নীলবসন্ত পর্ব-০১

0
10
নীলবসন্ত

#সূচনা_পর্ব
#নীলবসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু

বিয়ে করতে এসে যখন জানতে পারলো পাত্রীর বয়স এখনো আঠারো হয় নি তখন ক্যাপ্টেন তাহসিন মাহমুদ বিয়েতে নাকোচ করে দিল।সে একজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোক হয়ে কি করে দেশের আইন ভাঙবে?মায়ের তোড়জোড়েই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল।কাজের চাপে তার ওতো সময় হয়ে উঠে না পাত্রী পছন্দ করার।তাই তো সমস্ত দায়িত্ব তার মায়ের উপরে দিয়েছিল।মায়ের উপর তার সম্পূর্ণ আস্তা ও বিশ্বাস ছিল মায়ের পছন্দ তার জন্য উত্তম হবে।কিন্তু তার মা যে কি করে এত বড় একটা ভুল করে ফেললো সেটাই তার মাথায় ঢুকছে না।মেয়েটা নাকি দেখতে শুনতে বেশ সুন্দরী।যদিও সে এখনও দেখেই নি। মায়ের কাছ থেকে শুনা।মায়ের নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু মেইন সমস্যাই তো মেয়ের বয়স আঠারো হতে প্রায় এক বছর বাকি।এটা সে কিছুক্ষণ পূর্বে জানতে পেরেছে যখন কাজী বিয়ে পড়াতে এসেছে তখন।আর জানামাত্রই পুরো এক ঘর লোকের সামনে সে এক বাক্যে বলে দিল সে বাল্য বিবাহ করতে পারবে না।তার এই কথা শুনামাত্রই ঘরে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল।তাহসিনের বাবা তাজউদ্দিন মাহমুদ ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

-“এসব কি বলছো তুমি?ছেলেমানুষী হচ্ছে নাকি?”

তাহসিন গমগমে কন্ঠে বলল,
-“যা বলছি ঠিক বলছি।আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। বাল্য বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

তাজউদ্দিন ছেলেকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বললেন,
-“বুঝার চেষ্টা করো এই মুহুর্তে বিয়েটা ভাঙলে মেয়েটার মনে ব্যাড ইফেক্ট পড়বে।আশেপাশে মানুষের কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে মেয়েটা ডিপ্রেশনে ভুগবে।মেয়েটার বাচ্চা মনে বেশ আঘাত হানবে।নিজের কথা না ভেবে মেয়েটার কথা একটু ভাবো।”

তাহসিন বলল,
-“মেয়েটার বয়স সবে সতেরো।ওর এখন পড়াশোনা করার বয়স।এত ছোট বয়সে বিয়ে করবে কেন ও?”

-“দেখো তাহসিন..”

হাত উচু করে বাবাকে থামতে ইশারা করে বলল,
-“বাবা আমি এক কথা দু’বার বলতে পছন্দ করি না।যখন বলেছি বাল্য বিবাহ আমি করবো না তখন করবোই না।তাই শুধু শুধু জোর করো না।”

ওর কথা শুনে ঘর জুড়ে এক হুলুস্থুল কান্ড যেন বেঁধে গিয়েছে।পাড়া-প্রতিবেশীরা এখনই কানাঘুষা করছে রোদেলার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে।এমন সময় তাহসিনের মা নাজমা বেগম তাহসিনের কাছে এসে তাহসিনকে ডেকে বাহিরে নিয়ে যায়।বাহিরে একটু নিরিবিলি জায়গায় এসে দাঁড়ান।যেখানে মানুষের কোলাহল নেই।তাহসিন মায়ের কাছে এসেই বলল,

-“মা তুমি জেনে শুনে কেন এখানে আমার বিয়ে ঠিক করলে?ও আমার থেকে কতটা ছোট সে খেয়াল কি তোমার আছে?ওর মাত্র সতেরো চলছে আর আমার?আমি ঊনত্রিশের কোঠায়।গুনে গুনে বারো বছরের ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে করবো আমি?তাও কিনা যে মেয়ের বিয়ের বয়সটাও এখনো হয় নি।”

