নীলপদ্মগুলো পর্ব-০১

0
1

#নীলপদ্মগুলো – ১
আফসানা আশা

ওয়ান ফাইন মর্নিং রুবা আপুর প্রেমে পড়লাম। আহামরি কোনো ঘটনা ছিল না। অর্গানিক কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পার্টের প্রথম ক্লাস সেদিন। রুবা আপু ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিল। টিপটপ সাজে মনোযোগ টেনে নিচ্ছিল শুরু থেকেই৷ চুইংগাম চিবুনোর ফাঁকে ফাঁকে হাতে ধরা কলমটাকেও কামড়ে দিচ্ছিল। সুদূরে মরুর দেশে আফগানী কোনো কৃষকের আদর আর যত্নে ফলানো পাকা আনারদানা রঙের পুরু ঠোঁটটাকে মাঝেমাঝে বাঁকিয়ে মুখের একপাশে নিয়ে নিচ্ছিল। অপূর্ব সেই ভঙ্গিমা! অহংকারী আর উদ্ধত!

দর্পিত রাজহাঁসের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে ঠিক পেছনে বসা আমাকে বলল,

–তোদের সিআর কে? ওর নম্বরটা দে?

রুবা আপুর হালকা কাজলআঁকা চোখের ঘন পাঁপড়িগুলো ততক্ষণে একটা একটা করে আমার হৃদয়যন্ত্রটাকে বিঁধে ফেলেছে, ঠিক যেন কিউপিডের তীর ওরা একেকটা! নিশানায় গাঁথা হরিণশাবকের মতো যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে লাফাতে থাকা মনটাকে নিয়ে যান্ত্রিক গলায় টপাটপ ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভের ফোন নম্বরটা বলে দিলাম।

রুবা আপু তাকায়নি আমার দিকে৷ চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ঠোঁটে তাচ্ছিল্য ফুঁটিয়ে বলল,

–থ্যাংকিউ!

আমি কিছু মনে করলাম না৷ এরকম রূপবতীদের অন্য সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করাটাই নিয়ম!

কিন্তু নিয়ম-কানুন, সকাল-সন্ধের নিত্যকর্ম, এই দুনিয়াদারী আর দুনিয়াবি চাওয়া পাওয়া আমার কাছেও নগন্য হয়ে গেল৷

আমি চোখ খুললে হাজার তারার আতশবাজি দেখি, আর চোখের পাতা বুজলে রুবা আপুর মুখটা ভাসে!

আহত হৃদয়টাকে দুই হাতে চেপে ধরে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘাসের মাথা চিবুতে চিবুতে অনন্ত আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে বললাম,

–আই এম ইন লাভ!

দুপুরের রোদ গলে নরম বিকেল। ঘাসের ডগায় কণকরাঙা শেষ রোদ্দুর ঝিকিমিকি করছে। সাব্বির হাত পা ছড়িয়ে সবুজ ঘাসের গালিচায় শুয়েছিল। কণুইয়ে ভর দিয়ে আধাবসা হয়ে তাকাল আমার দিকে। চোখ দিয়ে ভ্রুকুটি করল,

–মামুর ব্যাটা, এই কাঠফাটা রোদে তোমার চোখে তো সত্যিই হিমালয় দেখা যাচ্ছে৷ কেসটা কে রে?

বিকেলবেলাতেই এদিকে গাছের তলা প্রায় অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। মশা এসে জুটতে শুরু করেছে। জিহান হাত দিয়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে আড়চোখে সন্ধিকে দেখাল। ওর চোখের জিজ্ঞাসার আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ সহজ। মেয়েটা সন্ধি কিনা জানতে চাইছে ও।

সাব্বির নিজের মাথায় চাপড় দিলো,

–আরে তাই তো! তোরা ফ্রেন্ডশিপের লাইন ক্রস করেছিস অবশেষে! অশেষ কৃতজ্ঞতা!

খানিকটা অভিনয় করে দেখাল সাব্বির,

–এপাশে থেকে একজন আসে, ‘এই, সন্ধি কই রে?’ ওপাশ থেকে আরেকজন কর্ণকুহরের পোকা নাড়িয়ে বলে ‘ওই, নাঈম আসেনি?’ লাইব্রেরিতে ফুসুরফাসুর, ক্লাসে উঁকিঝুঁকি, মাঠের ঘাস খোঁটাখুঁটি শেষ পর্যন্ত মন দেওয়া নেওয়াতে গেল তবে! পটাতে পারলি সর্দিরে?

জিহান বজ্জাতটাও সম্মতি দিলো,

–আর নয়তো কে! তিন বছর ধরে এমন ইমোশনাল ইনভেস্টমেন্ট কেউ খামাখা করে? তিন বছর ধরে এক ক্যান্টিনে খায়, একসাথে পরীক্ষার হলে ঢোকে, ঝগড়া করে, আবার রাত্তির তিনটায় সরি টরি না বলেই মেসেজ দেয়, ঘুমাইছিস? এটা যদি প্রেম না হয়, তাহলে প্রেম কী আবার! গাধা দুইটারে একসাথে না দেখলে আমারই তো দিনটা খালি খালি লাগে!

