নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
2

#নীল_কৃষ্ণচূড়া [অন্তিম পাতা]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১১.

আমার ক্লান্ত মন,,
ঘর খুঁজেছে যখন।
আমি চাইতাম__পেতে চাইতাম,
শুধু তোমার টেলিফোন।

অলস মেঘলা মন,,
আমার আবছা ঘরের কোণ।
রোদ গাইতো__আমি ভাবতাম,
তুমি আসবে আর কখন?

বাইরে গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডাকছে।প্রত্যুষ এখনো অফিস থেকে ফিরেনি।আমি সত্যিই নব বধূর মতো শাড়ি গয়না পরে তার জন্য বসে আছি।সে আসবে কখন,কিছু জানি না।আকাশের যা অবস্থা! তার অফিস শেষ হলেও বৃষ্টিতে আটকে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।

আমি বসে আছি অধীর আগ্রহে।কিছুক্ষণ আগে ইলিশ মাছের টুকরো ম্যারিনেট করে এসেছি।প্রত্যুষ বলেছে,মাতব্বরি করে একা একা না ভাজতে।আমিও ভালো বউয়ের মতো মাতব্বরি না করে তার কথা রেখেছি।সে আসার অপেক্ষায় আমি রান্নাঘরে অর্ধেক কাজ ফেলে ঘরে এসে বসে আছি।

ওহ! বলা হয় নি।প্রত্যুষের পোস্টিং এখন গাজীপুরে।আমরা থাকি টঙ্গীর কাছে একটা তিনতালা বাড়িতে।প্রত্যুষ নিজেই বছর খানেকের জন্য টঙ্গীতে পোস্টিং নিয়েছে।তার নাকি আর ঢাকা শহর ভালো লাগে না।সে রাজধানীর দূষিত হাওয়া থেকে মুক্ত হয়ে কিছুদিন ভালো বাতাস খেতে চায়।আমি বুঝি না,টঙ্গীর হাওয়া কোথাকার ভালো হাওয়া।সে তো একই অবস্থা।সারাদিন বাস ট্রাকের প্যা পু শব্দ।

আমি এখন সুস্থ।হাঁটাচলা করতে পারি,টুকটাক কাজ করতে পারি।সবই পারি।উঁহু,কথা বলতে পারি না।আমি নাটক সিনেমায় থাকলে বোধহয় এক অসুখ সারলে অন্যটাও সেরে যেতো।কিন্তু আমি তো নাটকের চরিত্র না।আমি একটা র ক্ত মাং সের মানুষ চরিত্র।তাই ভোকাল কর্ডের সমস্যা আমার এখনও ঠিক হয়নি।
হাহাহা।
ঠিহ হয়নি বলেই এমন লিখছি।নয়তো মুখ দিয়ে পট পট করে সব বলে ফেলতাম।

আমাদের বাড়িটা সুন্দর।প্রত্যুষ অনেক খুঁজে বের করেছে।পুরান একটা ইটের দালান।কিন্তু জানালার দৃশ্য চমৎকার।
“আমার মন বসে না শহরে,ইট পাথরের দেয়ালে” এই গানের সাথে যারা একাত্ম পোষণ করেন,তারা এক রাত আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন।আমাদের বাড়ি ইট পাথরের হলেও আপনার মন বসবে।মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে,সেই চমৎকার দৃশ্য এক কাপ চা হাতে জানালা দিয়ে দেখতে দারুণ লাগে।আমি দেখি।মন ভালো হয় আমার।

ঐ যে বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রত্যুষ সাহেব কে দেখা যাচ্ছে।তিনি ভিজে গেছেন ভীষণ ভাবে।তার হাতে একটা বাজারের ব্যাগ।তার সাবধানী কদম।কাদা পানিতে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার চিন্তায় তার কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়েছে।সাথে নাকটাও কুঁচকে রেখেছে কেমন করে।আমার তাকে দেখেই একটা গান মাথায় এলো-

একটা ছেলে মনের আঙিনাতে,
ধীর পায়েতে,,এক্কা-দোক্কা খেলে।
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে;
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে।

