নীরবে নিভৃতে পর্ব-২০

0
115

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_২০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

” আহনাফ তোমার কি এবার বিয়ে করা উচিত না? আমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকে না বাবা।”
বাবা-র বলা বারবার এই এককথায় আহনাফ মোটেও বিরক্ত হয় না। এই পৃথিবীতে পরিবার আর আপনজন বলতে শুধু বাবা-ই আছে আহনাফের। তাই সব সময় বাবাকে বুঝিয়ে রাখে। রমিজ আলীর বয়স সাতান্ন ছুঁই ছুঁই। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বয়স্ক লাগে উনাকে। সবকিছু বিভিন্ন রোগের বদৌলতে। ছেলের যত্ন আর ভালোবাসায় একাকীত্ব অনুভব না করলেও বাড়িতে একটা পুত্রবধূর খুব দরকার ফিল করেন। এতটুকু বয়সে তো ছেলেটার জীবন এভাবে থমকে যেতে পারে না!
” বাবা তুমি তো জানো বিয়ে নিয়ে আমি আর এগোতে চাইছি না। ”
” কিন্তু আহনাফ, একটা মেয়ে তোমাকে ঠকিয়েছে বলে তো আজীবন বিয়ে না করে তো চলতে পারে না। ”
” বাবা!”
আহনাফ রমিজ আলীর হাতে হাত রেখে আহ্লাদী কণ্ঠে ফের বলে,
” বাবা প্লিজ জোরাজোরি করো না! তকদীরে থাকলে সব হবে গো। চলো চলো তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ”

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে ঔষধ খেতে প্রায় ভুলে যান রমিজ আলী। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আহনাফ বাবাকে নিয়ে উনার ঘরে রেখে এসে বাজারের দিকে এগোলো।

গতকাল রাতে বাবা-মাকে সবকিছু খুলে বলেছিল মিষ্টি। প্রথমে বিষয়টা বিশ্বাস করতে চায়নি সিদ্দিক আহমেদ। তবে পরে সবকিছু বুঝতে পেরেছেন। তবুও মনকে পুরোপুরি শান্ত করতে পারছেন না তিনি। যতই হোক একজন ডাকাত কীভাবে কাউকে ভালোবেসে আগলে রাখবে? আদৌও কি তা সম্ভব! তার উপর মিষ্টির জীবনে এতো বড়ো অঘটন ঘটে গেছে, বাবা-মা হিসেবে এসব কখনোই কেউ সহ্য করতে পারে না। আনজুম আর সিদ্দিকও ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু মিষ্টি বুঝিয়েছে তাদের । যেখানে এতটুকু মেয়েটা সবকিছু সহ্য করেও শক্ত আছে সেখানে বাবা-মা হিসেবে তাদের উচিত মেয়েকে মানসিকভাবে আরো সাহস জোগানো। তাই নিজেদের সামলে নিয়েছেন দু’জনে। মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই মিষ্টির পরীক্ষা শুরু। তাই এখন থেকে মেয়ের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিবেন বলেন ঠিক করেছেন আনজুম।

সকাল থেকে ঘরে বসে আছে মেহেক। একবার বেরিয়েছিল কিন্তু লজ্জায় ফের ঘরে চলে এসেছে। মীরার প্রশ্নে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো একটু আগেই।
” মেহেক! তোমার ঘাড়ে সব দাগ হয়ে গেছে কেনো? রোশন কি তোমার উপর ফিজিক্যাল টর্চার করেছে? ”
মীরার প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মেহেক। সব ডাকাত গুলো যদি এসব দাগ দেখে মনে মনে কীসব ভাববে? রোশনের লজ্জা নেই, অমানুষ কিন্তু মেহেকের তো আছে। তাই মীরার প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলেই দৌড়ে ঘরে চলে আসে সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মেজাজ বিগড়ে যায় ওর। গলায়, ঘাড়ে সব লালচে দাগ হয়ে গেছে। ঠোঁটের এককোনায় কেটে গেছে। একটা মানুষ কখনো এমন করতে পারে? জঙ্গলে থাকে ঠিকই আছে, জানোয়ার একটা। মেহেক মনে মনে এসব ভেবে ভেবে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে না চাইতেও খেতে হয়েছে ওকে। রোশন নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে। না খেয়েও তো উপায় ছিলো না। রোশন কতবার যে কান ধরে সরি বলেছে তার হিসাব নেই। কিন্তু মেহেকের কাছে সবকিছু অভিনয়, ঢং বলেই বিবেচিত হয়েছে।