সন্ধি এতক্ষণ কিছু শোনেনি। কানে হেডফোন গুঁজে রেখেছিল। এককান খুলে দিয়ে হাত নাড়িয়ে জানতে চাইল,

–কী হয়েছে? তোদের চোখমুখ এরকম সিরিয়াস কেন? কোথায় কী হলো?

সাব্বির এবারে চড়টা সন্ধির মাথা বরাবর মারল,

–টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান! যা বলার বলা হয়ে গেছে। লেকচার আর ফিরিয়া আসিবে না! তুই লেট, সর্দি!

সন্ধি নাক সিঁটকালো,

–কেমিস্ট্রি না তোদের নাট্যশাস্ত্র পড়া উচিত ছিল! আর কতবার বলব, এই বিশ্রী নামে ডাকবি না আমাকে!

সাব্বির মুচকি হাসলো,

–নাটক আমরা করি না। নাটক করো তোমরা। তোমরা দুজনে। আমরা তো শুধু প্রেম ভালোবাসার ঘোষণা শুনে কিঞ্চিৎ টাসকান্বিত হয়ে পড়েছিলাম।

সন্ধি সারা কপালে ভাঁজ ফেলে, চশমার জোড়া কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে বলল,

–প্রেম? কার প্রেম? কে প্রেমে পড়ল?

এদের ঠাট্টা তামাশা থামবে না বুঝতে পেরেছি আমি। কোনো ভূমিকাতে না গিয়ে সোজা মূল বক্তব্য ধরতে চাইলাম। আমার হৃদয়ের মানচিত্র সম্পর্কে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। গতকাল রাত অবদি আমারও কোনো আইডয়া ছিল না। ওদের এলোমেলো পথে একটু দিকনির্দেশনা দিতেই হয় এখন৷

গলা খাঁকারি দিলাম বারদুয়েক। লজ্জা কাটাতে আগের চিবোনো ডগার ঘাসগুলো দাঁঁতে কাটতে কাটতে চোখ বুঝে বললাম,

–রুবা আপু!

সাব্বির আর জিহানের মুখ থমথমে হয়ে গেছে। ওদের চোখ দিয়ে অবিশ্বাস আর বিস্ময় উপচে পড়ছে।

সন্ধি আগের আলোচনা শোনেনি। সহজ কন্ঠে প্রশ্ন করল,

–রুবা আপু কী?

–আমি রুবা আপুর প্রেমে পড়েছি!

সাব্বির আর জিহানের দলে আরেকজন বাড়ল। স্তব্ধ হয়ে গেল সন্ধিও। কান থেকে হেডফোনটা খুলে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। চশমাটা খুলে ওড়না দিয়ে কাচগুলো মুছে নিলো। একটু সময় নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,

–রুবা!

সাব্বির স্থিতধী হয়েছে। চোখ গোল বানিয়ে বলল,

–ওই রুবা আপু? ফরেনারদের মতো চোখ? চুলের ঝুঁটিতে লাল রঙ করা? চকচকে লিপস্টিক? যখন হাঁটে ওর জন্য সবাই রাস্তা ফাঁকা করে দেয়, সেই রুবা? কটকট করে কথা বলে যে?

জিহানও সম্বিত পেয়েছে। সাব্বিরের কথার সাথে তাল দিয়ে বলল,

–কথা কই বলে? ঠাডা ফেলে কানের উপর!

–হুম, মাদাম রুবা! যে একবার তাকিয়ে হাসলেই ফার্স্টইয়ারের পোলাগুলাও মাথা ঘুরে উল্টাইয়া পড়িয়া থাকে!

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অবশেষে সঠিক রাস্তায় এসেছে বাঁদরগুলো। সম্মতি জানিয়ে বললাম,

–হ্যাঁ। রুবা আপু আসলেই ভীষণ সুন্দর!

আমার গলায় মুগ্ধতা ঝরে পড়ল! রুবা আপুর সৌন্দর্যের তুলনা আমি কীসের সাথে দেবো? শরতের ঝলমলে দুপুরের পুরো একটা আকাশ ও, সৌন্দর্যে আমার চোখদুটোকে ঝলসে দেয়! আমাকে অন্ধ করে দিতে চায়! কিংবা যেন কোনো এক তুর্কি রাজকন্যা, পথভুলে চলে এসেছে এইখানে, আমিও দুনিয়া ভুলে যাই! একবার ওই মুখে চোখ পড়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব! ফিনিক ফোটা জোৎস্না ও, শেষ চৈত্রে আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে! নইলে একটা পুরো বাগান ভরা আগুনে সূর্যমুখী ফুল!

কোমল গলায় বললাম,

–আই এম সিরিয়াসলি ইন লাভ!

সন্ধি বলল,

–রুবা আপু আমাদের সিনিয়র না?

