নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৫

0
211

নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৫

৫.

“তোর অনুকে ভালো লাগে না?”

অমিত যেন দ্বিধায় পড়ে গেল।প্রশ্নাত্মক চোখে সে আবারো তাকালো প্রত্যুষের দিকে।প্রত্যুষ হাতের সিগারেটে ছোট একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল——-“লাগবে না কেন?অবশ্যই লাগে। ”

——-“তাহলে?”

——-“তাহলে আবার কি?”

অমিত বিরক্ত হয়ে বলল——“তাহলে বিয়ে করতে রাজি হোস নি কেন?”

রাতের তখন প্রথম ভাগ চলছে।শৈলচূড়ায় ঠান্ডা বাতাস।প্রত্যুষ সামনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।হাতের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠে আশপাশ কিছুটা ঘোলাটে হয়ে আছে।সে বেশ স্বাভাবিক হয়ে বলল——-“তোকেও তো আমার ভালো লাগে।”

অমিত ভড়কে গেল।
“হ্যাঁ,তো?”

—–“তো চল বিয়ে করে নেই।”

অমিতের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল।প্রত্যুষ তাকে দেখেই শব্দ করে হেসে ফেলল।হাতের সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বলল——“কাউকে ভালো লাগলেই যে বিয়ে করতে হবে,এমন কোনো নিয়ম নেই।ভালো লাগা,আর সংসার করার মধ্যে অনেক তফাৎ।”

অমিত আর কোনো কথা বলল না।প্রত্যুষ কে চেনে সে অনেক বছর যাবত।অনিমার প্রতি তার যেই প্রখর টান,সেটার প্রমাণ সে বহুবার পেয়েছে।অথচ প্রত্যুষ বরাবরই এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত।যেন অনিমার সাথে প্রেম শব্দটির কোনোই যোগসাজশ নেই।

প্রত্যুষ একটু গম্ভীর হয়ে বলল——–“অনু আমার বোন।কতো ছোট্ট অবস্থায় তাকে আমি দেখেছি! আমাদের মধ্যে একটা আদর আদর সম্পর্ক।আমার তাকে আদর লাগে।এই মেয়েটা আমার প্রিয়।আমি তাকে পছন্দ করি,ভালোবাসি।কিন্তু সেটা সহজাত।আলাদা করে কোনো প্রেম টেম নেই।অনুকে আমি আমার জীবনের প্রত্যেক দশায় ঐ আদুরে মেয়ে হিসেবেই কল্পনা করতে চাই।এর বেশি কিছু না।”

——-“তোর ধারণা বিয়ে করলে অনু আর তোর আদরের থাকবে না?”

——-“অবশ্যই থাকবে।কিন্তু অনু তখন আমার স্ত্রী হবে।অতএব তখন আমাদের ভেতর কেবল আদর স্নেহের সম্পর্কই থাকবে না।তখন বিষয়টা খুব জটিল হবে।আমি আমাদের মধ্যে কোনো জটিলতা চাইছি না অমিত।”

অমিত অন্যমনস্ক হয়ে বলল———“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে না এতে তেমন কোনো সমস্যা হবে।কারণ অনু তোর খুব বাধ্য।”

প্রত্যুষ সামান্য শব্দ করে হাসলো।মাথা নেড়ে বলল——“উঁহু।অনু ইদানিং মাহাদ,দিবা,প্রজ্ঞা আর স্মৃতিকে বেশি পাত্তা দেয়।”

———“এতেও তোর সমস্যা?”

———“এটাই তো আমার মূল সমস্যা অমিত।আমি ঐ ব্যাপার গুলো নিয়ে পজেসিভ।অনু আমি বাদে অন্য কারো সাথে বেশি ভাব করলেও আমার সহ্য হয় না।আমার মনে হয়,অনুর সবচেয়ে কাছের মানুষটা আমি হবো।তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা যখন আমি না হয়ে মাহাদ কিংবা দিবা হয়ে যায়,তখনই আমার সবকিছু অসহ্য লাগে।আমি অনুকে তাদের সাথে মিশতে দেখলে অস্তিত্বহীনতায় ভুগি।”

অমিত হেসে বলল——-“বিষয়টা অদ্ভুত না?”

