#নীল_আকাশের_ধ্রুবতারা ( প্রথম অংশ)
#মৌসুমী_হাজরা
…আচ্ছা মামনি তুমি তো একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারো। বাপিও সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তোমার ছেলেও তাই। আমিও ঠিক করে টাইম দিতে পারি না তোমাকে। তোমার ছেলের আর আমার বিয়েটা হোক, তারপর সারাক্ষণ তোমার সাথে বকবক করবো। তোমার কাছে কাছে থাকবো।
নীলিমা দেবী মুচকি হাসলেন, ঋতিকার কথা শুনে। কয়েকমাস পর এই মেয়েটি বৌমা হবে তাঁর। বড্ড মায়াবী মেয়েটি। সারাদিনে কতবার ফোন করে। খাবার খেয়েছো? ওষুধ খেয়েছো? বিকেলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। মেয়েটার সাথে দেখা হবার পর, নিজের ভালোলাগাগুলো আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
…আচ্ছা মামনি, তুমি এত কবিতা লিখেছো, অথচ সব এইভাবে অবহেলায় কেন রেখেছো? একটা তো বই বের করতে পারতে?
…আমার এইসব ছাইপাঁশ লেখা কে পড়বে বল? তার চেয়ে এখানেই থাক। যখন মা’রা যাবো, তখন এই কবিতাগুলো তোর কাছে রেখে দিস।
…যাও তোমার সাথে আর কথা নেই।
…আহা রা’গ করছিস কেন? একদিন তো সবাইকেই ম’রতে হবে। আয় আমার কাছে আয়।
…মামনি তোমার ক’ষ্টগুলো আমাকে শেয়ার করতে পারো না?
…ক’ষ্ট কেন থাকবে?
…তোমার চোখ দেখলে যে আমি বুঝতে পারি। অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছো।
…আচ্ছা এইসব বাদ দে। তুই আমাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কেন খুলতে বলছিস?
…তুমি তোমার পুরোনো বান্ধবীদের ওখানে আবার ফিরে পেতে পারো। ফিরে পেলে আবার গল্প করবে, অতীতের স্মৃতি মনে পড়বে।
ঋতিকার কথা গুলো শুনে নীলিমা দেবী হারিয়ে গেলেন অতীতে। তখন তিনি অষ্টাদশী। মামা বাড়িতে মানুষ তিনি। বড় আদরে বড়ো হয়েছিলেন। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো ছিলেন। মাধুরীর সাথে স্কুল যাওয়া, ভরদুপুরে পুকুরে সাঁতার কা’টা, গাছে চড়া। এই পাড়া থেকে ওই পাড়া সাইকেলে করে দাপিয়ে বেরানো। কথাগুলো মনে পড়তেই চোখগুলো চিকচিক করে উঠলো তাঁর। মাধুরী… কেমন আছে এখন মাধুরী?
মামনি কী ভাবছো? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে কেন? ঋতিকার কথায় সম্বিৎ ফিরলো নীলিমা দেবীর। তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, আচ্ছা ফেসবুকে মাধুরীকে পাওয়া যাবে? মাধুরী রায়?? আবার কিছুটা ধীরে ধীরে বললেন, না না থাক, সব্যসাচী যদি….। না না থাক।
ঋতিকা এইরকম অবস্থায় কোনোদিন দেখেনি নীলিমা দেবীকে। পাশে বসে বললো, আমায় বলো মামনি। মাধুরী রায় কে? আর সব্যসাচী, তিনিই বা কে? আমাকে সব বলো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
শেষপর্যন্ত বানিয়ে ফেলা হলো নীলিমা সেনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। নীলিমা দেবী পাশে বসে চুপচাপ দেখছেন, ঋতিকা সব শিখিয়ে দিচ্ছে। ভালো ছাত্রীর মতো মাথা নাড়ছেন তিনি। ঠিক এইভাবেই স্কুলের মাস্টার মশাই অঙ্ক শেখাতেন, যতক্ষণ না মাথায় ঢুকছে, তিনি বুঝিয়ে যেতেন। মোটামুটি ভাবে কিছুটা শেখার পর ঋতিকা বললো, দাঁড়াও আগে তোমার বান্ধবী মাধুরী রায়কে সার্চ করি। সার্চলিস্টে এক এক করে অনেক মাধুরী রায়কে দেখা যাচ্ছে। নীলিমার বুকের ভিতর যেন কেঁপে উঠছে। একটা প্রোফাইলে এসে থামলো ঋতিকা, নীলিমা দেবী ছবিটা ভালো করে দেখছেন, আঠারো বছরের মাধুরীর সাথে খুব একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে না ছবিটাতে। কিন্তু প্রোফাইলের ডিটেইলস বলছে ইনিই তাঁর বান্ধবী। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে বত্রিশটা বছর। কত কিছুই তো বদলে গেছে। বয়স তো আগের মতো নেই। ঋতিকা কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে দিল মাধুরী রায়কে।
