নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৪

0
14

#নীল_কৃষ্ণচূড়া
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৪.

অনু লিখলো——“আমার মাথা ব্যথা করছে।তুমি অন্য ঘরে যাও।”

প্রত্যুষ সেটা পড়েই হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে কাগজটা ফ্লোরে ছুড়ে মারল।তারা বাড়ি ফিরেছে একটু আগে।এসেই প্রত্যুষ সবার প্রথমে তার ঘরে এলো।তারপর এক পায়ের সাহায্যে অন্য পায়ের জুতো খুলে খাটের ঠিক মাঝামাঝি শুয়ে বলল——-“পারবো না।তুই ইদানিং খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিস আমায়।আমি তোর আসল ভাই হলে তুই জীবনেও এমন করতিস না।”

অনিমা কথা বাড়ায় না।চুপচাপ হেঁটে পায়ের কাছ থেকে কাগজটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে।প্রত্যুষের জুতো জোড়া তুলে রাখে স্ব-স্থানে।প্রত্যুষ মাথা তুলে বলল——-“আচ্ছা আচ্ছা।তুই থাক।আমি যাচ্ছি।”

সে উঠে গিয়ে এক কোণায় বসলো।অনিমা খাটে বসার পরেও সে গেল না।উল্টো আলতো হাতে অনিমার কপাল স্পর্শ করে সন্দিহান গলায় বলল——–“মাথা কি বেশি ব্যথা?”

অনিমা উপর নিচ মাথা নামায়।প্রত্যুষ কোমল হাতে তার মাথা টিপে দিতে দিতে বলল——-“তুই আজকে মাহাদ আর দিবা কে পেয়ে দিব্যি আমায় ভুলে গেছিস।আসলে আমি তোর কেউ না।আমি শুধু শুধু তোকে এতো আদর করি।তুই আমাকে একটুও কদর করিস না।”

সে আর কথা বলল না।তার মনোযোগী দৃষ্টি অনিমার দিকে।হাতের চলন খুব সাবধানী।অনিমা পলক ফেলে না সহসা।দখিনের ঠান্ডা বাতাস খিড়কি ঠেলে সাঁ সাঁ করে ঘরের ভেতর ছুটে আসছে।চারিদিকে কি অদ্ভুত স্নিগ্ধতা! অনিমার ইচ্ছে হলো সে একটি গান গাইবে।

“আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো।
হারিয়ে যাবো আমি তোমার সাথে।

সেই অঙ্গীকারের রাঁখি পরিয়ে দিতে,
কিছু সময় রেখো তোমার হাতে।”

সেদিন বিকেলেই প্রত্যুষ জাভেদা পারভীনকে সঙ্গে করে বাড়ি চলে গেল।অনিমা সেসময় রং তুলিতে ল্যান্ডস্ক্যাপের একটা দৃষ্টিনন্দন পোর্ট্রে ফোটানোর চেষ্টা করছিলো।প্রত্যুষ আর যাওয়ার আগে তাকে কিছু বলল না।সে আজ রাতে রাঙামাটি যাচ্ছে।খোরশেদ আহমেদের একটা প্রজেক্টের কাজ চলছে সেখানে।সেই কাজে প্রত্যুষ মাঝে সাঝে সেখানে যায়।

সে বাড়ি এসেই কয়েক মিনিট ঝরনা ছেড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজলো।আজকের দিনে কেমন যে ভ্যাপসা গরম।মেঘ ডাকলেও গরম কমেনি।লম্বা সময়ের গোসল শেষে কিছুটা পরিতৃপ্ত হয়ে প্রত্যুষ বাইরে বেরিয়ে এলো।

খোরশেদ সাহেব ইদানিং ব্যবসার কাজে খুব বেশি ব্যস্ত থাকেন।তাকে আজকাল বাড়িতে পাওয়া যায় না খুব একটা।প্রত্যুষ কিছুক্ষণ নিজের ঘরে পায়চারি করে শেষে তার ঘরে গেল।খোরশেদ আহমেদ তাকে দেখেই মৃদু হাসলেন।ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আন্তরিক স্বরে বললেন———“কেমন আছো,আব্বু?”

