নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৯

0
12

৯.

জীবন থমকায়,সময় না।
সময় তার গতিতে,তার ছন্দে এগিয়ে যায় অহর্নিশ।
অনিমার জীবন থমকালো,নষ্ট রেডিওর মতো এক জায়গায় আটকে রইলো বছরের পর বছর।জীবনের গতি ঘুরে গেল।আম গাছের চারাটা ডালপালা মেলে ধরে প্রকান্ড আকার ধারণ করলো।
পরিবর্তন হলো না শুধু বনসাই গাছটার।আর সাথে অনিমার।

প্রত্যুষ একটা চাকরি নিয়েছে বছর দেড়েক আগে।তার অফিস বনশ্রীতে।অনিমার হাসপাতাল সেখান থেকে পাঁচ কিলো দূরে।সে অফিস শেষে বেরিয়ে একবার হাসপাতাল যায়।তারপর বাড়ি আসে।গোসল করে কিছুক্ষণ খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে।বিকেলের পর আবার হাসপাতাল যায়।

অনিমার অবস্থার উন্নতি বলতে তার ক্ষতগুলো দিনে দিনে সেরে উঠেছে।তাকে আর আগের মতো বিধ্বস্ত,ভয়ংকর দেখায় না।কিন্তু মুখে একটা অসহায়ত্ব আর মলিনতার ছাপ আছে।ঐ মলিনতাটুকু প্রত্যুষ মাঝে মাঝে দেখতে পায়।

জাভেদা পারভীন সেদিন একমনে রান্না করছিলেন।প্রত্যুষ এক গ্লাস পানি হাতে রান্নাঘরে এলো।উৎফুল্ল স্বরে বলল——-“আম্মু কি করো?”

——-“রান্না করি বাবা।তুমি না কোরমা খেতে চাইছিলে?”

——-“হু।”

——–“কোথায় যাও বাবা।”

——-হসপিটালে।

জাভেদা হাত থামালেন।কাজ ফেলে চোখ আনলেন ছেলের দিকে।অনুভূতিশূন্য গলায় বললেন——আর কতো প্রত্যুষ?

——-যতোদিন না অনু চোখ খুলছে।

——-নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো তুমি।”

—-উঁহু।বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজছি আম্মু।

—–এভাবে বেঁচে থাকা যায় না।

——আমি তো পারছি।

জাভেদা পারভীর পরাজয় মেনে নিলেন।স্টোভ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন——-জীবন এভাবে যায় না প্রত্যুষ।কারো জন্য কারো জীবন থামে না।

——-আমি জীবন থামাই নি আম্মু।আমি অফিস করছি,নিজের দৈনন্দিন কাজ করছি।কখনো আবার রাতে ল্যাপটপে মুভি দেখছি।আমার জীবন তো দিব্যি চলছে।

——তুমি ঘুরতে যাও না।পারিবারিক দাওয়াতেও যাও না।এভাবে কি জীবন চলে প্রত্যুষ?আর কতো?অনিমার অপেক্ষায় আর কতোগুলো বছর বিসর্জন দিবে তুমি প্রত্যুষ?

——আমি বিসর্জন দিচ্ছি না।আমি সংসার করছি।আমি সকালে চাকরি তে যাই।তারপর আমি আমার স্ত্রীয়ের দেখভাল করি।আবার মাঝে মাঝে আমি আমাদের ঘর সাজাই।

প্রত্যুষ প্রশস্ত হাসলো।অথচ জাভেদা পারভীনের দু চোখ টলমলে জলে ভরে উঠলো।তিনি ছেলের কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন——–এভাবে জীবন চলবে না প্রত্যুষ।সবকিছু এতো সোজা না।আমাদের সবারই একটা সময় একজন মানুষের প্রয়োজন হয়।

