নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০১

0
1

#নীল_কৃষ্ণচূড়া
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

জাভেদা পারভীন যখন তার ছেলের সাথে তার একমাত্র বোনের মেয়ে অনিমার বিয়ে দিতে চাইলেন,তখন প্রত্যুষ রীতিমতো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

প্রত্যুষ তার ছেলে।আপন নয়,তবে দত্তক নেওয়া।দীর্ঘ নয় বছর নিঃসন্তান থাকার পর জাভেদা পারভীন এবং তার স্বামী খোরশেদুল হক চাইল্ড হোম থেকে একটি শিশু দত্তক নেন।তার নাম প্রত্যুষ।
প্রত্যুষ নিজের পরিচয় জানতো না।জীবনের একটা লম্বা সময় জাভেদা এবং খোরশেদ কে মা-বাবা জানার পর হঠাৎই একদিন প্রত্যুষ তার নিজের পরিচয় জানতে পারল।সেটাও আবার তার পঁচিশতম জন্মদিনের কিছুদিন আগে।এই কথা জানার পর প্রত্যুষ কেমন যে পাল্টে গেল।বুঝ হওয়ার পর থেকে যাকে মা বলে জেনে এসেছে,যার আদর শাসন সবকিছুই তার কাছে সহজাত বলে মনে হয়েছে,নিজের পরিচয় জেনে যেতেই প্রত্যুষ আকস্মিকভাবে সেটাকে ভৎসনা আর করুণা বলে বিশ্বাস করতে শুরু করল।তার ধারণা,জাভেদা তাকে ভালোবাসে না।সে কেবল তাকে নিজের স্বার্থের জন্য বড় করেছে।নয়তো আপন মা কখনো নিজের ছেলের সাথে এমন কাজ করতে পারে না।

জাভেদার অন্যায় অবশ্য মিটার স্কেল কিংবা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপার মতো কিছু না।অথবা সেটাকে পুরোপুরি অন্যায় বলা যাবে নাকি,সেটাও নিশ্চিত না।

প্রত্যুষ যখন অনিমার সাথে তার বিয়ের প্রস্তাবে পুরো বাড়ি লণ্ডভণ্ড করছিল,তখন কেবল জাভেদা দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন———-“অনিমা কে বিয়ে করবে না বলে তুমি এমন লঙ্কাকাণ্ড বাধাচ্ছো?”

প্রত্যুষের হাতে তখন একটা ভাঙা ফুলদানির অংশ বিশেষ।প্রচন্ড রাগে নিঃশ্বাস উঠানামা করছিল।সে জাভেদা কে দেখতেই আরো বেশি ক্ষিপ্ত হলো।হাতে থাকা ফুলদানিটা সজোরে মেঝেতে আছাড় মেরে চূর্ণবিচূর্ণ করে বলল———“তো?কি করা উচিত আমার?তুমি একটা প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছো?আমার কি এখন খুশিতে নাচা উচিত?”

জাভেদা কিছুটা ব্যথিত হলেন।অথচ কন্ঠ মোলায়েম রেখে বললেন———-“অনু কোনো প্রতিবন্ধী না প্রত্যুষ।সে একটা দুর্ঘটনায় বাকশক্তি হারিয়েছে।আল্লাহ চাইলে সেও কোনো একদিন কথা বলতে পারবে।”

———“হ্যাঁ,পারবে।এগারো বছর ধরে পারে না,আর আমার সাথে বিয়ে হলেই সে তোতাপাখির মতো কথা বলতে শুরু করবে।তাই না?আমার ভেতর তো জাদু আছে।”

প্রত্যুষ ফুঁসতে ফুঁসতে কথা শেষ করল।রাগ আর ক্ষোভে তার কপালে তখন মোটা মোটা তিনটা ভাঁজ ফুটে উঠেছে।জাভেদা শান্ত হয়ে বললেন————“আজ হঠাৎ এমন করে অনুকে নিয়ে বলছো,যেন অনুকে তোমার স্রেফ প্রতিবন্ধীই মনে হয়।অথচ এই এতোগুলো বছরে তুমি নিজেই কাবেরীর ঘরে গিয়ে অনুর কাছে পড়ে থাকতে।”

প্রত্যুষ কপাল কুঁচকালো।তার চোখে কেমন যে তিরষ্কারের ভাব।জাভেদা কে দেখতেই অবজ্ঞা করে বলল———“অনুর কাছে পড়ে থাকতাম,কারণ আমার অতিরিক্ত বকবক করা মানুষ ভালো লাগে না।অনু চুপচাপ থাকে।তাই তাকে আমার ভালো লাগে।এখন রাস্তার কুকুর বিড়াল কেও তো আমার ভালো লাগে।পাশে পেলে খাবার দেই,যত্ন করি।তাই বলে কি রাস্তার কুকুরকে বিয়ে করবো আমি?”

