নীরবে নিভৃতে পর্ব-১২

0
107

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

” তা তোমার দুই মেয়ের সাথে যে ছেলে তিনটা ছিলো তারা কারা?”
রাহিমার পাশ থেকে করিম বেপারী কথাটা বলেই বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো। তার এই কথার আড়ালে যে ভয়ংকর ইঙ্গিত সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হয়নি। মিষ্টি ভয়ে কুঁকড়ে গেলো কিছুটা। সবাই যদি সবকিছু জেনে যায়! কিন্তু করিমের কথায় মেজাজ বিগড়ে গেলো মেহেকের। এখন আর সেই মেহেক নেই যে চুপ করে থাকবে।
” আপনার মেয়ে কেমন আছে এখন চাচা? গতবার যে রুবেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে আবার ফেরত আসলো তারপর তো খুব অসুস্থ ছিলো।”
মেহেকের হাসি হাসি মুখে কথা বলাতে করিম বেপারীর মেজাজ তুঙ্গে। কতবড় সাহস এই মেয়ের তার মেয়েকে নিয়ে কথা তুললো!
” বেশি বাড় বেড়েছে তোর মেহেক। মুখে দেখি কথাও ফুটেছে। ”
” কথা বলতে শিখলেই আপনাদের অসুবিধা চাচা। বোবা হয়ে থাকলে শান্ত,ভদ্র মেয়ে। আগে নিজের চরকায় তেল দিন তারপর অন্যের ঘরের চরকার খোঁজ নিতে আসবেন। ”
করিম বেপারী কিছু বললো না। রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে চলে গেছেন। উনার দেখাদেখি বাকি প্রতিবেশীরাও যে যার বাড়ির দিকে এগিয়েছেন। আনজুম মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেহেক বাবার হাত ধরে বলে,
” বাবা চলো ঘরে যাই। মা চলো।”
” হ্যাঁ চল তোরা, হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে খাওয়াদাওয়া করে নিবি।”
আনজুম বেগম মেহেক ও মিষ্টিকে একসাথে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। মেহেকের বাবার মুখে হাসি ফুটেছে আজ। কতদিন পর বুকটা শীতল হলো। মেয়েরা হচ্ছে বাবার প্রাণ। শরীরে প্রাণ না থাকলে কি মানুষ বাঁচে? সেজন্যই তো সিদ্দিকের মনে এতো কষ্ট, অস্থিরতা ছিলো এতদিন।

