নীরবে নিভৃতে পর্ব-২৯

0
107

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_২৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

” আরে কী করছেন! বুকে লেগে যাবে তো।”
” কিচ্ছু হবে না। ”
” কিন্তু মশারী… ”
” চুলোয় যাক তোমার মশারী, আগে আসো প্রেম করি।”
মেহেক মোটেও রোশনের ডাকে সাড়া দিলো না। একপ্রকার জোরাজোরি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মশারীর বাকি অংশ টাঙাচ্ছে এখন। হতাশ হলো রোশন। মুখটা প্যাঁচার মতো করে শুয়ে আছে।
” প্রেম করার বয়স নেই এখন। তাছাড়া আপনার সাথে প্রেম করতে আমার খুব আপত্তি। ”
মেহেক রোশনের বিপরীত দিকে ফিরে শুয়ে বললো কথাটা। চমকাল রোশন! এমন সিরিয়াস হয়ে কেনো কথা বলছে সুন্দরী?
” কীসের আপত্তি শুনি!”
পেছন থেকে কোমরে হাত রেখে শুধালো রোশন।
” আমার মনে আপনার প্রতি যতই ভালোবাসা জন্মাক কিন্তু একটা ঘৃণার জায়গা থেকেই গেছে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না আপনি একাধিক মেয়ের সাথে সহবাস করেছেন এবং সেটা তাদের অনিচ্ছায়! সোজা কথায় জুলম, জেনা, পাপ করেছেন। ”
মেহেকের বলা কথাগুলো বুকে বিঁধল রোশনের। মাঝে মধ্যে সত্যি সহ্য করা যায় না। ভীষণ তিক্ত লাগে। সত্যি তো! আজ সাধু হলেও তো একদিন এ-সব করেছিল রোশন। কিন্তু মেহেককে কী বলে শান্তনা দিবে এখন? কীভাবে মানাবে! একজন স্ত্রী’র পক্ষে এসব সহ্য করা নিশ্চয়ই সহজ ব্যাপার নয়।

” সুন্দরী আমি অস্বীকার করছি না এসব। হ্যাঁ আমি পাপ করেছি কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি আর অন্য কাউকে স্পর্শ করিনি। কিন্তু তবুও আমার অন্যায় তাতে কমে না। যা করে ফেলেছি তা তো অস্বীকার করতে পারি না। তবে তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ মেহেক। আমি শুধরে গেছি, বিশ্বাস করো।”

আচমকা রোশনের এমন আচরণে আশ্চর্য হলো মেহেক। লোকটা মেহেকের দু-হাত ধরে অনুরোধ করার ভঙ্গিতে কথা বলছিল। হঠাৎ কেঁদে উঠলো যেনো! মেহেকও শোয়া থেকে উঠে বসেছে।
” কী করছেন? আপনি কাঁদছেন! ”
রোশনের কী যেনো হয়েছে। বাচ্চাদের মতো ঠুকরে কেঁদে উঠলো সে। মেহেককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থেমে থেমে বলে,
” তুমি যা-ই করো শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না সুন্দরী। ”
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়ার মতো হয়ে গেছে রোশন। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় কতটা প্রবল তা শুধু ভুক্তভোগী জানে। মেহেকও আঁকড়ে ধরেছে রোশনকে। মায়া হচ্ছে লোকটার জন্য।

” শান্ত হোন প্লিজ। আমি আপনাকে ছাড়বোনা। আমৃত্যু আপনার বুকেই থাকবো। শুধু আমার মনের অস্বস্তি বলুন আর ঘৃণা বলুন কাটতে একটু সময় লাগবে। ”
” ভালোবাসা আর ঘৃণা কখনো একত্রে থাকতে পারে সুন্দরী? ”
” তবে ঘৃণা আমি করি না আপনাকে। হয়তো এটা অন্য কিছু। ”
রোশন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মেহেকের ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে বলে,
” মেইন কথা, তুমি আমাকে ছেড়ে না গেলেই হয়। ঘৃণা করো আর ভালোবাসো, একরম থাকলেই হলো। আমার ভালোবাসায় একদিন তোমার সব অভিমান, ঘৃণা বা অন্যকিছু বলো সব ভুলিয়ে দেবো। ”
মেহেক ফিক করে হেসে উঠলো। রোশন বুঝতে পারছে না কেনো হাসছে কিন্তু ও নিজেও সাথে হাসতে শুরু করেছে।
” আপনি হাসছেন কেনো?”
” তুমি হাসলে তাই।”
” পারেন বটে। এখন একেবারে ঠিকঠাক লাগছে আপনাকে। বাঘকে কখনো বিড়াল হলে কি মানায়?”