নীলিমা দেবী কিছুটা রা’গ করেই বললেন, তুই আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করবি তো, আমি এই ফেসবুক আর খুলবো না।
ঋতিকার মনে একটা রহস্যের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। রাতে নিজের ফোন থেকে নীলিমা দেবীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অন করলো ঋতিকা। আশ্চর্যের বিষয় হলো মাধুরী রায় নামের প্রোফাইল অনেক আগেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট অ্যাকসেপ্ট করেছেন, আর অনেক বার মেসেজ করেছেন। তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন নীলিমা সেন তাঁর সেই বান্ধবী কিনা? ঋতিকার মন খুব একটা সায় না দিলেও, তবুও নিজে নীলিমা সেন সেজে মেসেজ করলো, হ্যাঁ আমিই সেই তোর বান্ধবী নীলিমা। মাধুরী দেবী সাথে সাথেই মেসেজ সিন করে বললেন, লক্ষ্মীটি একবার দেখা কর আমার সাথে, অনেক কিছু বলার আছে, কেমন আছিস তুই? কোথায় আছিস?
ঋতিকা আর কোনো রিপ্লাই করলো না, মনে মনে ভাবলো, এখানেই সব রহস্যের জট খুলবে কিন্তু মামনিকে না বলে কাজটা করা ঠিক হবে না। নীলিমা দেবী নিজে ফেসবুক আর অন করেন নি। তাই কি হচ্ছে তা কিছুই জানেন না। এদিকে মাধুরী রায় বারবার মেসেজ করে যাচ্ছেন।
ঋতিকা এক সপ্তাহ পর আবার এই বাড়ি আসে, ওকে কাছে পেয়ে খুশি হলেন নীলিমা দেবী। ঋতিকা কিছুটা ভ য়ে ভ য়ে বললো, মামনি তুমি রা গ করো না, আমি তোমার ফেসবুক অন করে মাধুরী আন্টির সাথে একটু কথা বলেছি, উনি বারবার তোমার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
নীলিমা দেবী কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। ঋতিকা বুঝতে পারছে সে অ’ন্যায় করেছে, ওই ভাবে মামনির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অন করা উচিত হয় নি তার। কিন্তু নীলিমা দেবী কিছুটা ঋতিকাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তুই জানিয়ে দে, শেষ যেখানে দেখা করার কথা ছিল, সেখানে আগামীকাল বিকেলে দেখা হবে।
ঋতিকাও সাথে যাওয়ার কথা বললে, নীলিমা দেবী আর না করেন নি।
…মাধুরী, ভাগ্যিস তুই নুনের সাথে লঙ্কা গুঁড়ো নিয়ে এসেছিস। কাঁচা আমগুলো যা খেতে লাগছে না।
…তা তুই যাই বল, নিজের বাড়িতে চু’রি করার মজাই আলাদা। তাই না রে নীলু?
…তো কী করবো? মামিমা যদি জানতে পারেন, তাহলে খুব বকবেন। তাই তো চু’রি করতে হলো।
…মামিমা কী তোর খা’রাপের জন্য বলে? গাছ থেকে পড়ে পা ভা’ঙলে তখন কী হবে? তখন সব্যসাচী বাবুও তোকে পাত্তা দেবেন না।
…এই এই কী বললি? সব্যসাচী বাবু এখানে কী করছেন?
…আহা নেকু! আমি যেন কিছুই জানি না। কলেজে তোর চোখ কার দিকে থাকে, আমি কি কিছু বুঝি না?
…শোন মাধুরী, আমি তাঁর লেখা খুব ভালোবাসি। ব্যস এইটুকুই।
…ওহ তাহলে আমিই ভুল। যাইহোক এবারে মাসিক পত্রিকাতে তাঁর লেখা বেরিয়েছে। তুই দেখেছিস?