নাজমা বেগম ছেলেকে শান্ত কন্ঠে বললেন,
-“দেখো মেয়েটাকে আমার বেশ মনে ধরেছে।এক বছরের জন্য আহামরি ক্ষ*তি হয়ে যাবে না।আর আমি সিউর তুমি মেয়েটাকে একটাবার দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না তাহসিন।”

-“মা ওর এখন পড়াশোনা করার বয়স।বিয়ে করে সংসার করার বয়স নয়।”

নাজমা বেগম পেতে রাখা চেয়ারে ছেলেকে বসতে ইশারা করলেন।তাহসিন ধপ করে বসল।নাজমা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“হ্যাঁ আমি জানি ওর এখন পড়াশোনা করার বয়স।আর সেজন্যই তো তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।রোদেলা তো সবে এসএসসি দিল।রেজাল্ট বের হলে আমাদের ওখানের ভালো দেখে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। ব্যাস হয়ে গেল।”

তাহসিন বিরক্তি শ্বাস ফেলে বলল,
-“উফ মা।পড়াশোনার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক?ও কি বিয়ে ছাড়া পড়াশোনা করতে পারবে না?”

নাজমা বেগম ছেলের পাশে বসলেন।ছেলের ডান হাতটা বেশ যত্নে নিজের দুইহাতের আজলে নিলেন।এরপর বললেন,
-“না পারবে না।কারণ কি জানো তো?মেয়েটার মা নেই।বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে সৎ মা এনেছে।সেই মা কিছুতেই সৎ ঘরের সন্তানকে তার কাছে রাখবে না।এই যে এতটাদিন রোদেলা তার সৎ মায়ের চোখের কাটা হয়ে ছিল। সারাটাক্ষন মেয়েটাকে গাধার মতো খাটাতো।মেয়েটা যেই না এসএসসি দিল সেই থেকে সে মেয়েটার বাবাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে পাত্রের খোঁজ করতে থাকলো।মেয়েকে বিয়ে দিবে।আমিও তোমার জন্য তখন পাত্রী খুঁজি।তো এখানে আমার একটা বান্ধুবী থাকে।সে-ই ওর ছবি আমাকে দেখায়।এক দেখাতেই মেয়েটার প্রতি মায়া জন্মে যায়। এরপর মেয়েটার সৎ মায়ের কাহিনি যখন শুনলাম তখন ওর প্রতি বেশ মায়া হয়।আর কিছু না ভেবেই প্রস্তাব রাখি। এখন বাবা তুমি যদি মেয়েটাকে বিয়ে না করো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে চলে যাও সেটা মেয়েটার ছোট্ট মনে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা কি ভেবে দেখেছো? আচ্ছা তুমি না হয় মেয়েটা ছোট বলে বিয়ে করবে না।কিন্তু মেয়েটার বাবা আর সৎ মা তো ঠিকই অন্য কোনো পাত্রের সাথে ওর বিয়ে দিবে। কি দিবে না?”

এই পর্যায়ে তাহসিন উপর-নীচ মাথা নাড়লো।যার অর্থ হ্যাঁ। নাজমা বেগম ফের বলা শুরু করলেন,
-“সে পাত্র যদি ওকে না পড়ালো?কিংবা ওকে ভালো না রাখতে পারলো তখন কি হবে?মেয়েটা কি কখনো সুখ পাবে?কিন্তু আমাদের কাছে থাকলে তো মেয়েটা ভালো থাকতে পারবে।আমি ওকে মেয়ের মতোই আগলে রাখতে পারবো।তুমি আমার একমাত্র সন্তান। সেখানে আমার একমাত্র বউয়ের বেশ যত্ন-আত্মি আমিই করবো।ওকে দুঃখ ছুতেই দিব না।”

তাহসিন চুপচাপ মায়ের কথা শুনলো।তারপর বলল,
-“কিন্তু মা..”

