#নীলপদ্মগুলো – ২
আমাকে কাপুরুষ বলা যেতে পারে কিংবা ভীরু। সবসময়ের মতোই আজও আমি পালালাম। পলাতক বলাই যায় তাতে আমার রাগ করা সাজে না!
কী করব, কাকে কী বলব আর কীভাবে বলব এই মানসিক অস্থিরতা আর দৈন্যতা নিয়ে সেই মূহুর্তে সন্ধি কিংবা রুবা কারোরই মুখোমুখি হবার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না।
কয়েকটা দিন শুধু নিজের সাথে কাটালাম। নিজের সাথে নিজের একটা বোঝাপড়া!
দিন সাতেক পরে রুবার সাথে দেখা করলাম সবার আগে। নিজের দীনহীন দশা দেখিয়ে করুণা পাওয়ার প্রত্যাশায় সবকিছু খুলে বললাম। আর যোগ করলাম সেই বহুল-চর্চিত শব্দটা,
–রুবা আপু, সরি!
রুবা আমার মুখের দিকে তাকাল ক্ষণিক, তারপর বলল,
–ডোন্ট সে সরি। আসলে তুই দু:খিত না মোটেও। তোকে দেখে উচ্ছ্বসিত মনে হচ্ছে। হারানো কিছু ফিরে পাওয়ায় ভীষণ আনন্দিত!
–হালকা লাগছে। নিজেকে ফিরে পেয়েছি! তবে তোমার সাথে অন্যায় করেছি সেজন্য সত্যি আমি লজ্জিত! নিজের মন না বুঝে এতদিন তোমাকে বিরক্ত করেই গিয়েছি। তোমার অনুভূতি জাগাতে চেয়েছি, যেখানে আমি নিজেই নিজের অনুভূতির পরিচয় জানতাম না। তুমি যদি আমার প্রতি সামান্য উইক হও…
রুবা আপুর সব অঙ্গভঙ্গিই দর্পিত রাজহাঁসের মতো রাজকীয়। আঙুলটাকে অহংকারী স্পর্ধায় আমার চোখের সামনে নাড়িয়ে বলল,
–তোর একটা পরীক্ষা নিই, দাঁড়া! বল তো পিরিওড টেবিলের আঠারো নম্বর গ্রুপে কারা আছে?
এ তো বাচ্চাদের রসায়ন। বললাম,
–নিষ্ক্রিয় গ্যাস। হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, জেনন, রেডন! কেন? এই প্রশ্ন কেন?
রুবা আপু মুখ বাঁকাল,
–হুম! এদেরকে নিষ্ক্রিয় কেন বলে?
–এরা কেমিক্যাল রিএকশনে পার্টিসিপেট করে না তাই!
আমি অবাক হচ্ছি রুবা আপুর অসংলগ্ন ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে। তবুও উত্তর দিয়ে গেলাম। ওকে কষ্ট দিতে চাই না।
ও আবার প্রশ্ন করল,
–উহু, কেন করে না সেটা বল? বইয়ের ভাষায় বলতে হবে না। সহজে বুঝা।
–আউটার শেলে যতটা ইলেকট্রন থাকতে পারে সবগুলো পরিপূর্ণ থাকে বলে ইলেক্ট্রন দেওয়া বা নেওয়া কোনোটারই টেন্ডেন্সি থাকে না এই মৌলগুলোর। ওরা আর ইলেকট্রন দেয় না কাউকে, কারো থেকে নিতেও পারে না। এজন্যই ওরা সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় বিক্রিয়া করতে চায় না। এদেরকে অন্য মৌলের কাছাকাছি হাজারবছর রেখে দিলেও কেমিক্যাল রিএকশন ঘটবে না৷ অপরিবর্তিত থাকবে৷
–এক্সাক্টলি! অরবিটাল পরিপূর্ণ হয়ে গেলে অন্য সব মৌলিক পদার্থও গ্রুপ আঠারোর মতো আচরণ করে। পেয়ার বা অক্টেট ফিল হয়ে গেলে ওরাও আর ইলেকট্রন দেয় না, নিতেও পারে না। অর্থাৎ বিক্রিয়া করে না, নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তোর ইলেকট্রন তুই অনেক আগেই সন্ধিকে দিয়ে দিয়েছিলি। আমাকে দেওয়ার মতো কিছু তোর ছিল না। আমি শুধু সুন্দরী না। বুদ্ধিমতিও। তোর চোখে আমি আমার সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতাই দেখেছি শুধু, প্রেম দেখিনি কখনো। তুই যখন মুখ খুলেছিস, শত শত স্তুতিবাণী ঝরেছে, তাতে ভালোবাসা পাইনি। আমি তোকে ভালোবাসিটাসিনি কখনোই। তাই আমাকে ডাম্প করছিস এটা ভেবে স্যাড হওয়ার দরকার নেই। লেট ইট গো! আমিও তোকে ইউজ করেছি।
রুবা হাসলো,
–তোর বাইক সার্ভিস আমার পছন্দের! এখন কি এটা বন্ধ হয়ে যাবে?
