নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৬

0
13

৬.

প্রত্যুষ চারপাশ দেখে ঠোঁট গোল করে বলল——-“তোদের গ্রাম সুন্দরই।কিন্তু অতোটাও না যতোটা তোরা দুই ভাই বোন বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছিস।”

মাহাদ আড়চোখে তার দিকে তাকালো।তারা কিছুক্ষণ আগে নানুবাড়ি এসেছে।এসে হাত মুখ ধুয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই বেরিয়েছে।বড়রা অবশ্য বের হয়নি।

মাহাদ হাঁটতে হাঁটতে বলল——–“কখন মুখে ফেনা তুললাম?তুমি শুধু আমাদের পচাও।”

———“ওমা।তুলিস নি বুঝি?আমাদের গ্রাম এই,আমাদের গ্রাম সেই।তোদের গ্রামে ডাইনোসর আছে,ডলফিন আছে।কতো কিছুই তো বললি।”

অনিমা ঠোঁট বাঁকা করে হেসে ফেলল।দিবা মুখ ভার করে বলল———“মিথ্যা কথা।আমরা এমন কিছুই বলি নি।”

———“এ্যাহ্।তোমরা কতো সত্যবাদি!”

প্রজ্ঞা অনিমার হাত ধরে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেল।প্রত্যুষের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি অনিমার ঐ হাতের দিকে।অনিমা গাড়িতে নাজির সাহেবের সাথে বসেছে।নাজির সাহেব এখন মামানির বাসায়,ঘুমাচ্ছে।প্রত্যুষ এগিয়ে এসে বলল——-“অনু! এদিকে শোন।”

অনিমা প্রজ্ঞার হাত ছাড়িয়ে তার কাছে গেল।প্রত্যুষ একটা হাত পকেটে গুজে বলল——-“ডিঙি নৌকায় চড়বি?তুই যে ছবি আঁকিস,অমন ডিঙি নৌকা।”

অনিমা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো।প্রত্যুষ নিজেও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।অনুর দুই চোখ কেমন যে টলটল করছে।প্রত্যুষ সামনে যেতে যেতে বলল——–“আয়।আজ আমরা ডিঙি নৌকা চড়বো অনু।”

অনু দুই দিকে মাথা নাড়ে।প্রজ্ঞা এগিয়ে এসে বলল——–“অনু নৌকায় চড়বে না।তার পানিতে ভয় হয়।”

প্রত্যুষ চোখ কটমট করে তার দিকে তাকাল।এগিয়ে এসে জেদি গলায় বলল———“তো আমি কি অনুকে একা একা ছেড়ে দিচ্ছি নাকি?আমিও সাথে থাকবো।আমি থাকতে তার কিসের ভয়?”

———“বাবাহ! তোমার উপরই তো আমার ভরসা নেই।তোমার নিজেরই কোনো ভরসা নেই।তুমি অনুর দায়িত্ব নিবে?”

প্রত্যুষ চোখ মুখ শক্ত করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো।অনিমা দেখলো তার মুখোভঙ্গির আকস্মিক পরিবর্তন।সে এগিয়ে এসে উপরনিচ মাথা নাড়ল।ইশারায় প্রত্যুষ কে বলল,সে ডিঙি নৌকায় চড়বে।

প্রত্যুষের মুখের হাসি চওড়া হলো।সে বিজয়ী হেসে প্রজ্ঞার দিকে তাকালো।গর্ব করে বলল——-“তোমাদের মধ্যে অনু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করে।সে আমার সাথেই যাবে।”

অনিমা অবশ্য সত্যিই তাকে ভরসা করলো।দু’টো ডিঙি নৌকার একটাতে উঠল প্রত্যুষ,অনিমা আর প্রজ্ঞা।অন্য টাতে দিবা আর মাহাদ।

শান্ত স্থবির আর ছবির মতো সুন্দর নদীতে আস্তে আস্তে ডিঙি নৌকাটা এগিয়ে গেল।প্রত্যুষ সামান্য ঝুঁকে হাতের মুঠোয় কিছুটা পানি নিয়ে বলল———“এই নদীটা অনেক সুন্দর।পানি ধরবি অনু?”