নদীর পার হয়ে পাড়ে পৌঁছাতেই চমকাল রোশন। পাহারাদাররা মাটিতে লুটিয়ে আছে মৃত। লিমনও ভয় পাচ্ছে। ওদের অনুপস্থিতিতে নিশ্চিত বড়সড় কোনো ঘটনা ঘটে গেছে এখানে।
” লিমন তাড়াতাড়ি পা চালা তো। ”
” হ্যাঁ ভাই। ”
ভেজা শরীরে দু’জন দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে ঘন জঙ্গলের ভেতর। চাঁদের আলো খুব একটা না থাকলেও আবছা আলোতে পথ চলতে পারছে দু’জন।
” ভাই! এটা তো পুলিশ! ”
লিমনের কথায় থামল রোশন। সামনে মাটিতে একজন পুলিশের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। তবে রক্ত অবশ্য ওরা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু মৃত এটুকু বুঝতে পেরেছে। রোশন শার্টের নিচে কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে হাত নিয়ে লিমনকে বললো,
” ভালো করে চেক কর তো, হার্টবিট সচল আছে কি-না। ”
লিমন হাঁটু গেড়ে বসে পুলিশ কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষণ করে কিছু সময় পর উঠে দাঁড়ালো।
” না ভাই। শেষ। ”
” মনে হয় পুলিশ আক্রমণ করেছিল এবং বড়সড় একটা লড়াই চলেছে জঙ্গলে। তাড়াতাড়ি পা চালা তো। নিশ্চয়ই বাবাসহ সবাই বিপদে আছে। নইলে মৃত লাশগুলো এরকম পরে থাকতোনা। আর হ্যাঁ খুব সাবধানে পা ফেলবি।”
” ঠিক আছে ভাই। ”
রোশনের সাথে পায়ে পা চালিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর এগিয়ে যাচ্ছে লিমন। এরমধ্যেই একটা গুলির আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো রোশন। লিমন ভয়ে কেঁপে উঠল।
” ভাই মনে হয় ডেরায় পুলিশ পৌঁছে গেছে। ”
” পৌঁছলেও ওরা সংখ্যায় বেশি নেই। আসতে আসতে কমপক্ষে ছয়জনের লাশ তো পড়ে থাকতে দেখলাম৷ আমাদের লোকজনও কিছু কম যায় না। ”
” তা ঠিক বলেছো ভাই। ”
” দাঁড়া লিমন! দেখ দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে বাবার পাশে। বাকি সাতজনের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকজন লোক। কিন্তু পুলিশের পোশাক তো পরে নেই লোকটা! পেছন দিক থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু। কিন্তু মুখটা তো দেখা যাচ্ছে না!”
লিমন ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে। ওর দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ডাকাতরা যেমন চুপ করে আছে তাতে রোশন নিশ্চিত এটাও প্রশাসনের লোক। তবে ফর্মাল ড্রেসে নেই।
” ভাই ওদিকে গিয়ে দাঁড়ান তো, তাহলে হয়তো মুখটা দেখতে পারবো আমরা।”
রোশন লিমনের কথামতো সত্যি খুব সাবধানে বামদিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। লিমনও রোশনের পিছু পিছু দাঁড়িয়েছে। তবে রোশন সামনে থাকায় যা দেখতে পাচ্ছে লিমন তা পাচ্ছে না। রোশন এই মুহুর্তে যা দেখছে তাতে নিজের দৃষ্টিভ্রম হয়েছে বলেই মনে করছে সে। অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যি সামনে আসায় একপা পিছিয়ে গেলো রোশন। আর তাতেই সবকিছু স্পষ্ট হলো লিমনের সাথে। পুলিশের হাতের বৈদ্যুতিক চার্জার লাইটের আলোতে আগন্তুকের চেহারা স্পষ্ট। লিমনের মুখ থেকে অস্ফুটে স্বরে বেরিয়ে এলো,
“ অর্ক!”
” হ্যাঁ অর্ক! ও আমাদের ঠকিয়েছে লিমন।”
রোশন নিজেকে সামলে সামনে এগিয়ে এলো কিছুটা। লিমন ফিসফিসিয়ে বললো,
” কিন্তু কীভাবে? এতো নিখুঁত অভিনয়! ”
” সবকিছু গোলমেলে লাগছে লিমন। অর্কর সাথে বিষয়টা আমি বুঝে নিবো। তার আগে বাকি দু’জনকে শেষ করতে হবে। ওরা দু’জন আমারও দু’জন। অর্কর একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে না। তাই ওই দু’জনকে শুট করতে পারলেই ওকে। ”
” ঠিক আছে ভাই। আপনি একটা নিশানা করুন আমি করছি একটাকে। ”
” বি কেয়ারফুল লিমন৷ টার্গেট মিস হওয়া চলবে না। ”
” রিলাক্স ব্রো।”
” ওকে, আমি ইশারা করলে একসাথে গুলি মারবো। ওকে?”
” ডান।”

রোশন আর লিমন সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করলো। দু’জনেই তৈরি এখন। রোশন ইশারা করতেই লিমন গুলি ছুড়লো সাথে রোশনও। মুহুর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো পুলিশ কর্মকর্তা দুজন। সরাসরি মাথায় গুলি মারায় কারোরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। মজার কথা সব পুলিশের শরীরেই বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরা ছিলো। তাই ডাকাতরাও বুদ্ধি করে সরাসরি হেড শুট করে দিয়েছে। আচমকা এমন ঘটায় অর্ক ঘাবড়ে গেলেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে রোশনের কাজ এটা। সাথের সঙ্গী দু’জন মারা যাওয়ায় এখন উল্টো ডাকাতরা ঘিরে ধরলো অর্ককে। হাতের অস্ত্র নিয়ে উল্টো ওর কপালে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। রোশন এগিয়ে গেলো সেদিকে। সবুর হোসেনকে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” বাবা তুমি ঠিক আছো তো?”
” আমি ঠিক আছি রোশন। তোকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। ”
” আমি ঠিক আছি বাবা।”
বাবার বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোশন। ফয়সাল অর্ককে ইশারা করে রাগান্বিত স্বরে রোশনকে বললো,
” ভাই এই বেইমানটাকে কী করবে?”
রোশন ঘাড় কাত করে শান্তকে ইশারা করলো কিছু একটা। মিনিট দুয়েকের মধ্যে শান্ত কিছু একটা নিয়ে এগিয়ে এলো রোশনের দিকে। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে দিলো ওর। তারপর লাইটার দিয়ে সিগারেটও ধরিয়ে দিলো শান্ত। রোশন সিগারেটে সুখটান দিয়ে এগোতে লাগলো অর্কর দিকে। কপালের লম্বাচুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে রোশনের। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোও ভিজে চুপেচুপে।
” কী রে অর্ক? তোকে বিশ্বাস করার এই প্রতিদিন দিলি?”
অর্কর থুতনিতে হাত রেখে বললো রোশন। অর্ক মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
” বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা তোদের মতো ডাকাতদের জন্য নয় রোশন। তোরা কতো মেয়েদের জোর করে তুলে এনে ভোগ করেছিস এমনকি মেরেও ফেলেছিস। দু’দিন ভালোর মুখোশ পরলেই তো আর ভালো হয়ে যাসনি। তাছাড়া কত ব্যাংক লুট করেছিস তার কি হিসাব আছে? তোদের ধরার জন্যই আমাকে প্রশাসন এখানে পাঠিয়েছিল। তুই এসে সবকিছু বরবাদ করে দিলি। শিট!”
রোশন হাসলো একটু। সময় নিলো না সিন্ধান্ত নিতে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আরেকটা গুলির আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো আশেপাশের সব পশুপাখি। বেইমানির ক্ষমা নেই রোশনের কাছে।
” লাশগুলো সব নদীতে ভাসিয়ে দে, যাতে সবাই বুঝতে পারে পরেরবার আবারো এমনকিছু করলে ফল এমনই হবে। ”
ফয়সাল,শান্ত আর লিমন রোশনের কথামতো কাজ করতে লাগলো। রোশন গিয়ে বাবার সাথে ঘরের দিকে গেলো। পোশাক পাল্টাতে হবে। নদীতে আসতে গিয়ে ছোটো নৌকাটা আজ উল্টে গিয়েছিল। অর্কর লাশটা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে লিমন৷ ছেলেটার সাথে অল্প সময় হলেও বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওর। এইতো মাসদেড়েক আগে একদিন দলে এলো অর্ক। বলেছিল বাবা-মা মারা গেছে, এতিম সে। অথচ বের হলো কী!