এই কথাটা আমার পছন্দ হলো না। বিরক্তিভরা গলায় বললাম,

–তাতে কী? ভালোবাসার তো বয়স নাই! আর কতই বা বড়ো হবে? এসএসসি রেজিষ্ট্রেশনে আমার বয়স কমানো আছে। আসল বয়স এক বছর বেশি। ওর সমানই হব। একাডেমিক সেশনে এক বছর পিছিয়ে আছি শুধু! এখন এসব বয়সের গরমিল কেউ মানে? কোন ক্ষেত-ভুঁইয়ের বেগুন চাষ বাদ দিয়ে উঠে এলি তুই?

সাব্বির অত্যন্ত আশাহত হয়েছে মনে হলো। উদাদ হবার ভঙ্গিতে বলল,

–একে বলে সাকসেসফুল ব্রেইনওয়াশ। শুরুতে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে পটাতে সিনিয়র ভাইয়েরা বলত, এখন নাঈম বলছে!

জিহান আমার কাঁধে হাত রাখল,

–ভাইজান অলরেডি প্রেমে আহত। আমরা আর না মারি।

সন্ধির গলা একটু বিচ্ছিন্ন। একটা ছোটো নি:শ্বাস ফেলে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল,

–রুবা আপু দারুণ সুন্দরী। গুড চয়েস!

আমিও ঠাট্টা করে বললাম,

–নইলে আমার সাথে মানায় বল? যে কেউ কি এই বান্দা নাঈমের গফ হতে পারে? এমন বিদঘুটে শ্বাস ফেলার কী আছে তাতে?

সন্ধি আমার প্রশ্নগুলো খেয়াল করল না কিংবা থোড়াই কেয়ার করল। চোখ মটকে তরল গলায় বলল,

–আমার কি তোর নামে কেস করা উচিত? ইমোশনাল চিটিং কেস কি অডাল্টারির মধ্যে পড়ে? তিন বছর সংসার করলি আমার সাথে আর মন দিলি রুবারে! কী বলিস তোরা, এইটা এক্সট্রাম্যারিটাল এফেয়ার না?

হাসলাম সবাই গলা খুলে। বিকেলের ফাঁক পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে!

সন্ধির কোলে মাথা দিয়ে উদাস গলায় বললাম,

–দিয়ে দে কেস? এমনিতেও আমার দেবদাস অবস্থা। হয় জেলে যাব নই মাল খেয়ে আউট হয়ে থাকব! দেখ, হাফডেড হয়ে পড়ে আছি!

–ডেড হবি কেন? প্রপোজ করে ফেল?

–কীভাবে? যদি চড় থাপ্পড় মেরে বসে?

–মারলে মারবে! কোমল হাতের চড় খেতে ভালো লাগারই কথা। তাতেও প্রিয়তমার স্পর্শ ছুঁয়ে যাবে তোকে!

তারাবাতি জ্বলে উঠল মাথায়। মাথা নাড়লাম,

–একচুয়ালিই তুই আমার সোউলমেট! আমার মনের কথা সব বুঝে যাস! আমার কী দরকার, কখন কী করা উচিত একটা রুটিন বানিয়ে পিডিএফ করে দিস সময় করে! প্রিন্ট করে ঘরের দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেবো! কী করে আমাকে এত ভালো বুঝিস, সিক্রেটটা বল তো! তুই একটু সুন্দরী হলে মনে হয় তোকেই ভালোবাসতাম!

সন্ধি হাসলো,

–ভালোবাসা সুন্দরতম অনুভূতির নাম। অনেকেই এই অনুভূতিকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। ভুল করে ফেলে!

–আরে তুই তো দার্শনিক হয়ে গেলি! ভালোই হলো, আমি হব দেবদাস আর তুই এরিস্টটল! তোর হলো গতি আমার হলো অগতি!

দুয়েক সপ্তাহ অকারণ কেটে গেল। ক্লাস মিস দিয়ে ফাইনাল ইয়ারের রুটিন মুখস্থ করলাম। লাইব্রেরিতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে রুবা আপুকে দেখতে চেষ্টা করলাম। ওর সবুজাভ বাদামি চোখের মণিতে চোখ পড়লেই আমার হৃদয়জুড়ে তোলপাড় করা ঝড় তৈরি হলো। সন্ধিকে বাসায় পৌঁছে দিতে দিতে অহেতুক হুহু করে কাঁদলাম!

তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!

ল্যাবরেটরিতে মুখোমুখি হয়ে গেলাম। অর্গানিক কেমিস্ট্রির প্রাকটিক্যাল ক্লাস পড়েছে ল্যাব দুইতে। রুবা আপুর রিটেক আছে এই কোর্সের।

সবাই শুকনো মুখ করে ঘষঘষ করে রিএকশনের রিপোর্ট লিখছে। কেউ ল্যাব এসিট্যান্টকে গালি দিচ্ছে – কিছু হিন্ট না দিয়েই মডেল টেস্ট দিয়ে দেওয়াতে।

এলকিন, এলকেন যৌগ আর ব্রোমিডের কালার রিএকশন আমার মাথা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আমি উদভ্রান্ত পথিকের মতো রাস্তা ভুল করে রুবা আপুর সামনে এসে পড়লাম। ল্যাবকোট, মুখে সেফটি মাস্ক আর সেফটি চশমা পরা একগাদা মানুষের একটা কাউকেও আমি দেখতে পেলাম না। এই পৃথিবীতে সত্যিই যেন কেউ নেই!