*

*
প্রত্যুষ বাড়ি এলো কাকভেজা হয়ে।হাতে একটা বাজারের ব্যাগ।বৃষ্টির পানিতে ভিজে তার শরীর জুবুথুবু হয়ে ছিল।পরনের হালকা নীল শার্টটা অসহ্য বৃষ্টির দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে তার গায়ের সাথেই লেপ্টে ছিলো।মাথায় জমে থাকা পানি টপ টপ করে তার চুল বেয়ে নেমে আসছিলো।

অনিমা দরজা খুলে মৃদু হাসলো।প্রত্যুষ বিরক্ত মুখে বলল——“একদম জামা কাপড় সব ভিজিয়ে দিয়েছে শালা।”

সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়া দেয়।গায়ের অতিরিক্ত পানিটা ঝরে যেতেই সে ক্লান্ত পায়ে ভেতরে আসে।অনিমা দরজা ছেড়ে বেশ উৎসুক চোখে তার দিকে তাকালো।সে আজ শাড়ি পরেছে।প্রত্যুষ সেটা দেখলো না?দেখে কোনো মন্তব্য করলো না?

প্রত্যুষ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তার দিকে তাকালো।তারপর ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান গলায় বলল——কি সমস্যা?কি চাই?

অনু দুই দিকে মাথা নাড়ে।ইতস্তত হয়ে পিছিয়ে যায় দুই কদম।প্রত্যুষ বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে সেটা গলার দুই পাশে ঝুলিয়ে বলল——-তোকে খুব বিশ্রী লাগছে।এবার সামনে থেকে যা।

অনিমার পুরো মুখ ভোঁতা হয়ে এলো।সে চুপচাপ তার সামনে থেকে সরে এলো।তাকে মোটেই বিশ্রী লাগছে না।কিন্তু সমস্যা হলো ঐ ছেলেটা কোনোদিন তার প্রশংসা করে না।সে সারাদিন থাকে সংসারের দায়িত্ব আর অনুর যত্ন নিয়ে ব্যস্ত।

প্রত্যুষ গোসল করে একটা কালো ট্রাউজার আর সাদা শার্ট পরে বেরিয়ে এলো।তারপর ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে গিয়ে স্টোভ জ্বালালো।
অনিমা বসার ঘর থেকে একবার সেদিকে তাকালো।তারপর মুখ ভার করে সোফাতেই বসে থাকলো।

প্রত্যুষ সব কাজ শেষে ঘেমে নেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।টেবিলের উপর মাছ ভাজার প্লেট টা রাখতে রাখতে গলা উচিঁয়ে বলল——অনু আয়।খেতে আয়।

অনিমা এলো না।প্রত্যুষ নিজেই তাকে হাত ধরে টেনে চেয়ারে এনে বসালো।একটা লোকমা তুলে তার মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল—–নে হা কর।

অনিমা মুখ ভেংচি মেরে অন্যদিকে ঘুরে গেল।প্রত্যুষ বলল——-“অনু! অনেক কষ্টে ঘেমে ঘেমে রান্না করেছি।হা কর।খিদে পেয়েছে আমার।”

অনিমা উঠে হনহন করে নিজের ঘরে গেল।তারপর একটা কাগজ এনে লিখলো—–খাবো না আমি।তোমার রান্না তুমিই খাও।

——-জ্বালাবি না অনু।এমনিই বস সারাদিন কু ত্তার মতো খাটায়।মেজাজ গরম আছে আমার।

——-আমারও মেজাজ গরম।

প্রত্যুষ চোখ কুঁচকে বলল——কেন?তোর মেজাজের কি হয়েছে?

——আমি শাড়ি পরেছি।তুমি কিছু বললে না কেন?

প্রত্যুষ হঠাৎ কেমন ইতস্তত বোধ করলো।আরেকবার খাবারের লোকমা তুলে বলল——তো তুই শাড়ি পরলে আমি কি করবো?নে হা কর।ঠান্ডা হচ্ছে ভাত।

অনিমা ফোঁস ফোঁস শ্বাস ছেড়ে পুরো খাবার শেষ করলো।প্রত্যুষ নিজেও খেলো কোনো রকমে।অনিমা তার প্লেট হাতে নিতেই প্রত্যুষ তার হাত ধরে বলল——লাগবে না ম্যাডাম।আমি ধুয়ে নিবো সব।আপনি যে আমার সংসারে থাকেন,ওতেই আমি ধন্য।আর কাজ করতে হবে না।গিয়ে শুয়ে থাকেন চিতল মাছের মতো।

