#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট এখন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন গোটা গ্রামের লোকজন। গ্রামাঞ্চলে মানুষজন একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়।
তাই রাত বারোটা মানে প্রায় মধ্যরাত গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে। হাওলাদার বাড়ির কর্তা সিদ্দিক আহমেদ ঘুমোলেও গিন্নী আনজুম বেগমের চোখে এখনো ঘুম আসেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়েদের কথা ভাবছেন তিনি। মেয়েগুলোর সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলো না তো? মন স্থির করতে পারছেন না তিনি। মায়ের মন কি আর কিছুতে শান্ত হয়! আচমকা স্বামীর ফোনের রিংটোনে নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। এতো রাতে কে কল দিচ্ছে ভাবতে ভাবতে শোয়া থেকে উঠে বসলেন আনজুম বেগম। বালিশের পাশেই রাখা আছে ফোনটা। সিদ্দিক আহমেদের ঘুম বেশ গাঢ় হওয়ায় ঘুমন্ত অবস্থায় ফোনের রিংটোন শুনতেও পান না কখনো। তাই আনজুম নিজেই ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে নিলেন, কোনো পরিচিত নম্বর কি-না। অপরিচিত নম্বর! রয়েসয়ে কল রিসিভ করে কানে ফোন ধরে বললেন,
” হ্যালো! কে বলছেন? ”
” হ্যালো মা! আমি মিষ্টি বলছি মা। তুমি কেমন আছো মা? বাবা ঠিক আছে তো? ”
মিষ্টি উতলা হয়ে মায়ের সাথে কথা বলছে। আনজুম বেগমের ঘোর কাটে না। সত্যি সত্যি মিষ্টি কল দিয়েছে! কিয়ৎক্ষণ বাদে বাস্তবে ফিরলেন তিনি। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
” তুই কোথায় আছিস? ঠিক আছিস তো? মিষ্টি তুই বাড়ি আয়।”
” মা আমি বাড়ি আসছি, মা। আমি বাড়ি গিয়ে সব বলবো তোমাদের। আমি ইচ্ছে করে এতদিন যোগাযোগ করিনি তেমন নয় মা।”
” কোনো সমস্যা নেই। তুই ফিরে আসলেই হবে আমার। তাড়াতাড়ি আয় মা। আমাকে জড়িয়ে ধরবি একটু। ”
খুশিতে কান্না করে দিয়েছেন আনজুম। মিষ্টিও কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
” মা আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসছি। আরেকটু অপেক্ষা করো।”
এদিকে স্ত্রী’র কান্নারত আওয়াজে সিদ্দিক আহমেদও জেগে গেছেন। হন্তদন্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেছেন উনিও। কী ঘটছে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। তারপরই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন তিনিও।
” আনজুম মিষ্টি কথা বলছে? একটু দাও না কথা বলি!”
আনজুম স্বামীর হাতে ফোন দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
” মা রে তুই ঠিক আছিস? কোথায় আছিস?”
মিষ্টির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই মানুষটা তার আপন বাবা না হয়েও কতটা ভালোবাসেন অথচ মেহেকের সাথে কী আচরণই না করতো মা-মেয়ে মিলে! মিষ্টির পাশের সিটে মেহেক বসা। তাই বাবার কণ্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠলো সে।
” বাবা আমি বাসে আছি। বাবা আমার পাশে আপুও আছে। মেহেক আপু আছে। ”
বড়ো মেয়ের কথা শুনতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন সিদ্দিক। মিষ্টি মেহেকের কাছে ফোনটা দিলো।
” বাবা!”
” মেহেক মা! মা তোরা কেমন আছিস মা? আমাদের আর কষ্ট দিস না, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় না মা!”
মেহেকের বাবার মুখে মেহেকের কথা শুনে আনজুম বেগম খুশি হলেন। মেহেকও আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদতে লাগলো। কতগুলো দিন বাবার সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি!
” বাবা আমরা বাসে। কাল সন্ধ্যা হবে পৌঁছাতে। তোমরা ততক্ষণ চিন্তা করবে না। এখন রাখছি। ফোন তো আমাদের না।”
” ঠিক আছে মা। আয় তোরা। আমরা অপেক্ষা করছি।”
” আচ্ছা বাবা।”
কল কেটে ফোনটা পেছনের সিটে রোশনের হাতে দিলো মেহেক। সামনের সিটে মেহেক আর মিষ্টি বসেছে। আর পেছনে রোশন একাই দু’টো সিট দখল করে বসে। অর্ক ও লিমন পাশাপাশি অপরদিকের সিটে বসেছে। মিষ্টির চোখের জল মুছে দিয়ে নিজের চোখের জল মুছতে যাবে তার আগেই রোশন পেছন থেকে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মুছতে লাগলো। রোশনের এমন কাজকর্ম দেখে অর্ক আর লিমন মুচকি হাসছে। মিষ্টিও হাসছে। কিন্তু মেহেক সরিয়ে দিলো ওর হাত। ক্ষীণ স্বরে বললো,
” এটা বাস! দয়া করে এখানে বসেও অসভ্যতা করবেন না। ”
জানালা দিয়ে বাতাস এসে মেহেকের খোলা চুলগুলো কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে সেই দেখে রোশন ঘাড় কাত করে মুচকি হাসলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে বললো,
” পেছনের সিটে এসো।”
রোশনের কথায় চমকাল মেহেক। চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে ওর। পেছনে না তাকিয়েই বললো,
” মিষ্টি একা বসতে পারবে না।”
কিন্তু মিষ্টি বললো,
” আমি একাই পারবো আপু। এই কয়দিনে অনেক কিছুই শিখে গেছি। পারি না বলতে কোনো কিছু নেই এখন আর।”
মিষ্টির কথা শেষ হতে পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে। রোশন বিষয়টা স্বাভাবিক করতে বললো,
” মিষ্টির পাশে অর্ক বসবে। কি অর্ক?”