অনিমা কিছু বলার আগেই প্রজ্ঞা বাধা দিয়ে বলল——-“না না।অনু পারবে না ওসব।পড়ে যাবে।”

প্রত্যুষের মেজাজ গরম হলো।সে চোয়াল শক্ত করে বলল——“তোমার এতো ভাবতে হবে না।তুমি কথা কম বলো।”

——–“তুমি সবসময় আমার সাথে এমন আচরণ করো কেন?”

——-“তো কি করবো?তুমি সবসময় উল্টাপাল্টা কথা বলো।”

——–“তুমি কাজই করো উল্টা পাল্টা।”

——-“জ্ঞান দিয়ো না তো প্রজ্ঞা।আমার জ্ঞান ভালো লাগে না।”

প্রজ্ঞা মুখ ভার করে অন্য পাশে ফিরে গেল।মুখ ফেরানোর আগে অনিমা কে দেখে সাবধান করল——“এই ছেলে কিন্তু পাগল অনু।একে ভরসা করবি না।”

——-“তুমি কথা কম বলো প্রজ্ঞা।বড্ড বকবক করো তুমি।”

অনিমা ঠোঁট চেপে হাসে।প্রজ্ঞা আর সেদিকে তাকালো না।ঐ ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে।সে কি নিজেকে ওভার স্মার্ট ভাবে?প্রজ্ঞা তাকে বলতে চায়,তুমি একদমই ওমন না।তুমি খুব ক্ষ্যাত প্রত্যুষ।আমার তোমাকে অসহ্য লাগে।অথচ প্রত্যুষ কে মুখ ঘুরিয়ে কিছুই বলা হয় না।সে চঞ্চল হয়ে ডাকে———“অনু! অনু! এখানে আয়।আমার পাশে বস।পড়বি না তুই।তুই পড়তে গেলে আমি তোকে খপ করে ধরে ফেলবো।”

অনিমা সত্যিই আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার পাশটায় গিয়ে বসে।খুশিতে অনিমার দু’চোখ ছলছল।জল তার খুব প্রিয়।তবে ঐ যে,ডুবে যাওয়ার ভয়।অনিমা বুক ভরে শ্বাস নেয়,মনে মনে বাতাস থেকে শক্তি নেয়।তার পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে এখন খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছে।তার নাম আহসানুল হক প্রত্যুষ।যে তার অনুকে কিছুতেই পানিতে পড়তে দিবে না।

অনিমা সত্যিই পানিতে পড়ল না।একহাতে প্রত্যুষের শার্ট খাঁমচে ধরে সে পানির দিকে ঝুঁকলো।
তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে কিছুটা পানি নিজের হাতে নিলো।পানিটা বেশ ঠান্ডা।একেবারে পরিষ্কার।অনিমা সেই পানিটুকু আবার নদীতেই ছুড়ে মারল।প্রত্যুষ তার হাতের কবজি আলতো হাতে চেপে ধরে বলল——“থাক থাক।বেশি ঝুঁকিস না অনু।পড়ে গেলে পরে কেস খেয়ে যাবো।”

প্রজ্ঞা একবার অন্যমনস্ক হয়ে তাদের দিকে তাকালো।তারপরই আচমকা চোখ দু’টো সেখানেই আটকে গেল।শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলো বিস্তৃত হয়ে পানির উপর পড়ছে।সেই আলোর ছটা এসে অনিমার মুখেও পড়ছে।তাকে দেখাচ্ছে গোধূলি কন্যার মতো।আর তার পাশে শার্ট পরা একটা গম্ভীর ছেলে।তার চোখ জোড়া অতি সাবধানে অনিমার চারপাশ দেখে যাচ্ছে।মেয়েটা যদি পড়ে যায়!

প্রজ্ঞা আর সেদিন অন্যকিছু দেখতে পারলো না।যতোক্ষণ সে নৌকাতে ছিলো,ততক্ষণ সে শুধু তাদের দু’জনকেই দেখলো।তার হঠাৎ মনে হলো,এই দৃশ্যটা খুব বেশি সুন্দর।একেবারে নজর লাগার মতো সুন্দর।

____

রাতে আবার চাঁদের হাট বসলো বাড়ির উঠানে।রোকসানা উঠানের উপর একটা সুন্দর চাদর বিছিয়ে সবাইকে ডেকে আনলেন।প্রত্যুষ এসে কপাল চুলকে বলল———“এই রাতে বাইরে বসবো?”

