#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)
” বাবা সত্যি করে বলো তো, গতকাল রাতে তোমার কী হয়েছিল? ”
সবুর হোসেন প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন বারবার। আলাদা প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন বারবার। রোশন সেজন্য এবার একটু গলা উঁচিয়ে প্রশ্নটা করলো। সবুর হোসেন শত চেষ্টা করেও কেনো জানি সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারছে না আজ। ভয় হচ্ছে ভীষণ!
” দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম রোশন। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছিল তখন। সেজন্য নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি দুঃখিত তারজন্য। ”
চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সবুর। রোশন ঠিক বাবার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শুধুমাত্র একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ওরকম কেঁদেছিলেন বাবা? নাহ! সামথিং ইজ রং..
” ঠিক আছে বাবা। সরি তোমাকে জোর করার জন্য। ”
” সমস্যা নেই। যাও মেহেককে গিয়ে নাস্তা দিতে বলো। মীরার শরীর খারাপ। ”
রোশন বসা থেকে উঠে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছে। সবুর হোসেন বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে অহেতুক বিছানা ঠিকঠাক করার অভিনয় করতে ব্যস্ত।
” আচ্ছা বাবা। ”
রোশন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও আজ মনের ভেতর কৌতূহল, প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়েছে। সবকিছু জানতে হবে ওকে। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে খাবার খাওয়ার জায়গায় যায় রোশন।
মেয়ের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠেছেন সিদ্দিক। মিষ্টি আর আহনাফ ফিরেছে গতকাল। এসেই যা বলেছে তাতে মেহেকের বাবার চিন্তা দ্বিগুণ থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারের আদ্যপ্রান্ত থেকে সকল ডাকাতদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। যাদের সাথে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে তারা মারাও গেছে। মোটকথা ডাকাত মুক্ত দেশ গড়ার অপারেশনে নেমেছে প্রশাসন সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব শুনে কি স্থির থাকা যায়? উঠোনে বসে কাজ করতে করতে এসব চিন্তায় মশগুল হয়ে আছেন সিদ্দিক। আনজুম বেগম গেছেন মিষ্টিকে দেখতে। বিয়ের পর যদিও আরো বেশ কয়েকবার মেয়ের সাজানো-গোছানো সংসার স্বচক্ষে দেখে এসেছেন তিনি। তবুও মাঝে মধ্যে হুটহাট মেয়েকে দেখতে চলে যান তিনি। অবশ্য এতে মিষ্টির শ্বশুর বাড়ির সবাই বেশ খুশিই হোন।
” কী গো! এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করছো যে?”
হঠাৎ আনজুম বেগমের কথায় চমকালেন সিদ্দিক। ভাবনার অতলে ডুবে থাকায় মিষ্টির মায়ের আগমন টের পায়নি। হাতের কাজ রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন সিদ্দিক।
” মিষ্টি তোমাকে কিছু বলেনি?”
মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো আনজুমের। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে স্বামীর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
” হ্যাঁ। আমাদের কিছু করার নেই গো মিষ্টির বাবা। ”
সিদ্দিক আহমেদ কিছু বলেন না। কাঁধে রাখা গামছা উঠোনে টাঙানো রশিতে রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
” কী করছেন? ”
” কী মনে হচ্ছে? ”
রোশন আরেকটু গভীরভাবে হাত ছুঁয়ে দিলো মেহেকের ঘাড়ে। আয়নার সামনে বসে বিনুনি করছিলো ও।
” মতলব সুবিধার মনে হচ্ছে না। ”
মেহেক মুচকি হাসলো। রোশন ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে কোমরে হাত ছুঁইয়ে বেসামাল করে তুলছে ওকে।
” এতদিনে ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছো সুন্দরী! ”
পাঁজা কোলা করে মেহেককে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো রোশন। নিজেও পাশে কনুই-এ ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে।
” আপনাকে একটা কথা বলার আছে। ”
” হুম বলো,বলো। ”
প্রিয়তমার কপালে, গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে শুধালো রোশন। মেহেক উপুড় হয়ে শুয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
” কালকে বলবো। এখন না…….”
রোশন কিছু জিজ্ঞেস করলোনা আর। আপাতত তার নিজস্ব সুন্দরীতে মত্ত সে!
সারাদিন ছটফট করে কাটিয়েছেন সবুর। কেনো জানি মনে হচ্ছে উনার হাতে বেশি সময় নেই আর। এবার রোশনের সবকিছু জানা দরকার। রাতের নিস্তব্ধতা সমস্ত চিন্তাভাবনা আরো দ্বিগুণ করে তুলছে। দেয়ালঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে সময় দেখে নিলেন সবুর। রাত এগারোটা বাজে। আজকের রাতটা কেমন জানি অদ্ভুত! বেশি রাত হয়নি। শরীরটাও বিশেষ ভালো লাগছে না। অতিরিক্ত চিন্তার ফল সব। যদি এখন রোশানকে কিছু না জানিয়ে পৃথিবী থেকে সবুর বিদায় নেন তাহলে যেদিন রোশনের সবকিছু মনে পড়ে যাবে সেদিন কী হবে? না! সবকিছু বলা দরকার রোশনকে। তাতে সবুরকে রোশন ঘৃণা করলে করবে তবুও! এসব ভেবেচিন্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সবুর। এতকিছু ভাবনার মধ্যে যে জঙ্গলের আশেপাশে নিঃশব্দে কিছু মানুষ প্রবেশ করেছে সেসব সবুর টের পর্যন্ত পায়নি।
ক্লান্ত বদনে বরের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহেক। রোশন একা একা বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কথাই বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা! মেহেকের হাসি পাচ্ছে ভীষণ। অন্য বরেরা কোথায় স্ত্রীকে সুন্দর সুন্দর গল্প কিংবা শৈশবের কথা শোনায় আর এই বেটা রসুন শোনাচ্ছে ডাকাতির গল্প! অবশ্য বেচারার কী দোষ? ওর তো স্মৃতিপটে এরচেয়ে বেশি কিছু নেই এখন।
” কী হলো? ”
হঠাৎ রোশন মেহেককে বুকের উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসায় কিছুটা বিস্ময় নিয়ে শুধালো মেহেক। রোশন ইশারায় চুপ করে থাকতে বললো ওকে। এক মিনিট… দুই মিনিট….
