নীরবে নিভৃতে পর্ব-১৫

0
101

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

মিষ্টি চুপচাপ ব্যাগ থেকে বই , খাতা বের করছে। আহনাফ সেই ফাঁকে ঘরটা দেখে নিচ্ছে একবার। বেশ পরিপাটি মিষ্টির ঘরখানা। ঘরে একটা খাট,খাটের ডান পাশে পড়ার টেবিল, দরজার দক্ষিণ দিকে জামাকাপড় রাখার জন্য ওয়ারড্রব। টিনের বেড়ায় বিভিন্ন কাগজের রঙবেরঙের ফুল ঝুলে আছে। সৌখিনতা পছন্দ করে মেয়েটা। মিষ্টি সমস্ত বই ঘেঁটে যেখানে যেখানে ওর খটকা লাগে সেই পৃষ্ঠাগুলো মার্ক করে আহনাফকে দেখালো। মিষ্টির লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে বেশ সুন্দরভাবেই প্রথম দিন পেরিয়ে গেলো আহনাফের।

সন্ধ্যা বেলা। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে বসেছে মেহেক। ঘরে গরম লাগছে। কারণ ওর ঘরের ফ্যান বিকেল থেকে আচমকা চলা বন্ধ করে দিয়েছে। সিদ্দিক আহমেদ সেই বিকেলে গেছেন বাজারে। ফিরবে হয়তো আরো পরে। তাই আজকে আর ফ্যান সারানো হবে না মেহেকের। গরমে কীভাবে রাতটা কাটাবে সেটাই ভাবনার বিষয়। মেরুন রঙের থ্রিপিসে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ মেহেককে। এলোকেশী মেহেক বসা থেকে উঠে ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বেলে অল্প অল্প হেঁটে বাড়ির পেছনের দিকে এগোচ্ছে। ওখানে আবার দক্ষিণা বাতাস থাকে মাঝে মধ্যে। মিষ্টি খুব ভীতু, রাতে একা বাথরুমে পর্যন্ত যায় না। আর মেহেক তার বিপরীত! সানভিও সাহসী বেশ। গতকাল বিকেলে মামার বাড়ি গেছে ছেলেটা। একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসলো মেহেক। ফোনের ফ্লাশলাইট দিয়ে চারদিকে একবার ভালো করে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে ও। ফোন, টিভি যেখানেই যাওয়া হোকনা কেনো সব জায়গায় এখন শুধু রাসেল ভাইপার! সাপের ভিডিও দেখতে দেখতে অনেকের এমন অবস্থা হয়েছে গাছের পাতা নড়লেও মনে হয় সাপ এলো না তো? আচমকা পাতার মড়মড় শব্দে লাফিয়ে উঠলো মেহেক। রাসলে ভাই এলো না তো? মেহেক বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাতাস খাওয়ার দরকার নেই আর। রাসেল ভাইয়ের কামড় খেলে আজীবনে আর বাতাস খেতে হবে না ভেবে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো মেহেক। কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো চমকাল সে। পেছন থেকে কেউ হাত ধরেছে ওর। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভুউউউউত….. না তো? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো মেহেক কিন্তু মন বলছে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখ। কিন্তু ভয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। আজীবন মিষ্টিকে ভীতু বলে এসেছে কিন্তু আজ এখন মেহেক খুব করে বুঝতে পারছে নিজেই মহা ভীতু সে।

” কেমন আছো সুন্দরী? ”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে দাঁড়াল মেহেক। রোশন! এই সন্ধ্যায় এই ডাকাতটা এখানে? ভুতের ভয়ের থেকেও রোশনের ভয় মেহেককে জেঁকে বসেছে এবার। আবারো হয়তো ওই জঙ্গলে নিয়ে যাবে লোকটা ওকে। মেহেক রাগে, ঘৃণায় স্ব শব্দে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো রোশনের গালে। রোশন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ঘাড় কাত করে মুচকি হেসে এক হাত মেহেকের কোমরে হাত রেখে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। আর অন্য হাত দিয়ে মেহেকের দু’টো হাতই ওর পিঠের সাথে চেপে ধরে। মেহেক রাগান্বিত স্বরে বলে,

