নীরবে নিভৃতে পর্ব-১৪

0
214

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

নিশুতি রাত! গভীরে ঘুরে আচ্ছন্ন মেহেক। কেমন একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আড়চোখে খুব কাছ থেকে দেখছে ওকে। আচমকা চোখ মেলে তাকাল মেহেক। বিস্মিত হলো ভীষণ। খাটের পাশে চেয়ারে বসে আছে রোশন। ঠোঁটের কোণে সিগারেট গুঁজে সুখটান দিচ্ছে আর আড়চোখে তাকিয়ে আছে।
” ঘুম ভাঙলো তবে সুন্দরী? ”
” আপনি! আমি কোথায়? ”
” আমার ঘরে। ভালো করে তাকিয়ে দেখো। ”
রোশনের কথায় অবাক হলো মেহেক। দৃষ্টি সজাগ করে আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখেল একবার। সত্যি তো এটা মেহেকের ঘর নয়!
” আমাকে আবারো ধরে এনেছেন কেনো? আমি কিন্তু আপনাকে এবার সত্যি খু* ন করবো।”
মেহেক থেমে থেমে বললো কথাগুলো। রোশন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং সিগারেট ফেলে দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর হাসতে হাসতে মেহেকের পাশেই এসে বসলো। মেহেক সরে গেলো একটু দূরে, বিছানার মাঝখানে গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।
” কী হলো? অতদূরে বসে থাকলে খু* ন করবে কীভাবে সুন্দরী? কাছে এসো! মেরে ফেলো আমাকে। তোমার হাতেই তো মরতে চাই আমি আজ। আমার দিকে তাকাও, দেখো তোমার প্রিয় রঙের, পছন্দের পাঞ্জাবি পরেছি। ”

মেহেক নিজেকে আরো সরিয়ে নিলো রোশনের থেকে। ভীষণ ভয় লাগছে ওর, ভীষণ! রোশন হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে নিজেও চড়াও হলো মেহেকের উপর।
” আমাকে স্পর্শ করবেন না! ”
” তোমাকে স্পর্শ করার একমাত্র অধিকার আমার সুন্দরী। আজ তো স্পর্শ করতেই হবে! আজ যে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত, বাসররাত!”

রোশনের শেষ কথাটা শুনে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চমকাল মেহেক। লাল বেনারসি পরে আছে সে, পুরো ঘর সাজানো! রোশন এগোতে লাগলো তার কার্যে। মেহেকের দু’হাতে নিজের হাত রেখে বিছানায় চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে গেলো………………

ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে শোয়া থেকে উঠে বসেছে মেহেক। গলা শুকিয়ে গেছে, বুক ধরফর করছে। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা বুঝি এখুনি গলা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে তবুও ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে মেয়েটার শরীর। কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা জমেছে। লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে বালিশের পাশে থেকে টর্চ লাইট হাতে নিয়ে জ্বালল মেহেক। তারপর সমস্ত ঘর দেখে নিলো একবার। নাহ, নিজের ঘরেই আছে সে। এতক্ষণের ঘটে যাওয়া সবকিছুই তাহলে নিছক দুঃস্বপ্ন ভেবে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিলো। পাশের টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে কিছুটা পানি পান করলো মেহেক। রাত সাড়ে তিনটা বেজেছে। দেয়ালঘড়ি সেটাই জানান দিচ্ছে মেহেককে। ঘুমোতে হবে। নিজেকে শান্ত করে আবারো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো মেহেক। তবে সারারাত আর ঘুম হলোনা বেচারির।

পূর্ব আকাশে সূর্য তার নিজস্ব জায়গায় ফিরে এসেছে। রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে ধরণীর বুকে। সকাল সকাল মোরগদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙেছে সিদ্দিক আহমেদের। আজ শুক্রবার। দোকান বন্ধ। তাই একটু দেরি করেই ঘুম ভেঙেছে। হাতমুখ ধুয়ে বাড়ির উঠোনে বসেছেন তিনি। মাসখানেক বাকি মিষ্টির এসএসসি পরীক্ষার। সেজন্য একজন শিক্ষক বাড়িতে রাখা খুব দরকার বলেই মনে করছে সিদ্দিক আহমেদ। এতদিন অনেক ঝামেলা গেছে। এখন একটু ঠিকঠাক মতো লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ না দিলে হবে না। যদিও পরীক্ষার একমাসের মধ্যে নতুন করে কিছু শেখা হবে না কিন্তু একজন নিদর্শনা দিলে পড়ালেখা ভালো হবে বলেই ভাবছেন মিষ্টির বাবা।
” বাবা ভাত খাবে না? ”