জাভেদা আর সইতে পারলেন না।সপাটে ছেলের গালে একটা চড় বসিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।প্রত্যুষ তখন হতবাক হয়ে নিজের গাল চেপে ধরেছে।মা তাকে মারল?
তার হাসি পেল ভীষণ।সে দরজা অব্দি এগিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল———“আমি তোমার আসল ছেলে না তো।তাই তুমি এমন তুচ্ছ কারণে আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার পেয়েছ।আমি আসলে তোমাদের বাড়ির কাজের লোক।যার উপর তোমরা তোমাদের সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাও।”

*

অনিমার সাথে প্রত্যুষের বিয়ের ব্যাপারটা সম্ভবত সেদিনই স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।জাভেদা আর প্রত্যুষের সামনে সে কথা মুখে তুলেন নি।প্রত্যুষও আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চায়নি।

এক বিকেলে প্রত্যুষ বাড়ি ফিরতেই জাভেদা তাকে বললেন——-“তুমি কি তোমার খাম্মার বাড়িতে যাবে?আমি একটু পর যাচ্ছি।”

প্রত্যুষ ভ্রু কুঁচকে বলল———“কেন?সেদিকে গিয়ে আমার কি কাজ?”

———“কোনো কাজ নেই।অনুকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।আমি যাচ্ছি সেখানে।তুমি যাবে?”

প্রত্যুষ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।চোখ গোল গোল করে বলল———–“সত্যি?সত্যি অনুকে দেখতে আসছে?”

——-হু।”

——“কিন্তু কেন?অনুর তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।”

জাভেদা হাসলেন সামান্য।কৌতুক করে বললেন——–“হয়নি বুঝি?”

প্রত্যুষের চোয়াল শক্ত।জাভেদা থামতেই সে কঠিন মুখে বলল———“অনুর বয়স মাত্র উনিশ।তার এখনই বিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।অনুকে পড়তে দাও তোমরা।”

——–“অনুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।যেতে চাইলে চলো।”

——–“অবশ্যই যাবো।তোমরা অনুকে কার না কার হাতে তুলে দিচ্ছো,আমার দেখতে হবে না?”

জাভেদা আর দিরুক্তি করলেন না।শুধু যেতে যেতে বললেন——–“যাচ্ছো ভালো কথা।কিন্তু গিয়ে কোনো বাড়তি কথা বলবে না খবরদার।”

প্রত্যুষ হাসল।বিদ্রুপ করে বলল——-“তোমার দত্তক নেওয়া ছেলে তো।তাই এতো অবজ্ঞা করো তুমি আমাকে।”

জাভেদা চুপ হয়ে গেলেন।প্রত্যুষও আর কিছু বলল না।সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির কালো রঙের গাড়িতে করে দু’জন বেরিয়ে গেল অনিমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

________

“কুঞ্জবিতান”
বাড়ির সামনে বড় করে নামফলক বসানো।
বাড়িটা খুব বেশি বড়ো না।আবার তেমন ছোটও না।তিন গন্ডা জায়গার উপর নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন।বাড়ির কর্তা নাজির আহমেদ খুব শখ করে বাড়িটা বানিয়ে ছিলেন।তার একমাত্র সন্তান অনিমা এ ধরনের বাড়ি খুব পছন্দ করে।ছিমছাম গড়নের দোতালা বাড়ি,বিশালাকার বারান্দা।ছাদের সাথে একটা লাগোয়া চিলেকোঠার ঘর,বারান্দা ভর্তি ছোট ছোট গাছ,আর বাড়ির সামনে অল্প জায়গা জুড়ে একটা ছোটোখাটো বাগান।নাজির আহমেদ তার পুরো বাড়ি অনিমার পছন্দ মতোই তৈরি করেছেন।

