#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
❝ আইজ ময়নার গায়ে হলুদ কাইল ময়নার বিয়া
পরশু ময়না যাইতো গো ঢাক ঢোল বাজাইয়া। ❞
গায়ে হলুদের গানে মুখরিত আজ সিদ্দিক আহমেদের বাড়ি। এ বাড়ির ছোটো মেয়ে মিষ্টির বিয়ে আজ। সকাল হতেই তাই সবাই যে যার কাজে লেগে গেছে। এখন বেলা সাড়ে এগারোটা। মিষ্টির নানি জরিনা বেগম উঠোনের মাঝখানে বসে শিলনোড়ায় হলুদ পিষছে। শিলনোড়ার সামনে কুলোয় কাঁচা হলুদ, দূর্বাঘাস, পান, সুপারি আরো কিছু জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। জরিনা বেগম নাতনির বিয়ের আনন্দে পান চিবোতে চিবোতে উনার কাজ করছে। পাশে গোল হয়ে বসে আছে কিছু ছেলেমেয়েরা। আশেপাশের প্রতিবেশীদের মুখরোচক গল্প এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আহনাফকে গ্রামের সবাই সম্মান করে। তাকে নিয়ে কোনো সমালোচনা কেউ করে না। তাই মিষ্টি আহনাফ স্যারের বউ হবে বলে তাকে নিয়েও কোনো প্রকার আলোচনা করতে আগ্রহ পাচ্ছে না এখন প্রতিবেশীরা।
” নানি তোমার কতদূর হলো? একঘন্টার মধ্যে কিন্তু মিষ্টিকে গোসলের জন্য উঠোনে নামানো হবে। ”
মেহেক কাখে কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুর থেকে পানি এনে বড়ো ড্রামে রেখে ফিটকিরী মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে মাছমাংস ধুতে হয়।
” এইতো আরেকটু সময় লাগবে আমার। সাড়ে বারোটার দিকেই তোরা মিষ্টিকে গোসল করাতে পারবি। ”
” আচ্ছা নানি। ”
মেহেক কথা শেষ করে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে এগোলো। কথা বলার ফুরসত নেই আজ। লোকজন গিজগিজ করছে চারদিকে। গ্রামাঞ্চলে বিয়েশাদি মানেই এমন হৈ-হুল্লোড়। তার উপর গায়ে হলুদ শেষে সবাইকে মিষ্টির বদলে ফিরনী খাওয়ানো হবে বলে লোকজনের আনাগোনা একটু বেশি।
” সুন্দরী এটা কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে। ”
রান্নাঘরের বাইরে চেয়ারে বসে আছে রোশন। মেহেক ড্রামে পানি ঢেলে ফের কলসি নিয়ে বের হতে গেলেই হাত ধরে ফেলে।
” উঁহু এখন প্রেম করার সময় নেই। হাত ছাড়ুন, অনেক কাজ।”
” রাতে কি পাবো? না-কি রাতেও কাজ করবে?”
মেহেক হাসবে না-কি রাগ করবে বুঝতে পারছে না। হাতটা আস্তে করে ছাড়িয়ে যেতে যেতে বলে,
” যার বউ রাতে তার সাথেই থাকবে।”
রোশন রাজ্য জয় করে ফেলেছে এমন ভাবখানা করে হাসতে হাসতে উঠোনের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভাগ্যিস ডাকাতি করতে এলে মুখে কাপড় বেঁধে আসতো আগে। সেজন্য গ্রামের লোকজন এমনি বুঝতে পারে না। কিন্তু মুখে মাস্ক পরলে চোখ দুটো দেখে বেশ সন্দেহ করে। বিষয়টা পুরোপুরি উল্টো লাগছিল। কিন্তু মেহেক পরে বললো মুখ ঢেকে রাখলে আরো সন্দেহ করে লোকজন। তাই এমনি থাকাই ভালো। তাছাড়া কোনো সমস্যা হলে ব্যাকআপ প্ল্যান তো করাই আছে।