মেহেককে দেখে হাসলেন সিদ্দিক।

” খাবো। তুই খেয়েছিস মা?”
” হ্যাঁ বাবা খেয়েছি। ”
” ঠিক আছে। তুই ভাত টেবিলে রেখে ঢাকা দিয়ে রাখ, আমি খেয়ে নেবো।”
” আচ্ছা। বাবা দোকান থেকে কিছু বিস্কুট,রুটি নিয়ে এসো তো। মিষ্টি রাত জেগে পড়ে, ওর ক্ষিদে পায়।”

” ঠিক আছে। বিকেলে গিয়ে আনবো। তোর মা কোথায়?”

মেহেক উঠোনের একপাশে রাখা ঝাড়ু হাতে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে যেতে বললো,

” মা পুকুর ঘাটে। আমি গেলাম ঝাড়ু দিতে।”
” সাবধানে কাজ করিস, সাপখোপ থাকতে পারে। ”
মেহেক গলা উঁচিয়ে বলে, ” আচ্ছা। ”

গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রোশন। মন মানসিকতা ভীষণ খারাপ। গতকাল সবুর হোসেনের সাথে মেহেককে নিয়ে কথা বলেছিল ও। কিন্তু তিনি কিছুতেই বিয়েতে রাজি নন। ডাকাতেরা মেয়েদের তুলে এনে ভোগ করে কিন্তু বিয়ে! না বিয়ে করে নিজেদের রাজত্ব হালকা করতে চায় না কোনো ডাকাতই। যাদের আগে ঘরসংসার ছিলো তারা কেউ এখানে নেই। এখানকার সবাই বাজে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে, দুনিয়ায় কেউ না থাকর কারণে ডাকাতদের দলে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু এসব কোনো যুক্তি রোশন এখন বুঝতে চায় না। মেহেককে নিজের জন্য নয় মেহেকের জন্য বিয়ে করতে চায় রোশন। এই জঙ্গলে আর না আসুক মেহেক তবুও গ্রামে রোশনের স্ত্রী’র পরিচিতি পেলেই চলবে। রোশনের এমন আজগুবি কথায় সবুর হোসেন কাল থেকে বেশ ক্ষেপে আছেন। তাই বাবা ছেলের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ আপাতত।

” ফয়সাল! ওকে বল বিকেলে অপারেশনে যেতে হবে। ”

বাবার কথায় ভাবনার ছেদ ঘটেছে রোশনের। দূরে দাঁড়িয়ে আছেন সবুর হোসেন। ফয়সাল কোথা থেকে যেনো দৌড়ে এলো। রোশনের মনে পড়লো আজ একটা ব্যাংক লুট করার প্ল্যান ছিলো।

” জি বস বলতেছি।”

ফয়সাল সবুরকে বলে রোশনের দিকে এগোলো। রোশনও ফয়সালের কাছাকাছি আসছে।

” বলতে হবে না। আমি শুনেছি। বাবাকে গিয়ে বল আমি রেডি আছি। সময়মত চলে যাবো।”

” আচ্ছা ভাই। বসকে মানানো একটু কঠিন হবে তাই না?”
” হুম তা হবে। তবে মানাতে তো হবেই! বাবাও আমার আর সুন্দরীও আমার। আমি দু’জনকেই চাই। শালা কপাল আমার! অন্য ছেলেদের মায়েরা এমন ঝামেলা করে। মানে ছেলের সাথে তার পছন্দের মেয়েকে মানতে চায় না, ইমোশনাল ড্রামা করে। আর এখানে দেখো মাই ডিয়ার বাবা ঝামেলা করেছে। ”
ফয়সাল রোশনের কথায় হাসতে লাগলো। রোশন ভ্রু নাচিয়ে বলে,
” হাসছিস? আরে হাসিস না। তুই বুঝবি না। প্যান্টের চেইনে যার জিনিস আঁটকে সেই মজা বোঝে, বাকিরা তো চেয়ে চেয়ে দেখে।”