সে গিয়ে প্লেট ধোয়।পুরো কাজ শেষ করে।তারপর উঁকি দিয়ে বেডরুমের ভেতরে তাকায়।অনিমা বোধহয় বারান্দায়।প্রত্যুষ গিয়ে তার পেছনে দাঁড়ালো।অনিমা পেছন ফিরতেই সে বোকা বোকা হাসল।হাত বাড়িয়ে অনিমার হাতটা ধরে বলল——-তোকে আসলে শাড়িতে দারুণ সুন্দর লাগে অনিমা।তোকে সেরকম বউ বউ রূপে দেখলে আমার কেমন যে লাগে।এজন্য আমি তব্দা খেয়ে চুপ হয়ে যাই।দরজা খোলার পর থেকে তুই ভাবছিস,আমি এটা সেটা করছি।আমি আসলে এটা সেটার ছুতোয় তোকে দেখছি।অথচ তোকে দেখতে ছুতোর প্রয়োজন নেই।চাইলেই আমি তোকে ধরে টুপ করে চুমু খেতে পারি দুইটা।এমন করে-

বলেই সে একটানে অনিমাকে কাছে এনে তার কপালে টপাটপ দুটো চুমু খেল।অনিমা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো।প্রত্যুষ হাত দিয়ে তার চোখের পাতা বন্ধ করে বলল——এখন এমন ড্যাবড্যাব করে তাকাস না।আমারও তো লজ্জা লাগে ভাই।

সে সত্যিই অনুকে জড়িয়ে ধরলো।অনুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে স্বরে গাইলো-

আমার ছোট নদী,
আমার ভাঙ্গা ঘর।
আমার কিছু কল্পনা,
তার পৃথিবী সুন্দর।

____

প্রত্যুষের কোনো কাজের ঠিক নাই।একদিন বৃহস্পতিবার অফিস শেষে বাড়ি সে বলল—–অনু ব্যাগ গোছা।আমরা রাঙামাটি যাচ্ছি।

অনিমা বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালো।প্রত্যুষ আলমারি খুলতে খুলতে বলল——অবাক হওয়ার কিছু নাই।হঠাৎ প্ল্যান হয়েছে।আমি তুই,তৌকি আর তার ওয়াইফ।বল কি কি নিবি?শাড়ি পরবি?

সে উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই সব গুছিয়ে লাগেজ ভর্তি করলো।তারপর রাতে অনিমার কানের দুই পাশে একটা সুতির ওড়না পেঁচিয়ে তাড়াহুড়ো দিয়ে বলল—–চল চল।তারা চলে এসেছে।

অনিমা ভ্রমণ উপলক্ষে খুশি কিংবা বেজার,কোনোটাই হওয়ার সুযোগ পেল না।সে তখনও অবাক চোখে প্রত্যুষ কে দেখে যাচ্ছিলো।এভাবেও ট্যুর হয় নাকি?

তৌকি আর তার স্ত্রী মারিয়া মূল সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।তারা দু’জন সেখানে যেতেই তৌকি এগিয়ে এলো।সৌজন্য সূচক হেসে বলল——আসসালামু আলাইকুম ভাবি।

অনিমা নিজেও প্রশস্ত হাসলো।তৌকি হাসিমুখে বলল—–আপনার বরের নামে বিচার আছে।

প্রত্যুষ কপালে ভাঁজ ফেলে তার দিকে তাকায়।অনিমা দুই হাত এক করে তার কথা শুনে।তৌকি কিছুক্ষণ রয়ে সয়ে বলল——তার কাজে কোনো মন নাই।সারাদিন শুধু অনু অনু করে।নিজে বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হয়।তবুও বসে বসে ভাবে,অনু জানালা বন্ধ করেছে তো?

