নীরবে নিভৃতে পর্ব-১৬

0
106

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। )

দুপুরের কড়া রোদে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রোশন৷ মন-মেজাজের বালাই নেই আজ। আগামীকাল বিকেলে তার সুন্দরীকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ! ছেলে সরকারী চাকরি করে শুনেই যে মেহেকের পরিবার রাজি হয়ে গেছে সে বিষয় নিশ্চিত রোশন৷ কিন্তু মেহেক? মেহেক কীভাবে রাজি হলো! অবশ্য রাজি না হওয়ার কারণও তো নেই। রোশনের প্রতি তো কোনো অনুভূতি নেই মেহেকের হৃদয়ে।

” ভাই! এভাবে রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে কি কিছু হবে? ”
লিমনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো রোশন। খেঁকিয়ে উঠে বললো,
” তোর কী মনে হয়? আমি এখানে অহেতুক দাঁড়িয়ে আছি? শান্তকে পাঠিয়েছি খোঁজ লাগাতে। ”
” কীসের খোঁজ? ”
” সরকারী ডাক্তারের নাড়ীনক্ষত্র জানতে গেছে শান্ত। ”
” মনে হচ্ছে কপালে শনি আছে লোকটার। ”
” তো তো আছেই রে। আমার সুন্দরীকে বিয়ে করার শখ তো ঘোচাতে হবে। ”
” কিন্তু ভাই লোকটার তো দোষ নেই বলো। সে তো জানে না তোমার মতো একজন দিওয়ানা আছে মেহেক ভাবীর।”
লিমনের কথাটাও ভুল নয়। অহেতুক খুনখারাপি করা বন্ধ করতে হবে এখন থেকে। মেহেক এসব পছন্দ করে না।
” তা ঠিক। কী করি তাহলে বল তো? ভাবছিলাম শালাকে উড়িয়ে দিবো।”
” এতো ঝামেলার দরকার নেই ভাই। বিয়ে যখন করবেন…..”
লিমন কিছু একটা ইশারা করতেই রোশন হাসলো। লিমনকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হালকা থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিয়ে একসাথে জঙ্গলের দিকে এগোলো দু’জন।

