নীরভে নিভৃতে পর্ব-০১

0
189

#নীরভে_নিভৃতে
#সূচনা_পর্ব
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

” বয়সে বিশ বছরের বড়ো এক লোকের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার। শুনেছি ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। আমার জন্মদাত্রী মা বেঁচে থাকলে কখনোই এমন হতে দিতেন না। সৎ মায়ের সংসারে থাকার চেয়ে মানুষের বাড়ি কাজ করে খাওয়া ঢেরবেশি ভালো। ”
অশ্রুসিক্ত নয়নে অভিমান বুকে চেপে কথাগুলো বললো মেহেক। বান্ধবী সিনথিয়া মেহেকের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল মেহেকের মা আনজুম বেগম। আপন মা নন, বয়স যখন আট তখন দুরারোগ্য রোগে মারা গেছেন মেহেকের মা। বাবার হাত-পা ধরে কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করলো মেহেক। আর তারপরই বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। কেউ কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু এসে বলেছে, আগামীকাল বিকেলে তোর বিয়ে। সিনথিয়া মেহেকের বাসায় এসেছে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় বিয়ের খবরটা আপনাআপনি পেয়ে গেছে সে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। দুপুরে খাবার খায়নি মেহেক। এতদিন মায়ের মারধর খেয়ে আর সংসারের সব কাজ কোনোরকমে লেখাপড়া করে জীবন কাটছিলো। কিন্তু এখন কী হবে সেই নিয়ে হাজারো দ্বিধায় আছে মেয়েটা! সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

” মেহেক শোন,আমাদের হাতে কিছু নিয়ে নেই। তোর বাবাই তো তোর কথা শুনলো না। সবকিছু তার স্ত্রী ‘র কথায় করলেন। এখন কী করবি বল? কোথায় যাবি তুই বিয়ে না করলে? বিয়ে না করলে তো তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে এঁরা। ”

” সিনথিয়া মা যখন মরলেন আমাকে রেখে গেলেন কেনো? এই দোযখে জ্বলে মরতে? বল না সিনথিয়া! বল…”

মেহেক সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্না ছাড়া বুঝি কিছু করার নেই তার। মামার বাড়ির লোকজন কখনো তাদের ভালো চোখে দেখতো না। কারণ মেহেকের বাবা-মা বাড়ির সবার অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। আর মেহেকের কোনো চাচা কিংবা ফুপি নেই। তাই মেহেকের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই! আনজুম বেগমের এক ছেলে, এক মেয়ে। সানভি এবার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে আর মিষ্টি দশম শ্রেণীতে। সানভি মেহেককে যা-ও একটু পছন্দ করে কিন্তু মিষ্টি ওকে দু-চোখে দেখতে পারে না। অথচ মেহেক ওদের নিজের ভাইবোনের মতোই স্নেহ করে, ভালোবাসে।

রাতের আঁধার ফুরিয়ে দিনের আলো ফুটলো। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। হাওলাদার বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। আশপাশ থেকে লোকজন যাওয়া আসা করছে। শহর থেকে দূরে থাকায় যানবাহনের কর্কশ আওয়াজে কারো ঘুম ভাঙে না এখানে। বরং মোরগ-মুরগিদের ডাকে ঘুম ভাঙে। গ্রামের শেষ সীমানায় একটা নদী। আর নদীর ওপারে ঘন জঙ্গল। মেহেক রাতেও কিছু খায়নি। গতকাল থেকে সারাদিন না খাওয়ার ফলে শরীর ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু সেদিকে কারো নজর দেওয়ার সময় কই! বিয়ের দিন হলেও আজও সকাল সকাল উঠে নিত্যদিনের কাজকর্ম গুছিয়ে রাখতে হয়েছে ওকে। লোকে বলে মেয়ে কালো হলে তার দুঃখের সীমা নেই। অথচ সুন্দরী হলেও যে কতো বিপদ লুকিয়ে থাকে তা কয়জন বোঝে? মেহেক ছোটো থেকেই আগুন সুন্দরী। এই সৌন্দর্য অবশ্য মায়ের থেকেই পেয়েছে মেয়েটা। কিন্তু এই সৌন্দর্যই ওর কাল! গ্রামের বখাটেদের জ্বালায় ভয়ে ভয়ে থাকতো মেহেক। বাড়িতে কিছু জানালে উল্টো সবাই বলতো একহাতে তালি বাজে না। এমনকি এটাকে ইস্যু করেই মেহেকের বিয়েটা তাড়াতাড়ি ঠিক করতে পেরেছেন আনজুম। আসলে কালো হোক কিংবা সুন্দর কিছু মেয়েদের জন্মানোই অভিশাপ। নিজের মনের অবিন্যস্ত ভাবনাগুলো নিয়ে ঘরে বসে আছে মেহেক।
” যোহরের নামাজের পরেই তোর বিয়ে হবে। গোসল সেড়ে আয়। ”
আচমকা আনজুম বেগমের এরকম কথা শুনে চমকায় মেহেক। দেড় ঘন্টা পর বিয়ে! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো মনে হচ্ছে। কেউ কি বিশ্বাস করবে তার এই অসহায়ত্বের কথা? এভাবেও কাউকে বিয়ে দিতে পারে এখন! পারে বলেই তো ওর সাথে এসব হচ্ছে। মেহেক সাহস করে প্রশ্ন করলেন মা’কে।
” বিয়ে বিকেলে হওয়ার কথা ছিলো না মা?”