না থাকলেই ভালো। এই গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শুধু রুবা আপুই শুনুক। বাকি পৃথিবীটা বয়রা হয়ে যাক। ল্যাবজুড়ে এসিডের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে আমার ঘোর আরও খানিকটা গাঢ় হয়েছে।

ফ্যাসফেসে গলায় শব্দ হলো না। রুবা আপুর ডেস্কের উপর আঙুল দিয়ে টুকটুক করে শব্দ তুললাম। রুবা আপু তাকাল না। নাকের নিচে রাখা টেস্টটিউবটাকে স্ট্যান্ড দিয়ে ধরে হালকা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

–এলকিনে ব্রোমিনের লাল রঙ ডিসএপেয়ার হওয়ার কথা না? কই, এ ব্যাটা তো টুকটুক করছে। এরে লাল বউ হতে বলেছে কে? যা ব্যাটা, তাড়াতাড়ি বিধবা হ!

কী ভয়ংকর কঠিন কথা! প্রেম না জমতেই বিধবা হওয়ার আশা! আমি ঢোঁক গিলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। সময় চলে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা আমার সাথে শত্রুতা করে দ্বিগুণ কিংবা চারগুণ বেশি গতিতে দৌঁড়াচ্ছে। হৃদয়টাকে খামচে ধরে বললাম,

–একটা কথা বলব।

রুবা আপু তাকাল,

–তোদেরটার রিএকশন শুরু হয়েছে? কালার পাল্টেছে?

শিরদাঁড়া টানটান করে রুবা আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে বোমটা ফাটিয়ে দিলাম। তার আগে শুকনো গলায় বললাম,

–রিএকশন না! অন্য কথা।

–তাহলে কী?

–আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ, রুবা!

ইংরেজি ভাষার সার্বজনীনতার কারণ বুঝলাম এইমাত্র। আপনি তুমির ঝামেলা নেই ওদের। আপনি সম্বোধন করে প্রপোজ করলে সেটা শুনতে বিতিকিচ্ছিরি হতো! রুবা আপু সেফটি চশমা খুলে ফেলল। ওর চোখে বিরক্তি আর কৌতুহল।

কোনো নাম না জানা অচঞ্চল আর অগভীর নদীর মতো ইষৎ ঢেউখেলানো চুল ওর। তার কয়েকগাছি লালে রঙে রাঙানো। মাখনের মতো পেলব ত্বকে রঙিন চুলগুলো খুব মানিয়ে যায়। তবে ওরা বড্ড অস্থির। লাফিয়ে নেমে কপাল চুইয়ে ওর বাদামি রঙের চোখদুটোকে ঢেকে ফেলতে চায়। অবাধ্য চুলের গোছাকে আচ্ছা করে ধরে কানের পাশে পাঠিয়ে দিতে দিতে ও বলল ,

–কী বললি?

আমার পৃথিবী দ্রুত তাপমাত্রা হারাচ্ছে। শীতলীকরণ বিক্রিয়া শুরু হয়ে সাম্যাবস্থা পার করে শেষের দিকে যাচ্ছে। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে জমে যেতে চাইছে। মাথার ভেতর থেকে কেউ একজন বলল, সময় কম, নাঈম। সময় কম।

আমি জোর করে গলায় শব্দ আনলাম,

–আমি তোমাকে ভালোবাসি!

বেশি আস্তে বলে ফেললাম কি? ল্যাবের মধ্যে অন্য কেউ শুনল কিনা জানি না, রুবা আপুর কানেও কি ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারল? বুঝতে পারছি না কিছু। আমার কানে আমার হৃদস্পন্দনই যে ঢাকঢোল হয়ে বাজছে!

রুবা আপু টেস্টটিউবটা স্ট্যান্ডে রেখে হাতের গ্লাভস খুলে পাশে রাখল। স্থির হয়ে তাকাল আমার দিকে। কাটাকাটা করে বলল,

–তুই সতের ব্যাচের না? নাঈম?

আমি মানুষটা কোনো তলব ছাড়াই এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছি। অন্য কেউ একজন যেন আমার কন্ঠ ধার করে বলল,

–মাত্র এক ব্যাচ জুনিয়র!

–সন্ধি না তোদের ব্যাচের? ফার্স্ট ইয়ার থেকে তোদের দুটোকে একসাথে ঘুরতে দেখি। আমি তো জানতাম তোদের মধ্যে রিলেশন আছে। ব্রেকআপ হইছে নাকি? ও জানে তুই আমাকে প্রপোজ করবি?

আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

রুবা আপু চুলগুলোকে ধরে রিবন পেচাতে পেচাতে পনিটেল বেঁধে বলল,

–শোন, আমি তো আর তোর গার্জিয়ান না! তুই পড়াশোনা করবি নাকি প্রেম করবি সেটা আমি বলে দেওয়ার কেউ না। শুধু একটা কথা, ভুলেও কাউকে বলবি না, ল্যাবে কেমিক্যাল রিএকশনের মধ্যে তুই আমাকে প্রপোজ করেছিস। সন্ধির বয়ফ্রেন্ড আমাকে প্রপোজ করবে এটা হজম করতে আমার খানিকটা সময় লাগবে। তারপর ভাবব, তোর প্রপোজাল একসেপ্ট করা যায় কিনা! এখন ভাগ সামনে থেকে। নইলে সবার সামনে চড় থাপ্পড় খেয়ে বসবি। ইন্দুর মেরে আমি নিজের নামে স্ক্যান্ডাল ছড়াতে চাই না!

নাকের নিচে বুদবুদ করতে থাকা নানান এসিড আর মাথার ভেতর থার্মাইট রিএকশনের নি:শব্দ বিস্ফোরণ নিয়ে ডেস্কে ফিরলাম আমি। হেঁটে এসেছি নাকি উড়ে সেটা বোধগম্য হয়নি। টের পাইনি কিছুই।

সন্ধি আমার দিকে না তাকিয়েই নিজের কাজ করতে করতে বলল,

–কোর্সে ফেইল করবি! প্রেম আর রিএকশন দুটোই ফসকে গেছে!

জিহান ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল। আমাকে অভয় দিয়ে বলল,

–একচুয়ালি প্রেমে ফেল করা লোকেরা পরেরবার টপ করে!

সাব্বির ফিক করে হেসে উঠল,

–হ্যাঁ, যদি সেটা বায়োলজি প্রাকটিক্যাল হয়!

আমি কাঠকাঠ হয়ে সন্ধিকে তিরস্কার করলাম,

–তুই আর কখনো আমার আশেপাশে আসবি না। আমার সাথে কথা বলবি না। তোকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া দারোয়ানের চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম।

সন্ধি হঠাৎ বুঝতে পারেনি আমার বক্তব্যের শানে নুজুল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

–মানে?

–মানে কী? দাঁতে দাঁত ঘষলাম আমি। কিড়িমিড়ি করে বললাম,

–সবাই যেটা ভাবে রুবাও সেটা ভেবেছে। মনে করেছে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড। ওর ভুল ভাঙাতে হবে! তোর সাথে চলব না আর। নো কথাবার্তা। তোর কোনো হেল্প আমার লাগবে না আর কখনো। নোটফোট দিতে হবে না। পাশ করব কী ফেইল নিজের চেষ্টায় করব। তোকে মাতব্বরি করতে হবে না!

সন্ধি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

ল্যাবের ঘটনার পরে ভার্সিটিতে গেলাম না দুইদিন। হাওয়া গুণি বাতাস খাই৷ চোখ খুললেই হিন্দি সিরিয়ালের মতো এপিসোড রিক্যাপ হয় – রুবা আপু চোখ থেকে সেফটি গ্লাস নামিয়ে নিষ্ঠুর চোখে তাকিয়ে বলছে – সন্ধির বয়ফ্রেন্ড আমাকে প্রপোজ করেছে এটা হজম করতে আমার খানিকটা সময় লাগবে!

আমি ভয় পেয়ে কষে চোখ বন্ধ করে ফেলি। সব বাদ দিয়ে নেটফ্লিক্সের পর্দায়ও উদয় হয় রুবা। চুলের ভেতর হাত দিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে তার উচ্ছ্বসিত হাসি দেখি!

ইনকোর্সের ডেট পড়ে গেছে, সাব্বির মেসেজ দিয়েছে৷ যে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটে সূর্যমুখীর মতো উজ্জ্বল প্রেয়সী আমার, সেই ঘাসের চেরা ডগাগুলোও ডাকল আমাকে।

দুপুর নাগাদ চুপিচুপি মাঠের এক কোণে গিয়ে বসে রইলাম। সন্ধি এখানেও আমাকে খুঁজে বের করে ফেলল। হাতের লাল ফোল্ডারটা দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মেরে বলল,

–ভালোই তো নাটক জানিস! প্রফেশনালরা ফেইল। চেহারাসুরতও ভালোই আছে। অপূর্ব, নিশোকে টেক্কা দিতে পারবি। লাইনে নেমে যা!

আমি সরি বলতে চাইলাম। কিন্তু অনভ্যস্ততায় গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। সন্ধি এবারে আমার মনের কথা বুঝতে অক্ষম হলো। আমার মতোই পা গুটিয়ে বসে পড়ল পাশে। বলল,

–শোন, এমন ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি৷ রুবা আপু ভাববে বলেছে। একেবারে রিজেক্ট করে দেয়নি তো! আর আমি খোঁজ নিয়েছি। ওদের ব্যাচের রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় আছে। লাস্ট ইয়ার বাইশে শ্রাবণের প্রগ্রামে স্টেজ প্রেজেন্টেশনের জন্য কল করেছিল। ও নিজেও ছায়ানটের ছাত্র, রুবা আপুও। আবৃত্তি নিয়ে কয়েকদিন কথা হয়েছিল রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে। ক্যাজুয়াল ওয়েতেই রুবা আপুর কথা জানতে চেয়েছিলাম৷ ও কোনো রিলেশনশিপে নেই। তোর এখনো চান্স আছে৷

–সন্ধি শোন, আমি সেইদিন…

–বলতে হবে না। আমি জানি তুই মিন করে কিছু বলিসনি। আমিও ওসব ধরে রাখিনি, দেখতে পাচ্ছিস না?

