নীরবে নিভৃতে পর্ব-৩৯

0
112

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

” বাবা আমার মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে কেউ আছে যে প্রশাসনকে সাহায্য করেছে। নইলে এভাবে আক্রমণ করা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ”

রোশনের মুখে বাবা ডাক শুনে ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে সবুর। ছেলেটা তাহলে ভুল বোঝেনি উনাকে। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে ভেবে ইমোশন কন্ট্রোল করে কথায় মনোযোগ দিলেন সবুর।

” ঠিক বলেছেন ভাই। বস আমাদের মধ্যে কেউ বেইমানি করেছে। ”
লিমন কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বললো কথাটা। মেহেকের কথা ভেবে ভেতর ভেতর অস্থির লাগছে রোশনের। সবুর হোসেন লিমন ও রোশনের উদ্দেশ্যে বলেন,
” হ্যাঁ। ওরা পেছন থেকে গুলি চালাচ্ছে। আমাদের লোকসংখ্যা কমে আসছে। তিনজন একসাথে না থেকে ওদিকে গিয়ে দাঁড়াও। ”
সবুর হোসেনের ইশারায় একটু দূরে দূরে সরে দাঁড়াল ওরা।

একদিকে গুলির আওয়াজ অন্য দিকে অনবরত মাইকিং এর শব্দ! এরমধ্যে মেহেক শুধু পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে আবার হাঁটছে। মীরা নিজেও বসে নেই ঘরে।

হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই রোশনের পাশে পরপর দু’টো লাশ পড়লো। লিমনের চিৎকারে পাশ ফিরে তাকাতেই আঁতকে উঠল রোশন। সাদাত গুলি খেয়েছে, সাথে সবুর হোসেনও! সহসাই মাটিতে বাবার পাশে বসে পড়লো রোশন। বুকের ভেতর অজস্র যন্ত্রণার কীট নড়েচড়ে উঠলো ওর।

” বাবা! বাবা? এই তুমি কী করলে এটা? ”

লিমন একাই রোশনকে আড়াল করে গুলি ছুড়ছে। সবুর হোসেন পিটপিট করে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। যেনো কোনো যন্ত্রণা ছুঁতে পারেনি উনাকে। রোশন সবুরকে কোলে তুলে নিয়ে যথাসম্ভব একটা বড়ো গাছের আড়ালে গিয়ে বসলো। পেটে গুলি লেগেছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে।

” তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার কিছু হতে দিবো না বাবা। তুমি এখানেই বসো। ”

” রো..শ..ন যেও না। আমা…র হাতে বেশি স..ময় নেই। ”

ছেলের হাত ধরে খুব কষ্ট করে থেমে থেমে কথাগুলো বললেন সবুর। রোশন বসলো বাবার পাশে। ছলছল নয়নে চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলো একবার। লিমনের কী হলো চিন্তা হচ্ছে! তাছাড়া মেহেক ঘরে আছে তো?

” আমি জানি রো..শন, তুমি আমা..কে ক্ষ..মা করে দিয়েছো। তবুও আমি অপরাধী তোমার কা..ছে। পারলে…. ”
সবুর হোসেনের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। রোশন কিছু বুঝতে পারছে না যেনো। মিনিট পাঁচেক ওভাবেই বসে থাকার পর শেষ বারের মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। চোখের কার্ণিশ থেকে একফোঁটা জল ঝরে পড়লো রোশনের। মেহেকের কাছে যেতে হবে! রোশন আর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে সোজা দৌড়ে ঘরের দিকে এগোলো।

” স্যার মনে হচ্ছে প্রায় সবাই মারা গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন হয়তো বেঁচে থাকতে পারে। কী করবো আমরা? ”
” সব সাফ করে ফেলো। অলরেডি অনেক ডাকাত জমা আছে থানায়। এতো জিজ্ঞাসাবাদের দরকার নেই। আমি উপরমহলে জানিয়ে দিবো সব বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ”
” ওকে স্যার। ”