সাঁঝের বেলা, আজ বৃহস্পতিবার। আগামীকাল পড়ানো হবে না বলে আজকে একটু বেশি বেশি করে পড়াচ্ছে আহনাফ। মিষ্টি বরাবর মনোযোগী ছাত্রী তার। কিন্তু আজকে মিষ্টিকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। এসে থেকেই আহনাফ বিষয়টা খেয়াল করছে। জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করছে না। কিন্তু এভাবে তো পড়াও হচ্ছে না মেয়েটার। লোকমুখে মিষ্টির উধাও হওয়া নিয়ে অনেক কথাই শুনেছে আহনাফ। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করে না। যে যার জীবন যেমন ইচ্ছে কাটাক সে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? কিন্তু নাহ এখন একটা প্রশ্ন করা খুব দরকার বলেই মনে হচ্ছে আহনাফের।
” মিষ্টি তোমার কি কিছু হয়েছে? ”
স্যারের প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে উঠলো মিষ্টি। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা ভাবছিল।
” নাহ স্যার। কিছু হয়নি তো।”
” তবে এতো অমনোযোগী কেনো বলো তো! ”
” আপনি বুঝতে পারছেন?”
” হ্যাঁ। বুঝবো না কেনো? তোমার আচরণে বোঝা যাচ্ছে। ”
” আপনি জানেন, আগামীকাল আপুকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ বিয়েটা ঠিক হবে না আপুর জন্য। ”
মিষ্টির কথায় একটু চমকাল আহনাফ। কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলো। বইয়ের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দু’জনেই কথোপকথনে মনোযোগী হয়েছে।
” এমন মনে হওয়ার কারণ? ”
” সবকিছু তো খুলে বলতে পারবোনা কিন্তু শর্টকার্টে বলি, আপনি হয়তো শুনেছেন গতবার আপুর বিয়ের আসরে ডাকাত এসেছিল?”
” হ্যাঁ শুনেছি। হবু বরকে না-কি বিয়ের আসরে গুলি করেছিল ডাকাতেরা। তারপর মেহেককে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ”
” হ্যাঁ স্যার। আমি জানি না রোশন ভাই ডাকাতদের কে,কিন্তু উনি আপুকে ভীষণ ভালোবাসেন।”
মিষ্টির মুখে রোশন নামটা শুনে চমকাল আহনাফ। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
” রোশন? তুমি শিওর? ”
” হ্যাঁ স্যার। ”
” রোশন ডাকাত সর্দারের ছেলে। এই ক’দিন আগে পুলিশের সাথে বড়সড় বন্দুকযুদ্ধ হয়েছিল ওদের। তখন খবরে শুনেছিলাম। কিন্তু একজন ডাকাত কোনো মেয়েকে ভালোবাসে কথাটা অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর মিষ্টি। ”
আহনাফ দুহাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙার মতো অঙ্গভঙ্গি করে নড়েচড়ে বসলো। মিষ্টি শান্তভাবে ফের বলে,
” ভালোবাসার চেয়ে বড়ো কিছু কী আছে স্যার? হৃদয় পরিবর্তন করতে সক্ষম এই ভালোবাসা নামক অনুভূতি। আবার হৃদয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করার জন্যও যথেষ্ট। ”
কথাগুলো বলতে বলতে মিষ্টি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। আহনাফ হালকা কেশে উঠে বললো,
” বুঝলাম। কিন্তু তোমার বোন কি রোশনকে….?”
” নাহ। আপু তো উনাকে ঘৃণা করে। অবশ্য করার কারণও আছে। কিন্তু আমি মনে করি রোশন ভাইয়া আপুর জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। আমি জানি ওই মানুষটার মধ্যে একটা ভালো মানুষ আছে। নইলে আমাকে বাঁচাতে… ”
” কী?”
মিষ্টি কথা শেষ না করে থেমে যাওয়াতে আহনাফ প্রশ্ন করে। কিন্তু মিষ্টি প্রসঙ্গ বদলায়।
” কিছু না। শুনুন স্যার, আমার মনে হয় আপুর বিয়ে, ছেলে পক্ষের আসার কথা এরমধ্যেই রোশন ভাইয়া জানে। আর আমার মনে এটাও হচ্ছে উনি নিশ্চিত এ বিয়ে হতে দিবে না। ”
” তুমি কী করতে চাচ্ছো এখন?”
” আমি চাই আপুর সঙ্গে উনারই বিয়ে হোক। ”
” কিন্তু কেনো? তোমার বোন তো তাকে ঘৃণা করে মিষ্টি। ”
” সময়ের সাথে সাথে যেমন তীব্র ভালোবাসা একদিন ঘৃণায় রূপ নিতে পারে, তেমনই এই তীব্র ঘৃণাও একদিন ভালোবাসায় রূপ নিতে পারবে। ”
” বেশ। তারপর? ”
” আপনার সাথে শুধু শেয়ার করলাম বিষয়টা এইটুকুই। ”
আহনাফ মুচকি হাসলো। এতটুকু মেয়ের কতো গম্ভীর কথাবার্তা।
” ঠিক আছে। আমিও শুনলাম। এখন বলো কোনো হেল্প লাগবে? ”
” তেমন কিছু না। তবে যদি তেমন পরিস্থিতি হয় আমি বলবো।”
” ওকে। এখন পড়ো।”
মিষ্টি মুচকি হাসলো। আহনাফ তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। কিন্তু দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। এতটুকু মেয়ের দিকে আজকাল কেমন দৃষ্টিতে তাকায় ভাবতেই নিজের বিরক্ত লাগে আহনাফের। একজীবনে আর কোনো সম্পর্কে জড়াবে না বলে বিয়ে অবধি না করার সিন্ধান্ত নিয়েছিল আহনাফ। এক নারীতে আসক্ত হয়ে চরমভাবে ঠকে গিয়েছিল লোকটা। সেই কষ্ট আজও ভুলতে পারিনি। কিন্তু মিষ্টির দিকে তাকালে সেই একইরকম কষ্ট অনুভব করে আহনাফ। এতটুকু মেয়ের জীবনে কি সত্যি তেমন কোনো কষ্ট আছে!

আগামীকাল ছেলের বাড়ি থেকে ছেলেসহ সবাই আসবে বলে সিদ্দিক আহমেদ বাজার-সদাই কিনে নিয়ে বাড়িতে এসেছেন মাত্র। মেহেক আর আনজুম উনার কাছ থেকে বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রাখছে। এশার আজান দিচ্ছে। আহনাফ এখনো পড়াচ্ছে মিষ্টিকে। তবে এখন চলে যাবে। দরজার চৌকাঠে বসলেন মেহেকের বাবা। মেহেক এক গ্লাস পানি এনে বাবার হাতে দিলো। আনজুম দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
” বুঝলে মিষ্টির মা, সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। ”
” তা আর বলতে! তা সবকিছু এনেছো তো?”
” হ্যাঁ। তবুও লিস্ট ধরে মিলিয়ে নাও একবার। ”
” ঠিক আছে। মেহেক তুই বাতাস কর তো মা আমি দেখি গিয়ে। ”
মেহেক মায়ের হাত থেকে হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলো। আনজুম বেগম বাজারের লিস্ট ধরে সমস্ত কিছু চেক করতে বসেছেন। আপাতত পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মিষ্টিও এসেছে।