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে দুই মেয়ের থেকে সব কথা শুনলেন সিদ্দিক ও আনজুম। তবে মেহেক মিষ্টির পতিতালয় যাওয়ার বিষয়টা শুধু গোপন করে গেছে। বিক্রি করতে চেয়েছিল পল্লব এতটাই বলেছে। আনজুম বেগম তো রাগে ফুঁসছেন। পল্লবের মা’কে গিয়ে কয়েক কথা না শুনিয়ে দিতে পারলে শান্তি নেই। ছেলেকে নিয়ে কতো বড়ো বড়ো কথা মহিলার! অথচ দেখো কীসব কুকর্ম করে বেড়ায় ছেলে।
” আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া তোরা প্রাণে বেঁচে ফিরেছিস। ওই শয়তান পল্লব একবার আসুক গ্রামে।”
মায়ের কথা শুনে মেহেকের রোশনের কথা মনে পড়লো। রোশন তো পল্লবকে বলেছিল,গ্রামের আশেপাশে দেখলেও শেষ করে ফেলবে ওকে। জীবনে প্রথম কাউকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে মেহেকের। এই পল্লবকে একদিন নিজের হাতে মার*বে বলে মনস্থির করেছে মেহেক।
” ঠিক বলেছো মিষ্টির মা।”
সিদ্দিক আহমেদ একটু থেমে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে আবারো বললেন,
” তোরা গিয়ে নিজেদের ঘরে শুয়ে পড়। কতদিন শান্তিতে ঘুমাসনি!”
বাবার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো দুই বোন। কখনো ভাবতেই পারেনি আবারো নিজ গৃহে ফিরতে পারবে। অথচ আজ পারলো।
” হ্যাঁ বাবা। আমরা যাচ্ছি এখন।”
মিষ্টি মেহেককে ইশারা করতে মেহেকও উঠে দাঁড়ালো। দুই বোন খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের শোয়ার ঘরের দিকে এগোলো।

❝ নয়া দিঘী গ্রামের পাশের জঙ্গলে পুলিশ ও ডাকাতদলের মধ্যে ভয়ানক বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। হতাহতের খবর জানা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে সাংবাদিকরা।❞

ফোন হাতে নিয়ে ইউটিউবে একটা নিউজ চ্যানেলে লাইভে ঢুকেছে মেহেক। কিন্তু আচমকা এমন খবরে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। পাশের জঙ্গলে মানে তো রোশনদের সাথে! অস্থির লাগছে মেহেকের। রোশনের কিছু হবে না তো? চমকাল, থমকাল মেয়েটা নিজেরই অদ্ভুত ভাবনাচিন্তায়। ওই ডাকাতদের তো এরকমই শাস্তি পাওয়া উচিত। তবে কেনো খারাপ লাগছে?

চলবে,