নীলপদ্মগুলো পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
2

#নীলপদ্মগুলো – ৩
কিছুদিন পরে সন্ধির বিয়ের জাঁকালো অনুষ্ঠান হয়েছিল। সাব্বির আর জিহান গিয়েছিল বিয়েতে। সঙ্গত কারণেই আমি যাইনি। পরস্ত্রীকে মনে পুষে রাখা অন্যায় হতো। তাই বিয়ের আগের সন্ধিকেই মনে রাখতে চেয়েছিলাম আমি, রিদওয়ানের স্ত্রীর সামনে যেতে চাইনি।
ফলাফলস্বরূপ আমাকে আবার পালাতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম আমি। এমনিতেও কেমিস্ট্রি হচ্ছিল না আমার। মৌল কিংবা মানবমন, কোনোটারই জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া বুঝতে আমি অক্ষম, সেটা বেশ স্পষ্টভাবেই প্রমাণ হয়ে গেছে৷
বাবা পুরান ঢাকার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী। সেই সুবাদে ভালোই টাকাপয়সা করেছেন। হঠাৎ পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াতে গালাগাল করলেও টাকার জোগান দিলেন। বিজনেস স্টাডিজ পড়ার নাম করে বিদেশ পাড়ি দিলাম। যদিও আশা করিনি, তবে আমার মন শান্ত হয়ে গেল। এবারে পড়াশোনায় মন দিতে পারলাম।
শুরু শুরুতে সবার সাথেই যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত কথাবার্তা হতো। তারপর জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম সবাই। ভাবের আদান-প্রদানের গতি মন্থর হয়ে গেল। কালেভদ্রে দুয়েকটা মেসেজ চালাচালি হয়।
পাঁচ বছর পার করে দেশে ফিরেছি। আমার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের জোরাজুরিতেই আসতে হলো। ছেলের বিয়ে দিতে উদভ্রান্ত হয়ে গেছেন তিনি। এক ডজন পাত্রী দেখে ফেলেছেন। দেশের মাটিতে পা দিতেই ঘরোয়াভাবে দুজনের সাথে খানিকটা আলাপও হয়েছে। তাদেরকে আমার অপছন্দ হয়েছে সেটা নয়। কিন্তু কোথায় কিছু একটা মেলেনি। প্রবাসে বসেও নিষ্কষ সাধুপুরুষ হয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলাম সেটাও নয়। অনেকের সাথেই ঘুরেছি। ডেটে গিয়েছি কারো কারো সাথে। কিন্তু কারো সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হতে ইচ্ছে করেনি। রুবা আপু ঠিক বলেছিল। সব আমার ইলেক্ট্রন বিন্যাসের দোষ। আউটার অরবিটালে পরিপূর্ণ ইলেকট্রন নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছি। হৃদয়ের শক্তিস্তরে অন্য কাউকে বসাতে গেলে, প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল অন্য কাউকে প্রয়োজন। তাকে কি পাব কখনো? বিবাহযন্ত্রে ঝাঁকুনি খেলে যে উচ্চ চাপ ও নিম্ন তাপমাত্রা তৈরি হবে তাতে সাময়িক বিক্রিয়া হয়ে যেতেও পারে, সেই সম্ভাবনাতেই বিয়ের জন্য সম্মতি দিয়েছি।
দেশে ফেরার পরে জাহিন আর সাব্বিরের সাথে এটাই প্রথম দেখা। সন্ধিকে কিছু জানাইনি। অন্যদেরকেও মানা করে দিয়েছি ওকে জানাতে। হৃদয় খুঁড়ে আর বেদনা জাগাতে চাই না।
গুলশানের একটা কফিশপে বসেছি। জিহান এসে পৌঁছায়নি। বিদেশে বসে ঢাকার যানজট মিস করলেও দেশের রাস্তায় স্থবির গাড়ির চাকা খুব একটা উপভোগ্য নয়। সাব্বির আর আমি কেবলই ধূমায়িত কফির গ্লাসে চুমুক দিয়েছি, আমাদের দুইজোড়া চোখ কপালে উঠল।
এখানে এভাবে রিদওয়ান ভাইকে দেখতে পাওয়াটা নেহায়েতই কাকতাল নাকি দৈব বলব জানি না। সুঠাম সুদর্শন সিনিয়র ভাইটির মুখোমুখি যে মেয়েটা বসে আছে সেটা সন্ধি নয়! মেয়েটার সাজগোজ আর গালের সলজ্জ আভা বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা কোনো কর্পোরেট মিটআপও নয়।
রিদওয়ান চিট করছে আমাদের সন্ধির সাথে!