———“হুম।কিছুটা অদ্ভুত অবশ্যই।”

প্রত্যুষ আর কথা বললো না।কটেজের সামনের ঠান্ডা বাতাস হু হু করে ছুটে এসে তার শরীর ছুঁয়ে গেল।প্রত্যুষ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো।তারপর উন্মনা হয়ে বলল——–“আমি প্রচন্ড ইনসিকিউরিটি তে ভুগি অমিত।আমি জানি আমার মা আমাকে ভালোবাসে।কিন্তু কোনো এক জায়গায় আমার মনে হয় যে আমি আসলে কেউ না।তখন প্রচন্ড ফ্রাস্টেটেড লাগে।এর মাঝে অনু আমাকে জোন আউট করে দিলে আমার সত্যিই প্রচন্ড ইগনোরড ফিল হয় অমিত।”

অমিত আস্তে করে একটা হাত তার কাঁধে রাখলো।রাত বেড়েছে।চারপাশে একটা কনকনে শীতের আবহ।অমিত এর মাঝেই বলল——-“এমন কিছু না প্রত্যুষ।অনু তোকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।মাহাদ দিবা ওসব কিছু না।”

প্রত্যুষ বিমূঢ় হলো।তাকে দেখালো বিষন্ন।সে আহত স্বরে বলল——–“মা আমার সাথে রেগে আছে।আমি বিয়েতে মত দেই নি।কিন্তু আমার দিকটা মা বুঝে না।আমি অনুকে সবসময়ই বোনের চোখে দেখেছি।এর বাইরে আমি অনুকে নিয়ে কিছুই অনুভব করি না।”

——–“তাহলে অনুকে অন্য বাড়ির বউ হতে দে।”

——–“এটাই তো সমস্যা,অমিত।অনু যে বিয়ের পর নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হবে,আমাকে কম পাত্তা দিবে,এটাও তো আমার সহ্য হয় না।”

অমিত অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকালো।কপালে একটা হাত চেপে হতভম্ব হয়ে বলল———-“তুই ডাক্তার দেখা প্রত্যুষ।তোর মাথায় সমস্যা।”

প্রত্যুষ হাসে।হাসতে হাসতেই বলে——–“তোকে এখন একটা জিনিস দেখাবো।যেটা দেখলে তোর মাথা ঘুরে যাবে।”

অমিত কপাল কুঁচকে বলল——-“সেটা কি?”

প্রত্যুষ আস্তে করে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল।তারপর সেটা খুলে অমিতের দিকে মেলে ধরল।অমিত গোল গোল চোখে সেদিকে দেখে আবিষ্কার করল,প্রত্যুষের ওয়ালেটে অনিমার একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি।

তার হতভম্ব দৃষ্টি দেখেই প্রত্যুষ হেসে ফেলল।মাথা নেড়ে বলল——–“হু।এরপরেও আমি বলবো,আমি অনুকে একদমই ভালোবাসি না।ছ্যাহ্।”

________

মাহাদ দের নানাবাড়ি গ্রামে। নাম নিশিথপুর।নামটা দারুণ।মাহাদ আর দিবার ভাষ্য মতে,নামের মতো নিশিথপুর দেখতেও দারুণ।আঁকাবাঁকা মেটে রাস্তা,স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা,উঠোনভর্তি ফুলের গাছ,আর প্রশস্ত বিশাল খেলার মাঠ।

রোকসানা একদিন বাড়িতে এসেই বায়না ধরলেন,সবাইকে তার বাড়িতে যেতে হবে।দিবা মাহাদ সবার পরীক্ষা শেষ।এই উপলক্ষে সবাই মিলে কয়েকদিন তার বাড়িতে ঘুরে আসবে।নাজির সাহেব অবাক হয়ে বললেন——–“সেটা কি করে সম্ভব?এখন জানালে কি আর কিছু করা যাবে?কতো কাজ পড়ে আছে।এতো কাজ গোছাবে কে?”