” সুন্দরী! ”
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বউকে ডাকছে রোশন। লুঙ্গির সাথে সাদা টি-শার্ট পরে আছে সে। মেহেকের জন্য কিছু থ্রিপিস আনিয়েছে। সেগুলো হাতে নিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ও। মেহেক রোশন এসেছে বুঝেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রোশন নিজে থেকেই এগিয়ে গেলো।
” ডাকছি আমি, সাড়া দিবে তো বলো?”
” না দিলে কী করবেন? আবারো খুবলে খাবেন? নিন খান।”
মেহেক গায়ের ওড়না মাটিতে ফেলে দিয়ে রেগেমেগে বললো। রোশন ঘাড় কাত করে মুচকি হাসলো একবার। এক হাতে থ্রিপিসগুলো ধরে অন্যহাতে পড়ে থাকা ওড়না তুলে মেহেকের গায়ে জড়িয়ে দিলো। আর থ্রিপিসগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” কতবার সরি বলেছি সুন্দরী? লাগলে আজীবন বলবো। তবুও এমন করে রেগে থেকো না। আমি নিজে থেকে না চাইলে ওড়না না সবকিছু খুলে সামনে আসলেও কিছু হবে না। আমি কখনো চাইবো না আর। তুমি চাইবে,সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবো। এটাই তো কথা ছিলো কিন্তু…. সরি সুন্দরী। রেগে থেকো না প্লিজ! ”
মেহেক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করলো। রোশন ঠিক সেই দিকেই গিয়ে দাঁড়াল। একেবারে মেহেকের চোখের সামনে।
” আচ্ছা দেখো তো সবগুলো পোশাক তোমার পছন্দ হয়েছে? না হলে বলো পাল্টে নিয়ে আসবে ওরা।”
” দরকার নেই। পোশাক পেয়েছি সেটাই অনেক।”
” কী বলছো! তুমি আমার বউ, তুমি রাজরানীর মতো থাকবা। যা ইচ্ছে তাই পরবা, যা লাগবে শুধু বলবা। ”
” আমি একটা স্বাধীন জীবন চাই। আপনার থেকে মুক্তি চাই।”
” স্বাধীন জীবন তোমাকে দেওয়া হবে কিন্তু আমার থেকে মুক্তি সেটা হবে না। যতদিন আমার দেহে প্রাণ আছে আমি তোমাকে ছাড়ছি না। সে তুমি আমাকে ভালোবাসো আর নাই বাসো। সব সম্পর্কে তো প্রথম থেকেই ভালোবাসা থাকে না। ”
মেহেক হাতের পোশাকগুলো হেঁটে গিয়ে বিছানার একপাশে রেখে বসলো। এই ঘ্যানঘ্যান ওর ভালো লাগে না তবুও শুনতেই হয়। রোশন মেহেকের পাশে বসেছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে মেহেকের দিকে তাকিয়ে আছে।
” তারমানে আপনি আশা করছেন ইন ফিউচার আমাদের সম্পর্কে ভালোবাসা আসবে? ”
মেহেক কিছুটা ঠাট্টা করেই বললো। জীবনের সবথেকে মজার কথাই যেনো এটা। রোশন নাকমুখ থেকে একত্রে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
” অবশ্যই। তুমি আমাকে চোখে হারাবে একদিন। ”
” কল্পনার জগতে বাস করছেন আপনি। এমনটা আমি মরে গেলেও হবে না। ”
রোশন মেহেকের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে ম্লান কন্ঠে বলে,
” এসব আর বলবে না। তুমি বেঁচে থাকতেই আমাদের সবকিছু হবে। বিশ্বাস করো!”
মেহেক রোশনের আঙুলটা ছিটকে সরিয়ে দেয়। ওর ছোঁয়া লাগলেও ঘেন্না লাগে মেহেকের।
” বিশ্বাস, ভালোবাসার কথা আর কখনো বলবেন না। আর ওই নোংরা হাতে আমাকে দ্বিতীয়বার স্পর্শ করবেন না, কখনো না।”
” ভালোবেসে মাঝে মধ্যে একটু জড়িয়ে ধরবো। তবে খারাপভাবে স্পর্শ করবোনা কখনো। এতটুকু অন্তত সহ্য করো?”
” অনুমতি চাইছেন অথচ নিজেই ঠিক করে নিয়েছেন ধরবেনই। আপনি যান তো। আমার বিরক্ত লাগে। ”
” দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়ে তারপর যাবো। মীরা আপু খাবার নিয়ে আসছে তোমার। তোমার প্রিয় খাবার হাঁসের মাংস রান্না হয়েছে আজ সাথে সাদা ভাত। ”
মেহেক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল রোশনের দিকে। কিছু একটা জানতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে রোশন। তাই মেহেক জিজ্ঞেস করার আগেই রোশন আগবাড়িয়ে বলে,
” মিষ্টির কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফাঁকে, তোমার পছন্দ- অপছন্দের কথা। ”
” মিষ্টি! মেয়েটা মানুষ চিনতে বরাবর ভুল করে। ”

ওদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়াল মীরা। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলে রোশন খাবার রেখে যেতে বলে। মীরা কথামতো বিছানার একপাশে সব খাবার রেখে প্রস্থান করে।

” লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নাও এখন। আমার কাজ আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ”
ভাত ঝোল দিয়ে মেখে মাংস নিয়ে হাত উঁচিয়ে ধরে আছে রোশন। মেহেক মুখ ঘুরিয়ে বসেই আছে।
” আমি খেয়ে নিবো। আপনি যান।”
” সুন্দরী! জেদ ছাড়ো, খেয়ে নাও। ”
” বললাম তো আপনি যান।”
” বেশ। তাহলে জোর করেই…”
” না থাক,দিন।”
মেহেক নিজের ইচ্ছেতে সবটুকু খাবার খেলো রোশনের হাতে। ওই যে কথায় আছে না? পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে! মেহেকের অবস্থা সেটাই হয়েছে। মুখ মুছিয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে প্রসস্থ হাসি ফুটিয়ে বললো রোশন,
” এখন চুলগুলো আঁচড়ে নাও তো। সব এলোমেলো হয়ে আছে। আর মীরাকে দিয়ে মলম পাঠিয়ে দিচ্ছি ঠোঁটে লাগিয়ে নিও। ঘাড় আর গলার দাগ এমনি চলে যাবে। রাতে দেখা হবে। ”
মেহেক চুপ করেই রইলো। কিছুটা ঝুঁকে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো রোশন। মেহেক চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বললো,

” বিবাহিত পুরুষের জন্য কাজে যাওয়ার আগে বউয়ের কপালে চুমু খাওয়া বাধ্যতামূলক। টাটা সুন্দরী।”
মেহেকের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই স্থান ত্যাগ করলো সে। রোশন চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেহেক।

” আসবো মেহেক?”
” মীরা আপু! এসো এসো। তোমার আবার অনুমতি লাগে? ”
মীরা ঘরে প্রবেশ করে মেহেকের পাশে বসলো।
” এখন তুমি রোশনের বউ। সেজন্য আরকি। আচ্ছা এই নাও, এই মলমটা ঠোঁটে একবার লাগিয়ে নাও এখন। রাতে আরেকবার লাগিও সেড়ে যাবে ব্যথা ।”

মেহেকের আবারো ইতস্তত লাগছে। রোশনের সামনে তো রেগে থাকে তাই লাজলজ্জা কম কাজ করে। কিন্তু মীরা আপু তো বড়ো বোনের মতো।

” আচ্ছা আপু। ”

চলবে,