–উহু! তুমি যখন ডাকবে এসে যাব!
রুবা মুখ বাঁকাল,
–কিন্তু এতদিন না ডাকলেও এসে যেতিস। আই থিংক, আই উইল মিস ইউ! কিন্তু একটা ব্যাপার৷ আই ডেয়ার ইউ, আমাকে আপু বলা যাবে না। এতদিন রুবা বলতি, সেটাই বলবি। না হলে ডাকবিই না। ওকে?
আমি মাথা নাড়লাম। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছিলাম। রুবাই ডাকল,
–তোকে তখন ইলেকট্রন দেওয়া-নেওয়ার সায়েন্টিফিক এনালজি দেখালাম না, সাহিত্যে একটা চমৎকার উদাহরণ টেনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমুর হাতে কয়েকটা নীলপদ্ম বইতে। আমাদের সবার কাছেই কয়েকটি নীলপদ্ম থাকে। এটা এমন না যে নীলপদ্মই। গোলাপও হতে পারে। যাস্ট ইমাজিন কর, নীলপদ্ম। কয়টা? ধর পাঁচটা। একবার কাউকে নীলপদ্ম দিয়ে দিলে আমরা নি:স্ব হয়ে যাই। অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারি না। তোরগুলো তো সন্ধিকে দিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু সন্ধির নীলপদ্মগুলো যদি রিদওয়ানের কাছে থাকে, তাহলে তুই বেকুব কী করবি?
হতাশা ভর করল আমাকে। গত কয়েকদিনে হাজারবার, লক্ষবার ভেবেছি এটা। উত্তর পাইনি।
রুবা বলল,
–রিদওয়ান আর সন্ধি তো সিরিয়াসলি রিলেশনে আছে। ক্যাম্পাসে সবাই জানে। এটার কী হবে?
–তুমি কি একটু রিদওয়ান ভাইকে বলে দেবে? প্লিজ?
–একটা লাইফ হ্যাক শুনে রাখ। সুন্দরী মেয়েদের বন্ধু হয় না। আমি রিদওয়ানের সাথে অতটা ক্লোজও নই! একচুয়ালি আই এম ভেরি লোনলি! নক্ষত্রের মতো একা!
রুবার চোখে কি বেদনা দেখা গেল? জানি না।
খানিকটা অধিকার নিয়ে জিহানকে বললাম,
–সন্ধি আমার কতখানি সেই হিসাব তো জানতি, আমি সন্ধির কতটুকু সেই অংক কষেছিস? আমার অবস্থা দেখে মায়া লাগছে না তোর? আমাকে ডুবতে দিয়েছিস, সন্ধিকে সতর্ক করবি না?
জিহানের মুখ মলিন হলো। হাসবার বৃথা চেষ্টা করে বলল,
–ওই যে বলেছিলাম, জীবনে প্রম্পটার থাকে না। ও কতখানি চাপা আর অতখানি অভিমানী সে তো তোর অজানা নয়! সন্ধি মুভ অন করে গেছে৷ ওকে এলোমেলো করে দেওয়ার দরকার কী?
জিহানের উপদেশ পছন্দ হলো না আমার। একবার চেষ্টা তো করাই যায়! সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে? প্রত্যাখ্যান? বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সবকিছুই পেয়েছি ওর কাছে, প্রত্যাখ্যানও সয়ে নেবো!
পরদিন সন্ধির মুখোমুখি হবার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, রাত নয়টায় ওর ফোন এলো। আচমকাই বলে বসল,
–এই নাঈম শোন না, আমার না বিয়ে হয়ে গেছে আজকে! এমন হুট করে হলো, আগে থেকে জানাতেই পারলাম না। আমার তো প্রিপারেশনও ছিল না কোনো। পরীক্ষার বাকি কয়েক মাস মাত্র। এখন আবার বিয়েটিয়ে কী? কিন্তু রিদওয়ানের ফ্যামিলি এমন তাড়াহুড়া করল, কবুল বলেই ফেললাম!
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম,
–বিয়ে করে ফেলেছিস?
সন্ধির গলা আনন্দিত শোনা গেল,
–হুম। এই একটু আগে। তুই শুধু কলরিসিভ করলি। জিহানকে ফোনে পাইনি। সাব্বিরও ফোন ধরেনি। কিন্তু পরে ঠিকই ঝগড়া করবে। তুই বলে দিস, প্লিজ!
ওপাশে অনেক লোকের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। অকারণ মিথ্যা কিংবা অহেতুক তামাশা করার মেয়ে সন্ধি না। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল, যখন বুঝলাম সত্যিই ও অন্যের হয়ে গেছে! আমি নোবডি হয়ে গেছি ওর জীবনে। একজন সহপাঠী কিংবা বড়োজোর ভালো বন্ধু!
সবগুলো ইলেক্ট্রন আর নীলপদ্ম হারিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
–চার বছর সংসার করলি আমার সাথে, আর বিয়ে করে নিলি রিদওয়ানকে?
চলবে…
আফসানা আশা