ”

ফরিদ ওয়াসিফের কথায় পিলে চমকে উঠে মেহেকের বাবার। দু-চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে ভদ্রলোকের।
” এভাবে বলবেন না স্যার। দয়া করে আপনাদের কাজ অব্যাহত রাখুন। ”
” আমরা কোনো খোঁজ পেলেই আপনাকে জানাবো। হোক সেটা গুড নিউজ অথবা ব্যাড।”
” ঠিক আছে। ধন্যবাদ।”
” ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ”
পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে মেইন রোডের দিকে এগোচ্ছেন মেহেকের বাবা। কথায় আছে না দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বোঝেনা? মেহেকের বাবার অবস্থাও ঠিক তেমন হয়েছে। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার খাওয়া পর্যন্ত মেয়েটা কতকিছু খেয়াল রাখতো। সে নেই তাই খেয়াল রাখারও কেউ নাই এখন। আনজুম বেগমের সাথে গতকাল মনমালিন্য হয়েছিল সিদ্দিকের। বিয়ের সময় তো এমন কথাই ছিলো দু’জন দু’জনার ছেলেমেয়েদের কখনো পর ভাববে না। বরং নিজেদের ছেলেমেয়ে মনে করেই ভালোবাসবে, যত্ন করবে। মিষ্টি সিদ্দিক আহমেদের ঔরসজাত সন্তান না। মিষ্টিকে সাথে নিয়েই মেহেকের বাবাকে বিয়ে করেছিলেন আনজুম বেগম। মিষ্টিকে নিজের মেয়ের থেকে কখনো আলাদা চোখে দেখেননি তিনি৷ অথচ আনজুম সব সময় মেহেককে অনাদর, অবহেলা করে গেছে। অবশ্য এর পিছনে সিদ্দিক নিজেও দায়ী। স্ত্রী’র প্রতি অন্ধ মোহ,ভালোবাসায় মেয়ের দিকে খেয়াল রাখেননি। উপরন্তু নিজেও একই আচরণ করেছেন।

” এই যে ভাই রাস্তায় দেখেশুনে চলাফেরা করতে পারেন না?”
বেখেয়ালি হয়ে হাঁটতে গিয়ে একটুর জন্য গাড়ি এসে চাপা দেয়নি সিদ্দিককে। গাড়ির ড্রাইভার কড়াভাবে শাসিয়ে কয়েকটা কথাবার্তা বলে চলে গেছে। সিদ্দিক চুপ করেই ছিলো। মেহেককে ছাড়া পুরো পৃথিবী যেনো আজ অন্ধকার উনার কাছে।

নিজের বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোশন। আশপাশের এক শহরে আজ ডাকাতি করার প্লান ছিলো ওদের। অবশ্য সবকিছুই ওদের প্লান মাফিক হয়েছে। রোশানের সাথে অন্য বিষয় কথা বলতে ডেকেছেন সবুর হোসেন। সবুর হোসেন দেখতে কুচকুচে কালো, লম্বা দেহ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বটে। বাবার কাছ থেকেই রোশনও শ্যামবর্ণ পেয়েছে কিন্তু বাবার থেকে একটু ফর্সা সে। সবুর হোসেনের মুখভর্তি দাড়ি আর চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত হওয়ায় জঙ্গলের সাথে যেনো তার চেহারার পারফেক্ট ম্যাচিং হয়েছে।
” রোশন শুনলাম গ্রাম থেকে একটা মেয়ে তুলে এনেছ? তা-ও এখনো বাঁচিয়ে রেখেছ,কিন্তু কেনো?”

এখানকার নিয়ম হচ্ছে প্রয়োজন ফুরোলে প্রাণে মেরে ফেলা। মাস্তি করার পরেই মেয়েদেরকে মেরে ফেলে এরা। যদিও আগে মেয়েদেরকে ছেড়ে দিতেন সবুর। কিন্তু একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আর কোনো মেয়েকে বাইরের জগতে বের হতে দেয় না এখন।
” হ্যাঁ বাবা। ওর সাথে কাজ কমপ্লিট হলে তবে ঠুস!”

ঘাড় কাত করে বললো রোশন। সবুর মুচকি হাসলো। তো সুখকর নয় সেই মেকি হাসি। অতীতকে মনে করতে না চাইলেই প্রায়শই সেসব মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সবুরের।
” যাই করো কোনো প্রমাণ যাতে বাইরে বের না হয়। যাইহোক, এসো এখন তুমি। আজকে দুপুর হতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হামলে পড়লো আমার। ”
নাবার কথায় হাসি পাচ্ছে রোশনের। সবুর হোসেন যে কতটা ঘুমকাতুরে সেসব সবাই জানে। দিন নেই রাত নেই যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারার বিশেষ গুণ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন তিনি৷

চলবে,