#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
অস্থির লাগছে মেহেকের। রোশনের কিছু হবে না তো? চমকাল, থমকাল মেয়েটা নিজেরই অদ্ভুত ভাবনাচিন্তায়। ওই ডাকাতদের তো এরকমই শাস্তি পাওয়া উচিত। তবে কেনো খারাপ লাগছে? হয়তো এতদিন একসাথে ছিলো বলে এই ভাবনার উদয় হয়েছে মনে। হ্যাঁ সেটাই। মেহেক ভিডিও স্কিপ করে অন্য ভিডিয়োতে ক্লিক করলো। নিজের পছন্দমতো একটা গান প্লে করে দু-চোখ বন্ধ ফেললো মেহেক। একটা শান্তির ঘুম দরকার। বহুদিন শান্তিতে ঘুম হয় না….. দু-চোখ বন্ধ করে গান শুনতে কখন যে মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলো টেরই পেলো না সে।
চোখ বন্ধ করলেই শুধু বাজে বাজে দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মিষ্টি কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছে না। শোয়া থেকে উঠে বসে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। সামনে এসএসসি পরীক্ষা! পড়ালেখার দিকে কীভাবে মনোযোগ দিবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। রাতটা এভাবেই ছটফট করতে করতে কাটলো মিষ্টির। কিছু ভয়াল স্মৃতি ম্লান হতে সময় লাগে।
দেখতে দেখতে দুই বোন বাড়ি আসার সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এরমধ্যে নানান কটুক্তির স্বীকার হতে হয়েছে ওদেরকে। ঘর থেকে বেরোলেই প্রতিবেশীরা নানান প্রশ্ন করে। সেসব প্রশ্নে মিষ্টি মানসিকভাবে বেশ দূর্বলও হয়ে গেছে। এতো বড়ো একটা ট্রমা থেকে বের হওয়ার যে পরিবেশ দরকার সেটা পাচ্ছে না মেয়েটা। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে স্কুলের বান্ধবী, শিক্ষক সবাই কটাক্ষ করছে মিষ্টিকে। মিষ্টির বিষয় তা-ও কেউ জানে না। সবাইকে আনজুম বলেছে ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তাই কোনো খোঁজ জানাতে পারেনি। কিন্তু মিষ্টির সাথে মেহেককে ফিরতে দেখে আর সাথে ছেলেরা থাকায় গ্রামের কেউ সে কথা বিশ্বাস করেনি। উপরন্তু বিয়ের দিন মিষ্টিকে কীভাবে ডাকাতরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেসব নিয়ে সবাই জল ঘোলা করছে সব সময়। গতকাল বাজার থেকে ফিরছিলেন সিদ্দিক আহমেদ। বাজারের এক দোকানদার তো বলেই বসলো,
❝ বড়ো মেয়েকে তো ডাকাতরা নিয়ে ভোগ করলো। তা ছোটো মেয়েকেও কি ইচ্ছে করেই তাদের কাছে পাঠিয়েছিলে? হ্যাঁ হ্যাঁ সব বুঝি। ডাকাতেরা নিশ্চিত মোটা টাকাপয়সা দিয়েছে দুই বোনকে। মজা শেষ তাই এখন ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ❞
কথাগুলো শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি সিদ্দিক। লোকটার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। লোকজন এসে শেষে দু’জনকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এভাবে ক’জনের সাথে রাগারাগি করবে? লোকের কথা তো বন্ধ করতে পারবেনা। নিজেদের ভীষণ অসহায় লাগছে ওদের।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া করছে মিষ্টি। মেহেক নিজের ঘরে বসে আছে। খাওয়াদাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই ওর। বাবা বাড়িতে নেই। মিষ্টি অবশ্য বারকয়েক সেধেছিল বোনকে। কিন্তু মেহেক এলোনা খেতে। এখন মনে হচ্ছে নিজের জন্য সবাইকে এতো সমস্যায় পড়তে হয়েছে। মিষ্টি কোথায় গিয়েছিল সেটা লোকজন যতটা না কথাকথি করছে তারচে তিনগুণ বেশি ডাকাতদের সাথে মেহেকের থাকা নিয়ে কথা বলছে। কী করবে এখন! নিজের জন্য বাবাকে,বোনকে কথা শুনতে হবে এটা মেহেক কিছুতেই মানতে পারছে না। বিছানায় বসে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে আছে মেহেক। এক হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে মেয়েটা। রোশনের উপর তীব্র ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে ওর মনে। ওই লোকটা যদি ওকে না তুলে নিয়ে যেতো আজ এই অবস্থা হতোনা। আর পল্লব! পল্লবের জন্য মিষ্টির জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। এই দু’টো ছেলেকে খু*ন করতে পারলে শান্তি পেতো মেহেক।
“ ভাই। ”
শান্ত এসে দাঁড়িয়েছে রোশনের সামনে। কড়া রোদের মধ্যে চেয়ার পেতে বসে সিগারেট ফুঁকছে সে।
” হ্যাঁ বল। কী খবর আমার সুন্দরীর?”
” বিশেষ ভালো না। গ্রামের লোকজনের জন্য অতিষ্ট হাওলাদার বাড়ির লোকজন। সবাই খুব আজেবাজে কথা বলছে। ”
” কী করা যায় শান্ত? পুরো গ্রামের লোকজনকে কীভাবে বোঝাবো আমার সুন্দরী পবিত্র! ”
শান্ত চুপ করে রইলো। রোশন ভাবছে। কীভাবে কলঙ্ক মুক্ত করবে তার সুন্দরীকে। আচমকা শান্ত বলে উঠলো,
” ভাই বিয়ে করে নিলেই তো হয়!”