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের উপস্থিতিতে মিষ্টির গায়ে হলুদ খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ঘড়িতে সময় বেলা তিনটা, সবাই দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করলো মাত্র। রান্নাবান্না করতে দেরি হয়ে গেছে। মিষ্টিকে সাজাচ্ছে ওর বান্ধবীরা। মেহেক আর আনজুম বেগমের একটু দাঁড়িয়ে থাকারও সুযোগ নেই যেনো। রোশন বেচারা আজ একা একা বোর হচ্ছে শুধু। যার সাথে একটু গল্পগুজব করতো সেই মিষ্টির আজ বিয়ে। তাই এখানে-ওখানে বসে ফোন টেপা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এখন৷ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেনা বলে রোশন অনেক কাজের হাত থেকে বেঁচে গেছে।
” এতো নড়াচড়া করলে সাজাবো কীভাবে? ”
মিষ্টি বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নীলার কথায়ই এই অভিব্যক্তি তার।
” আর সাজাতে হবে না রে।”
” হ্যাঁ বললেই হলো! চুপচাপ বস তো।”
নীলার কথায় কোনোরকমে চুপ করে বসেছে মিষ্টি। ভারী মেকআপ কখনো করেনি বলে অস্বস্তি লাগছে। এরমধ্যে মেহেক এসে সাজগোছ কতদূর হলো তা দেখতে এসেছিল। এখন আবারো এলো।
” কতদূর হলো নীলা? আসরের নামাজের পরপর বিয়ে। বেশি সময় নেই কিন্তু। হাত চালিয়ে কর একটু। ”
” আপু এতো সাজগোছ কেনো করতে হবে বলো তো? কখন থেকে সাজিয়ে যাচ্ছে ওরা। ”
” তুই চুপ থাক মিষ্টি। ”
নীলা মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখলো। লাল টুকটুকে বেনারসি পরনে, চুলগুলো খোঁপা করা, খোঁপায় গোলাপ ফুল, মুখে ব্রাইডাল মেকআপ। কানে,গলায়, হাতে সোনার গয়না। একেবারে পারফেক্ট সাজগোছ!
” মেহেক আপু দেখো তো, হয়েছে না?”
মেহেক বোনকে দাঁড় করিয়ে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিলো একবার। বোনকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো মেহেক,
” খুব সুন্দর লাগছে রে। আমার ছোট্ট বোনটার আজ বিয়ে হবে! সুখে থাকিস বোন আমার। ”
মিষ্টিও মেহেককে জড়িয়ে ধরে ছলছল নয়নে বলে,
” তোমাদের ছেড়ে কীভাবে থাকবো জানি না আপু।”
” পাগলি! মেয়েদের জন্মই শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য। দেখ না, আমার বিয়ের সবকিছুই তো জানিস? জোরাজোরি করে থাকলেও অভ্যাস তো হয়ে গেছে বল? তোর তো ভালোবাসার সংসার হবে। দেখিস আহনাফ তোকে খুব ভালো রাখবে। এখন বস এখানে। আমি দেখি বাইরে গিয়ে। ”
বোনকে ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মেহেক। মিষ্টির বান্ধবীরা ওর সাথে আহনাফকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এরমধ্যেই।
নিশুতি রাত। বাইরে থেকে ব্যাঙসহ নানা ধরনের পোকামাকড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। দুই পরিবারের সম্মতিতে এবং খুশিতে আহনাফ ও মিষ্টির বিয়ে সম্পন্ন হলো আজ। সন্ধ্যার আগে আগে মিষ্টিকে নিয়ে গেছে বরপক্ষ। একমাত্র মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন আনজুম বেগম। এখন স্বাভাবিক আছেন। সারাদিন খাটাখাটুনি করে না খেয়েদেয়ে ক্লান্ত বদনে ঘুমিয়ে গেছেন।
” কী হলো? ওদিক ফিরে শুয়ে রইলে কেনো সুন্দরী? ”
” আমার ঘুম পাচ্ছে। ”
রোশন মেহেকের দিকে এগিয়ে শুয়ে কোমরে হাত রাখলো। মেহেকেরও শরীর ক্লান্ত লাগছে।
” ঘুমাও কিন্তু আমার দিকে ফিরে। ”
” কেনো?”