…না রে, হাতে এখন টাকা নেই, তাই কিনতে পারিনি।
…জানতাম আমি, তাই তো তোর জন্য আমি একটা পত্রিকা কিনে এনেছি। দাঁড়া ব্যাগ থেকে বের করি।
পত্রিকাটা বের করে মাধুরী, নীলিমার হাতে তুলে দিতেই, তার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। কবিতাখানা বারবার পড়লো। কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলো।
মাধুরী একটু ব্যঙ্গ করে বললো, তা বুকে জড়িয়ে ধরলি কেন? তুই তো তাঁকে ভালোবাসিস না।
নীলিমা কিছুটা রে গে রে গে বললো, আমি সব্যসাচী বাবুকে নয় তাঁর লেখা কবিতাকে জড়িয়ে ধরেছি।
গ্রীষ্মকালের বিকেল যেন একটু বড়ই হয়। দুইজন অষ্টাদশী নিজেদের মতো হাসাহাসি করছে, গল্প করছে। বারণ করার কেউ নেই। দুজনের চোখে স্বপ্ন অনেক। দুজনের বন্ধুত্ব গাঢ়। একসাথে দুজনের বড়ো হওয়া। বন্ধুত্ব বড়ো পবিত্র আর দামী সম্পর্ক। নীলিমা যখন ছোট বেলায় মাকে হারায়, তখন মামা আর মামিমা মিলে এখানে নিয়ে ওকে চলে আসেন। নিজেদের মেয়ের মতো তাকে বড়ো করেন।
এতটুকু বলে থামলেন নীলিমা দেবী। অধীর আগ্রহে সব কথা শুনছিল ঋতিকা।
…তারপর, তারপর কী হয়েছিল মামনি? সব্যসাচী বাবুর ব্যাপারে কিছু বলো।
…সব বলবো, আজ রাতে তো আমার কাছেই থাকবি।
…কী আর করবো বলো? বাপি আর তোমার ছেলে আজ বাইরে গেছে। আমাকেই তো তোমার দেখাশোনা করতে হবে। কত দায়িত্ব বলো আমার।
…হয়েছে হয়েছে, এবার চল খেয়ে নিই। বাকিটা আবার রাতে বলবো।
রাত নামলে শহরটা আরও জমকালো হয়। ব্যস্ততা, ট্রাফিক, সারাক্ষণ সবাই যেন ছুটছে, কেউ কারোর কথা শুনতে চায় না। সবাই যেন মরিয়া হয়ে ছুটছে। কিন্তু এর শেষ কোথায়?
সন্ধ্যের গোড়ায় গোড়ায় নীলিমা যখন সাইকেলটা নিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ি ঢুকলো, মামিমা তখন তুলসি তলায় সন্ধ্যে প্রদীপ দেখাচ্ছেন। তিনি নীলিমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, এই তোর বাড়ি ঢোকার সময় হলো নীলু? আজ তোর মামা আসুক আমি সব বলবো। মামা সঠিক সময়ে বাড়ি ফিরলেও, মামিমা কোনোদিন নীলিমার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ জানান নি। নীলিমা জানতো, এইবাড়ির মানুষেরা কত ভালোবাসে তাকে।
রাতে পত্রিকার কবিতাটা আবার চোখ বুলিয়ে, যত্ন করে আগের পত্রিকা গুলোর সাথে এটাও রেখে দিল। মাধুরীকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো। মেয়েটা না থাকলে যে কি হতো! সব্যসাচী বাবুর প্রতিটি কবিতায় নীলিমা নিজেকে খুঁজে পেত। মনে মনে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল।
সকাল সকাল মাধুরীর গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভাঙলো নীলিমার। মামিমা রান্নাঘর থেকে বললেন, দেখো তো মাধুরী, নীলু মহারানীর ঘুম ভা’ঙলো কিনা, তাকে বলো, গরম গরম লুচি আর আলুর দম বানাচ্ছি। মাধুরী কিছু বলার আগেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো নীলিমা। মাধুরী এসে বললো, তা মহারানী আগে লুচি খাবেন? নাকি খুশির খবরটা জানবেন? নীলিমা অবাক হয়ে বললো, সকাল সকাল তুই কী খুশির খবর আনলি রে? মাধুরী কিছুটা অহংকারী হয়ে বললো, সব তো আমারই দায়িত্ব এখন, কাল রাতে আমি জানতে পারলাম সব্যসাচী বাবু আমার দাদার বন্ধু। তাই দাদার কাছে ওনার প্রশংসা করে সব্যসাচী বাবুর বাড়ির ঠিকানাটা জোগাড় করেছি। নীলিমা এটা শোনার পর আনন্দে যেন লাফিয়ে উঠলো। তারপর আবার শান্ত হয়ে বললো, বাড়ির সামনে গিয়ে কী আমি ধর্ণায় বসবো?