” হ ভাই অবশ্যই। ”
মেহেকের মেজাজ খারাপ লাগছে। বাসে বসেও শান্তি নেই! পাশাপাশি বসলেই শুরু করবে জ্বালাতন। ধ্যাৎ ভাল্লাগে না। মিষ্টিটা কেন বললো বসতে পারবে? না বললে তো আর রোশনের কাছে বসতে হতোনা! এসব ভেবে বসে আছে মেহেক। রোশন বললো,
” আসবে নাকি কোলে তুলে নিয়ে আসবো?”
মেহেক দ্রুত বসা থেকে উঠে রোশনের পাশের সিটে এসে বসে পড়লো। এই লোকের বিশ্বাস নেই। বাসের মধ্যে কোলে তুলে নিলে তো সবাই হাসাহাসি করতো। অর্ক লিমনের পাশ থেকে উঠে এসে মিষ্টির পাশে বসেছে।
” গুড গার্ল। এখন জানালার পাশের সিটে বসো। ”
” বসেছি আবার জানালার পাশের সিটে কেন?”
রোশন মেহেকের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,
” যেখানে বসে আছো সেখানে বসে থাকলে পরপুরুষের বাতাস লাগবে তোমার গায়ে। এই যে দেখো যাত্রীরা উঠে নামে তাতে তোমার গায়ে লাগবে। সেটা আমার সহ্য হবে না মোটেই। ”
মেহেকের কেনো জানি ভীষণ হাসি পাচ্ছে। পরপুরুষ!
” আপনি কে তাহলে? ঘর-পুরুষ!”
রোশন সোজা হয়ে বসে সিগারেটে সুখটান দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ সেটাই মনে করতে পারো। এখন আসো।”
মেহেকের চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নিজেও তো সরবে না আর ওপাশেও বসতে বলছে। এখন গায়ের ওপর থেকে ওপাশে গিয়ে বসতে হবে! কী এক মুসিবত। মেহেক রোশনকে পাশ কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর জানালার পাশের সিটে বসলো।
” হয়েছে? ”
দাঁতে দাঁত চেপে কিছুটা রেগে বলে মেহেক। রোশন হেসে আবারো কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
” ওপাশে না গিয়ে কোলেও তো বসতে পারতে সুন্দরী? আবছা আলোতে কেউ দেখতো না। ”
” লুচ্চা মার্কা লোক আপনি। ”
” হাসালে সুন্দরী। আমি যে চরিত্রহীন তা কি নতুন জানলে?”
মেহেক চুপ করে রইলো। অহেতুক কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। এর সাথে কথা বলার থেকে ঘুমানো ভালো। কিন্তু ঘুমাতে গেলেও ভয় লাগছে এখন। যদি বাসের মধ্যে কিছু করতে শুরু করে!
রাতটা কোনোরকমে কাটলো সিদ্দিক দম্পতির। মেয়েদের আসার খবরে রাতে ঘুম হয়নি। সকাল হতেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। যদিও জানে বিকেলের আগে কিছুতেই ওদের আসার সম্ভাবনা নেই তবুও বাবা-মায়ের মন মানে না। পাশের বাড়ির রোকেয়া ওদের ভাবগতিক দেখে এগিয়ে এলো। রোকেয়া এক সন্তানের জননী, রাহাতের মা। স্বামী প্রবাসী।
” চাচি কী হয়েছে? সকাল সকাল এখানে দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন!”