“বিয়েটা আসরের নামাজের পরে হওয়ার কথা থাকলেও পাত্রপক্ষের আবদারে যোহরের পরে হবে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ে উদ্ধার কর আমাকে।”
আনজুম বেগম মুখ ঝামটি দিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান করেন। বিয়ে করলেই সবাই মনে হয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে? এমনকি নিজের জন্মদাতা বাবাও! মেহেক মুচকি হাসে। সে মনস্থির করে ফেলেছে, এ বাড়িতে বসে আর একটুও মন খারাপ করে থাকবে না। যাদের কাছে সে এতটা ঝামেলা তাদের কাছে মন খারাপ প্রকাশ করাও অনুচিত।

” পাত্রপক্ষ এসে গেছে…. ”
মিষ্টি বান্ধবীদের সাথে হৈচৈ করতে করতে গেটের দিকে এগোলো। বোনকে বিশেষ পছন্দ না করলেও বোনের বিয়েতে তার খুব আনন্দ হচ্ছে। আর হবেই না কেনো? হবু দুলাভাই টাকাপয়সার খনি। সুন্দরী বোনকে বিয়ে করার জন্য মিষ্টিকেও তো কম উপহার পাঠায়নি সে। নিজের ঘরে বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে মেহেক। সিনথিয়া বসে পাশেই। বিয়ের জন্য কেনা শাড়িটা পরা ছাড়া আর কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করেনি। এটা তো মেহেকের কাছে বিয়ে নয় মনে হচ্ছে নিজেকে চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছে সবাই।
” মেহেক!”
বাবার আগমনে নড়েচড়ে উঠলো মেহেক। সিনথিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এই মানুষটাকে দেখে বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। মায়ের পর তো এই পৃথিবীতে বাবা-ই একমাত্র আপন মানুষ।
” হ্যাঁ বাবা বলো।”
” আমার উপর খুব রাগ করে আছিস তাই না? রাগ করিস না। ইকবালের সাথে ভালো থাকবি তুই। অনেক টাকাপয়সা আছে। তোকে রাণী করে রাখবে।”
বাবার প্রহসনে হাসি পাচ্ছে মেহেকের। টাকাপয়সা থাকলেই সুখী হওয়া যায়? সত্যি? এই মানুষটার সাথে কিছু বলে লাভ নেই। তাই মেহেক কথা বাড়ালো না। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেবল। সিনথিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল।