——–“জ্বী।ভালো।”

——–“ব্যাগ গুছিয়েছো?”

——-“হুম।”

প্রত্যুষ নিজ থেকেই ডাকলো——–“আব্বু!”

——“বলো।”

——“আমি কি অমিতকে আমার সাথে রাঙামাটি নিতে পারি?”

খোরশেদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন——–“অবশ্যই পারো।এতো ফর্মাল হচ্ছো কেন?”

——“না এমনিই।”

প্রত্যুষ রয়ে সয়ে ধীর কন্ঠে বলল——-“আমি একটু পরেই চলে যাবো।তুমি আম্মুকে বলে দিও।”

——-“অদ্ভুত! তুমি কেন বলছো না?”

প্রত্যুষ আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল।মাথা নামিয়ে দুই হাত কাছাকাছি এনে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বলল——“এমনিই।”

——“প্রত্যুষ!’

——“হুম।”

——“এখানে তাকাও।”

প্রত্যুষ কাচুমাচু মুখে খোরশেদ সাহেবের দিকে তাকালো।তিনি বিষন্ন মুখে বললেন——–“তুমি আবার তোমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করেছো?”

——“বেয়াদবি না আব্বু।”

——-“তাহলে?”

সে কিছুক্ষণ থম মেরে বলল——-“মা অনুর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছিলো।”

——-“এরপর?”

——“এরপর আমি অনেক কাহিনি করেছি।”

খোরশেদুল হক চমকানো সুরে বললেন——-“অদ্ভুত তো!”

——–“অদ্ভুত কেন বললে?”

———“অনুর সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে বলে তুমি তোমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করছো।ব্যাপারটা অদ্ভুত।আমার ধারণা ছিল তোমার এতে তেমন আপত্তি থাকবে না।”

——-“তোমার কেন এমনটা মনে হলো?”

——-“কারণ আমার মনে হয়েছে অনুকে তুমি বেশ পছন্দ করো।”

——“তা করি।এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

খোরশেদুল হক বিস্ময়ে সুর টানলেন——-“তাহলে?”

——-“পছন্দ করা মানেই কি বিয়ে করা?আমরা তো নিরীহ প্রাণীদেরও পছন্দ করি।”

——“সেকি! প্রাণী আর অনু কি এক হলো?তুমি তাকে সত্যিই এতো অবজ্ঞা করো?”

প্রত্যুষ উত্তর দিতে পারলো না।বলতে গিয়ে আমতা আমতা করে শেষে থেমে গেল।অপরাধীর মতো মুখ করে বলল——-“এই উপমা টা আসলে খুব বাজে হয়েছে।আমি এখন অনুধাবন করতে পারছি।অনু শুনলে খুব কষ্ট পাবে।”

তাকে সত্যিই মনঃক্ষুণ্ণ দেখালো।খোরশেদ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না।প্রত্যুষ নিজেও আর সময় নষ্ট করল না।গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরে ইয়ার্ডে দাঁড় করানো।সে ধুপ ধাপ পায়ে নিচে নেমে এলো।সিঁড়ির শেষ মাথায় জাভেদা পারভীন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তাকে দেখেই প্রত্যুষের কদম শ্লথ হলো।সে থেমে গিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।

জাভেদা আগের মতো করেই তার কাছাকাছি এলেন।মনে মনে কি যেন পড়লেন বিড়বিড় করে।তারপর এগিয়ে এসে প্রত্যুষের গলার কাছে একটা ফুঁ দিলেন।প্রত্যুষ না চাইতেও মৃদু হাসলো।এটা আম্মুর বহুদিনের স্বভাব।সে বাইরে যাওয়ার আগে আম্মু এসে তার গায়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে যায়।
প্রত্যুষ তেজ দেখাতে গিয়েও আর কিছু বলল না।জাভেদা তার একটা হাত প্রত্যুষের মাথায় রেখে আর্দ্র স্বরে বললেন———“সাবধানে থেকো বাবা।আয়ুতুল কুরসি পড়ো বের হওয়ার সময়।”