———-“হ্যাঁ,তো সমস্যা কি?”

———“অনেক মশা।”

রোকসানা চোখ রাঙিয়ে বললেন———-“রাঙামাটিতে মশা ছিলো না প্রত্যুষ?তখন তুই ছিলি না সেখানে?”

প্রত্যুষ আশাহত ভঙ্গিতে উঠোনের উপর বসল।তার চুলগুলো কপাল ছাড়িয়ে চোখের পাতার কাছাকাছি এসে থেমেছে।কাবেরী বললেন———-“তোর চুলের এই অবস্থা কেন প্রত্যুষ?”

সে চুল টেনে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“জ্বালাতন করো না তো খাম্মা।আমার লম্বা চুলই ভালো লাগে।”

অনিমা বসেছে উঠানের ডান দিকে।প্রত্যুষ তার পাশে বসে বলল,
“তোর না গতকাল শরীর খারাপ করছিল?তুই আবার রাতে বের হলি কেন?”

অনিমা দুই দিকে মাথা নাড়লো।হাত নেড়ে কিছু ইশারা করার চেষ্টা করতেই প্রত্যুষ মহাবিরক্ত হয়ে তার হাতটা ধরে ফেলল।চোখ গরম করে বলল——“তুই লিখতে পারিস না?কথা শুনিস না তুই?লিখে বল কি বলবি।”

অনিমা নিজেও বিরক্ত মুখে লিখলো।

——-“এখন ভালো আছি।একটু থাকলে কিছু হয় না।”

প্রত্যুষ পড়েই মুখ কুঁচকে তাকালো।অনিমা আজকে একটা নীল কুর্তি গায়ে জড়িয়েছে।তাকে সকালের সদ্য ফোঁটা বেলির মতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।অথচ এখন সকাল না।এখন রাত।রাতে কাউকে বেলির মতো দেখায় না।কিন্তু অনিমাকে দেখাচ্ছে।প্রত্যুষ এক মিনিট একদৃষ্টে তাকে দেখলো।কেন দেখলো?সে জানে না।হয়তো দেখতে ইচ্ছে হলো।এখন মনে হচ্ছে দেখা উচিত হয়নি।সে কেন অনুকে দেখবে?অমিত বার বার তাকে ক্ষেপায়।সে অনুর প্রতি অবসেসড,সে অনুকে পছন্দ করে আরো কতো কি! প্রত্যুষের ধারণা সে অনুকে স্নেহ করে।এর বেশি কিছু না।

____

সেদিন রাতে প্রত্যুষ অনুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো,মাহাদ দিবা প্রজ্ঞা সব অনিমার ঘরে।মাহাদ আর প্রজ্ঞা মনোযোগ দিয়ে একটা কিছু করছিলো।

প্রত্যুষ সামনে এগিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলল——“এ্যাই তোরা কি করিস?”

প্রজ্ঞা বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকায়।মুখ দিয়ে চ কারান্ত শব্দ করে বলে——–“আমরা অনুর চুলে নতুন একটা হেয়ার স্টাইল এপ্লাই করছি।”

———“তোমাদের এসব ফাও কাজ করতে বলেছে কেউ?”

——–“তোমার সমস্যা কি?”

প্রত্যুষ এক ঝাড়ায় মাহাদের হাতটা অনিমার চুল থেকে সরিয়ে দিলো।তার মেজাজ তখন তুঙ্গে।প্রজ্ঞা বলল——“অনুর সবকিছুতে তুমি এতো নাক গলাও কেন?”

——–“আমার নাক আমি গলাই।তোমার সমস্যা কি?”