” তোমাকে দেখতে দেখতে ঘুমাবো সেজন্য। ”
রোশনের দুষ্ট মিষ্টি কথায় হাসি আটকে রাখতে পারে না মেহেক। মৃদু হেসে বলে,
” আপনি তাহলে এদিকে এসে শুয়ে পড়ুন। তাহলে আমাকেও আর ওদিক ফিরে শুতে হবে না আর আপনার ইচ্ছেও পূর্ণ হবে! ”
মেহেক বলা মাত্র রোশন অন্য পাশে এসে শুয়ে পড়েছে।
” আহা সুন্দরীর কতো বুদ্ধি! এখন ঘুমাও তুমি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
” এমনি ঘুম আসবে। এতো আদরের দরকার নেই। ”
রোশন কিছু বললো না। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখেই মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেহেক আর বাঁধা দিলো না। পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ফুল দিয়ে সজ্জিত বিছানায় বসে আছে মিষ্টি। বিয়ের ভারী শাড়ি, গয়নার বদলে এখন হালকা ফুলের সাজ শোভা পাচ্ছে মিষ্টির বদনে। দেয়াল ঘড়ির দিকে বারবার তাকিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। রাত বারোটা ছুঁইছুঁই! তবুও মানুষটা ঘরে আসছে না কেনো? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার গ্রিল ভেদ করে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঢুকছে ঘরে। তবে কি বিয়ে করার পর আফসোস হচ্ছে আহনাফ স্যারের? কোনো কারণে কি অতীত নিয়ে ভাবছেন? এমনিতেই আসার সময় মা’কে ওরকম অবস্থায় দেখে এসেছে, তারমধ্যে এখন আহনাফের এমন আচরণ! সবকিছু মিলিয়ে অস্থির লাগছে মিষ্টির। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটল ওর। মাথা উঁচিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্রতায় মোড়ানো এক বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিচ্ছে। হাতে তার একটা ব্যাগ! মিষ্টি বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলো আহনাফের দিকে। কিন্তু মিষ্টি যখনই ঝুঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলো আহনাফ বাঁধা দিয়ে বললো,
” পায়ে হাত দিচ্ছো কেনো? এসব ঠিক না। মুখে সালাম দিতে হয়। ”
মিষ্টি বুদ্ধিমতী মেয়ে। কালবিলম্ব না করে মুচকি হেসে বললো সে,
” আসসালামু আলাইকুম । ”
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। দুঃখিত মিষ্টি! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম তোমাকে। একটু বের হয়েছিলাম, এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। সেজন্য দেরি হয়ে গেছে। ”
মিষ্টি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ নানান দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা।
” সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি। ”
” ঠিক আছে। চলো বিছানায় বসে কথা বলি। ”
আহনাফ মিষ্টিকে ইশারা করে খাটে গিয়ে বসলো। হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে মিষ্টিকেও হাত ধরে বসালো মুখোমুখি। আহনাফ ব্যাগের ভেতর থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি বের করলো, রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে আনা। সাথে কিছু চকলেট আর একটা মোবাইল।
” এসব কেনো আনলেন! ”
মিষ্টি বিস্ময় মিশ্রিত কণ্ঠে শুধালো। মুচকি হেসে বললো আহনাফ,
” তুমি তো গরুর মাংস খাও না। সেজন্য চিকেন বিরিয়ানি এনেছি। বাসায় তো গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। সারাদিনের ধকলে নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে এখন। ”
সত্যি সত্যি খিদে লাগলেও সেটা মুখ ফুটে বলতে পারবে না মিষ্টি। কিন্তু আহনাফকে যত দেখে মুগ্ধ হয় মিষ্টি। এতো ভালো কীভাবে হয় কেউ?
” আমার খিদে পায়নি স্যার। ”
” চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা। এখন চুপচাপ খেয়ে নাও। আমি খাইয়ে দিতে পারি না কাউকে। তাই তোমাকে নিজেই খেতে হবে। চকলেট পরে খেও বরং। ”
” কিন্তু নতুন ফোন কেনো? আমার এই ফোনটা তো ঠিকঠাক চলছে! ”
” দরকার না হলে রেখে দাও। পরে ব্যবহার করবে। আমার মনে হলো তাই কিনলাম। ”
মিষ্টি মাথা নেড়ে “হুম।” বললো। আহনাফ উঠে গিয়ে পাশের টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা এনে মিষ্টির পাশে রেখে বললো,
” খেতে শুরু করো এখন। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমোতে হবে না? ”
মিষ্টি আর ইতস্তত না হয়ে আস্তে আস্তে খেতে লাগলো। ভীষণ খিদে পেয়েছিল মেয়েটার। আহনাফ বসে বসে ওর খাওয়া দেখছে। অর্ধেক খাওয়ার পর মিষ্টির মনে হলো সামনে থাকা লোকটাকে একবার সাধলো না কেনো? ইশ কী লজ্জা!
” আপনি খেয়েছেন রাতে? আসুন একসাথে খাই বরং।”
” আমি খেয়েছি। তুমি খাওয়া শেষ করো। আরেকটা জিনিস দেওয়ার আছে। ”
” আবার কী?”
” আগে খাওয়া শেষ করো। ”
” আচ্ছা। ”
চলবে,