সন্ধি কাঁধ নাচাল৷ এই মেয়েটা এত ভালো! আমার চোখে পানি এসে গেল। বললাম,

–আজকে তো ক্লাস নেই? বাসায় ফিরবি? চল?

–উহু! সাব্বির আর আমি একটু চাঁদনিচকে যাব। ইনকোর্সের আগে সাব্বির বাড়ি যাবে। আন্টি আর সোমার জন্য জামাটামা কী কী কিনবে।

–চল যাই? তোরা ফকিন্নি দুইটার কাছে রিকশাভাড়া আছে? সেই আমার বাইকের তেলই পোড়ানোর ধান্ধা!

সন্ধি হাসলো। উঠে যেতে যেতে আমার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল,

–তুই রুবা আপুর দিকে কনসেন্ট্রেট কর। লেগে থাক। পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি, বুঝেছ বৎস?

পরের কিছুদিন আমি রুবার আগেপিছে ঘুরতে থাকলাম। ওকে বাইকে করে বাসায় আনা-নেওয়ার চাকরিটা নিলাম। ল্যাবরিপোর্টে ভারী হওয়া ব্যাগ টানলাম। নতুন হেয়ারকাট আর লিপস্টিক শেডের ভূয়সী প্রশংসায় মাতলাম। এদিক দিয়ে পরীক্ষা এসে চলেও গেল।

বর্ষা নামল প্রকৃতিজুড়ে।

রবীন্দ্র নজরুল জন্মজয়ন্তীতে সেজে উঠেছে ক্যাম্পাস। রুবা নৃত্যনাট্য রক্তকরবীতে কন্ঠ দেবে। স্টেজে নাচবে যে সেও নন্দিনী সেজেছে, রুবাও হাতে মাথায় ফুলের গয়নায় নন্দিনী সেজেছে। আমি অপলক তাকিয়ে দেখছি রূপসী সূর্যমুখীকে। নাটকের পর্দা ওঠার আগে স্টেজে উঠবে সঞ্চালকরা। এবারের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে সন্ধি। সবখানেই ও নিবেদিত প্রাণ। পরীক্ষাতেও সিরিয়াস, উপস্থাপনাতেও। খেয়ে না খেয়ে রিহার্সাল করেছে। অনেকদিন ধরেই ভীষণ ব্যস্ত ও।

ব্যস্ত!

চিরকাল টিউবলাইট ছিলাম আমি। এখন মাথার ভেতর হাজার ওয়াটের সার্চলাইটটা জ্বলে উঠল৷

রুবার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধির মেকি ব্যস্ততা আর আমার সাথে দূরত্ব তৈরির এই সঙ্গীন চেষ্টাটা আমার খেয়ালেই আসেনি। কী মিথ্যুক এই সন্ধি! মুখে ঠিকই বলেছিল, আমার রাগের মাথায় বলে ফেলা কটুক্তিতে কিছু মনে করেনি। কিন্তু মনে মনে বিশাল মাইন্ড খেয়ে বসে আছে! এই সেই নানান অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে গিয়েছে। আর আমি ভেবেছি সিরিয়াস ছাত্রী পরীক্ষা নিয়ে মহাব্যস্ত! কতদিন কথা হয়নি আমাদের, কতদিন দেখা হয়নি কিংবা আমি খেয়াল করিনি! কতদিন একটা মেসেজ দেয়নি ও, কতদিন আমার ফোন রিসিভ করেনি! ইনকোর্স পরীক্ষার আগেও আমাকে পড়তে বলে বিরক্ত করেনি। নোট দেয়নি। পরীক্ষার হলে আলাদা সিট পড়েছিল নাকি ও সিট বদলে নিয়েছিল, কে জানে!

শালীর ঘরের শালী!

ওকে তো ছাড়ব না!

সন্ধিকে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম ব্যাকস্টেজে। গোলগাল মুখের ছোটোখাটো আয়তনের মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে মনে হলো, সত্যিই কতদিন দেখিনি ওকে! অথবা চোখের সামনেই ছিল ও, আমিই এড়িয়ে চলেছি! কিংবা ও পাশ কেটে চলে গেছে! হাত নেড়ে ডাকলাম। ও দেখল না। পাশে রিদওয়ান ভাই। দুজনে স্টেজে উঠবে বলে অপেক্ষা করছে। রিদওয়ান ভাই ওর কপালে ছোটো একটা টিপ গেঁথে দিলেন। হয়তো বাঁকা হয়েছিল টিপটা, সোজা করে দিলেন। এর আগে আমিও বহুবার ওর কপালের টিপ ঠিক জায়গায় এনে দিয়েছি। একদম আমার সেই নিজস্ব দায়িত্বটা এখন অন্য একজনের! টিপ পরানো শেষে ওর কপালে একটা টোকা দিয়ে হেসে উঠলেন রিদওয়ান ভাই। সন্ধিও হেসে ফেলল।

অনেকদিন ধরে সুর কেটে যাওয়া ছেঁড়া সুতোর উৎসটা খুঁজে পেলাম আমি!