” থাপ্পড় একটা খেয়ে হয়নি? আরো লাগবে? এতদিন পরে আবারো আমার জীবনটাকে এলোমেলো করতে এসেছেন আপনি? আপনি জানেন আপনার জন্য আমার কতো কথা শুনতে হয়? আমার বাবা-মা লোকের কথা শোনে? আবারো, আবারো কেনো এসেছেন আপনি? কেনো?”
রোশন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেকের ঠোঁটের দিকে। ওর কথা বলার ধরণ ভীষণ ভালো লাগে রোশনের। মেহেক উক্ত কথাগুলো একনিঃশ্বাসে বলে একটু দম নিয়ে ফের বলতে লাগলো,

” আর কী চাইছেন আপনি বলুন! ”
” সুন্দরী! তুমি রাগ করলে না তোমাকে ভীষণ সেক্সি লাগে। সবাই বলে রাগলে সুন্দর লাগে আসলে বলতে পারে না যে হট লাগে । ”
মেহেক নিজের হাতদুটো চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছেনা। মেজাজ খারাপ লাগছে ভীষণ ওর।
” অসভ্য! লুচ্চা, শয়তান মানুষ আপনি। আপনার স্পর্শে আমার শরীর ঘিনঘিন করছে। ছাড়ুন নয়তো চিৎকার করবো আমি। ”
রোশন সো কুল মুডে আছে। কিছুতেই যেনো যায় আসে না, ডোন্ট কেয়ার মুডও বলা চলে। কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে হেসে বললো রোশন,
” আমি খারাপই। আর আমার স্পর্শ ছাড়া আর কোনো পুরুষ স্পর্শ একজীবনে আর পাবে না তুমি। আর রইলো কথা চিৎকার করার? পারলে করো। আমি তো মানা করিনি। ”
মেহেক ভীষণভাবে নড়াচড়া করে যাচ্ছে। সত্যি বলতে চিৎকার করা সম্ভব না মেহেকের পক্ষে। কারণ রোশন কখনোই একা আসবে না গ্রামে। আশেপাশেই নিশ্চিত আরো কিছু ডাকাত আছে। আর ওদের সবার সাথেই তো পিস্তল থাকে! চিৎকার করলে মা,বোন এমনকি আশেপাশের লোকজন আসবে। না সেসব কিছুতেই হতে দেওয়া সম্ভব না। অগত্যা চুপ করে রইলো মেহেক। খোলা চুলগুলো দক্ষিণা বাতাসে উড়ে বারবার মুখে গিয়ে পড়ছে মেহেকের। রোশন কোমরে রাখা হাতটা সরিয়ে অবাধ্য চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো। বিরক্ত লাগছে মেহেকের।
” এতো ঢং কীসের জন্য? প্রয়োজন মিটিয়ে ছুঁড়ে ফেলা আপনাদের স্বভাব! তাহলে কেনো সব সময় এমন ন্যাকামি করেন?”
রোশন হুট করে পেছন দিক করে দাঁড় করালো মেহেককে। পেছনে হাতদুটো ধরে রেখেই ঘাড়ে আলতো করে কামড়ে দিতে লাগলো রোশন। নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মেয়েটা। কিন্তু রোশনের শক্তির কাছে ওর জোর কিচ্ছু না। এদিকে রোশন ঘাড় ছাড়িয়ে গলা,কানের নিচে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে। রোশনের এলোমেলো স্পর্শে চোখ ছলছল করছে মেহেকের। রোশন নিজের মতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওকে। মেহেকের হাত মুক্ত করে আবারো নিজের দিকে ফিরিয়ে দু-হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে রোশন। মেহেকের বাঁধা দেওয়ার মতো মন মানসিকতা নেই এখন৷ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। রোশন শান্ত হয়েছে। কেবল বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিনিট দশেক। তারপর ছাড়লো প্রিয়তমাকে।
” দুঃখিত সুন্দরী! অনেকদিন পর তোমাকে কাছে পেয়ে নিজেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি বলে এটুকু দুষ্টমি করে ফেলেছি। তবে কথা দিচ্ছি বিয়ের আগে লিমিট ক্রস করবোনা। ”