” রোশন? ঘুমিয়ে গেছো? ”
বাবার কণ্ঠস্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রোশন।
” বাবা এসেছেন। মনে হচ্ছিল আশেপাশে কেউ হাঁটছিল। জামাকাপড় ঠিক করে নাও। ”
মেহেক মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের পোশাক ঠিক করে নিলো। রোশন গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
” বাবা! ঘরে এসো। আবার কি দুঃস্বপ্ন দেখেছো? ”
সবুর হোসেন ছেলের কথামতো ঘরে প্রবেশ করে। রোশন দরজা আঁটকে দেয়। মেহেক একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। সবুর চেয়ারে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” নাহ, দুঃস্বপ্ন দেখিনি। কিছু কথা বলতে এসেছি। ”
মেহেক ও রোশন দু’জনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার।
” হ্যাঁ বাবা বলো। ”
” আমি জানি কথাগুলো বিশ্বাস করতে তোমার কষ্ট হবে। এবং পাশাপাশি তুমি আমাকে ঘৃণাও করবে। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা তখন এমন ছিলো যে আমি শুধু নিজের কথা ভেবেছিলাম। ”
বাবার কোনো কথা রোশন বুঝতে পারছে না। মেহেক তো নীরব দর্শক। সবুর হোসেন আবারো বলতে শুরু করলেন,
” জানি কিছু বুঝতে পারছো না। আর মেহেকের পক্ষে তো বোঝা অসম্ভব। যেহেতু মেহেক এখন আমাদের একজন এবং তোমার স্ত্রী তাই ওর সবকিছু জানার অধিকার আছে। এখন যে কথাগুলো বলতে চলেছি সেগুলো সম্পর্কে আমি ব্যতীত এখানকার অধিকাংশ লোকজন জানে না। কারণ সবাই অল্পবয়সী। আগে যারা ছিলো তাদের অধিকাংশ লোকজনকে আমি ইচ্ছে করে অন্য দলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে করে সব সত্যি কখনো তোমার সামনে না আসে। ”
রোশন অস্থির হয়ে উঠলো এবার।
” কীসের সত্যি বাবা? ”
” তোমার স্মৃতি নষ্ট হওয়ার পেছনে আমি-ই দায়ী রোশন। ”
সবুর হোসেনের কথাটা হজম করতে সময় লাগলো রোশনের। মেহেক অবাক হলো উনার কথায়। বাবা কেনো তার ছেলের স্মৃতি শক্তি নষ্ট করবেন? সবুর হোসেন ফের বলতে লাগলেন,
” বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটা সত্যি রোশন। এবং তারচে বড়ো সত্যি আমি তোমার জন্মদাতা পিতা নই। ”
রোশন থমকাল সবুরের কথায়। একপা পেছনে সরে গেলো। সবুরের দু-চোখ ছলছল করছে। রোশনের বিধস্ত মুখাবয়ব দেখে মায়া হচ্ছে মেহেকের।
” বাবা! ”
” এটাই সত্যি রোশন। তুুমি এখানকার কেউ নও। ”
” তুমি আমার কেউ না? বাবা তুমি কি মাঝরাতে আমার সাথে মজা করতে এসেছো? ব্যাড বয়!”
রোশন সবুর হোসেনের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শুধালো কথাগুলো। লোকটা এসবকিছু সহ্য করতে পারছে না। মেহেকের কিছু করার নেই। সত্যির মুখোমুখি সবাইকে হতে হয়। সবুর হোসেন নিজেকে শক্ত রেখে বললেন,
” আমি মজা করছি না রোশন। ”
” তাহলে আমি কে? কে আমি? এখানে কী করছি? কে!”
উত্তেজিত হয়ে রাগে, কষ্টে থরথর করে কাঁপছে রোশন। মেহেক রোশনের এই রূপ আগে কখনো দেখেনি।
” তুমি আমার প্রাক্তন স্ত্রী’র সন্তান। ”
” প্রাক্তন স্ত্রী! আমার মা আছে? আমার মা! কোথায় আমার মা? বাবা প্লিজ একটু পরিষ্কার করে বলো সব। আমার… আমার কেমন পাগল পাগল লাগছে।”
সবুর রোশনের কাঁধে হাত রেখে নিজেও মাটিতে বসলেন। সময় এসেছে এখন, সবকিছু প্রথম থেকে খুলে বলার…..
চলবে,