সন্ধি কোথাও বদলায়নি। সেই একঢাল কালো চুলে কোমর ছাপানো। সেই চশমার পেছনে উদগ্রীব চোখ। শ্যামলা গালে টোল ফেলা মৃদু হাসি। শান্ত কিন্তু উচ্ছ্বসিত মুখচ্ছবি! একঘেয়ে জামা ওড়না ছেড়ে আজকে উৎসবের আটপৌরে সুতি শাড়ির সাজ। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেলাম, একটা টিপে কী দারুণ বদলে গেল মেয়েটা! সন্ধি থেকে নারী হয়ে উঠল। নাকি পরী, আমি জানি না! আমার হতবিহ্বল লাগল। কোথায় যেন কী একটা নেই! কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। কী একটা মিলছে না! আমার মন বলছে, কী একটা খুব ভুল হয়ে যাচ্ছে!

ফেলে আসা স্মৃতির পাতা থেকে আমার সমস্ত নরম বিকেল আর মেঘমেদুর সন্ধেগুলো বেমালুম হারিয়ে গেছে মনে হলো।

তীব্র উত্তেজনার পাশে ফিকে হয়ে আসছে শিশিরভেজা ভোরের মিঠে আলোড়ন!

গোলাপের কড়া সুগন্ধির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে ঝরা বকুল আর বাসি শিউলির সুবাস!

চর্চিত অপেরার সুরেলা মূর্ছনায় তাল মেলাতে না পেরে খালি গলায় গাওয়া সব গানেরা চুপিচুপি নির্বাক হয়ে যেতে চাইছে।

সোডিয়াম বাতির ঝলকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে নির্ঘুম প্যাঁচার দলটাকে সাথে নিয়ে নিভে যেতে চাইছে আমার গত হওয়া নিশুতি রাত্রিগুলোর অগণিত তারার মালা!

সাব্বির আর জিহানকে খুঁজে বের করলাম। জানতে চাইলাম,

–এসব কবে থেকে?

সাব্বির ফ্যাফ্যা করে হাসলো,

–ওই কানিভাঙা রেডিও ওয়ান আর সর্দির প্রেমটা? তুমি কি এতদিন কানা ছিলা মামুর ব্যাটা? নাকি আসহাবে কাহাফের গুহা থেকে টপকাইলা? ওরা তো এখন ক্যাম্পাসের মোস্ট হট এন্ড হ্যাপেনিং কাপল!

জিহান বলল,

–দুজনকে দারুণ লাগে, তাই না? পারফেক্ট ম্যাচ! রিদওয়ান ভাইয়ের কন্ঠে তো ম্যাজিক আছে! গমগম করে গলা। সন্ধির মিষ্টি গলাটা তাকে কমপ্লিমেন্ট দেয়!

আমি আর কিছু শুনতে পারলাম না। শব্দগুলো এসে পৌঁছাল না আমার কাছে, গুজরে গুজরে বদ্ধ বাতাসে মিলিয়ে গেল সব কথারা। বুকের ভেতরটা কেমন গুম গুম করছে। যেন মাথার মধ্যে কেউ এক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। এরকমটা তো আগে হয়নি! এরকম করে বুক থরথর করে কাঁপেনি তো কখনো! এরকম হুতাশনে মাথার ভেতরটা অবিশ্রাম ফাঁকা হয়ে যায়নি কোনো কালেও! বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এভাবে থমকে দাঁড়ায়নি কভু! কষ্ট, দু:খ তো কত এলো গেল জীবনে, এতটা বিষাদ তো কোনোদিন ছোঁয়নি আমাকে!

আশ্চর্য, আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে?

কতখানি কষ্ট পেলে তাকে যন্ত্রণা কয় লোকে?

সাব্বির আর জিহানের হাসি, অডিটোরিয়ামের কোলাহল, লাইটের ঝলকানি—সবকিছু যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, সন্ধির মতো!

সন্ধি আর রিদওয়ান ভাই?

কীভাবে আর কেন?

আমি সরে এলাম। পেছনে তাকাতে সাহস পেলাম না। অজানা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলাম। একবার মনে হলো, সন্ধি বুঝি পেছন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। আবার তাকালাম। না, সন্ধি তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। ডায়াসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিচ্ছে! উপস্থাপনে সাবলীলতা আনতে রিদওয়ানের দিকেও এক পলক তাকাল। দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। মৃদু হাসি দুজনের ঠোঁটে!