পুরো কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই নাজমা বেগম শুধালেন,
-“কোনো কিন্তু না বাবা।আমি চাই না তোমার জন্য রোদেলার মনে কোনো ব্যাড ইফেক্ট পড়ুক।সে মানুষের কথা শুনুক।তুমি না মায়ের বাধ্য সন্তান।মায়ের এই কথাটা শুনো। রোদেলাকে বিয়ে করে মাকে খুশি করো।মা তোমার কাছে আবদার করছি।প্লিজ বাবা আর কোনো ঝামেলা নয়। প্লিজ।”

মায়ের আবদার কিংবা অনুরোধ তাহসিন ফেলতে পারলো না।মাকে যে সে খুব ভালোবাসে।মা এভাবে তার কাছে আবদার করছে সে রাখবে না তা কি করে হয়?বিয়েটা মায়ের ইচ্ছেতেই না হয় করলো।তাহসিনকে রাজি হতে দেখে নাজমা বেগম বেশ প্রসন্ন হলেন।তাহসিনকে নিয়ে তিনি রোদেলাদের ঘরে যান।যেখানে কাজী সাহেব অপেক্ষা করছিলেন বরের কবুল বলার জন্য।কনে তো সেই কখনোই কবুল বলে দিয়েছিল।বরের জন্যই দেরি হলো এতক্ষণ। তাহসিন ঘরে ঢুকা মাত্রই কাজী ফের বিয়ে পড়াতে লাগলেন।তাহসিন কবুল বলার পর ঘরজুড়ে আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনি মুখরিত হলো।কাবিননামায় সাইন করার পর সকলে মিষ্টি মুখ করলেন।রোদেলার বাবা তাহসিনের বাবার সাথে কোলাকুলি করলেন।সকলের মুখে হাসি।শুধু হাসি নেই ক্যাপ্টেন তাহসিন মাহমুদের মুখে।সে হাস্যহীন চেহারা নিয়ে বসে আছে।