——মানুষ তো আছে।অনুর কাছে আমি আছি।আর আমার কাছে অনু আছে।

জাভেদা আবার কাজে মনোযোগী হয়ে উঠলেন।রান্নার ধোঁয়া উপরে উঠে তার চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে।তিনি সবকিছু ঘোলা দেখছেন।সম্ভবত চোখ দু’টোই ঘোলা হয়ে গেছে।প্রত্যুষ আলতে করে তার কাঁধে মাথা নাড়লো।জাভেদ শক্ত থাকলেন।কিন্তু কন্ঠ ভেঙে এলো।তিনি বড় বড় শ্বাস ছেড়ে বললেন——-“জীবনকে যেই বিচ্ছিরি শাস্তি তুমি দিচ্ছো,যেই আগুনে তুমি রোজ পু ড় ছো,আমি দোয়া করি,স্রষ্টা যেন তোমাকে যেই আ গু ন থেকে ফানাহ দেয়।আমার তোমার জন্য কষ্ট হয়।আমার তোমার এই রূপ সহ্য হয় না।”

প্রত্যুষ বেখায়ালে হাসলো।নিঃশ্বাস সামলে বলল——-“অনুরও খুব কষ্ট হয় মা।সে বলতে পারে না।কিন্তু আমি জানি।অনুও তো কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে মা।আমাদের সবার জীবনেই কি আরামের হয় বলো?”

_____

প্রত্যুষ ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরিয়ে অমায়িক হাসল।প্রজ্ঞা এসে অন্য একটা চেয়ারে বসলো।প্রত্যুষ ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর রেখে বলল——–“কি ব্যাপার প্রজ্ঞা?মন খারাপ তোমার?”

——–“কই না তো।”

——গুড।শুনলাম তোমার নাকি বিয়ের আলাপ চলছে বাড়িতে?

প্রজ্ঞা বেশ ক্ষীণ স্বরে বলল—–হ্যাঁ।এমনটাই শুনছি আমিও।

——তো এমন মন মরা হয়ে আছো কেন?বিয়ের খবর শুনলে তো মেয়েরা খুশি হয়।

——-আমি তো খুশি হতে পারছি না।

——-সেকি! কেন?

প্রজ্ঞা শূন্য চোখে সামনে দেখতে দেখতে বলল—–জানি না।আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।

——-কেন?তোমার বয়স তো বিয়ের জন্য পারফেক্ট।

——-তুমি আমার বয়স জানো?

প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।প্রত্যুষ শব্দ করে হেসে উঠল।বলল—–জানবো না কেন?তোমার বয়স পঁচিশ।তুমি আমার চার বছর জুনিয়র।তোমার জন্মদিন অক্টোবর মাসের এগারো তারিখ।

প্রত্যুষ সেই আগের মতো হাসে।প্রজ্ঞা বড় বড় ডাগর চোখে তার মুখের দিকে তাকায়।আবেগী মেয়েদের মতো ছটফটে হয়ে বলে——“আর কি জানো তুমি আমাকে নিয়ে?”

বলার পরেই তার মনে হলো,সে সীমা ছাড়িয়ে গেছে।সাথে সাথে সোজা হয়ে বসে অন্যদিকে তাকালো প্রজ্ঞা।প্রত্যুষ চাপা স্বরে বলল——–“আর জানি তোমার এখন বিয়ে করতে হবে।তোমার সব সমস্যার সমাধান হলো বিয়ে।”

প্রজ্ঞা চুপ করে বসে থাকলো।তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।দুই ফোঁটা তরল টুপ টুপ করে মেঝেতে পড়তেই সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।অথচ সে পারলো না।আচমকা সুনশান নিরব কেবিনে প্রজ্ঞা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

প্রত্যুষ প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।তারপর স্বাভাবিক হয়ে এলো।জীবনে হয়তো প্রথম প্রজ্ঞার জন্য তার মায়া হচ্ছে।সে একটা হাত প্রজ্ঞার মাথায় রেখে বলল——–“আই অ্যাম সরি প্রজ্ঞা।আমার মনে হচ্ছে তোমার এই অবস্থার জন্য কোনো না কোনো ভাবে আমি দায়ী।”

প্রজ্ঞা হাত দু’টো মুখের উপর চেপে ধরল।শ্বাস টানতে টানতে বলল——না।তোমার দোষ নেই।আমার দোষ।আম….আমি আর কখনো আসবো না তোমার সামনে।সরি,সরি।

——অযথা ভুল বুঝছো প্রজ্ঞা।

——তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।

——-আচ্ছা তাহলে ঠিকটা বোঝাও আমাকে।

প্রজ্ঞা কিছুক্ষণ মাথাটা চেপে ধরে বসে।তারপর আহত গলায় বলে——–আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।জানি না কেন এতো কষ্ট হচ্ছে।