বিয়ের আসরে দুইপাশে বসে আছে পাত্র ও পাত্রী। পাতলা কাপড়ের আড়ালে বসা মেহেক,সাথে সিনথিয়া ও অন্য কয়েকজন মেয়েরা। ইকবাল নামক মানুষটাকে দেখেনি মেহেক কিন্তু কথাবার্তা শুনেছে। কিন্তু কোনো আগ্রহ খুঁজে পায়নি। তবুও কয়েক মুহুর্তের মধ্যে তিন কবুল বলে নিজেকে তার নামে করে দিবে। ভাবতেই বারবার শিউরে উঠছে মেহেক।
” কাজী সাহেব এবার বিয়েটা শুরু করুন। ”
পাত্র নিজেই বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে বলে আশেপাশে থাকা প্রতিবেশিরা কানাঘুষা শুরু করেছে। ইকবাল সেসবের তোয়াক্কা করছে না অবশ্য। মেয়ের হবু জামাইয়ের সাথে তালে তাল মিলিয়ে সিদ্দিক আহমেদও বললেন,
” হ্যাঁ শুরু করুন।”
” ঠিক আছে। ”
কাজী সাহেব বিয়ের কাজ শুরু করবেন এমন সময় গুলির আওয়াজে চমকে উঠলো সবাই। এই দিনদুপুরে বন্দুকের গুলির আওয়াজের উৎস খুঁজতে অস্থির হয়ে উঠেছে সবাই। এমনিতেই এই গ্রামে ডাকাতদের উপদ্রব আছে। নদীর ওপারে জঙ্গলের পরই ডাকাতদের এরিয়া বলে সবাই জানে। পরপর কয়েকটা গুলির আওয়াজে উপস্থিত সবাই প্রাণের ভয়ে এদিক-সেদিক ছুট লাগিয়ে দিয়েছে। মেহেক আর সিনথিয়া অবাক হয়ে বসেই আছে। মিষ্টি আগেই দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেছে। সিদ্দিক আহমেদ ইকবালকে বাড়ির দিকে আসতে বলে নিজেও বাড়ির দিকে ছুটে গেলো। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে শান্ত পরিবেশটা কেমন অশান্ত হয়ে গেছে।
” ইকবাল সাহেব! বিয়ে করতে এসেছেন বুঝি? এই বয়সে এমন কচি মেয়ে তো আপনি সামলাতে পারবেন না। খামোখা মেয়েটার যৌবন নষ্ট করে কী লাভ বলুন তো! ”
ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে সামনে ছাব্বিশ কিংবা সাতাশ বছরের এক যুবক পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার কুচকুচে কালো শার্ট, জিন্স এবং মুখে মাস্ক। চুলগুলো বেশ লম্বা,ঘাড় ছুঁইছুঁই। অচেনা এই যুবককে দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছে ইকবাল। লোকটা অন্য দিকে দৌড় দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার আগেই আরো কিছু বন্দুকধারী লোকজন তাকে ঘিরে ধরলো।
” রোশন প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি চেষ্টা করছি যতটা দ্রুত সম্ভব আপনাদের লোককে জেল থেকে বের করবো।”
ইকবাল হাত জোর করে যুবকের কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। আর তাতেই অন্য লোকজনগুলো হেসে উঠলো। মনে হচ্ছে কোনো জোক্স বললো ইকবাল। রোশন ঘাড় কাত করে মাথা চুলকে ডিরেক্ট ইকবালের কপালে পিস্তল ঠেকাল। চমকে উঠলো লোকটা। থরথর করে কাঁপতে লাগলো সে। রোশন হেসে বললো,
” সেই ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। তোর কী মনে হয় পুলিশ আমাদের লোক ধরে নিয়ে সব তথ্য জেনে যাবে আর আমরা শুধু তোর ভরসায় বসে থাকবো? আমাদের পেশাই এমন জান দিবো কিন্তু নিজেদের বিষয় মুখ খুলবো না। রাহাতও তাই করেছে। মারা গেছে রাহাত তবুও ওর মুখ খোলেনি। তুই ইচ্ছে করে আমাদের সাহায্য করিসনি। তাই তোকে তোর প্রাপ্য দিতে আমি নিজেই এসেছি আজ।”
ইকবাল বুঝতে পারছে আজ আর তার নিস্তার নেই। স্বয়ং ডাকাত সর্দারের ছেলে এসেছে তাকে খুন করতে। তবু অনুরোধ করতে থাকলো সে।
” রোশন আমাকে মারবেন না প্লিজ। আমি আপনাদের… ”
ইকবালের কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনে আঁতকে উঠেছে মেহেক। সিনথিয়া জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। কনের বসার জন্য উঁচু জায়গা তৈরি করা, তার নিচেই পড়ে গেছে মেয়েটা। সরাসরি মাথায় গুলি লাগায় বেশি সময় লাগেনি ইকবালের পরলোক গমন করতে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তার মৃত দেহ। রোশন ঘাড় কাত করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
” কাজ শেষ। তাড়াতাড়ি চল এখন। দিনে-দুপুরে এরকম রিস্ক আগে কখনো নেইনি। বাবা জানতে পারলে বকাবকি করবে।”
” ঠিক আছে রোশন ভাই, চলেন।”
সবার আগে আগে রোশন এগোতে লাগলো। একটএ এগোতেই দলের একজনের নজর পড়লো পাতলা পর্দার আড়ালে মেহেকের উপর। মাস্ক পরিহিত ডাকাদের নজর নিজের উপর পড়েছে বুঝতেই ঘোর কাটে মেহেকের। পাশে তাকিয়ে দেখে সিনথিয়া নেই। কোথায় গেছে ভাবার সময় পায় না।
” ভাই জামাইকে তো মেরে দিলেন। বউয়ের কী হবে? ”
রোশনকে উদ্দেশ্য করে বললো রকি। রোশন চলা বন্ধ না করেই বললো,
” পছন্দ হলে নিয়ে আয় কিন্তু তাড়াতাড়ি! ”
ভয়ে কেঁপে উঠল মেহেক। বিয়ে হলে তো মানসম্মান থাকতো কিন্তু এখন! শেষমেশ এই জানোয়ারদের ভোগের সামগ্রী হতে হবে তাকে? রকি রোশনের আদেশ পাওয়া মাত্রই দ্রুত গতিতে মেহেকের দিকে এগোলো। মেহেক পালানোর জন্য উল্টো দিকে দৌড় দিতে চাইলেই শেষ রক্ষা হয় না। রকি মেহেকের নাকে একটা রুমাল চেপে ধরতেই জ্ঞান হারায় সে।
” রকি চল চল আজ রাতে খেলা হবে হেহে….”
মেহেককে কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে ফয়সাল বিশ্রীভাবে হেসে বলে কথাটা। রকিও হাসিতে তাল মিলিয়ে দ্রুত পা চালায়।

চলবে,