রোকসানা গো ধরে পড়ে থাকলেন।তার শখ হয়েছে তিনি সবাইকে তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবেন।কাবেরী সব শুনে বাধা দিয়ে বললেন——–“শুধু শুধু ঝামেলা করছেন ভাবি।আমরা না হয় পরে কোনোদিন যাবো।”

——–“পরে আর হয় না,কাবেরী।হুটহাট কোথাও ঘুরতে গেলেই মজা।একবার গিয়ে দেখো।ভালো না লাগলে চলে এসো।মানা করবো না আমি।”

কাবেরী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।চাপা স্বরে বললেন———-“অনু তো সব জায়গায় যেতে চায় না।তাই আরকি ভাবছিলাম।”

———“অনুকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তার দায়িত্ব আমি নিবো।”

নাজির সাহেব কন্ঠ নামিয়ে বললেন——-“তুমি শুধু শুধু ঝামেলা করছো রোকসানা।আমরা কিন্তু পরেও দিন তারিখ ঠিক করে যেতে পারি।”

———-“না,ভাই।পরে আর আপনারা যান না।”

নাজির সাহেব পরাজয় মেনে নিলেন।ক্লান্ত নিচু স্বরে বললেন——-“আচ্ছা।দেখো অনুকে নিতে পারো কিনা।আমার তাহলে সমস্যা নেই।”

_______

অনু লিখলো–
“এই অসময়ে গ্রামে টামে যেতে পারবো না আমি।”

মাহাদ সেটা পড়েই বিরক্ত হলো।
———“তোর না গ্রাম ভালো লাগে?এখন হঠাৎ নাটক শুরু করেছিস কেন?”

———“গ্রাম ভালো লাগে শীতে।এখন কি শীতকাল?”

মাহাদ বিরক্ত হলো।কাগজ টা হাত দিয়ে মুচড়ে মাটিতে ফেলে বলল———“শোন অনু! অনেক কষ্টে সবাইকে রাজি করিয়েছি।তুই এখন সবকিছুতে জল ঢেলে দিস না প্লিজ।দয়া করে আমার আর দিবার কথা ভেবে হলেও আমাদের নানুবাড়িতে চল।কতোদিন যাই না অনু!”

অনু অন্য একটা কাগজে লিখলো——–“তোমরা যাও না।আমাকে টানছো কেন?”

মাহাদ মুখ বিকৃত করে বলল——–“তোমাকে কি সাধে টানছি?তোমরা সবাই না গেলে মা আমাদের কাউকেই নিবে না আর।এজন্যই তোমাকে রাবারের মতো টানছি।”

অনিমা পর পর কয়েক বার পলক ফেলল।তারপর বলপয়েন্ট কলমে পুনরায় লিখলো———“প্রত্যুষ ভাই তো আজকে মাত্র বাড়ি ফিরলো।ও যাবে?”

মাহাদকে এবার গম্ভীর দেখালো।সে ভাবুক হয়ে বলল——-“উমম।তার কথা বলতে পারছি না।সে তো শহরের বাইরে গেলে তারপর বাড়ি ফিরে কয়েক ঘন্টা টানা ঘুমায়।তবুও মা তাদের বাড়ি যাবে।বড় ফুফুকে ছাড়া গ্রামের বাড়ি ট্যুর জমবে না।”

দিবা জোরে জোরে মাথা নাড়ল।সায় দিয়ে বলল——–“একদম ঠিক।মূল সমস্যা হলো প্রত্যুষ ভাই।সে মনে হয় না রাজি হবে।”

অনিমা আর কিছু বলে না।মাহাদ আর দিবার মতো তাকেও এই মুহূর্তে কিছুটা ভাবুক দেখালো।সে গালের নিচে হাত দিয়ে ঘড়ির কাঁটা দেখে।দুপুর দুইটা।মামানি এখন গিয়েছে মণি মার কাছে।আর এতোক্ষণে বোধহয় তাদের ঘুরতে যাওয়ার খবর ঐ ছেলের কানেও চলে গেছে।