মাধুরী কিছুটা বির’ক্ত হয়ে বললো, আহা ধর্ণায় বসবি কেন? চিঠি তো লিখতে পারিস।
দুজনেই লুচি আর আলুরদম খেয়ে চিঠি লিখতে বসলো। নীলিমা অনেক ভেবে একটা নাম ঠিক করলো, তারপর নিজেই লিখতে শুরু করলো, আর মাধুরী চুপ করে পাশে বসে রইলো।
প্রিয় ধ্রুবতারা,
অবাক হবেন না নামটা শুনে। আপনি আমার আকাশের এক এবং অদ্বিতীয়। তাই এইরূপ নামকরণ। আমি আপনার লেখার বড় ভক্ত। সামনাসামনি বহুবার কলেজে আপনাকে দেখেছি, কিন্তু কখনো আপনার সাথে কথা বলার সাহস হয় নি। ভবিষ্যতেও হবে না। আমি দূরেই থাকবো দাঁড়িয়ে আজীবন, আপনি আরও লিখুন। আমার চিঠিটা হয়তো বাকি চিঠির তলায় চাপা পড়ে যাবে, হয়তো কোনোদিন আপনার হাতে স্থানও পাবে না। আর যদি এই চিঠিটা আপনি এখন পড়ছেন, তাহলে জেনে রাখুন, কেউ একজন গোপনে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।
ইতি,
এক নীল আকাশ
কলেজে পড়াশোনা আগেই শেষ হয়েছে, তবুও মাঝেমধ্যে এখানে আসে সব্যসাচী। কলেজের সব বিষয়ে খোঁজ খবর রাখে। সম্প্রতি একটা জবও পেয়েছে, তার সাথে সাথে লেখালেখিও ভালো চলছে। এই সময়কার একজন বিখ্যাত কবি হয়ে উঠেছে। বইয়ের তাকে বিভিন্ন লেখক লেখিকার বইয়ের সাথে, নিজের বইগুলিও স্থান পেয়েছে। কিন্তু সেদিনের চিঠিটা হাতে পাওয়ার পর আরও যেন তার আনাগোনা বেড়েছে কলেজে। সবসময় মনে হয় নীল আকাশ যেন তাঁর কাছে কাছেই আছে। এ যেন এক লুকোচুরি খেলা।
পরের মাসে সব্যসাচী বাবুর লেখা নতুন বইটি কিনে মাধুরী ছুটতে ছুটতে নীলিমার কাছে এলো।
…কী রে কী ব্যাপার? এত ছুটে ছুটে আমার কাছে আসার কারণ কী? এইমাসের পত্রিকা তো এখনও বের হয়নি।
…পত্রিকা ছাড়, এই নে সব্যসাচী বাবুর নতুন বই।
…আরে সোনা অনেক অনেক আদর তোকে।
…আদর পরে করবি, আগে বইয়ের উৎসর্গপত্রটি দেখ।
নীলিমার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো, উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, “ধ্রুবতারার নীল আকাশের জন্য”…
ঋতিকা চুপ করে অষ্টাদশী নীলিমা সেনের গল্প শুনছিল এতক্ষন। এবার সে অত্যন্ত কৌতূহল হয়ে প্রশ্ন করলো, নীল আকাশ সত্যিই কী ধ্রুবতারাকে ভালোবেসে ছিল?
নীলিমা দেবী ছলছল চোখে বললেন, ভীষণ ভালোবেসে ছিল।
নীলিমা দেবী প্রথমবার নিজের ফেসবুক আইডি খুলে মাধুরী রায়কে মেসেজ করলেন, শেষ যেখানে দেখা করার কথা ছিল, সেখানেই দেখা হবে আমাদের।
ঘড়িতে তখন রাত্রি ১০:৩০ টা। ঋতিকা পাশেই বসে আছে। একবার জিজ্ঞাসা করলো, মামনি, মাধুরী আন্টি কেমন আছে সেটা তো জানতে চাইলে না?