প্রত্যুষ মাহাদকে ঠেলে অনিমার পাশে গিয়ে বসলো।অথচ আশ্চর্য ব্যাপার,অনিমা সেদিন তার সাথে কোনো কথাই বলে নি।সে ব্যস্ত ছিলো মাহাদদের সাথে।তাদের সাথে তার কথোপকথন দীর্ঘ হয়।অথচ পাশে থাকা প্রত্যুষ অবলীলায় তার চোখ এড়িয়ে যায়।প্রত্যুষ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না।ভেতরে একটা পাথর এসে নিঃশ্বাসের গতি মন্থর করে দিলো।সে নিঃশব্দে উঠে ঘর থেকে বের হয়।যেতে যেতে তার চোখ কাঁপে।অনিমা আজকাল তাকে বড্ড বেশি অবহেলা করে।

______

জাভেদা পারভীন সবে মাত্র রাতের ঔষধ খেয়েছেন।তিনি খুব বেশি রাত জাগতে পারেন না।কাবেরী আর রোকসানা কথা বলছে উঠানে দাঁড়িয়ে।জাভেদা সেখানে যান নি।বারোটার পর জেগে থাকলে তার মাথাব্যথা করে।

দরজায় আচানক ঠক ঠক শব্দ হলো।জাভেদা পারভীন উঠে গিয়ে দরজা খুললেন।দরজার অন্য পাশের মানুষটা তার জন্য অপ্রত্যাশিত।প্রত্যুষ এসেছে।বিমূঢ়,ধস নামা চোখ।জাভেদাকে দেখতেই সে মিছেমিছি রাগ দেখালো।জাভেদা চিন্তিত হয়ে বললেন——-“কি হয়েছে বাবা?”

প্রত্যুষ তার হাত টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এলো।তারপর তাকে বসিয়ে দিলো খাটের ডান দিকে।সে বসলো মেঝেতে।জাভেদার পায়ের কাছে।জাভেদা পারভীন চমকে উঠলেন সহসা।পা জোড়া মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে তুলে বললেন——–“সেকি প্রত্যুষ! কি হয়েছে তোমার?”

প্রত্যুষ সহসা কোনো উত্তর দিলো না।দরজায় আরো এক জোড়া পা এসে থামলো।জাভেদা উঁকি দিতেই দেখলেন,অনিমা একটা খাতা হাতে দাড়িয়ে আছে।জাভেদা হেসে ডাকলেন———“অনু! এসো না মা।”

অনিমা ঘরে আসে।জাভেদা পারভীন তার চুল দেখে বললেন——–“বেণীটা তো খুব সুন্দর হয়েছে।কে করে দিলো?”

অনিমা খাতায় লিখলো——–“মাহাদ ভাইয়া আর প্রজ্ঞা আপু।”

জাভেদা লিখাটা ভালো মতো পড়ার আগেই প্রত্যুষ এক হ্যাঁচকা টানে খাতাটা তার হাতে নিলো।তারপর অহেতুক রাগ ঝেড়ে বলল——–“তো যা।মাহাদ আর দিবার কাছে যা।এখানে কি?”

অনিমা ব্যথিত চোখে তার দিকে তাকায়।জাভেদা পারভীন ছেলেকে ধমক দিয়ে বললেন——–“প্রত্যুষ! এগুলা কেমন কথা?”

অনিমা অভিমানী চোখে কাগজে লিখলো——–“আমরা ছাদে যাচ্ছি।তুমি যাবে?”

প্রত্যুষ সেটা পড়েই গজরাতে গজরাতে বলল——–“না যাবো না।তুই যা ছাদে।আমি পারবো না।তুই ওদের সাথেই থাক।আর জীবনেও আমার কাছে আসবি না।”

অনিমার দুই চোখ ছলছল করে উঠল।সে চুপচাপ চলে গেল ঘর ছেড়ে।জাভেদা রুষ্ট হয়ে বললেন——–“এটা ঠিক না প্রত্যুষ।অনু কষ্ট পেয়েছে।”

প্রত্যুষ জেদ করে বলল——“আমিও কষ্ট পেয়েছি।অনু কি আমার কষ্ট বোঝে?আমি এতো কেন বুঝবো তার কষ্ট?”

জাভেদা থেমে গেলেন।প্রত্যুষ তার কোলে মাথা রেখে বলল——–“মা তোমাকে একটা কথা বলি?”