প্রত্যুষ জবাব দিলো না।পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে কেবল বার কয়েক পলক ফেলল।জাভেদার দুই চোখ সামান্য ভেজা।তিনি খুব দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।অথচ প্রত্যুষ দেখলো তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা খুব দুর্বল।সে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরল।নির্বিকার কন্ঠে বলল——-“আসি আম্মু।আল্লাহ হাফেজ।”

জাভেদা পারভীন কাঁপা হাতে ছেলের মাথায় হাত ছোঁয়ালেন।প্রত্যুষ তাকে ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে গেল।তারপর হঠাৎ কি ভেবে যে থেমে গেল।পেছনে ফিরে তাড়াহুড়ো করে বলল——“আম্মু আরেকটা কথা।”

জাভেদা প্রশ্নাত্মক চোখে তার দিকে তাকালেন।প্রত্যুষ গম্ভীর হয়ে বলল——-“আমি যে অনুকে পোষা প্রাণীদের সাথে তুলনা করেছি,এটা একদম ভুল বলেছি।আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি।অনু আসলে একটা পুতুল।তুমি তাকে এই কথা বলবে না কোনোদিনও।আমি কখনোই অনুকে সেই চোখে দেখি না।টাটা।”

সে আর পিছু ফিরলো না।শার্টের কলার টানতে টানতে সে তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।জাভেদা শূন্য চোখে কিছুক্ষণ সদর দরজার দিকে চেয়ে থাকলেন।দেখতে দেখতেই তার মুখের হাসি চওড়া হলো।আজ অনেকদিন পর তিনি প্রশান্তিতে হেসেছেন।

_____

——“অনিমা! তোমার কি কখনো নিজেকে খুব ছোট মনে হয়?”

নাজির সাহেব খুব ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করলেন।তিনি আর অনিমা এই মুহূর্তে তাদের বাড়ির ছাদের উপর পাটি বিছিয়ে বসেছেন।এখন বিকেল পাঁচটা।গোধূলি নামতে আরো অনেক দেরি।নাজির সাহেব বসেছেন মেয়ের মুখোমুখি।

অনিমার হাতে একটা সাদা খাতা আর কালো রঙের কলম।পরনে কলাপাতা রঙের একটা জামা।সে খুব মনোযোগী হয়ে নাজির সাহেবের কথা শুনলো।এরপর হাসিমুখে লিখলো———-“নাহ্।আমার কখনো নিজেকে ছোট মনে হয় না।আমি কখনো সেভাবে কল্পনাই করি না নিজেকে।”

——-“ভেরি গুড।দ্যাটস লাইক আ ব্রেভ গার্ল।কখনো মন ছোটো করবে না এসব নিয়ে।তুমি কিন্তু এক্সিডেন্টর পর খুব হীনমন্যতায় ভুগতে।”

সে লিখলো——–“তখন খুব খারাপ লাগতো আব্বু।কারণ একবার কথা বলতে শেখার পর তারপর বাকশক্তি হারানো খুব কষ্টের।আমার খুব অসহায় লাগতো নিজেকে।”

——-“কিন্তু তুমি অসহায় না অনু।”

——-“জানি।আমি নিজেকে অসহায় ভাবিও না আব্বু।আমি হয়তো কিছুটা অপূর্ণ তাই না?”

——–“তুমি অপূর্ণ নও।স্রষ্টা তোমাকে প্রতিবন্ধকতা দিয়ে পরীক্ষায় ফেলছেন।বুঝলে?”

অনিমা হাসলো।তখনি কাবেরী ছাদে এসে তার দিকে একটি মুঠোফোন বাড়িয়ে দিলেন।নাজির সাহেব অবাক হয়ে বললেন——-“কে ফোন দিলো?”

——“প্রত্যুষ।”

—–“প্রত্যুষ?”