রাকিব রিজভী আহমেদের কথামতো ডাকাতদের ঘরগুলোর দিকে এগোলো। আচমকা মেহেককে সামনে দেখে চমকাল রোশন। কিছু হয়নি তো ওর? দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো মেহেককে।
” তুমি ঠিক আছো সুন্দরী? তোমার কিছু হয়নি তো? ঘর থেকে কেনো বেরোলে? ঘরে চলো। ”
রোশন বাহুডোর থেকে মুক্ত করে মেহেকের হাত ধরে সামনে এগোচ্ছে।
” আমি ঠিক আছি। সবকিছু ঠিক আছে তো? ”
মেহেক কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে শুধালো। রোশন হাঁটা থামিয়ে দু-হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো।
” একদম কাঁদবে না। আমার সুন্দরীর চোখে পানি সহ্য করতে পারি না আমি। আমাদের ঘরের নিচে মানে মাটির নিচে একটা কক্ষ আছে। বড়সড় বিপদ হলে যেনো লুকানো যায় সেজন্য তৈরি করা। তাড়াতাড়ি চলো। ”
” কিন্তু বাকিরা? ”
রোশন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” কেউ নেই। বাবাকে বাঁচাতে পারিনি কিন্তু তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না আমি। ”
মেহেক কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষটা সবকিছু হারিয়েও শুধু ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এই মানুষটাকে একদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভাবতেই আজ আফসোস হচ্ছে মেহেকের। এরমধ্যে ওরা দুজনে ঘরের সামনে এসে পৌঁছেছে।
” মীরা আপু! ভালো হয়েছে তুমিও এখানে। চলো আমাদের সাথে। ”
মেহেক মীরাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলার পরেই চমকায় রোশন। মীরা একহাতে পিস্তল উঁচিয়ে আছে রোশনের দিকে। অন্য হাতে আইডি কার্ড ধরে নিজের পরিচয় দিচ্ছে, স্পেশাল ক্রাইম অফিসার আয়েশা সিদ্দিকী অব বাংলাদেশ পুলিশ! মেহেক ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে।
” রোশন মেহেকের জন্য হলেও নিজে থেকে ধরা দাও। আমি চাই না তোমাদের বড়সড় কোনো ক্ষতি হোক। ”
রোশনের আরকিছুই বুঝতে বাকি রইলো না। নিজের পিস্তল দিয়ে মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি ছুড়লো রোশন। মীরার বাম পায়ে গুলি লাগায় ওর হাতের পিস্তল ছিটকে দূরে গিয়ে পড়েছে। মেহেক রোশনের পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” রোশন ভুল করছো তুমি। ”
” চুপ! তোর মতো বিশ্বাসঘাতকের সাথে কোনো কথা নেই। তোর জন্যই আজ আমাদের এই অবস্থা। ”
রোশন রাগে থরথর করে কাঁপছে। এতগুলো বছরেও বুঝতে পারলোনা এই মীরাই ওদের বড়ো শত্রু!

