নীলবসন্ত পর্ব-০৩

0
3
নীলবসন্ত

#নীলবসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_০৪
সময়টা এখন রাতের দ্বি-প্রহর।রোদেলা ফোন হাতে নিয়ে সময় গুনছে তাহসিন কখন ফোন দিবে।এই ফোনটা গতরাতে তাহসিন তাকে উপহার দিয়েছে।এর আগে কখনো রোদেলা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে নি।তাই এর ব্যবহারও রোদেলা জানে না।তাহসিনই গতরাতে টুকটাক শিখিয়ে দিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় কিছু এপস্ও নামিয়ে দিয়েছে। আজ সকাল ভোরেই তাহসিন নিজের কর্মস্থলে ফিরে যায়। যাওয়ার পূর্বে রোদেলাকে বলে যায় নিজের খেয়াল রাখতে, ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে।তাহসিন রাতের দিকে সময় পেলে ফোন দিবে।তাহসিন যাওয়ার সময় রোদেলার চোখে দিয়ে অশ্রুর বর্ষণ নামতে চায়।কিন্তু রোদেলা অশ্রুর বর্ষণ হতে দেয় নি।নিজেকে খুব কষ্টে শক্ত রেখেছে।তবে তাহসিন যাওয়ার পর শূন্য ঘরটার দিকে তাকাতেই নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারে নি।ঝুম বৃষ্টির ন্যায় তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু নামে।নিজেকে বিন্দুমাত্র আটকানোর প্রয়াস করে নি সে।কান্না করতে করতেই একসময় ঘুমিয়ে যায়।শাশুড়ী মায়ের ডাকে তার ঘুম ভাঙে।ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে বেশ বেলা হয়েছে।গোসল সেরে নামাজ পড়ে খেতে যায়।এরপর শাশুড়ীর সাথেই গল্প করে সময় কাটায়। সারা বিকেল শাশুড়ীর সাথেই সময় কাটে।এরপর সন্ধ্যায় তার শ্বশুড় কর্মস্থল থেকে ফিরলে শ্বশুড়-শাশুড়ী দুইজনের সাথে সময় কাটায়।রাতে খাওয়া-দাওয়া করেই সে রুমে আসে।এর মধ্যে একটা বারও তাহসিন তার খোঁজ নেয় নি। এই যে এখন যে এই ঘরে এলো এখন তাহসিনের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলোই বারেবার মানসপটে ভেসে উঠছে। বুকটা মুচড়ে উঠছে তার।সে কী করে এই ঘরটাতে একা থাকবে?তার তো দম বন্ধ লাগছে।খুব করে চাইছে তাহসিনের কন্ঠস্বর শুনতে।কিন্তু সব চাওয়াই কি পূর্ণতা পায়?হয়তো হ্যাঁ নয়তো না।তবে রোদেলার ক্ষেত্রে হয়তো হ্যাঁ।তাইতো তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করতে তার ফোনটা সশব্দে বেজে উঠে।ফোনের স্ক্রিনে “জনাব মাহমুদ” নামটি ভেসে উঠতেই রোদেলার আনন থেকে মন খারাপ সরে গিয়ে ঠোঁট জুড়ে প্রশান্তির হাসি বয়ে গেল।খুশিমনে ফোন রিসিভ করে নিম্নস্বরে সালাম ঠুকলো।তাহসিন সালামের জবাব নিয়ে শুধালো,

-“কেমন আছো?”

রোদেলার মন বলে উঠলো, “ভালো নেই।আপনাকে ছাড়া এই শূন্য ঘরে মোটেও ভালো নেই আমি।” মনের কথা মনেই রইল।মুখে বলল,

-“আলহামদুলিল্লাহ।আপনি?”

ফোনের ওপাশ থেকে তাহসিন বলল,
-“ভালো।কি করো?”

-“এইতো বসে আছি।আপনি?”

-“জরুরি মিটিং সেরে রুমে ফিরলাম মাত্র।”

-“সারাদিন বুঝি খুব ব্যস্ত ছিলেন?”

-“হু।এতদিনের পেইন্ডিং কাজগুলো করতে হয়েছে।সামনেই একটি বড় মিশন আছে।সেটা কামপ্লিট না হওয়া অব্দি কাজের প্রচুর চাপ থাকবে।বুঝোই তো এখানে নিজের আরামের কথা না ভেবে দেশের জন্য প্রাণপনে ছুটতে হয়।”

রোদেলা ছোট্ট করে বলল,
-“হুম।”

-“খাওয়া-দাওয়া করেছো?”

-“হুম।আপনি।”

-“এইতো করছি।বাবা-মা কেমন আছেন?খাওয়া-দাওয়া করেছেন?”