চমকাল রোশন। বিয়ে! শব্দটা কয়েকবার আওড়ে নিলো। এই অনিশ্চিত জীবনে কীভাবে মেয়েটাকে জড়াবে? তাছাড়া তার সুন্দরী কখনো স্বেচ্ছায় বিয়ে করবে না তাকে।
” তা হয় না শান্ত। আমি চাই মেহেক ভালো থাকুক। সেজন্যই নিজের অন্তরের জ্বালা সহ্য করে দূরে আছি ওর থেকে। তাছাড়া আমাকে ও কখনো মন থেকে বিয়ে করবে না। অর্ক তো মৃত্যুর আগে ঠিকই বলেছিল বল? আমি এখন সাধু হয়ে গেছি মানে আগে যেসব নোংরামি করেছি তা তো মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। ”
শান্ত অর্কর কথা ভাবলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক চিঁড়ে। মাঝে মধ্যে হুটহাট করে নেওয়া সিন্ধান্তের জন্য পরে আফসোস হয় মানুষের। যেমনটা এখন হচ্ছে রোশনের।
” সবকিছু ঠিক আছে ভাই। কিন্তু লোকজনের মুখ বন্ধ করতে হলে বিয়ে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। ”
” লোকজন যখন শুনবে ডাকাত বিয়ে করেছে, বিষয়টা কি আদৌও কেউ বিশ্বাস করবে? আর মেহেক রাজি হবে কেনো? আমি ওর সাথে যা করেছি!”
” জোর করে করতে হবে ভাই। আর বিয়েটা ওদের বাড়িতে বসেই হবে তাহলে সবাই বিশ্বাস করবে। আর সম্প্রতি প্রশাসনের সাথে আমাদের যে লড়াই হলো এরপর স্থানীয় পুলিশ খবর পেলেও সহজে আসবেনা আমাদের কাজে বাঁধা দিতে। কারণ ওরা জানে আমরা কতটা ভয়াবহ এখন।”
শান্তর সব কথাগুলো মন দিয়ে শুনল রোশন। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অবশিষ্ট অংশটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রোশন। সবুর হোসেনের সাথে কথা বলবে রোশন। ডাকাতদের কোনো পরিবার নেই। সেখানে বিয়ে!
সকাল সকাল মিন্টুর মায়ের আগমন মোটেও ভালো চোখে দেখছে না হাওলাদার বাড়ির লোকজন। বসার ঘরে চেয়ারে বসে আছেন তিনি। সামনে আনজুম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসে আছেন। পান চিবোতে চিবোতে মন্টুর মা বললেন,
” তা তোমার মেয়েদের কি বিয়ে দিবে না? যদি রাজি থাকো আমার মন্টুর জন্য তাহলে মেহেককে বউ করে নিতাম। ”
ভদ্রমহিলার এমন প্রস্তাবে চমকাল মিষ্টি। পাশের ঘরে বসে বই পড়ছিল মেয়েটা। মেহেকের অনুপ্রেরণায় নিজেকে খুব করে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। যেহেতু টিনের তৈরি ঘর তাই এপাশে বসেও ওপাশের কথোপকথন সবকিছু শোনা যায়। আনজুম বেগম হিসিয়ে উঠলেন।
” তোমার ওই জুয়া খোর ছেলের সাথে আমার মেহেককে বিয়ে দিবো ভাবলে কী করে মন্টুর মা? এক তো আগের বউ ছিলো, তারপর নেশাখোর, জুয়া খেলে!”
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন মন্টুর মা। রাগে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। দাঁত খিচিয়ে বলেন তিনি,
” তোমার ঘরে কেচ্ছা কাহিনী জানার পরেও যে বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছি এটাই তো ওই মেয়ের কপালের জোর। নটীপনা করে খাওয়ার শখ যখন তাই করুক। সংসার করা এসব মেয়েদের কাজ না। আমার ছেলের থেকেও খারাপ ছেলে জুটবে ওর কপালে। ”
ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলে এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেহেকের মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসেই আছেন। উচিৎ কথা বললে উল্টো কথা শুনতে হয় আজকাল তা ভালো করে টের পেয়ে গেছেন তিনি। মিষ্টি এসে মায়ের পাশে বসেছে। মেহেক গেছে পুকুরে এঁটো থালাগুলো ধুতে।
” মা তুমি মন খারাপ করছ কেন? লোকের মুখ আছে বলবে। তোমার কান আছে এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে সবকথা বের করে দিবে। মস্তিষ্কে সেগুলো নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করার তো কোনো দরকার নেই। ”
আনজুম বেগম সমস্ত ভাবনাচিন্তা পাশে সরিয়ে মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছোটো মেয়েটা এই ক’দিনে কতটা বড়ো হয়ে গেছে! আসলে বয়স কেবলমাত্র একটা সংখ্যা। ম্যাচুরিটি আসে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। যেমন মিষ্টির বেলায় হয়েছে!
” হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। এতো সুন্দর করে কথা বলতে শিখলি কবে থেকে মা?”
মিষ্টি মুচকি হাসলো মায়ের কথায়। মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
” এসব মেহেক আপু বলেছিল আমাকে। আমি আবার তোমাকে বললাম। জীবনে সবার কথা শুনতে নেই, পাত্তা দিতে নেই। আর অযোগ্য ব্যক্তিদের সাথে তর্কও করতে নেই। কারণ আমাদের সময়ের মূল্য অনেককক…”
মিষ্টির মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হেসে বললো,
” ঠিক বলেছে তোর আপু৷ তুই গিয়ে পড়তে বস। আমি গিয়ে দেখি মেয়েটা একা একা কী কাজ করছে।”
” আচ্ছা মা।”
মিষ্টি আবারো নিজের পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেছে। মেহেকের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরে ঘাটের দিকে এগোচ্ছেন আনজুম বেগম।
চলবে