সাব্বির আমার দিকে তাকাল একবার। চোখাচোখি হলো আমাদের। ও অল্পতেই উত্তেজিত হওয়া ছেলে, চড়মাতালে ধরনের। করণীয় ঠিক করে নিলো সাথে। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করেই রিদওয়ানের উপর চড়াও হলো। কলার জাপটে হিসহিস করে বলল,
–শালার কানিভাঙা! ডিসপ্লে তো আগে থেকেই নষ্ট, এবারে এন্টেনায় আগুন ধরিয়ে দিই?
রিদওয়ান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সেকেন্ড দশেক সময় নিলো সামলে নিতে। বলল,
–চলো, তোমাদের টেবিলে বসি। কথা বলি!
–কীসের কথা তোর সাথে? আমি এখনই সন্ধিকে ফোন করছি।
–সেটা তুমি মিনিট দুই পরেও করতে পারবে। এখানে একজন ভদ্রমহিলা আছেন। আমরা ওদিকে গিয়ে কথা বলি।
আমি সাব্বিরকে টেনে নিয়ে এলাম। ক্রোধে আমারও কপালের রগ লাফাচ্ছে তবে পাবলিক প্লেসে নুইসেন্স না করার মতো বোধ এখনো অবশিষ্ট আছে খানিকটা।
রিদওয়ান টিসু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল,
–ওই ভদ্রমহিলা আমার হবুস্ত্রী!
আমি আর সাব্বির মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। এমন অদ্ভুত শব্দ আমরা জীবনেও শুনিনি!
রিদওয়ান বলল,
–তোমরা তো বেস্টফ্রেন্ড, জানো না কিছু?
মনের ভেতর অশনীসংকেত বাজল। কয়েকদিন আগেও ফেসবুকে ছবি পোস্ট করতে দেখেছি সন্ধিকে। ওর বারান্দাবাগানের ছবি। ওতে একটা লাভরিএক্ট আছে আমার। ব্যক্তিগত ছবি ও পোস্ট করে না। এইসব ঘাস, লতা, পাতাই সব পোস্টে! তাতে বোঝা যায় ও এক্টিভ আছে। তাহলে কী মিস করেছি? কী জানি না?
রিদওয়ানই বলল,
–আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে!
সমস্বরে দুই বন্ধুতে চিৎকার করে উঠলাম,
–কবে? কীভাবে?
–বিয়ের দেড় বছরের মাথায়!
–কেন? আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসতেন!
–সে অনেক কথা। ছোটো করে বলি, ভালোবাসাটা একপাক্ষিক ছিল সবসময়ই। সম্পর্কের শুরুতেই আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা মিসিং! ওকে হারাতে চাইনি বলে চটজলদি বিয়ে করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম ও ইন্ট্রোভার্ট, মনের ভাব প্রকাশ করে উঠতে পারে না, বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওটা আমার ভুল ছিল। বিয়ের পরেও কিছু একটা মিলল না। কিছু একটার অভাববোধ করতাম। কিছু একটা অফ ছিল। এমন না যে সন্ধি ইরেসপন্সিবল ছিল। ও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করত যেন সম্পর্কটা ওয়ার্ক করে। কিন্তু পারত না। ওর লাগাতার অসহায় প্রচেষ্টা দেখতে আমার খুব কষ্ট হতো। আমি তো সমঝোতার ভালোবাসা চাইনি। আমাদের চাওয়া-পাওয়া মিলছিল না। তিক্ততা বাড়ছিল। একটা সময় গিয়ে মনে হলো, এভাবে চলতে পারে না। তাই আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতদিন পরে এসে মুভ অন করতে পেরেছি, আর তোমরা বাগড়া দিলে!
আমি আর বাকি কথা শুনতে পেলাম না৷ কান ঝাঁঝাঁ করছে। কথার মাঝখানে জানতে চাইলাম,
–সন্ধির ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে? আগেরটাই কি আছে?
রিদওয়ান ভাইয়ের গলা ব্যথিত শোনাল কিছুটা,
–না। মুছে দিয়েছি। নম্বরটাও বদলে নিয়েছি। সন্ধিও নম্বর বদলেছে।
আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বললেন,
–বিচ্ছেদের পরেও মাঝেমাঝে পাগলামি চাপত মাথায়। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। ওর নম্বরে ডায়াল করে বসতাম।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,
–ভালো হয়েছে নম্বরটা বদলে ফেলেছে! আমি স্টেবল হতে পেরেছি!
আমি জানি, রিদওয়ান ভাই আর এই জীবনে স্থির হতে পারবেন না। হারিয়ে ফেলা নীলপদ্মগুলো ওনাকে তাড়িয়ে বেড়াবে জীবনভর!