——সময় নেও প্রজ্ঞা।সম্ভব হলে তোমার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথে কথা বলো।আমার মনে হচ্ছে বিয়ের পর তুমি কিছুটা বেটার ফিল করবে।

প্রজ্ঞা কিছু সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালো।চারদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।তার মনে হচ্ছে,দীর্ঘদিনের লুকোচুরি খেলায় সে হেরে গেছে।প্রত্যুষ তার সবটা পড়ে নিয়েছে।সে সব জেনে গিয়েছে।অথচ তার তো জানার কথা ছিলো না।

সে ওড়না টা ভালো মতো মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে বলল——–“আসি প্রত্যুষ।ভালো থেকো তুমি।”

সে আর কথা বাড়ায় না।জমে যাওয়া পা দু’টো টেনে কোনো রকমে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।তার মনে হলো,পুরো দুনিয়া ঘুরছে।চরকির মতো।আরেকটু হলেই সে নিজেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

একটা হাত আপনাআপনি মাথায় গিয়ে ঠেকলো।এই জীবনে প্রথমবার প্রত্যুষ তার মাথায় হাত রেখেছে।প্রজ্ঞা এতে খুশি হয় নি।তার লজ্জা হচ্ছে।ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা।প্রত্যুষ সব বুঝে গেছে।বুঝে গেছে বলেই সহানুভূতি দেখাচ্ছে।মানুষ তো আর সবাইকে সহানুভূতি দেখায় না।লুজারদের দেখায়।প্রজ্ঞা লুজার।তাই তাকে দেখাচ্ছে।

_______

এরপর কার্তিকের একটা ঝলমলে দিনে প্রজ্ঞার সাথে একজন ভদ্রলোকের বিয়ে হয়ে গেল।ভদ্রলোক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।চট্টগ্রামে পরিবার নিয়ে থাকেন।বিয়ের পর প্রজ্ঞা কেও সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো।

প্রজ্ঞা বিয়ের দিন একটা গোলাপি শাড়ি পরেছিল।প্রত্যুষ তার বিয়েতে এসেছিল।সে তাকে উপহার দিলো একটা জুয়েলারি বক্স,আর একটা পার্লের নেকলেস।

প্রজ্ঞা বিয়ের পর একবার অনিমার কেবিনে গিয়েও তার সাথে দেখা করলো।প্রত্যুষ বলল——আমাদের জন্য দোয়া করবে প্রজ্ঞা।

প্রজ্ঞা হাসে।সবসময়ের মতো বিনীত স্বরে জবাব দেয়——আসি আমি।ভালো থেকো।

তারপর সে গিয়ে কালো রঙের গাড়িতে বসে।গাড়িতে তার পাশে জুয়েল বসে।জুয়েল তার বর।দেখতে খারাপ না।উঁচা লম্বা বেশ ভালো দেখতে।প্রজ্ঞা তাকে নিয়ে অনায়াসে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।

গাড়িটা এক সময় চলতেও শুরু করে।প্রজ্ঞা সেই গাড়ির চাকার মতো অতীতের সমস্ত কিছু পিঁষে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।তারপর কেবল এগোতেই থাকে।আর পিছু ফেরা হয় না।

*

*

এক পূর্ণিমা রাতে আহসানুল হক প্রত্যুষের সমস্ত অপেক্ষাদের অবসান ঘটিয়ে অনিমার জ্ঞান ফিরে এলো।
এমন না যে জ্ঞান ফিরে আসার পর সে গবাদি পশুর মতো দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেল।কিন্তু তার নিথর শরীর সে রাতে বহু বছর পর কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠতে সক্ষম হলো।

ডাক্তার যখন তাকে এই কথা জানালেন,তখন সে পুরো বরফের মতো জমে গেল।এমনকি তাকে কেবিনে ডাকার পরেও সে কিছুক্ষণ অনুভূতিশূন্য হয়ে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকলো।তার মনে হলো,তার দুই পা আবারো ভারি হয়ে উঠেছে।সে আর হাঁটতে পারবে না কখনো।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সে কেবিনের ভেতর এলো।
টুট টুট শব্দে তখনও কেবিনের যন্ত্রপাতি আগের মতো চলছিল।প্রত্যুষের পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার হলো।সে সামনে তাকাতেই দেখলো অনিমার হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে।