ফয়সালের হাসির মাত্রা দ্বিগুণ হলো রোশনের কথায়। রোশন হাসলো না। বরং সিগারেট ধরিয়ে অন্য দিকে হাঁটতে লাগলো। কতদিন তার সুন্দরীকে দেখে না সে! বুকটা প্রেম পিপাসায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে একেবারে। শুধু ওই মেয়েটাকে জড়াতে পারলেই এই পিপাসা মিটবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটছে ডাকাতের বাচ্চা রসুন!

” তাহলে বাবা এই কথাই রইলো? কাল থেকে তুমি মিষ্টিকে পড়াতে বাড়িতে আসবে।”

বাজারে ক্লাবঘরে দাঁড়িয়ে আহনাফকে বললেন সিদ্দিক আহমেদ। আহনাফ প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মিষ্টির জন্য উনাকেই ঠিক করেছেন ওর বাবা। আহনাফ রোজ বিকেলে ক্লাবঘরে আসে ক্যারামবোর্ড খেলতে।

” হ্যাঁ চাচা যাবো সমস্যা নেই। তবে সন্ধ্যায় যাবো। সকালবেলা তো স্কুল থাকে আর বিকেলে একটু এখানে আসি, মনটা ফুরফুরে লাগে। ”

” ঠিক আছে। তোমার সময়মত এসো, সমস্যা নেই। ”
” আচ্ছা চাচা। আমি কাল সন্ধ্যা থেকে যাবো পড়াতে। ”
” বেশ বাবা। বাঁচালে। আসছি আমি। ”
” সাবধানে যাবেন। ”

মিষ্টির বাবা হাতে ছোটোখাটো একখানা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন। মেহেক আর মিষ্টি দু’জনেই টেংরা মাছের ঝোল তরকারি খুব পছন্দ করে। তাই এই বিকালবেলা হুট করে বাজারে টেংরা মাছ পেয়ে লোভ সামলাতে পারেননি সিদ্দিক। মেয়েদের মুখে আজ মাছ দেখে যে হাসি ফুটবে সেটা ভেবে সিদ্দিকের মুখেও হাসি ফুটেছে।

পড়ার টেবিলের দুইপাশে বসে আছে দু’জন। একদিকে আহনাফ খান অন্য পাশে মিষ্টি। আহনাফকে আগে থেকেই চেনে মিষ্টি কারণ একসময় তো প্রাইমারির স্টুডেন্ট ছিলো। সেই সুবাদে স্যার ডাকার অভ্যাসটা রয়েই গেছে। আহনাফ শ্যামবর্ণের, উচ্চতা ছয় ফুট, জোড়া ভ্রু’র নিচে তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ তার৷
” মিষ্টি কেমন আছো? ”
” ভালো স্যার, আপনি? ”
” এইতো চলছে।”
মিষ্টি চুপ করে গেলো। আগের মতো কথা বলার স্বভাব নেই এখন৷ বাবা ব্যতীত সব পুরুষদের থেকেই এখন নিজেকে গুটিয়ে রাখে। অন্ধকার গলিতে না হারালে তো জানতো না, এই দুনিয়ায় দিনের বেলায় যে পুরুষ ভদ্রলোকের মুখোশ পরে চলে রাত হলে সেই ভদ্রলোক নামক পুরুষটিই যায় অন্ধকার গলিতে।
” চলো পড়া শুরু করো তাহলে। আজ থেকে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার গৃহশিক্ষক। ”
” জি স্যার। ”
” প্রথমে তাহলে গণিত নাও? যেখানে যেখানে সমস্যা দেখে জানাও। ”
” আচ্ছা। ”
মিষ্টি চুপচাপ ব্যাগ থেকে বই , খাতা বের করছে। আহনাফ ঘরটা দেখে নিচ্ছে একবার।

চলবে,