নীলিমা দেবী অভিমানের সুরে বললেন, কাল তো দেখা হচ্ছে আমাদের। তাছাড়া মেসেজ টাইপ করতে ভালো লাগছে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাধুরী দেবীর রিপ্লাই এলো, তাই হবে নীলু, ওই জায়গাতেই আমাদের দেখা হবে। কৃষ্ণচূড়া গাছটা আজও সাক্ষী আছে। আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্য।
নীলিমা দেবী আর কিছু লিখলেন না। ঋতিকা একটা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে। তারপর শান্ত গলায় বললো, মামনি এসো, আমার কোলে মাথা রাখো, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
এত আলোর মাঝেও কত বি’ষণ্ণতা লুকিয়ে থাকে। অথচ তখন অন্ধকার রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাকির আলোতে কত কাব্য বোনা হতো।
এই মাসের মাসিক পত্রিকাতে সব্যসাচী বাবুর লেখা কবিতাটি এই নিয়ে বাইশ বার পড়লো নীলিমা। কেনই বা বারবার পড়বে না? কবিতা লেখা হয়েছে নীল আকাশকে নিয়ে। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললো নীলিমা, এই লুকোচুরি যেদিন শেষ হবে, সেদিন ধ্রুবতারা শুধু নীল আকাশেই দেখা যাবে।
…বাবা গো বাবা! আগুন তাহলে দুই তরফ থেকেই লেগেছে।
…বেশি হেয়ালি করিস না তো, যা বলবি পরিষ্কার করে বল মাধুরী।
…ওওওওও আমিইইই হেয়ালি করি। আর এদিকে যে কবিতায় কবিতায় প্রেম নিবেদন চলছে তাতে কোনো দোষ নেই?
লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেল নীলিমার। মাধুরীর থেকে মুখ ফিরিয়ে উলটো দিকে চেয়ে থাকলো।
দীর্ঘদিন দাবদাহের পর আজ আকাশে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। পাখিরা বুঝতে পেরে সময়ের আগেই তারা বাসায় ফিরছে। শুকিয়ে যাওয়া নদী থেকে পুরো পৃথিবী যেন প্রার্থনা করছে বৃষ্টির। প্রার্থনাতে অনেক জো’র থাকে। মামিমা বলেন, মন থেকে চাইলে একদিন সব পাওয়া যায়।
মাধুরীকে নিয়ে নীলিমা ঘরে ফিরলো, দুজনে সন্ধ্যেবেলা একসাথে পড়বে বলে। মামা কিছুক্ষণ পাশেই বসে ছিলেন ওদের। উনি চলে যাওয়ার পর, ওরা আবার চিঠি লিখতে বসলো।
নীলিমা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে লিখতে শুরু করলো,
প্রিয় ধ্রুবতারা,
ইদানীং কলেজে আপনার আনাগোনা বেড়েছে। বিশেষ কোনো কারণ আছে নাকি? আপনার নতুন বইটি পড়লাম। অবশ্য পড়বার আগে অনেকক্ষণ আটকে ছিলাম উৎসর্গেপত্রে। আচ্ছা মশাই, এই যে আমি আপনাকে চিঠি লিখি, বেহায়ার মতো বলি, ভালোবাসি আপনাকে। আপনার ভালো লাগে? নাকি সবটুকু হেসে উড়িয়ে দেন? তবুও আমি লিখবো। আমাদের গ্রামের পাশে যে সাঁকো টা আছে, তার কাছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। খুব বেশি বয়স নয় গাছটির। যেদিন প্রথম ফুল ফুটবে, সেইদিন আমরা দেখা করবো।
ইতি,
এক নীল আকাশ
সাঁকোর কাছে এসে চিঠিটা আবার বের করে পড়লো সব্যসাচী। কিন্তু ঠিকানাহীন একটা মানুষকে খুঁজবে কী করে সে? নীল আকাশকে দেখা যে অত্যন্ত জরুরী। এখন যে, সেই সব্যসাচীর লেখার প্রেরণা হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি যেদিন ফুলের সাজে সেজে উঠবে, আমি সেদিন নীল আকাশে ভাসবো…
চলবে।