*

প্রত্যুষ বাড়ি ফিরেছে ঘন্টা দুয়েক আগে।এসেই সে দরজা বন্ধ করে ঘুম দিয়েছে।জাভেদা তাকে দুইবার খেতে ডাকার পরেও সে দরজা খুলেনি।পরে জাভেদা নিজেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলেন।প্রত্যুষ তখনও গভীর ঘুমে।

জাভেদা কিছুক্ষণ একমনে ছেলের দিকে তাকালেন প্রত্যুষ কে নিস্তেজ দেখাচ্ছে।মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ।জাভেদা আস্তে করে তার চুলের ভাঁজে আঙুল চালালেন।তাতেই প্রত্যুষ বিরক্তিতে বিড়বিড় করে উঠল——–“মা প্লিজ।এখন ঘুম ভাঙাবে না আমার।”

জাভেদা রাগ হলেন না।উল্টো হাসলেন কিছুটা।প্রত্যুষের কানের কাছে গিয়ে ধিমি স্বরে বললেন———-“রোকসানা বাড়ি এসেছিল একটু আগে।”

প্রত্যুষ ঘুম জড়ানো গলায় বলল——–“ভালো।এবার যাও।আমি ঘুমাবো।”

——–“রোকসানা বলেছে তার গ্রামের বাড়ি যেতে।বেড়ানোর জন্য।”

—–“তুমি যাও।”

প্রত্যুষ বালিশটা কানের সাথে চেপে ধরল।জাভেদা তার বালিশ টেনে ধরে বললেন———“চলো না বাবা।অনু,মাহাদ,দিবা,প্রজ্ঞা-সবাই তো যাচ্ছে।”

সহসা প্রত্যুষের ঘুম উড়ে গেল।সে এক লাফে উঠে বসে হড়বড় করে বলল——“কিহ্! অনুও যাচ্ছে?”

——–“হ্যাঁ।”

প্রত্যুষ চোখ ডলতে ডলতে বলল——“তোমরা আমাকে রাঙামাটি ফেলেই এতো প্ল্যান করে ফেলেছো?”

——–“প্ল্যান আজকে সকালেই হয়েছে।আমরা কেউ ই আগে থেকে জানতাম না।তুমি এখন বলো,তুমি যাবে নাকি?”

প্রত্যুষ এক লাফে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো।কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল——-“ও বাবা! যাবো না বুঝি?আপন ছেলে না দেখে তুমি আমাকে ফেলেই চলে যাবে?”

———“খামোখা কথার প্যাঁচ ধরবে না প্রত্যুষ।তুমি তো টায়ার্ড।তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

প্রত্যুষ আলমারি খুলে কাপড় বের করতে করতে বলল——“যাবো আমি।”

——-“আচ্ছা আসো।আমি ব্যাগ গোছাই।”

জাভেদা ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।প্রত্যুষ তক্ষুনি মুঠোফোন টা হাতে তুলে কাবেরীর নম্বরে ফোন দিলো।কাবেরী সেটা তুলতেই সে তাড়াহুড়ো করে বলল——“খাম্মা! এক্ষুনি অনুর বাচ্চাকে ফোন দাও।খুবই জরুরি প্রয়োজন।”

কাবেরী সত্যিই ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি অনিমার হাতে ফোন ধরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন।অনিমা কপাল কুঁচকে ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে।
প্রত্যুষ অন্য পাশ থেকে গজ গজ করে বলল———“ঐ অনু! আমাদের আসতে একটু দেরি হবে।তুই যদি ভুলেও মাহাদ অথবা দিবা কারো সঙ্গে গাড়িতে বসেছিস,তাহলে আর জীবনে তোর সাথে কথা বলবো না।খাম্মার সাথে বয়।সমস্যা নাই।তোর বাবার সাথেও বসতে পারিস।কিন্তু ওদের সাথে না খবরদার!”

চলবে-