নীরবে নিভৃতে পর্ব-১১

0
108

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

গতকাল থেকে এই লোকটার পাশে বসে থাকতে থাকতে এখন বিরক্ত লাগছে মেহেকের। দুপুর হলো মাত্র! বিকেলের আগে বাস থেকে নামা হবে না। এসব ভেবেই ভাল্লাগছে না মেয়েটার। জানালার পাশে বসায় রোদের তাপ গায়ে লাগছে ওর। যদিও জানালার পর্দা টেনে দিয়েছিল রোশন কিন্তু মেহেক পর্দা সরিয়ে ফেলেছে। এরমধ্যেই মিষ্টি আর অর্কর মধ্যে কথা হতে হতে একটা কথা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক হয়ে গেছে।
” চলো।”
রোশন মেহেকের কাঁধে থুতনি রেখে বললো। মেহেক কাঁধ সরিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
” কোথায়? ”
” হানিমুনে! ”
” জানে মেরে ফেলবো। ”
মেহেক জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। রোশন মেহেকের হাতে হাত রাখতেই হাত সরাতে চাইলো মেহেক। কিন্তু রোশন ছাড়লো না।
” আমি তো সেই কবেই মরে গেছি সুন্দরী। তোমার ছলছল নয়নে মায়া মায়া সেই দৃষ্টিতে! ”
” কেনো বলছেন এসব? ”
” আমিও তো জানি না। ”
মেহেক চুপ করে গেলো। মাঝে মধ্যে নিজের উপর বিরক্ত লাগে ওর। জানে যখন এই লোকের সাথে কথা বলা অসহ্য তবুও কেন বলে! রোশন মেহেকের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো। বাস থেমেছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া করার জন্য বিশ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছে।
” হাত ছাড়ুন বলছি।”
” খেতে চলো। আর একটু কমকম রাগ করো। ডেরায় থাকতে তো চুপচাপ থাকতে। ”
” সময় আমাকে বদলে দিয়েছে। আর সেই বদলের কারণ আপনি! ”

” আপু! আসছো না কেনো তোমরা? ”
মিষ্টি বাসের জানালার বাইরে থেকে বললো। অর্ক, লিমন আর মিষ্টি আগেভাগে বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। রোশন ভ্রু উঁচিয়ে মিষ্টিকে দেখাল।
” তোমার বোন তোমার থেকে ফার্স্ট। চলো এবার, কথা পরে হবে। ”
কথায় কথা বাড়বে তবুও এই লোক হাত ছাড়বে না। তাই অহেতুক তর্ক না করে রোশনের সাথে বাস থেকে নামলো মেহেক।

দুপুরের কড়া রোদে হাসফাস লাগছে সবুর হোসেনের। আজকে গরম একটু বেশি মনে হচ্ছে। ক’দিন ধরে মেঘের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না৷ পাখপাখালি পর্যন্ত গরমে অতিষ্ট। আচমকা গুলির আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো সবুর হোসেন। সীমান্তে নিশ্চিত পুলিশ হানা দিয়েছে! কয়েকদিন ধরে ওতপেতে ছিলো প্রশাসনের লোকজন। সবুর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে বেরোতেই ফয়সাল এলো দৌড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
” বস! বস পুলিশ ঢুকেছে জঙ্গলে। ”
” কী! নদীর পাড় পেরিয়ে এলো কীভাবে? সবাইকে পজিশন নিতে বল। অস্ত্র বের কর। ”
” ঠিকাছে বস।”
ফয়সাল ফের হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো অন্য দিকে। সবুরও এগোলেন সামনে। গুলির আওয়াজে বেশ বুঝতে পারছেন আঁটসাঁট বেঁধে এসেছে তারা আজ। ভয় লাগছে রোশনের জন্য। দূর্ভাগ্যবশত যদি আজ কোনোভাবে রোশন এলাকায় আসে তখন! সবুর হোসেন চিন্তায় পড়ে গেছেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাত্র দুই-তিন কিলোমিটার পেরোলেই মেহেকের গন্তব্য। রোশনের কেমন জানি অস্থির লাগছে । কীসের জন্য এই অস্থিরতা তা অবশ্য বুঝতে পারছে না। মেহেকের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করছে রোশন। মেহেক জানালার বাইরে দেখতে ব্যস্ত। রোশনের দিকে ওর কোনো মনোযোগ নেই। রোশন মেহেকের কোমরে হাত দিয়ে হঠাৎ করে নিজের দিকে টেনে নিলো। মেহেক চমকাল, থমকাল। বড়ো বড়ো চোখ করে রোশনের দিকে তাকাল।
” কী হচ্ছে এসব? এটা বাস!”
” এরপর তো পাবো না তোমাকে। একটু আদর করে দেই? ”
” কী নির্লজ্জ আপনি! আমি কিন্তু চেঁচামেচি করবো।”
” পারলে করো। পারবে না তুমি। ”