সফেদ চাদরে আবৃত টানটান বিছানার ঠিক মাঝে বসে আছে সদ্য বিবাহিতা কিশোরী রোদেলা।তার পড়নে এখনো লাল রঙা শাড়ি,বিয়ের ভারী গহনা,মুখে এখনো বিয়ের সাজ।নব বধূ সাজেই হাটুতে থুতনি ঠেকিয়ে তার স্বামীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে।এখনও সে তার স্বামীকে দেখে নি।বিয়ে করার পর তাহসিনের কি একটা কাজ পড়ে যায় তার জন্য সে আগেই এসে পড়েছে।আর রোদেলাকে নিয়ে নাজমা বেগম,তাজউদ্দীন মাহমুদ,উনাদের আত্মীয়রা কিছুক্ষণ পরে এসেছেন।বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটার মতো বেজেছে।রোদেলাকে মাহমুদ ভিলায় এনে নাজমা বেগম নিজের ঘরে রেখেছেন।এই তো কিছুক্ষণ আগেই তাহসিনের রুমে দিয়ে গিয়েছেন।সে থেকেই নববধু দুরুদুরু বুকে তার স্বামীর আগমনের অপেক্ষা করছে। শুনেছে তার স্বামী নাকি বেশ মেজাজী।এমন কি বিয়ের আসরেই তো সে পাশের রুম থেকে তার স্বামীর কর্কশ কন্ঠ শুনেছে।সে থেকেই মেয়েটা গুটিয়ে আছে।এছাড়াও তাদের গ্রামের বড় আপুরা,ভাবীরা তাকে বলেছে তার স্বামী ডিফেন্সে চাকরি করে।উনাদের সামলাতে বেগ পোহাতে হবে।আরও কত কি বলে মজা লুটেছে।সেসব শুনেই মেয়েটার মনে আরও ভয় জেকে বসেছে।এমনিতেই সে শান্ত,ভীতু মানবীর অধিকারী।এরপর তো ওসব কথা শুনার পর সে লজ্জায়,আড়ষ্টতায়,ভয় সবকিছুতে একদম মিইয়ে গিয়েছে।এক ঘন্টার উপরের হতে চললো রোদেলা তাহসিনের জন্য অপেক্ষা করছে।অথচ তাহসিন এখনও আসছে না।এইদিকে বসে থাকতে থাকতে তার পায়ে ঝিম ধরে যাচ্ছে।এই ভারী সাজে কিশোরীর প্রায় বেহাল দশা। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বসা থেকে বেড সাইডে মাথাটা রেখে আধশোয়া হয়ে চোখটা একটু বুজলো।সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে হানা দিল এক রাজ্য ঘুম।চোখ বুজার কিছুক্ষণের মাঝেই তার চোখে ঘুম নেমে এলো।রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে গেল সে।আরও প্রায় আধঘন্টা বাদে তাহসিন রুমে এলো।তখন রাত একটা ছুঁইছুঁই।ভিড়ানো দরজা ঠেলে রুমে পা রাখলো।এরপর দরজা আটকে দেখলো রুমের আলো জ্বালানো।বিছানায় তাকাতেই দেখলো তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বিছানার হেড সাইডে মাথা ঠেকিয়ে হাত-পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।মেয়েটাকে সে এই প্রথম দেখলো।তার মা ভুল কিছু বলে নি।আসলেই মেয়েটার চেহারার আদল মায়াবী।গালগুলো একটু ফোলা ফোলা,চোখের পাপড়িগুলো বড় বড়,চোকা নাক,পাতলা গোলাপি ঠোঁট, গায়ের রঙ ফর্সা।সৃষ্টিকর্তা যেন মেয়েটার মাঝে অপার সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন।এতটা আদুরে মানবী হয়?তাহসিন এগিয়ে গিয়ে বিছানায় কাছে গিয়ে রোদেলার একদম কাছে যেয়ে বসলো।তারপর চুপ করে রোদেলার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।চোখ ফেরানো যেন দায় হয়ে পড়লো।উপরমহল থেকে জরুরি কল আসায় সে তখন বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।এরপর বাসায় এসে ল্যাপটপে জরুরি কিছু ফাইল রেডি করে।তার যে বেশি ছুটিও নেই।আজকের রাত বাদে হাতে আর মাত্র দুইদিন ছুটি আছে।এরপরই আবার চলে যাবে।একেতে কাজের চাপ দুইতে মায়ের জন্য এত ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হয়েছে।দুইটা মিলে তার মেজাজ বেশ চটে ছিল। কিন্তু এই যে রুমে এসে ফুলের মতো সুন্দর,স্নিগ্ধ জীবন্ত এই ফুলটাকে দেখে যেন এক ঝটকায় তার সকল মেজাজ উবে গিয়ে হৃদপিন্ড জুড়ে কেমন একটা ভালো লাগার শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।কিছুতেই যেন এই মেয়ের থেকে চোখ সরাতে পারছে না।তাহসিন চোখ বন্ধ করে বার কয়েক জোরে নিঃশ্বাস টেনে ছাড়ল।উঠে যেতে নিবে এমন সময় খেয়াল করলো রোদেলার শাড়ির আঁচলের অনেকখানি অংশ মেঝেতে ঝুলছে।আঁচলটা ঠিক করার জন্য মেঝে থেকে তুলতে যাবে এমন সময়ই রোদেলার ঘুম ভেঙে যায় সে চোখ মেলে।আর ঠিক সেসময়েই তাহসিনও রোদেলার দিকে তাকায়।দুইজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়।চোখ খুলেই তার এত কাছাকাছি একটা অচেনা পুরুষকে দেখে রোদেলার বুক ধ্বক করে উঠে।কে এই পুরুষ?এখানে তার এত কাছে কি করছে?তার স্বামী কোথায়?ভয়ে সে কোনোদিক চিন্তা না করে চিৎকার করে উঠতে নেয় আর তখনই তাহসিন রোদেলার মুখ চেপে ধরে বলল,

-“কুল কুল।ভয় পাচ্ছো কেন?আমি তোমার হাসবেন্ড। তাহসিন মাহমুদ।”