বিয়ের কথা শুনে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেললো মেহেক।
” আমি মরে গেলেও আপনার মতো জানোয়ারকে বিয়ে করবোনা। তারচে গুলি মারুন আর শেষ করে দিন আমাকে। ”

মেহেকের চোখে নিজের জন্য তীব্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে রোশন৷ খারাপ লাগছে ওর। আজকে একটু বেশিই করা হয়েছে ভেবে অনুশোচনা হচ্ছে ওর। নাহ উষ্ণতা ছড়িয়ে আপন করা যাবে না সুন্দরীকে। ভালোবেসে, যত্নে, সময় নিয়ে নিজের করে নিবে মেহেককে সে। এসব ভেবে আর দাঁড়াল না রোশন। নিঃশব্দে স্থান পরিত্যাগ করলো। মেহেক বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে ওর গমনপথের দিকে। এভাবে চলে গেলো? এতটা খারাপ আচরণ করার পরেও কেনো প্রাণে মারলো না লোকটা!

” ভাই! কিছু হয়েছে? তোমার চোখমুখ এমন?”

মেহেকদের বাড়ির পেছনের কাঁদার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে শান্ত,লিমন। লিমন জিজ্ঞেস করলো রোশনকে। রোশন চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। দিনে দিনে মেহেকের মনে ওর জন্য শুধু ঘৃণা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

” বিয়ের ব্যবস্থা কর তোরা। বাবাকে নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমি স্বার্থপর খুব। আমার সুন্দরীকে কাছে চাই এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি। আমার সুন্দরীর গায়ে অন্য কারো শরীরের বাতাস লাগলেও আমার সহ্য হয় না। সেখানে একটা ছেলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে আসে। ”
রোশন ঠোঁটের কোণে সিগারেট গুঁজে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাল। শান্ত বললো,
” ছেলেটাকে তাহলে শেষ করে দেই ভাই? ”
” নাহ! মিষ্টিকে পড়াতে আসে, মেহেককে নয়। অহেতুক মারামারির দরকার নেই। যা বললাম তাই কর তোরা। ”
” ঠিক আছে ভাই। ”
” হু,চল এখন।”
সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে দলবল নিয়ে নদীর দিকে এগোলো।

নিজের ঘরে বসে আছে মেয়েটা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। গতকাল সারারাত আর ঘুম হয়নি মেহেকের। মায়ের কথা মনে পড়েছিল, প্রতিবেশীদের তীক্ষ্ণ কথাবার্তা, অপবাদ, রোশনের অত্যাচার সবকিছু ভাবতে ভাবতে খুব কান্না করেছে রাতে। মন খারাপের রাতে মা’কে খুব করে মনে পড়ে মেহেকের । মনে হয় মাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারলেই সবটুকু দুঃখ, যন্ত্রণা শেষ হতো!

” কী হয়েছে রে মেহেক? তোর চোখমুখ এমন শুকনো লাগছে কেনো? রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়েছে তো?”
আনজুম বেগমের আগমনে নড়েচড়ে উঠলো মেহেক। স্মিথ হেসে বলে,
” সবকিছু ঠিক আছে মা।”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা মেহেক তোর সাথে একটা কথা বলতে এসেছি মা।”
মেহেকের পাশে বসলেন আনজুম। মাথায় হাত বুলিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন। মেহেকের কেমন একটা খটকা লাগছে। হঠাৎ এতটা সমীহ করে কথা বলছেন!
” হ্যাঁ মা বলো।”
” ভালো একটা সম্মন্ধ এসেছে তোর জন্য। ছেলে আমাদের সরকারি হাসপাতালে নতুন এসেছে, ডাক্তার। ”
মেহেকের কোনো হেলদোল হয়নি বিয়ের কথা শুনে। আজকাল কোনো কিছুই আর ভাবায় না।
” বাবা কী বললেন? ”
” উনি তোর কাছে বলার সাহস পাননি বলেই আমাকে বলতে বললেন। গতবার যা হলো তারপর…. ”
” বাদ দাও মা ওসব। তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো।”
আনজুম বেগম হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। খুশিমনে মেয়েকে আরো কিছু কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে স্বামীর সাথে কথা বলতে গেলেন।

চলবে,