” এটাই আমার ডিউটি ছিলো। দেখো রোশন প্রশাসনের লোকজন এখানকার প্রতিটা জায়গা সম্মন্ধে অবহিত। তোমরা কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। তারচে ধরা দাও। ”
রোশন মীরার কথায় রাজি হবে না। কারণ ধরা পড়লেও হয় মৃত্যুদণ্ড নয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এরমধ্যে রাকিব ওর দলবল নিয়ে রোশনদের কাছে চলে আসে। প্রশাসনের লোকজন আক্রমণ করতেই রোশন মেহেককে গাছের আড়ালে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গুলি করতে শুরু করে। মীরা আহত অবস্থায় ওখানেই বসে আছে।
” রাকিব প্লিজ গুলি করো না। প্লিজ! ওদের একটা সুযোগ দাও। ”
রাকিব মীরা অর্থাৎ আয়েশার কথা শুনতে পায় না। দুজনের মধ্যে গোলাগুলির একপর্যায়ে একটা গুলি এসে রোশনের বুকে লাগে। ঠিক আগের গুলির ক্ষতে গুলিটা লাগায় মুহুর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মেহেক রোশনকে ধরার জন্য দৌড়ে আসতে গেলে ওকেও গুলি করে প্রশাসনের লোকজন। আয়েশা চিৎকার করে কাঁদছে দেখে এতক্ষণে রাকিব ওর দিকে এগোয়। নিজের চোখের সামনে মেহেককে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে এই অবস্থায়ও ছটফট করছে রোশন। কিন্তু একবিন্দু নড়াচড়া করার শক্তিও ওর নেই এখন। মেহেক কোনোরকমে উঠে রোশনের পাশে পড়ে গেছে আবার। দু’জন দু’জনার যন্ত্রণার দিকে না তাকিয়ে সামনে থাকা ভালোবাসার মানুষকে না বাঁচাতে পারার কষ্টে দিশেহারা।
” সুন্দরী! আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে ভালোবেসে মৃত্যু দিলাম আমি! আমার সাথে না জড়ালে আজ এই পরিণতি হতোনা তোমার। ”
প্রিয়তমা স্ত্রী’র হাতে হাত রেখে থেমে থেমে কথাগুলো বললো রোশন।
” এসব বলার সময় নেই এখন৷ আপনাকে বলেছিলাম না একটা খবর দেওয়ার আছে? ”
মেহেক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে কথাটা বলে। তারপর আবারো বলে,
” আমি কখনো ভাবিনি এই কথাটা এমন পরিস্থিতিতে বলতে হবে আমাকে। ”
রোশন খুব কষ্ট করে তাকিয়ে আছে মেহেকের দিকে। মেহেক রোশনের একটা হাত নিজের পেটের উপর রেখে বলে,
” আমাদের সন্তান আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারলোনা রোশন। আপনি বাবা হতে চলেছেন। আর আমি মা! ”
মেহেকের বলা কথাগুলো রোশনের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে বারবার আন্দোলিত হচ্ছে। ইচ্ছাশক্তির জোড়েই ভালো করে চোখ মেলে তাকাল রোশন। মেহেককে বুকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পুরুষের কান্না বড্ড বিশ্রী। নিজের অনাগত সন্তানকে রক্ষা করতে না পারা আর স্ত্রী’কে বাঁচাতে না পারার কষ্ট সেই বিশ্রী জিনিসকেও হার মানালো আজ৷
” কী শোনালে সুন্দরী! আমি এতটা হতভাগা কেনো আল্লাহ! সারাজীবন অনেক পাপ করেছি কিন্তু তার শাস্তি এদেরকে কেনো দিলে!”
” শান্ত হোন। ভালোবাসি! আমি তোমাকে ভালোবাসি রোশন। আপনি থেকে তুমি ডেকে আফসোস মিটিয়ে দিলাম আজ। ”
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মেহেকের। রোশনেরও চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রায়।
” ভালোবাসি সুন্দরী! আমাদের আবার দেখা হবে। আবা…”
রোশনের কথা বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তেই মেহেকও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সাথে সাথে রোশনও!

” কেনো মারলে ওদের? আমি তো বললাম ওদেরকে একটা সুযোগ দাও! কেনো মারলে? মেয়েটা সেদিন কতটা খুশি মনে আমাকে বলতে এসেছিল, ও মা হতে চলেছে। রাকিব! কী করলে!”

আয়েশা রাকিবকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। রাকিব নিজেও বুঝতে পারেনি মেহেক প্রেগন্যান্ট! তাছাড়া আয়েশার কথা তখন শুনতেও পায়নি। আয়েশা আর রাকিবের মাঝে ছয় বছরের সম্পর্ক।

চলবে,