আমি বেরিয়ে এলাম।

ঝুম বৃষ্টির গন্ধে ভিজে যাচ্ছে চারদিক।

পেছনে থেকে মাইকে সন্ধির গলা ভেসে এলো—

“নৃত্যনাট্য রক্তকরবী এখন মঞ্চে আসছে…”

তালি পড়ছে। শিস। উল্লাস।

আমি দাঁড়িয়ে আছি অডিটোরিয়ামের পেছনের করিডরে। ঠোঁটের কোণায় সিগারেটের তৃষ্ণাবোধ করছি মনে হলো। ফিল্টারে আগুন দিয়ে বুঝলাম, নিকোটিনে এই জ্বালা মিটবে না। বুকভরা অন্য কীসের যেন পিপাসা, বুঝতে পারছি আবার ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছি না!

দ্রুতপায়ে হেঁটে এলো জিহান। আমার কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইল,

–কই যাস?

–ভাল্লাগছে না!

–রুবা আপুর গান আছে না? থাকবি না?

–ভাল্লাগছে না৷ বললাম না?

—তুই ঠিক আছিস তো?

আমি হেসে ফেললাম। ভেতরের চৌচির হওয়া বুকের রক্তক্ষরণ দৃশ্যমান করতে চাইলাম না। বললাম,

–আমি? আমার আবার কী হয়েছে? আমি একদম পারফেক্ট আছি। তুই যা, এঞ্জয় কর? সন্ধি উপস্থাপনা করছে, ওকে চিয়ার আপ করগে…

জিহান মুখ গম্ভীর করে বলল। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখল। তারপর যেন বলতে চাইল না কিছু। ইতস্তত করল। কিন্তু বলেই ফেলল,

–তুই দেরি করে ফেলেছিস, নাঈম। নাটক জমে গেছে, গল্প টানটান, দর্শক বুঁদ, অভিনেতারা অনবদ্য। সবাই সুখী সমাপ্তির অপেক্ষায় উত্তেজিত! নাথিং ইজ মিসিং হিয়ার! তুই একেবারে থার্ড অ্যাক্টের মাঝপথে এসে বলছিস, ‘আমি এই নাটকে আরও ভালো অভিনয় করতে পারতাম!’

আমার গলা রুদ্ধ হয়ে আছে। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে। অমৃতের তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে অথচ অঞ্জলিতে সে জিনিস খানিকটা শুধু আমার ঠোঁটছোঁয়ানো চুমুকের অপেক্ষাতে ছিল! যে শুধু আমার ছিল, নিদারুণ অবহেলায় সেই অযাচিত অর্ঘ্য আমি উপুড় করে দিয়েছি অন্যের পায়ে! এখন কোন মুখে ফিরে চাওয়ার স্পর্ধা করি?

ধরা গলায় বললাম,

–তোরা জানতিস?

জিহান মাথা নাড়ল,

–আমরা সবাই জানতাম! শুধু তুই জানতি না, সন্ধি তোর কতখানি! ওকে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে দেখে তোর সহ্য হবে না, এটা আমাদের জানাই ছিল!

–আমাকে কখনো বলিসনি কেন? সতর্ক করে দিসনি তো! তোরা না বন্ধু আমার? আমার এত বড়ো সর্বনাশটা কীভাবে করলি?

জিহান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কন্ঠে কিছুটা রোষ,

— জীবনটাকে কি তোর একটা নাটক মনে হয় রে?, প্রোম্পটার বলে আছে কেউ কোথাও? এখানে প্রতি পদক্ষেপ শিখিয়ে দেয় কেউ? না। আমরা কেউ কাউকে কিছু শিখিয়ে দিতে পারি না। কেউ কাউকে কিছু বলে দিতে পারি না! আর যদি বলেও দিতাম, তাতে কি কিছু বদলাত, নাঈম? ধর তখন যদি বলতাম, তুই রুবা আপুকে না আমাদের সন্ধিকে ভালোবাসিস। তুই কি সেটা মেনে নিতি?

আমি চুপ করে রইলাম।

জিহান এবার নরম গলায় বলল,

–চল, ভেতরে যাই। রুবা আপু তোকে খুঁজছিল। ওর ব্যাগ নাকি তোর কাছে।

আমি হেসে মাথা নাড়লাম,

–ব্যাগটা নিয়ে যেতে পারবি? করে দে না এই কাজটা! আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজব।

জিহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, তারপর রুবার ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল।

আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে খুলে দেখলাম পুরোনো একটা মেসেজ। সন্ধির কাছ থেকে শেষ মেসেজ। ইনকোর্সের রুটিন দিয়েছে জানিয়ে মেসেজটাই ওর কাছ থেকে আসা শেষ মেসেজ ছিল। সরি বলেছিল। সাথে লিখেছিল,

“আমি কিন্তু তোর কথাগুলো মন থেকে নিইনি…”

আমি তখন সিনিক্যাল হয়ে রিপ্লাই দিইনি।

তখন যদি একটা ইমোজিও দিতাম! নিদেনপক্ষে একটা স্যরি বলতে পারতাম!

সেদিনের সেই নীরবতা আজকে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে!

আফসোসগুলোকে যত্ন করে বুকপকেটে তুলে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

দুনিয়ার লোকে ঠিক বলে, বর্ষাধারা আর চোখের জলের কোনো পার্থক্য করা যায় না!

চলবে…