অনিমার বয়স এখন উনিশ।সে কিছুদিন আগে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছে।অনিমার সমস্যা,সে কথা বলতে পারে না।আট বছর বয়সে একটা এক্সিডেন্টে তার ভোকাল কর্ড গুরুতর আহত হওয়ার পর থেকে সে আর কথা বলতে পারে নি।এক্সিডেন্টের পর ব্রেইন ইঞ্জুরি হয়ে অনিমা বহুদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল।অনিমা এখন চলতে পারে,লিখে লিখে মনের কথা বোঝাতে পারে।তবে তিন তিনটা দেশ ভ্রমণ করেও নাজির সাহেব যা পারেন নি,তা হলো অনিমার বাকশক্তি ফেরানো।শত চেষ্টা স্বত্তেও তিনি কোনো ভাবেই অনিমার বাকশক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেন নি।

অনিমা হলো ধীর লয়ে বয়ে চলা অতি শান্ত জলধারা।জাগতিক কোনো কিছুতে সে সহজেই বিচলিত হয় না।অনু খুব আঁকতে ভালোবাসে।অবসরে সে বারান্দায় পাটি বিছিয়ে আঁকাআঁকি করে।

নাজির সাহেবের দুই ভাইয়ের বাড়ি তাদের সাথেই,এক গলিতে।মাঝেমধ্যে তার ভাইদের সন্তানরা বাড়ি আসে,কিছুক্ষণ থেকে আবার রাতের দিকে চলে যায়।কখনো আবার কাবেরী পারভীনের বোন আসেন তার ছেলেকে নিয়ে।কাবেরীর বোনের ছেলে প্রত্যুষ।বাড়িতে আসার পরেই প্রত্যুষ সবার প্রথমে অনিমার ঘরে গিয়ে বসে।অনিমা অবসর সময়ে মন দিয়ে আঁকাআঁকি করে।প্রত্যুষ গিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে সেই আঁকিবুঁকির বাছবিচার করে।

সেদিন রাতে অনিমাকে দেখার জন্য বাড়িতে পাত্রপক্ষ এলো।ছেলে একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে।বয়সে অনিমার চেয়ে নয় বছর বড়।পাত্রপক্ষ আসা উপলক্ষে নাজির সাহেব তার দুই ভাইকেই বাড়িতে ডাকলেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজির সাহেব সবচেয়ে ছোট।তার বড় ভাইয়ের নাম সোবহান।সোবহান সাহেবের দুই মেয়ে-জয়া,স্মৃতি।
আর তার মেঝো ভাই রিয়াজুল আহমেদের এক ছেলে,এক মেয়ে-আহান,প্রজ্ঞা।

প্রজ্ঞা বাড়িতে এসেই উপরের ঘরে গেল।অনিমা সেখানেই থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।ঘরে তখন জয়া আর স্মৃতি বসা।প্রজ্ঞা ঘরে এসেই এদিক সেদিক তাকাল।অনিমাকে খুঁজে পেতেই সে ক্ষুদ্ধ হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।কর্কশ স্বরে বলল———-“এ্যাই মেয়ে! তুই নাকি বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিস?”

অনিমা অবনমিত মস্তক তুলে তার দিকে তাকাল।কালো মণির দু’টো শান্ত নিরীহ চোখ।সেই চোখ দেখেই প্রজ্ঞা সমস্ত রাগ ভুলে গেল।হতাশ হয়ে বলল——-“তুই সত্যিই বিয়ে করবি অনু?এতো জলদি?”

অনিমা চোখ নামাল পুনরায়।তার সামনে একটা খোলা খাতা।পৃষ্ঠার উপর কোনো লিখা নাই।অনিমা কলম হাতে তুলে লিখলো——-“আব্বুর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আমার কোনো সমস্যা নেই দিভাই।”

প্রজ্ঞা লিখাটা পড়েই কপাল কুঁচকালো।নাক সিটকে বলল——-“তোর ঐ টই টই করা প্রত্যুষ ভাই এসব জানে?”

অনিমা ঠোঁট উল্টে অন্যদিকে ফিরে গেল।সে কেমন করে জানবে?তার সাথে তার তেমন কথা হয় না।

তবে সে এলো মিনিট খানেকের ব্যবধানেই।পরনে গাঢ় নীল শার্ট।হাতে একটা ঘড়ি।সাথে সাদা রঙের জিন্স।এসেই সে সবাইকে উপেক্ষা করে অনিমার দিকে এগিয়ে গেল।অনিমা মাথা তুলে তার দিকে তাকাতেই প্রত্যুষ চোখ পাকিয়ে বলল——“কেস কি রে অনু?তুই ঐ বুড়ো দামড়া কে বিয়ে করতে রাজি হলি কিভাবে?চেহারা দেখেছিস তার?ওমন লোককে বিয়ে করার চেয়ে আজীবন কুমারী থাকা ভালো।কিছু বুঝলি?”

চলবে??