‘আমি তোমার হাসবেন্ড’ কথাটি শুনে রোদেলা শান্ত হয়ে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে তাহসিনকে পরোখ করতে থাকে।বলিষ্ঠ শ্যামলা পুরুষটি তার দিকে ঝুঁকে আছে।যার চোখ গুলো তীক্ষ্ণ,মুখের আদল কেমন গম্ভীর, চোকা নাক,দাড়িহীনা গাল,চুলগুলো একদম ছোট ছোট করে কা*টা।চওড়া,লম্বা এই পুরুষের পড়নের টি-শার্টটা কেমন আটশাট হয়ে গায়ের সাথে লেগে আছে।টি-শার্টের ভিতরেও যেন তার চওড়া মেদহীন শরীর উন্মোচন হয়ে আছে।তার হাতের একেকটা পেশী কেমন ফোলে ফেঁপে আছে।এই মানুষটাই বুঝি তার স্বামী?তার অর্ধাঙ্গ?তাহসিন রোদেলার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে একটু সরে আসতেই রোদেলার ভ্রম কাটে।সে লজ্জায় গুটিয়ে যায়।সে কেমন নিলজ্জের মতো এতক্ষণ তাহসিনের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে ছিল সেটা ভাবতেই এক রাশ লজ্জা এসে তাকে আড়ষ্টতায় ডুবিয়ে দেয়।ছি:ছি: সে এতটা নিলজ্জ কবে থেকে হলো?কিছুক্ষণ আগে কিনা এই পুরুষটাকে না চিনে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার দেওয়া ধরেছিল? সবাই শুনলে কি ভাবতো?সেসব ভেবে আরও গুটিয়ে গেল। রোদেলা শোয়া থেকে উঠে বসে চিবুক গলায় নামিয়ে মাথা নিচু বসে থাকে।তাহসিন হয়তো রোদেলার আড়ষ্টতা বুঝতে পারলো তাই ওকে কিছুটা সহজ করতে বলল,

-“এখনো এত ভারী সাজে কেন?যাও চেঞ্জ করে এসো।”

রোদেলা মাথা একপেশে কাত করে সায় দিল।এরপর সে গুটিগুটি পায়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।লাগেজ থেকে পাতলা সুতির হলুদ রঙা একটা শাড়ি নামালো।তাহসিন ওকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিল।সে ওয়াশরুমে চলে গেল। রোদেলা ওয়াশরুমে যেতেই তাহসিন বিছানার বাম পাশটা খালি রেখে ডান পাশে যেয়ে তার শরীর এলিয়ে দিল। কপালের উপর হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকলো।কিছু সময় বাদে ওয়াশরুমের দরজা খট করে খোলার শব্দ পেয়েও সে সেদিকে তাকালো না।একভাবেই শুয়ে থাকলো।প্রায় অনেকক্ষণ পরও বিছানায় কারো অস্তিত্ব না পেয়ে কপাল থেকে হাত সরিয়ে তাকালো আর দেখতে পেল হলুদ শাড়ি পরিহিত মায়াবী মুখখানা।যে কিনা বিছানার কাছ ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।তা দেখে তাহসিন শোয়া থেকে উঠে বসল।হাস্যহীন চেহারায় রোদেলার উদ্দেশ্যে বলল,

-“কি হলো দাঁড়িয়ে কেন?”

রোদেলা চুপ করে মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুটছে।তাহসিন ফের বলল,
-“এ্যানি প্রবলেম?এক বেড শেয়ার করতে প্রবলেম হলে বলো অন্যরুমে যাচ্ছি।”

রোদেলা বলল,
-“না মানে সেটা নয়।”

-“তাহলে?”

রোদেলা মিনমিন করে বলল,
-“আ..আসলে আমার অন্ধকারে ঘুমাতে ভয় লাগে।এর উপর নতুন একটা জায়গা তাই আর কী।”

তাহসিন বলল,
-“ও এই ব্যাপার?তুমি শুয়ে পড়ো।আমি ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছি।আসলে ফকফকে আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না। তাই লাইট তো আর জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব নয়।পুরোপুরি রুম যাতে অন্ধকার না হয় সেজন্য ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না।”

রোদেলা একপাশে মাথা নাড়লো।বিছানার এক কোণে সে শুয়ে পড়লো।তাহসিন ঘরের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দিল।যেটা ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচালো।তাহসিন বিছানায় পিঠ এলাতে এলাতে বলল,
-“ঘুমিয়ে পড়ো।”