আবার বলাও যায় না, অক্সিডাইজার ব্যবহার করলে কখনো কখনো পরিপূর্ণ ইলেকট্রন নিয়েও জেনন বিক্রিয়া করে বসে। অদূরে বসে থাকা রমণীটি কি সেই অক্সিডাইজার হতে পারে?
শুভকামনা জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। অতীতে সময়ের কাছে হেরে গেছি আমি, এবারে জেতার তাড়া।
সন্ধির বাসায় গেলাম। রাত নয়টা বাজে। বাসায় পেলাম না ওকে। ও একটা ফার্মাসিউটিক্যালসে জুনিয়র রিসার্চার হিসেবে কাজ করছে। প্রায়ই রাত গভীর হয় ল্যাবে কাজ করতে করতে। তখন ল্যাবেই থেকে যায়। আজকে তেমনই একদিন।
আমার ধৈর্যের জোর ফুরিয়ে গেছে। টঙ্গির পথ ধরলাম। সন্ধির অফিসের সামনে পৌঁছেছি, মধ্যরাত তখন। এন্ট্রি বন্ধ। গেটে মস্ত তালা ঝুলিয়ে সিকিউরিটি উধাও।
আমি সন্ধিকে লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছি। ফোনে, মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে! বন্ধ পাচ্ছি সবকটা।
প্রায় চল্লিশমিনিট পরে মহারানির সময় হলো ফোনটা খোলার। ক্লান্ত গলায় বলল,
–নাঈম? কী হয়েছে?
–আমি বুঝলি কী করে? এই সিম তো বাংলাদেশে এসে নিয়েছি।
–মেসেঞ্জারে তোর একগাদা কল। ট্রুকলারেও নাম দেখাচ্ছে। আর দেশে এসেছিস সেটা তো জানিই!
–জানিস তবুও দেখা করতে চাসনি?
সন্ধি কিছু বলল না। আমি প্রসঙ্গ বদলালাম। চড়া সুরে বললাম,
–কোথায় মরেছিলি?
সন্ধি হাসলো,
–ল্যাবে ছিলাম। মোবাইল একসেস থাকে না। কেবলই রুমে এসেছি।
–নিচে আয়?
সন্ধি আঁতকে উঠল,
–তুই এখানে এসেছিস? কী আশ্চর্য! কেন?
–নিচে আয় আগে, বলছি।
–ফজরের আগে তো গেট খুলবে না। পারমিশন নেই। আমি আর দুজন কলিগ ছাড়া এই অফিসে কেউ নেইও এখন।
–ফজর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকব এখন?
–দাঁড়িয়ে থাকবি কেন? ফিরে যা। কালকে দেখা করি?
–উহু! আমার নীলপদ্মগুলো নিয়ে ঘাপটি মেরে আছিস শত শত বছর কেটে গেছে।
–কী বলছিস আবোলতাবোল? ড্রাংক তুই?
–তুই জানাসনি কেন?
সন্ধি হাই তুলল,
–ঘুম পাচ্ছে? কী জানাইনি বললি?
–ডিভোর্সের কথা?
–ওটা কি ঢাকঢোল পিটিয়ে পার্টি করে জানাবার বিষয়?
–খুব বেশি দু:খে আছিস সেটাও তো না!
সন্ধি হাসলো,
–কীসব বলে যাচ্ছিস? আর কী পাগলামি শুরু করেছিস? রুরাল এরিয়া। সিকিউরড না। গাড়ি আছে না সাথে? ঢাকায় ফিরে যা।
–আমি এক পাও নড়ব না, সন্ধি! আজকে তো না-ই! আমার সাথে তুইও জেগে থাকবি। আমরা নীলপদ্মগুলোর হিসাব করব, ইলেকট্রনবিন্যাসে দেওয়া-নেওয়ার অংক কষব! আমাদের দশ বছরের অপূর্ণ একটা সংসার করা বাকি আছে যে…
সন্ধির গলা থমথমে হয়ে গেল,
–রাখছি নাঈম!
–খবরদার না। তাহলে ঢিল ছুঁড়ে সবগুলো জানালার কাচ ভেঙে দেবো। কয় তলায় আছিস তুই? সিগন্যাল দে।
সন্ধি চারতলার একটা জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়াল। আবছা অবয়ব দেখতে পেলাম ওর। বললাম,
–ফোনটা কানে রাখ। সারারাত জেগে থাকব আজ। তারপর একসময় সূর্য উঠবে। সুন্দর একটা ভোর হবে। পাশাপাশি হাঁটব কিছুক্ষণ। আমার হাত ধরতে তোর আপত্তি নেই, সেটা তোকে বলতে হবে না। আমি জানি!
সন্ধি চুপ করে থাকল। আমি এটাও জানি, মৌনতাই সম্মতি!

সমাপ্ত
আফসানা আশা