-“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছেন।হ্যাঁ খাওয়া-দাওয়া করেছেন।এইতো এতক্ষণ বাবা-মায়ের সাথেই ছিলাম। কিছুক্ষণ হলো রুমে এলাম।”

-“ও আচ্ছা।তো ঘুমাও নি কেন?বেশি রাত জাগা ভালো না। জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়বে।আর সকাল সকাল উঠে পড়বে।তবেই না শরীর আর মন দুটোই ভালো থাকবে।”

রোদেলা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
-“আপনি বলেছিলেন রাতে কল দিবেন তাই আর কী।”

ওপাশ থেকে তাহসিনের তপ্ত শ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনা গেল।তাহসিন একটুখানি চুপ থেকে বলল,
-“আগামীকাল থেকে আরও বেশি ব্যস্ত থাকবো।তাই সময় করে ফোন নাও দিতে পারি।রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে।আমি কল দেওয়ার হলে এর আগেই দিব।আর যখন দেখবে এগারোটা পাড় হয়ে গিয়েছে কল দেই নি।তখন বুঝে নিবে সেদিন আর কল দিব না।তাই আমার অপেক্ষায় না থেকে ঘুমিয়ে পড়বে ঠিক আছে?”

-“হু।”

-“ঠিক আছে তবে এখন ঘুমাও।”

রোদেলার কান্না পেল।সবেই তো কল দিল।দুই মিনিট না হতেই ফোন রেখে দিচ্ছে?রোদেলার যে কথা বলার বেশ তেষ্টা পেয়েছে।এত জলদিই কি এই তেষ্টা মিটবে?মিটবে না তো।অপর পাশের লোকটা কি আজ তার মন পড়তে পারছে না?নাকি দূরে গিয়েছে বলে রোদেলার কদর কমে গিয়েছে?রোদেলার ছোট্ট মনে অভিমান জমলো। অভিমানের প্রকোপেই বলল,

-“ঠিক আছে রাখছি।ভালো থাকবেন।আসসালামু আলাইকুম।”

রোদেলা খট করে ফোন রেখে দিল।তাহসিনকে আর কিছু বলার সুযোগ অব্দি দিল না।ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোনের স্ক্রিনে অনিমেশ তাকিয়ে রইল।ভাবলো এই বুঝি তাহসিন ফের কল দিবে।তার অভিমান ভাঙাবে।কিন্তু না রোদেলা আশাহত হলো।তাহসিন ফোন দিল না।তবে ছোট্ট একটি মেসেজ এলো তাহসিনের নম্বর থেকে,,

-“ঘুমিয়ে পড়ো অভিমানিনী।আজ এমন কেউ নেই যে তার হাতের আঙুল কিংবা হাত মুঠোতে পুরে ঘুমাবে।একা একা ঘুমানোর অভ্যাস করো।”

এই ছোট্ট মেসেজটুকু পড়ে রোদেলার বুক ধুকপুক করে উঠলো।তার মানে রোদেলা যে তাহসিনের হাতের আঙুল ধরে ঘুমাতো সেটা তাহসিন টের পেতো?রোদেলা যেন লজ্জায় মিইয়ে গেল।লোকটা যদি সামনে থাকতো রোদেলার যে কি হতো আল্লাহ মালুম।কুন্ঠায় চোখ তুলে তাকাতে পারতো কি?

কেটে গেল আরও দিন পাঁচেক।তাহসিন চলে গিয়েছে সপ্তাহ হতে চললো।সে রাতের পর তাহসিন আর একটাবারের জন্যও রোদেলার ফোনে ফোন দেয় নি।মাঝে দিয়ে একদিন শাশুড়ী মায়ের ফোনে মিনিট দুয়েকের জন্য ফোন দিয়েছিল।তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা হয়েছিল।সে জানিয়ে ছিল সে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।ফোন দেওয়ার সময় অব্দি পাচ্ছে না।রোদেলা মনে মনে বেশ অভিমান জমায়।প্রতি রাতে কান্না করতে করতে ঘুমায় সে।তার এমন মন খারাপ দেখে শ্বশুড় মশাই তাকে বেশ কয়টা উপন্যাসের বই এনে দেয়।যাতে বই পড়ে সময় কাটিয়ে রোদেলার মনটা ভালো যায়।রোদেলা অবসর সময়ে বই পড়ে।শাশুড়ীর হাতে হাতে টুকটাক কাজ এগিয়ে দেয়।শ্বশুড়-শাশুড়ীর সাথে সময় কাটায়।তবে যা-ই করে দিন কাটায় না কেন এই রাতের প্রহরে সে একাকিত্বে ভোগে।রাতের সময়টা যেন তার কাটেই না।একাকিত্ব এসে তার মনে আঁচড় কাটে।মনে মনে তাহসিনের নামে বেশ অভিমান ঠুকে।সে বুঝে তাহসিনের যে চাকরি সেখানে ব্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে বুঝলেও যে তার মন মানতে চায় না।না ছিল তাহসিনের সাথে পূর্বে সম্পর্ক আর না ছিল পূর্বপরিচিত। অথচ তিনদিনের এই অল্প পরিচিত স্বামী নামক মানুষটার জন্য তার মন পোড়ে।