জাভেদার শ্বাস আটকে এলো।কতোগুলো দিন পর প্রত্যুষ এভাবে তার কোলে মাথা রাখলো! তার নেই অভিমানী কন্ঠ।ক্রিকেট খেলায় হেরে গেলে সে এভাবে মন খারাপ করতো।তারপর কতো বছর কেটে গেছে! এক বছর ধরে প্রত্যুষ আর মায়ের কাছে আসে না।আজ এলো।মায়ের কোলে মাথা রেখে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেল।জাহানারা বললেন——–” কি হয়েছে তোমার বাবা?বলো না।”

প্রত্যুষ বলল——–“মা! আমি অনুকে বিয়ে করতে চাই।আমি অনেক ভেবেছি।আমি আমার আগের সমস্ত কথা ফিরিয়ে নিলাম।আমি অনুকে বিয়ে করবো মা।তুমি রাগ করো না প্লিজ।তুমি খাম্মা আর আঙ্কেল কে বলো।আমি শুধু অনুকেই বিয়ে করতে চাই মা।তুমি দয়া করে আমার এই কথাটা শোনো।”

জাভেদা পারভীন ভাষা হারিয়ে ফেললেন।হতভম্ব হয়ে তিনি বসে থাকলেন আগের মতো করে।প্রত্যুষ শ্বাস ফেলে বলল——-“আমার ইদানিং খুব মন খারাপ লাগে আম্মু।আজ আমার মনে হলো,অনুর হাতটা ধরে বসে থাকলে আমার মন ভালো হবে।আমি অনুকে বিয়ে করতে চাই আম্মু।”

জাভেদা ছেলের মুখটা দুই হাতের আজলে নিলেন।প্রত্যুষ আজ কোনো বাড়াবাড়ি করলো না।তাকে দেখালো শান্ত আর উৎসুক।সে জবাবের অপেক্ষায় মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো।অথচ জাভেদা কিছু বলার আগেই ছাদ থেকে আগত বিকট শব্দে মা ছেলে দু’জনই কেঁপে উঠল।

প্রথমে একটা ধস নামার মতো বিকট শব্দ।তারপর একটা মেয়েলির কন্ঠের ভয়ংকর,গা কাঁটা দেওয়া বিভৎস আর্তচিৎকার।প্রত্যুষ আর জাভেদা ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর দু’জনেই খেই হারিয়ে দরজার দিকে ছুটলেন।

সেই রাত নিশিথপুরের ঐ ছোট্ট বাড়িতে বিভীষিকা এনে দিয়েছিল।চারপাশে মানুষের আর্তনাদ আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল বার বার।প্রত্যুষ যখন দিগবিদিক ভুলে বাড়ির উঠানে ছুটে এলো,তখন অনিমার ছোট্ট শরীরটা রক্তে ভেসে বড়ো বিচ্ছিরি হয়ে উঠেছিল।প্রত্যুষ আর সামনে এগোতে পারে নি।পা দু’টো বরফ হয়ে জমিনের সাথে গেঁথে গেল।কাবেরী ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছেন।শহর থেকে ছুটে আসা এম্বুলেন্সের শব্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে।কিন্তু প্রত্যুষের কাছে সব ঘোলা লাগে।একসময় প্রজ্ঞা তার সামনে এসে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।প্রত্যুষ কাঁদে না।সে দেখে অনিমার রক্তাক্ত নিথর শরীর।সে কানামাছি খেলতে গিয়ে পা পিছলে ছাদ থেকে পড়ে গেছে।কি বিভৎস একটা দৃশ্য স্থির চিত্রের মতো চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে!

প্রত্যুষ প্রজ্ঞাকে সান্ত্বনা দিলো না।সে ভারি হয়ে থাকা পা দু’টো টেনে অনিমার কাছে গেল।ততক্ষণে অনিমা কে স্ট্রেচারে তোলা হয়েছে।অনিমার রক্ত জমে গেছে।আঠালো তরল চ্যাট চ্যাটে হয়ে মাথায়,কপালে আর হাতে মেখে আছে।চারপাশে অসম্ভব কোলাহল,অথচ প্রত্যুষ কিছুই শুনে নি।
সে দেখলো অনিমার ঘোলাটে চোখ।ঘন্টা দেড়েক আগে মেয়েটা মন খারাপ করে তার ঘর থেকে চলে এলো।আচ্ছা,অনুর মন কি এখনো খারাপ?প্রত্যুষ কি তার পাশে গিয়ে বসবে?অনু কি আবার অভিমান করবে?কাঁদবে ভীষণ করে?

চলবে-