—–হ্যাঁ।

নাজির আহমেদ ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই কাবেরী সেটা অনিমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।অনিমা বেশ শান্ত হয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরল।তারপর উঠে গিয়ে ছাদের এক কোণায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।নাজির আহমেদ একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন——“অনুকে চাইছে?”

—–“হু।”

—–“কেন?”

——-“কথা বলবে তাই।”

নাজির সাহেব হকচকিয়ে গেলেন।
——“অনুর সাথে কথা বলবে?”

——“হু।”

——-“অনু কথা বলবে কিভাবে?”

—–“অনু কথা বলে না।অনু শুধু শোনে।”

কাবেরী ব্যস্ত পায়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন।নাজির আহমেদ তখনও উদগ্রীব চোখে অনিমার দিকে চেয়ে থাকলেন।অনিমা ফোনটা কানে ধরে খুব হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।প্রত্যুষ অন্যপাশ থেকে বলল——“অনু! তুই পাহাড়ে যেতে চাস?তোকে একদিন নিয়ে আসবো এখানে।পাহাড় অনেক সুন্দর।দেখবি?”

অনু ভারি ভারি নিঃশ্বাস ছাড়ল।প্রত্যুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল——-“জায়গাটা ভারি সুন্দর অনু! আমি আর অমিত একটা কটেজ নিয়েছি।বাবার প্রজেক্ট এখান থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে।আমরা সকালে প্রজেক্টের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় কটেজে ফিরি।পাহাড়ি এলাকা,গভীর নিশুতি রাত,জোনাকি পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দ,চারপাশে অদৃশ্য মেঘের ছাড়ছড়ি,আর সাথে মাথার উপর এক ফালি চাঁদ।বিশ্বাস কর অনু,এর চেয়ে চমৎকার কিছু তুই লোকালয়ে আশাই করতে পারিস না।”

প্রত্যুষ থামলো।অনেকটা সময় ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে অনু কোনো পুরুষালি স্বর শুনতে পেল না।কেবল বুঝলো,প্রত্যুষ একটু থেমে থেমে শ্বাস নিচ্ছে।দুই পাশে কি অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য! কোনো শব্দ নেই,বাক্য নেই।অথচ অনিমা আর প্রত্যুষ কতোখানি কথা এগিয়ে নিল! প্রত্যুষ হঠাৎ হেসে বলল——“মাহাদ,দিবা,প্রজ্ঞা আর জয়ার সাথে কথা কম বললে তোকেও আমি এখানে নিয়ে আসবো।মনে থাকবে তো?”

অনিমা হেসে ফেলল হুট করে।প্রত্যুষ সেই হাসি দেখেনি।তবুও আচমকা কন্ঠ নামিয়ে বলল——“তোর জন্য গিফট আছে অনু।শুধু তুই না।আম্মু,দিবা,খাম্মা,মামানি-সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে।”

চারিদকে কি সুন্দর মৃদু ঠান্ডা বাতাস! অনিমা মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে নিল।চারপাশ হঠাৎ মনোরম হয়ে উঠেছে খুব।অল্প বাতাস,বিকেলের দমে যাওয়া সূর্যের আঁচ,অনিমাদের সুন্দর গোছানো ছাদ,আর অন্য পাশে প্রত্যুষের নিরব দীর্ঘশ্বাস।সে মুঠোফোন টা চেপে রাখলো কানের সাথে,খুব গভীরভাবে।

নাজির সাহেবের পা দু’টো শক্ত করে ছাদের মেঝের সাথে আটকে গেল।মনে হলো আরেকটু সামনে এগিয়ে নেওয়ারও কোনো জো নেই।পা টা ভারি হয়ে উঠেছে হঠাৎ।তিনি স্পষ্ট দেখলেন,অনিমা কাঁদছে।সেই অশ্রুতে তার চোখ ভাসছে,গাল ভাসছে,সাথে ভাসছে বুক।কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে উঠছে খুব মৃদু বেগে।নাজির সাহেব কেমন যে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।বুকে কিছু একটা এসে আকস্মিক বেগে আঘাত করল।অনিমাকে আজ তিনি বহুদিন পর বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখছেন।

চলবে-