রোদেলা চুপচাপ শুনলো।আর ভাবলো সে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিল।তার প্রতিবেশী বড় আপুদের কথা শুনে সে শুধু শুধু ভয়ে টইটম্বুর হয়ে ছিল।যাক একটুখানি হলেও তো ভয়টা কাটলো।মানুষটা আসলে খুব একটা খারাপ নয়।শুধু মুখটাই কেমন গম্ভীর করে রাখে।একটু হাসেও না।কিন্তু রোদেলার তো আর এইরকম মানুষ পছন্দ নয়।যাদের মুখে হাসি লেপ্টে থাকে সেসব মানুষই পছন্দ।যাক ব্যাপার না। রোদেলা অনেকক্ষণ ধরে এপাশ-ওপাশ করতে থাকলো তবে তার চোখে ঘুম ধরা দিল না।বাড়ির কথা বেশ মনে পড়ছে।বিশেষ করে তার সৎ বোনের কথা।তার মা টা খারাপ হলে কি হবে তবে বোনটা ছিল তার ন্যাওটা।তাকে ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝতো না।বোনটা বয়স সবে দশ।ওই বোন আর সে সবসময় একসাথেই ঘুমাতো।সে গল্প শুনাতে শুনাতে বোনকে ঘুম পাড়াতো।দুইজন দুইজনকে ঝাপটে ধরে ঘুমাতো।সে অভ্যাসই যে রয়ে গিয়েছে।কাউকে জড়িয়ে না ধরলে তার যে ঘুমই ধরা দেয় না।তখন কি করে যেন ঘুমটা চোখে এসে পড়লো।এখন তো আর ঘুমই আসছে না।পাশেই তার সদ্য বিয়ে করা বর ঘুমাচ্ছে।তার সাথে তো দুটো ভালো করে কথাও হয় নি।এতেই সে কি করে এই পুরুষকে জড়িয়ে ধরবে?ভাবতেই তো লজ্জা লাগে।এইদিকে বাহিরে অজানা কত পোকা,পাখি ডাকছে।তাতেই যেন তার শরীরে হিম ধরে যাচ্ছে।রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকালো।দেখতে পেল তাহসিন সটান হয়ে ঘুমাচ্ছে।রোদেলা আর কিছু না ভেবে একটুখানি এগিয়ে তাহসিনের বাম হাতের একটা আঙুল তার মুঠোতে পুরল।তাহসিনের আঙুল স্পর্শ করতেই যেন তার মাঝে কেমন একটা অনুভূতি হানা দিল।হৃদপিন্ডটা যেন কেঁপে উঠল।হাতটাও তার কেমন থরথর কাঁপছে।সবকিছু দূরে ঠেলে সে চোখ বুজলো। তাহসিনের আঙুলটা নিজের হাতের মুঠোতে নিয়েই ঘুমানোর চেষ্টা করলো।একটা সময় ঘুমিয়েও পড়লো।তার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ যখন পড়তে থাকলো তখনই তাহসিন চোখ খুলে পাশে তাকালো।সে চোখ বুজে থাকলেও তার ঘুম তখনও হানা দেয় নি।আর তখনই রোদেলা তার আঙুল মুঠোতে পুরে।সবটাই সে বুঝতে পারলো।রোদেলা লজ্জা পাবে ভেবে সে আর চোখ খুললো না।তবে এই যে মেয়েটা তার আঙুল মুঠোতে পুরে কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এই বিষয়টা তাহসিনের কাছে বেশ লাগলো।সে রোদেলার দিকে তাকালো।ঢিম লাইটের হালকা হলুদাভ আলোতে রোদেলার মুখটা কি সুন্দর চকচক করছে।হলুদ শাড়িতে মেয়েটাকে বুঝি একটু বেশি সুন্দর লাগছে?তখন তো এক নজর দেখেই যেন নিজের নজর সরানো দায় হয়ে পড়েছিল।তবুও মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলতে চায় নি বলে তাকায় নি।যে ছেলে কাজ ছাড়া অন্য কোনো মেয়েতে তাকানোর সময় অব্দি পায় নি।সে কিনা এই সপ্তদশী কিশোরীতে ঘায়েল হয়ে পড়ছে?আশ্চর্য না?
তাহসিন তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

-“কন্ট্রোল তাহসিন মাহমুদ কন্ট্রোল।নিজেকে সামলাও। এভাবে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে নিশ্চিত নিজেকে তার মাঝে হারাবে।মাথায় রেখো তোমাকে সামলানোর মতো বয়স এখনো তোমার বউয়ের হয় নি।ছোট্ট একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো তুমি,একটুখানি তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।আগে তার মনের সঙ্গী হও পরে না হয় শরীরের সঙ্গী হয়ো।”

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]