রোশন গলা খাঁকারি দিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। কিছু হয়নি এমন ভাবখানা করে বলে,
” কীসব যে বলো! বাঘ কখনো বিড়াল হয় না হুহ্। ”
” তাই না-কি! তাহলে একটু আগে…”
” ওটা তো মন গলানোর নিনজা টেকনিক ছিলো। আমি ঘুমাচ্ছি। শুভ রাত্রি। ”
রোশন চোখ বন্ধ করে রইলো। মেহেক একা একাই হেসে যাচ্ছে…

সকাল থেকেই বাড়িঘর ঝাড়পোঁছ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মেহেক ও আনজুম। সারা ঘর সুন্দর করে পরিপাটি করতে হবে। বিকেলে আহনাফের পরিবার মিষ্টিকে দেখতে আসবে। সেজন্যই এতসব। সিদ্দিক আহমেদ গেছেন বাজারে। মিষ্টি আর রোশনেরই শুধু কোনো কাজ নেই। তাই দু’জনে বসে বারান্দায় লুডু খেলছে। মিষ্টির সাথে আগে থেকেই রোশনের অন্য রকম একটা বন্ডিং ছিলো। এখন সেটা আরো ভালো হচ্ছে। রোশন মিষ্টির প্রতি কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি মিষ্টি ইশারায় ওকে জিম্মি করে মেহেককে বিয়ে করার বিষয় ফোর্স না করতো তবে ঝামেলায় পড়তো রোশন। মিষ্টিই শুধু প্রথম থেকে চেয়েছিল মেহেক রোশনের হোক।

” ভাইয়া হবে না কিন্তু! বাটপারি চলবে না। ”
মিষ্টির তিরিক্ষি মেজাজে হেসে উঠলো রোশন। মিষ্টির একটা গুটি এই নিয়ে পাঁচবার কেটে দিয়েছে রোশন। মেয়েটা কিছুতেই রোশনের সাথে পেরে উঠছে না। তাতেই রাগ করছে।
” আমি কই বাটপারি করলাম? তোমার গুটি বারবার আমার গুটির সামনে আসে কেন শ্যালিকা? ”
” এতো নিষ্ঠুরভাবে কীভাবে কেউ কারো গুটি কাটে!”
মিষ্টির কথায় রোশনের হাসির আওয়াজ আরো বৃদ্ধি পেলো। মেহেক উঠোনে কাজ করছিল। ওদের হাসাহাসি শুনে বারান্দার দিকে এগোলো।
” এখন যেভাবে কাটলাম হাহা।”

” কী হয়েছে? এতো শোরগোল কীসের? ”

মেহেককে দেখেই মিষ্টি নালিশ জুড়ে দিলো।

” দেখো না আপু, ভাইয়া কতবার আমার একটা গুটি খেয়েই যাচ্ছে। ”

মেহেক মুচকি হেসে রোশনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই রোশন ঘাড় কাত করে হাসলো একটু।

” তোমার বোনকে বিয়ে কেনো দিচ্ছে বলো তো! এতটুকু মেয়ে! এখনো লুডু খেলতে গেলে রাগারাগি করে। ”
” আপু শোনো!”
মিষ্টি গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহেক এগিয়ে গেলো ওর দিকে।

” একদম আমার বোনকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করবেন না হু। মিষ্টি তুই চল তো আমার সাথে। আমি কাজ করবো আর তুই দেখবি।”

মিষ্টি বোনের কথামতো উঠে দাঁড়ালো।
” হ্যাঁ চলো আপু।”
দুই বোনের প্রস্থানে একা হয়ে গেছে রোশন। তা-ও মিষ্টি ছিলো এতক্ষণ! এখন একা কী করবে?