মেহেক রোশনের হাতটা ধরে সরাতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। রোশন হাত কোমরে রেখেই হুট করে বুকে জড়িয়ে নিলো মেহেককে। মেহেকের মাথার তালুতে থুতনি রেখে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রোশন। অন্য দিকে মেহেক রাগে ছটফট করছে।
” কী করছেন! আরে আমার বোন দেখতে পাবে তো। আশেপাশে সবাই নিশ্চয়ই তাকিয়ে আছে। ”

মেহেক খুব জোরাজোরি করাতে রোশন ছেড়ে দিলো ওকে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল মেহেক মিষ্টি অর্কর সাথে কথা বলতে বাস্ত। শুধু পাশের সিটের লিমন মুচকি মুচকি হাসছে। মেজাজ খারাপ লাগছে মেহেকের। কী একটা অবস্থা! ধুরর………

সারাদিন অপেক্ষা করতে করতে প্রায় হাঁপিয়ে গেছেন আনজুম ও সিদ্দিক। মেয়েগুলো যে কখন আসবে সেই ভেবে ভেবে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন সিদ্দিক।
” আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? বিকেল থেকে তো এখানেই আছো।”
স্ত্রী’র কথায় পেছন ফিরে তাকালেন।
” সন্ধ্যা তো হলো! ওদের আসার সময় হয়ে এসেছে। ”
” আচ্ছা তোমার কি মনে হয় সত্যি মিষ্টি কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছিল? ”

আনজুম বেগমের কথায় চমকালেন মেহেকের বাবা। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

” তাতে কী এসে যায় মিষ্টির মা? বয়স কম ভুল করতেই পারে। মেয়ে ফিরে আসছে সেটাই অনেক। যদি সত্যি তেমন হয় তো জামাইও নিশ্চয়ই সাথে আসবে।”
স্বামীর কথায় চুপ করে রইলেন আনজুম। মনটা অস্থির লাগছে। অল্প বয়সের ভুলগুলো যে বড্ড মারাত্মক হয়। আবেগের বয়সে একটা ভুল করে সারাজীবন আফসোস করেও সেই ভুলের সংশোধন করা যায় না।

বাস থামতেই এক এক করে নেমেছে সবাই। রোশন ভালো করে মুখে মাস্ক পরে নিয়েছে এখন৷ সাথে লিমনও৷ অর্কর বিষয় আলাদা। ও সবে কয়েকদিন হলো ডাকাতদের দলে যোগ দিয়েছে। তাই ওর কোনো রিস্ক নেই বললেই চলে। মেহেক আর মিষ্টি অনেক দিন পর যেনো প্রানখুলে নিঃশ্বাস নিলো। আর একটু অপেক্ষা! তারপরই সেই চিরচেনা ঘরে পৌঁছাবে।
” অর্ক তুই ওদেরকে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত দিয়ে আসবি। আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা করছি। এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। ”
রোশন সিগারেটে ফুঁক দিয়ে বললো। লিমন ওর পাশে অনুগত দাসের মতো দাঁড়িয়ে। অর্ক বললো,
” ঠিক আছে ভাই। আফনেরা যান।”

রোশন মেহেকের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। মিষ্টির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে মেয়েটা। একবারও একটু ফিরেও তাকাচ্ছে না বলে রাগ হচ্ছে রোশনের।