ডাক্তার ইকবাল সিদ্দিক কিছুটা ঝুঁকে নরম গলায় বললেন——-“অনিমা! তুমি কি কিছু শুনতে পারছো?অনিমা! দেখো।দেখো তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছে।”

প্রত্যুষ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে এলো।অনিমা তখন বড় বড় করে শ্বাস টানছে।প্রত্যুষ বলল——“আমি কি অনুর হাত ধরতে পারি?”

—–“অবশ্যই।তুমি ওর হাসব্যান্ড।আমার মনে হয়,সে তোমাকে দেখে আরো খুশি হবে।”

——–“কিন্তু সে তো চোখ খুলছে না।”

ইকবাল সিদ্দিক তার অধৈর্য মুখটা দেখে হেসে ফেললেন।খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বললেন——“খুলবে বাবা।অপেক্ষা করো একটু।”

প্রত্যুষ গিয়ে তার একটা হাত চেপে ধরল।মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল—–“অনু!অনু! এদিকে তাকা।দেখ।
দেখ,আমি কতো বড় হয়ে গেছি।”

অনিমা সেদিনই তাকালো না।সে পরের দিন চোখ খুলল।একেবারে নবজাতক শিশুর মতো পিট পিট করে চোখ খুলে সে সামনে তাকালো।সবার প্রথমেই সে দেখলো মোটামুটি বয়সের একটা ভদ্রলোককে।তার নাম ইকবাল সিদ্দিক।তিনি চওড়া করে হাসি দিয়ে বললেন——-কনগ্রেচুলেশনস অনিমা।তুমি ভীষণ সাহসী।সাহসী বলেই তুমি ফিরে এসেছো।উই আর সো প্রাউড অফ ইউ।”

অনিমা দুর্বল শরীরে কিছুটা হাসার চেষ্টা করে।লোকটার কথা সে শুনতে পারছে।মনে হচ্ছে অনেক দূরে কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে কেউ তার সাথে কথা বলছে।কেমন ক্ষীণ আর ভাঙা কন্ঠস্বর।সে কেবল মৃদু হাসে।হেসে জানায়,সে সব শুনতে পায়।

এরপর সেদিন রাতেই ঐ উষ্কখুষ্ক ছেলেটির সাথে তার দেখা হয়েছিল।কি যেন নাম তার?
মনে পড়েছে।আহসানুল হক প্রত্যুষ।সে প্রথমে খুব জড়োসড়ো হয়ে এলো।যেন অনিমাকে সে খুব ভয় পায়।এসেও সে এক দফা হেসে অনিমা থেকে দুরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো।বিড়বিড় করে কি যেন বলল।অনিমা শুনতে পায় নি ঠিক মতো।

অনিমা আলতো করে তার হাতটা প্রত্যুষের দিকে বাড়িয়ে দিলো।প্রত্যুষ প্রথমে সে হাত ধরল না।সে দেখলো অনিমার হাতটা থরথর করে কাঁপছে।অনিমার দুই ঠোঁট সামান্য বেঁকে আছে।সে কি হাসছে?

প্রত্যুষ দিগুন কাঁপতে কাঁপতে তার হাতটা ধরল।তারপর ধপ করে বেডের এক পাশে বসে গেল।সময় গড়ায়,মুহূর্ত অতিবাহিত হয়।এরপর প্রত্যুষ আচানক বাঁধনহারা হয়ে মেয়েটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।অনিমা হাঁসফাঁস করে উঠে দুইবার শ্বাস ছাড়ে।প্রত্যুষ তার ঝরঝরে চুলের ভাঁজে মুখ গুজে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে——–অনু! আমি একদম ভালো নেই অনু।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আমি অনেক দিন প্রাণখুলে হাসি নি অনু।কাঁদিও নি।আমি শুধু শুকনো চোখে সব দেখেছি।তোকে এতো জোরে ধরলাম বলে কষ্ট পেলি অনু?
আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত।আমি একটু এভাবেই থাকি কিছুক্ষণ?প্লিজ?”

চলবে-