রোকেয়ার কথায় আনজুম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
” রোকেয়া আমার মেয়ে দুটো আসবে আজ। ওদের পাওয়া গেছে রে।”
রোকেয়ার কপালে ভাজ পড়লো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
” কোথায় ছিলো এতদিন মিষ্টি? আর মেহেককে তো ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছিল বলেই জানতাম। তা দু’জনই কি তাদের সাথে ছিলো না-কি? ”
আনজুম বেগম চুপ করে রইলেন। কী উত্তর দিবে? এসবকিছুর উত্তর তো উনি নিজেও জানেন না। সিদ্দিক আহমেদ বললেন,
” আগে ওরা আসুক তারপর সবকিছু জানতে পারবো। ”
” ওহ। আসছি আমি কাজ আছে আমার। ”
রোকেয়া চলে যেতে মেহেকের বাবা বলেন,
” আনজুম আমার মেয়েদের অনেক কথা শুনতে হবে। তুমি দয়া করে ওদের সাথে ভালো আচরণ করবে। বাইরের লোকজন যা বলে বলুক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কারো টাকায় তো খাই না,নিজের উপার্জনের টাকায় খাই।”
” আমি আগের মতো নেই মেহেকের বাবা। আমার দ্বারা মেহেক আর কোনো কষ্ট পাবে না তুমি এ বিষয় নিশ্চিত থাকো।”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। আমি যাই কিছু বাজার করে নিয়ে আসি। বিকেলে তো ভালো কিছু পাওয়া যায় না। এ বেলায় রান্নাবান্না করে রাখো।”
” ঠিক আছে। তুমি দাঁড়াও আমি বাজারের ব্যাগ নিয়ে আসছি।”
সিদ্দিক আনজুমের কথামতো দাঁড়ালেন। আনজুম পাকঘর থেকে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসে উনাকে দিলেন। ভদ্রলোক বেশ ফুরফুরে মেজাজে মেয়েদের জন্য ভালো বাজার-সদাই কিনতে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
সূর্যের আলো চোখে পড়াতে চোখগুলো নড়ছে মেহেকের। কেমন অসহ্য লাগছে ঘুমন্ত অবস্থায়। মনে হচ্ছে এই রোদ আবার এই ছায়া! এরকম কিছুক্ষণ চলার পরে ঘুম ভেঙে গেলো মেহেকের। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখল রোশন জানালার পর্দা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এজন্যই এতক্ষণ এমন আলোছায়া এসে চোখে লাগছিল।
” এভাবে ঘুমটা ভেঙে দিলেন কেনো?”
” ওয়াও! আমার সুন্দরীর ঘুম ভেঙেছে তবে।”
” ধুর! যতসব বাজে কথা।”
মেহেকের রাগান্বিত চেহারা দেখে রোশন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগলে মেয়েটাকে অন্য রকম লাগে। একেবারে রণচণ্ডী! সামনের সিটে মিষ্টিকে ডেকে মেহেক বললো,
” মিষ্টি তুই ঠিক আছিস?”
” হ্যাঁ আপু। আমরা তো নাস্তাও খেয়ে নিলাম। রোশন ভাই তোর জন্য না খেয়ে বসে শুধু। ”
মানুষ ভুত দেখলে যেমন চমকে মিষ্টির বলা উপরোক্ত কথাটি শুনেও মেহেক তেমনভাবে চমকাল। এই লোক কি ঢং করছে না-কি অন্য কিছু? ভালোবাসা তো ওর দ্বারা অসম্ভব। তাহলে?
” হ্যাঁ মিষ্টি তুমিও বুঝতে পারছ শুধু তোমার আপু বুঝতে পারছে না।”
” আপনাকে আমি চিনি কিন্তু আমার বোন চেনে না। কী মতলব করছেন? আমাকে আবারো ওই জঙ্গলে নিয়ে রাখবেন? ”
মেহেক কণ্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বললো। রোশন যেনো ডোন্ট কেয়ার মুডে থাকে সব সময়। এতো সিরিয়াস কথায়ও হাসলো সে। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
” আপাতত বোনকে নিয়ে বাড়ি যাও তারপর দেখা যাবে। ”
ভড়কাল মেহেক। তারমানে আবারো বাড়িতে হানা দিতে পারে ওরা? কিন্তু কেনো? শরীর পাওয়ার থাকলে তো এতদিনে জোর করেই সেটা ভোগ করতো রোশন। তবে কীসের জন্য এতো ন্যাকামি! লিমন রোশনের দিকে দু’টো কেক আর একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো। সেগুলো হাতে নিয়ে রোশন মেহেকের দিকে ধরে খেতে বললো। কিন্তু মেহেক খাবে না। রোশন জোর করলোনা। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। মেহেক কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কেক খেতে শুরু করেছে এখন। রোশনের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে।
” আপনার কিছু লাগলে কইবেন কিন্তু। ”
অর্ক হেসে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে। মিষ্টিও বদলে মৃদু হেসে বলে,
” জি বলবো।”
অর্ক জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে চলমান দৃশ্য দেখছে। মিষ্টি চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিতেই চোখের সামনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ভাসতে লাগলো। বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলোনা মিষ্টি। ভয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে হাঁপাতে শুরু করেছে মেয়েটা।
” কী হলো? ”
” না আসলে….”
অর্ক বুঝতে পেরেছে মিষ্টির তিক্ত স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।
” দেখুন যে স্মৃতি আমাদের কষ্ট দেয় তা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করাই ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যা আমরা ভুলতে চাই তাই আরো বেশি করে স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। তাই যেমন আছে তেমন থাকুক সব। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু এমনি ফিকে হয়ে যাবে। ”
মিষ্টি কিছুটা অবাক হলো অর্কর কথা বলার ধরণে। কারণ রোশন,লিমনের সাথে ওর আচার-আচরণ মিলে না। হয়তো জীবনের কোনো কঠিন চপেটাঘাত এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে অর্ককেও!
চলবে,