” সুন্দরী আমাদের শীঘ্রই দেখা হবে। ততদিন সাবধানে থেকো আর পরপুরুষ থেকে দূরে থেকো। দূরে মানে দূরে… গট ইট?”
রোশনের কথায় গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে মেহেকের।
” একজীবনে আর দেখা না হোক আমাদের। পারলে আর কোনো মেয়েকে আমার মতো তুলে নিয়ে যাবেন না।”
” আর শখ নেই! তবে একজীবন না তুমি চাইলেই যখন-তখন আমাদের দেখা হবে। ”
” আমি কখনো চাইবো না।”
” এমন কথা বলবে না যা রাখতে পারবে না। তুমি চাইবে! অর্ক ওদের নিয়ে যা।”

মেহেকের দিক থেকে নজর সরিয়ে অর্ককে বললো রোশন৷ মেহেক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল আজ। রোশন আর লিমন এগোলো অন্ধকারে। মিষ্টি, মেহেক আর অর্ক বাড়ির পথে এগোচ্ছে। বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব একটা দূরে না ওদের বাড়ি। হেঁটে গেলে বিশ-একুশ মিনিটের পথ। তবুও অর্ক একটা অটোরিকশা ডাকলো। তিনজন মিলে রওনা দিলো। গাড়িতে পৌঁছাতে মিনিট দশেক লাগলো। অর্ক ভাড়া মিটিয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে ওদেরকেও নামতে বললো।
” মিষ্টি, মেহেক নামুন।”
” ধন্যবাদ অর্ক ভাইয়া। আপনি সবার থেকে একটু আলাদা। ভালো থাকবেন। ”
মেহেক হেসে বললো অর্ককে। অর্ক মিষ্টির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
” চলুন একেবারে বাড়ির ভেতরেই পৌঁছে দিয়ে আসি৷ ভাইয়ের আদেশ। ”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মেহেক। লোকটা নেই তবুও তার কথা! যেহেতু নিজে থেকে বাড়ির ভেতর যেতে চাচ্ছে অর্ক। তাই আর না করলোনা কেউ।
” আচ্ছা। ”

বাড়ির সামনে অটোরিকশা থামার আওয়াজেই এরমধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন মেহেক ও মিষ্টির বাবা-মা। আশেপাশে থেকে কিছু প্রতিবেশীরাও এসেছে অবশ্য। এতদিন পর মা’কে দেখে মিষ্টি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মেহেককে বুকে জড়িয়ে নেন সিদ্দিক। সবাই বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে। অর্ক দাঁড়িয়ে দেখছে সবকিছু। কোথাও যেনো একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে ছেলেটা। চোখ টলমল করছে ওর। থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
” কী গো মিষ্টির মা এই কি তোমার মেয়ের জামাই? ”
অর্ককে ইশারা করে পাশের বাড়ির রহিমা শুধলেন। মা’কে ছেড়ে অর্কর দিকে দৃষ্টিপাত করলো মিষ্টি। মেহেকও অবাক হয়ে গেছে।
” মা উনি আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছেন শুধু। ”
মিষ্টি ওর মা’কে বললো। আনজুম বেগম রাহিমার প্রশ্নের উত্তরে বলে,
” না।”
” ওও বুঝতে পারছি সব!”
রাহিমার আচার-আচরণ বিরক্ত লাগছে মেহেকের।
” চল মা তোরা ঘরে চল এখন৷ আর বাবা তুমিও চলো। একটু নাস্তা করে যাবে।”
মেহেকের বাবার প্রস্তাবে অর্কর ভাবনায় ছেদ ঘটে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
” না চাচা। আরেকদিন আসুম। আজ যাই। মিষ্টি, মেহেক এলাম।”
মাথা নেড়ে স্বায় দিলো দুই বোন। যখন যেতেই হবে তখন দেরি করে লাভ নেই। এমনিতেই আশেপাশের লোকজন উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে।
” তা তোমার দুই মেয়ের সাথে যে ছেলে তিনটা ছিলো তারা কারা?”
রাহিমার পাশ থেকে করিম বেপারী কথাটা বলেই বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো। মিষ্টি ভয়ে কুঁকড়ে গেলো কিছুটা। সবাই যদি সবকিছু জেনে যায়! কিন্তু করিমের কথায় মেজাজ বিগড়ে গেলো মেহেকের। এখন আর সেই মেহেক নেই যে চুপ করে থাকবে।

চলবে,