প্রত্যুষ তাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে এলো।তাদের এখন কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হবে।অনিমা গিয়ে দাঁড়ালো মারিয়ার পাশে।
তাদের রাঙামাটি যাত্রা ভালোই গেল।তেমন ঝুট ঝামেলা ছাড়াই দুই জোড়া কপোত-কপোতী পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে গেল অনায়াসে।

পাহাড়ে উঠতে চান্দের গাড়ি ব্যবহার করা হয়।মারিয়া সেই গাড়ি থেকে নেমে অনিমা কে নিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল।পেছন থেকে হাস্কি গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠটা তাদের দু’জন কে থামিয়ে দিলো।

——“মারিয়া,দাঁড়াও।অনু কিছু চেনে না এখানে।ওকে আমার কাছে পাঠাও।”

মারিয়া ঘুরে দাঁড়ালো।অনিমার সাথে তার চোখাচোখি হতেই সে অবিশ্বাস্য সুরে বলল—–আন-বিলিভেবল অনু! তুমি কোন দোয়া পড়ে তাকে ফু দাও বলো তো?কারো হাজবেন্ড এতোটা কেয়ারিং কিভাবে হতে পারে?যাও যাও।বরের কাছে যাও।নয়তো তুমি হারিয়ে যাবে।

অনিমা হচকচ করতে করতে প্রত্যুষের কাছে গেল।তারা বর বউ মিলে বার বার অনুদের ক্ষেপায়।প্রত্যুষ তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল——আয়,আমার সাথে আয়।

অনিমা রোবটের মতো তার পিছু পিছু হাঁটে।তারপর ঘুরে ঘুরে পাহাড় দেখে।অফ সিজন চলছে বলে চারপাশে মানুষ কম।কেবল সবুজে ঢাকা সারি সারি পাহাড়।এর মাঝে কয়েকটা কালচে খয়েরি রঙের কটেজ।

অনিমাদের কটেজের অবস্থান বেশ সুন্দর জায়গায়।কটেজের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায়,মেঘ ধরা যায়।অনিমা গিয়েই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল।

তার ঘুম ভাঙে বিকেলের দিকে।ঘুম ভাঙতেই দেখলো,কটেজ ফাঁকা।প্রত্যুষ মেসেজ দিয়েছে-“তৌকির সাথে বের হচ্ছি।রেডি থাকিস।এসে কল দিবো।”

অনিমা লাগেজ খুলে একটা নীল শাড়ি বের করল।সাথে মিল করে নীল সাদা চুড়ি।পাহাড়ের কাছে গেলে নীল পরতে হয়।যেন সাদা সাদা মেঘের ভীড়ে ঐ নীলটা আকাশের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।

দরজায় টোকা পড়ে।অনিমা শাড়ির কুচিটা চেপে ধরে দরজা খুলে।দরজার বাইরে একটা বারো তেরো বছর বয়সী ছেলে দাঁড়ানো।মুখটা শ্যামলা।চোখে কিঞ্চিৎ বিরক্তভাব।

অনিমা তার দিকে তাকাতেই ছেলেটা স্বাভাবিক গতিতে নিজের হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।অনিমা তাকালো তার হাতের দিকে।প্রশ্নাত্মক চোখে ইশারায় জানতে চাইলো,এটা কি।

ছেলেটা ভাবলেশহীন হয়ে বলল——“আমি জানি না।আপনের বর পাঠাইছে।”

সাথে সাথে দুই চোখ বড় হয়ে গেল তার।প্রত্যুষ পাঠিয়েছে?অনিমা এক টানে চিঠিটা নিজের হাতে নিলো।খুলতেই দেখল,প্রত্যুষের লিখা।সে চিঠির মতো করে কিছু বাক্য লিখেছে।

অনিমা,
ধরে নাও,তোমার স্বামীর পক্ষ থেকে এটা তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার।তুমি করে বলছি,কারণ প্রেয়সীকে জীবনে একবার অন্তত তুমি করে বলতে হয়।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাকে ধরে নাও একজন গম্ভীর,সাংসারিক এবং চাপা স্বভাবের পুরুষ হিসেবে।ধরে নাও তুমি আর আমি কেবলই স্বামী স্ত্রী।এর বাইরে আর কিছু না।আমাদের সংসার দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রাণখোলা হাসিতে,আর তোমার মনোরম নীরবতায়।

অনিমা,তুমি কি জানো?নীরবতাই যে তোমার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য?তোমার সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা হলো তোমার দুই চোখ,আর সেই সাথে তোমার গভীর নিভৃত চলন।তোমাকে নীরবতায় বেশি মানায় অনু।তুমি কথা বললে বোধহয় তোমার আর আলাদা সৌন্দর্য থাকবে না।কারণ যখন তুমি কথা বলতে শুরু করবে,তখন তোমার চোখ কথা বলা বন্ধ করে দিবে।আর যেদিন তোমার চোখ কথা বলবে না,সেদিন তোমার সমস্ত সৌন্দর্য ফুরিয়ে যাবে।আমার ধারণা,তোমার অক্ষমতাই তোমার সবচেয়ে বড় অলংকার।