রোদেলা আজ ঘর গুছাতে যেয়ে একটা নতুন ডায়েরি পেল।সাথে কলমও ছিল।যেটার প্রথম পেইজেই সুন্দর করে তাহসিন মাহমুদ নামটা লেখা।এছাড়া পুরো ডায়েরিটা ছিল সাদা ফকফকা।কলমের কালির কোনো আঁচড়ই নেই। রোদেলা ভাবলো তার সকল অব্যক্ত কথাগুলো সে এই ডায়েরিটাতে টুকে রাখবে।কিন্তু যার ডায়েরি তার থেকে তো অনুমতি নেওয়া লাগবে।রোদেলা গত দুইদিন ধরে তাহসিনের সাথে কোনো প্রকার কথাই বলছে না।যখন দেখে তাহসিন মিনিট খানেকের জন্য তার শাশুড়ী মাকে ফোন করেছে তার সাথেও ওই কয়েক সেকেন্ড কথা বলবে তখনই রোদেলা কাজের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যেত।কথা বলতো না।কিন্তু এখন তো কথা না বলে আর পারছে না।তাই হাজারটা দ্বিধা-দ্বন্ধ নিয়েই তাহসিনের নম্বরে ফোন লাগালো।কয়েকবার রিং হতেই তাহসিন ফোন ধরলো।ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

-“হুম বলো।”

রোদেলা বলল,
-“আপনার ড্রয়ারে একটা ডায়েরি পেয়েছি।সেটা কি আপনার খুব বেশি প্রয়োজন?আমি কি সেই ডায়েরিটা ব্যবহার করতে পারি?”

তাহসিন বলল,
-“সমস্যা নেই তুমি ওই ডায়েরিটা কাজে লাগাও।আমার লাগবে না ওটা।”

-“ধন্যবাদ।”

-“আর কিছু বলবে?”

-“না।”

-“ঠিক আছে রাখছি তবে।মিটিং আছে এখনই।”

তাহসিন ফোন রেখে দিল।রোদেলার অভিমান হলেও কিছু বললো না।এই কয়টাদিনে যেন এসবে নিজেকে বেশ অভ্যস্ত করে নিতে চাইছে।রোদেলা উঠে যেয়ে ডায়েরিটি হাতে নিল সাথে কলমটিও নিল।এরপর বিছানায় এসে বসলো। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় তাহসিনের লেখা নামটি আলতো হাতে ছুয়ে দিল।এরপর তাহসিনের নামের পাশে গুটিগুটি অক্ষরে নিজের নামটি লিখলো।তবে নিজের পুরো নাম লিখলো না।তাহসিনের ডাকা “মায়মূন” নামটিই লিখলো। এরপর অপর পৃষ্ঠা থেকে তারিখ এবং সময়টা লিখে লেখা শুরু করলো,

“প্রিয় স্বামী,
আপনি তো ছিলেন অপরিচিত,অজ্ঞাত এক ব্যক্তি।তবে কেন এত অল্প দিনের আলাপে হয়ে গেলেন আমার হৃদয়ের রাজত্বকারী?আপনার জন্য জমিয়ে রেখেছি অব্যক্ত কিছু অভিমান।কবে দেখা দিয়ে ভাঙাবেন সেই মান?”

এইটুকু লিখেই রোদেলা ডায়েরিটি বন্ধ করে তার বালিশের পাশে রাখলো।এরপর ঘরের আলো নিভিয়ে স্বপ্নালো জ্বালিয়ে বিছানায় এসে নিজের বালিশে মাথা রাখলো। এরপর পাশ থেকে টেনে নিল তাহসিনের বালিশটি।যেটা কিনা ঠাঁই পেল রোদেলার বুকে।বালিশটি জড়িয়ে ধরে সে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।তাহসিন যাওয়ার পর থেকে রোদেলা এমনটাই করে আসছে।এই বালিশটিতে যে তাহসিনের চুলের সুবাস লেগে আছে।যা কিনা রোদেলার নাসারন্ধ্রে পোঁছালেই মনে হয় তাহসিন তার পাশে আছে।তাহসিনকে অনুভব করতে করতেই ঘুমের শহরে সে পাড়ি দেয়।আবার কখনো বা তাহসিনকে অনুভব করতে করতে চোখের জল ফেলে।এইতো এমন ভাবেই কাটছে রোদেলার দিন।

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।