আসরের নামাজের পরপর পাত্রপক্ষ এসেছিল মিষ্টিকে দেখতে। অতিথি আপ্যায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মিষ্টির পরিবার। আহনাফের পরিবারের সবাইও বেশ খুশি হয়েছে। হবু ছেলের বউকে আংটি পরিয়ে গেছে আহনাফের চাচী জাহানারা বেগম। সামনের শীতে বিয়ে। বলতে গেলে মাস দুয়েক বাকি। কী দরকার ছিলো বিয়েটাকে শীত পর্যন্ত টেনে নেওয়ার সেটাই ঘরে বসে ভাবছে আহনাফ। অবশ্য ভালোই হয়েছে। এই দুই মাসে মিষ্টির সাথে আরো ভালো করে চেনাজানা হবে, কথা হবে। ভালোবাসা হয়নি মিষ্টিকে কিন্তু একটা মায়া ঠিক জন্মেছে। একবার তীব্র ভালোবেসেও তো ঘর বাঁধতে পারেনি আহনাফ। তাই এবার ঠিক করেছে বিয়ের পরেই ভালোবাসবে মিষ্টিকে।
” আহনাফ আসবো বাবা?”
জাহানারা বেগমের আগমনে নড়েচড়ে উঠলো আহনাফ। হাসি হাসি মুখে চাচির দিকে এগিয়ে গেলো সে।
” আমার ঘরে আসতে তোমার অনুমতি লাগে ছোটো মা?”
জাহানারা বেগম সহাস্যমুখ করে ঘরে ঢুকলেন।
” তা নয় বাবা। ছেলেমেয়ে বড়ো হলে তাদের তো একটা আলাদা জগত হয় বল?”
” আমি এখনো অবিবাহিত। সুতরাং আমার ঘরে ঢুকতে তোমার কোনো নক করার দরকার নেই। ”
” বজ্জাত ছেলে!”
চাচির কানমলা খেয়ে ‘আউ’ করে উঠলো আহনাফ। আহনাফ এমনিতে শান্ত স্বভাবের হলেও ভেতর ভেতর বেজায় দুষ্ট। তবে সেই দুষ্টমি শুধুমাত্র আপনজনদের জন্য বরাদ্দ।
” ছাড়ো, লাগছে কিন্তু… ”
” আচ্ছা শোন, সাইমুম কল দিয়েছিল। বললো মাস ছয়েকের মধ্যে ফিরবে। তোর বিয়েটা হয়ে যাক তারপর তোর ভাইয়ের জন্যও মেয়ে খুঁজতে হবে কিন্তু! ”
” অবশ্যই। দুপুরে হোয়াটসঅ্যাপে আমি কথা বলেছি ওর সাথে।”
” ভালো করেছিস। আচ্ছা আমি গেলাম। তুই ঘুমো বরং।”
” ওকে ছোটো মা।”

জাহানারা বেগম চলে যেতেই আহনাফ পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লিস্ট চেক করে। এতক্ষণ ভাইব্রেট হচ্ছিল ফোনটা, মিষ্টি কল করেছিল একবার। আরেকটা মেসেজ –
❝ আগামীকাল বিকেলে আসবেন? পাশের গ্রামে মেলা শুরু হয়েছে। নতুন গ্রাম তো সেজন্য। আপু আর ভাইয়া যাবে। আপনি এলে আমিও যেতাম। আজকাল তো মেলার চল নেই বললেই চলে! তাই মিস করা উচিত হবে না। ❞

আহনাফ ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো। মেয়েটা আসলেই পিচ্চি এখনো। মেলায় যাওয়ার জন্য ভীষণ আনন্দে আছে। কিন্তু সচারাচর তো মেলা হয় না এদিকে! যা-ও হয় অনেক দূরে… যাগগে! আহনাফ বিছানায় শুয়ে মেসেজের রিপ্লাই দিল,
❝ ঠিক আছে আসবো আমি। খুশি? ❞
❝ অনেককক… শুভ রাত্রি! ❞
সাথে সাথে ওপাশ থেকে মিষ্টির মেসেজ এলো। আহনাফের ঠোঁটের কোণের হাসি আরেকটু প্রসারিত হলো তাতে।
❝ শুভ রাত্রি। ❞

চলবে,