আচমকা বাড়ির উঠোনে লোকজনের কথাবার্তা শুনে চমকাল সবাই। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে দশ-বারোজন লোক হবে।
” কারা এসেছে বাবা? ”
” মিষ্টি আমি গিয়ে দেখে আসি আগে তারপর বলছি।”
মেহেককে থামিয়ে দিয়ে ওর বাবা বললো,
” তোদের যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। ”
বাবার কথায় দুবোন চুপ করে গেলো। সিদ্দিক আহমেদ বাড়ির উঠোনে পৌঁছাতেই আঁতকে উঠল। চোখের সামনে আবারো সেই ডাকাতদের দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে উনার।
” আসসালামু আলাইকুম বাবা।”
রোশন সবাইকে পেছনে ফেলে ঘাড় কাত করে সামনে এগিয়ে এসেছে।
” আপ আপনারা এখানে! ”
” তুমি করে বলুন বাবা। আমি আপনার ছেলের বয়সী। আমি ডাকাত হলেও বেয়াদব না। বিয়ে করতে এসেছি বাবা,আপনার বড়ো মেয়েকে। যদিও এতো তাড়াহুড়ো করতাম না আমি। কিন্তু আপনাদের তো বড্ড তাড়া! মেয়ের জন্য এরমধ্যে আবারো বিয়ে ঠিক করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ”
রোশনের কথায় সিদ্দিক চেঁচিয়ে উঠলো। মেহেকের জীবনটা আর নষ্ট হতে দিতে চাননা উনি। তাই সব ভয়ডর রেখে রাগান্বিত স্বরে বললেন,
” খবরদার! আমার মেয়ের দিকে নজর দিবে না তোমরা। প্রয়োজনে মরে যাবে আমার মেয়ে তাও তোমাদের সাথে অসম্মানিত হতে যাবে না। ”
” বাবা আপনি ভুল বুঝছেন। বিশ্বাস করুন আপনার মেয়ের দিকে আমি ছাড়া কেউ চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাবে না। আমি তাকাবো কারণ আমি আপনার মেয়ের বর হবো। ”

সিদ্দিকের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এরমধ্যে মিষ্টি, আনজুম, মেহেকও উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই তো ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। মেহেকের ভীষণ রাগও হচ্ছে রোশনের উপর। এই লোকটা ওর জীবনটা শেষ করেই ছাড়বে! রোশন মেহেককে দেখে বললো,
” এইতো আমার সুন্দরী বউটা এসে গেছে.. ”
রোশনের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিদ্দিক আহমেদ সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। আকস্মিক ঘটনায় সবাই চমকে উঠলো। প্রাণের ভয় থাকলেও কোনো বাবা তার মেয়েকে নিয়ে কোনো অসম্মানজনক কথা শুনতে পারে না। রোশনের বলা কথাগুলো মজা ভেবেই এতটা রেগে গেছেন মেহেকের বাবা। রোশনকে থাপ্পড় মারার ফলে চোখের পলকের মধ্যে ছয়জন বন্দুক ঠেকাল সিদ্দিকের মাথায়। প্রাণের ভয়ে হুঁশে এলেন তিনি। কতবড় ভুল করেছেন তা ভাবতেই প্রাণের ভয় জেঁকে বসেছে উনার মনেপ্রাণে। মেহেক আর মিষ্টি দৌড়ে বাবার কাছে যেতে চাইলে আনজুম বেগম বাঁধা দিলেন৷
” উহুম! ”
রোশন সবাইকে হাত দিয়ে “ না” বোধক ইশারা করতেই সবাই বন্দুক সরিয়ে ফেললো। রোশন এগিয়ে এলো মেহেকের বাবার দিকে।

” উনি আমার শ্বশুর হন তাই সবাই উনার কাছে ক্ষমা চাইবি। উনার মাথায় বন্দুকের নল ঠেকানোর সাহস হয় কীভাবে তোদের? ”
রোশনের ধমকে সবাই আঁতকে উঠেছে। শুধুমাত্র মেহেকের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। এতো ঢং,ন্যাকামি! রোশনের কথামতো সবাই ক্ষমা চাইলেন মেহেকের বাবার কাছে। রোশন হাসছে। এরমধ্যে লিমন আর শান্ত এলো কাজী সাহেবকে নিয়ে। মেহেক ভয়ে মায়ের পেছনে লুকিয়েছে।

চলবে,