অনু! আমি তোমায় ভালোবাসি,এ কথা সত্য না।
আমি তোমায় যত্ন করি।
আমি তোমায় হারাতে ভয় পাই।
আমি তোমার ভেতর আমার একটা সংসার খুঁজে পাই।
কিছু না থাকা আমি,তোমাকে দেখলে নিজের একটা পরিচয় পাই।
আমি তোমাকে বলতে চাই,আমার জীবন থমকে দেওয়ার মতো অসম্ভব ক্ষমতা তোমার আছে।
আবার আমাকে শান্ত,বিনয়ী এবং সুপুরুষ করার মতো বিশেষ ক্ষমতাটুকুও তোমরাই হাতে আছে।

আপাতত চাইছি,তোমাকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে যেতে।চিরকুটটা পড়া মাত্র তুমি সব ছেড়ে ছুড়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসবে।আমি আছি।পাহাড়ের একেবারে শেষ মাথায় তুমি আমাকে পাবে।

ইতি,
এই আমি বাদে তোমায় এতো বেশি আর কে চায় বলো?

অনিমা মোহাচ্ছন্ন হয়ে লিখাটা পড়ে।পড়তে গিয়ে সে আটকে গেল,কখনো থেমে গেল।কখনো আবার আবেগে সিক্ত হয়ে উঠল।এরপর চিঠিটা হাতের ভাঁজে নিয়ে সে সত্যিই কটেজ থেকে বেরিয়ে এলো।

পাহাড়ের শেষ মাথায় প্রত্যুষ দাঁড়ানো।অনিমা হেঁটে গিয়ে তার পেছনে দাঁড়ালো।তার চুড়ির রিনঝিন শব্দে প্রত্যুষের ধ্যান ভাঙলো।সে তাকে দেখেই হালকা করে হাসলো।হাত দু’টো পকেটে গুজে টান টান হয়ে বলল,”অমিতের সাথে যখন এখানে এসেছিলাম,তখনই বলেছিলাম,তোকে একদিন এখানে আনবো।বল,জায়গাটা খুব সুন্দর না?”
অনিমা উপরনিচ মাথা নাড়ে।

প্রত্যুষ তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল——–“আয়।হাত ধর আমার।”

অনিমা ভয়ে ভয়ে পাহাড় ঘেঁষা উপত্যকার দিকে তাকালো।প্রত্যুষ সাহস দিয়ে বলল——“আরে বাবা ভয় নেই।আমি আছি।আমি তোকে ফেলবো না।”

পৃথিবীর খুব শক্তিশালী কথা গুলোর একটি হলো—“আমি আছি।”
সবার কিন্তু আমি থাকে না।গুটিকয়েক মানুষের আমি থাকে।ঐ আমির থাকাটা খুব দামী,খুব শক্তিশালী।অনিমা শক্তিশালী,কারণ তার জীবনে “আমি আছি” বলার মতো একজন সে আছে।

অনিমা প্রত্যুষের হাত ধরে আরেকটু এগিয়ে গেল।সে কাছে আসতেই প্রত্যুষ তাকে দুই হাতে আগলে নিল।অনিমা লজ্জা পেল সামান্য।ক্ষণিক বাদে সে নিজেই নির্ভার হয়ে তার সমস্ত ভার প্রত্যুষের উপর ছেড়ে দিলো।তার সংসার জীবনে সে এই ছেলেটিকে বহুবার জড়িয়ে ধরেছে।আর যতোবার জড়িয়ে ধরেছে,ততোবার মনে হয়েছে,এক গুচ্ছ সাদা গোলাপের তোড়া তাকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে রেখেছে।

ঠান্ডা,গা হীম করা বাতাস সবেগে ছুটে এসে তাদের শরীরে আঁছড়ে পড়ল।মনে হলো পুরো শরীরে মৃদু দোল খেলে গেছে।আনন্দে,প্রাপ্তিতে অনিমার দুই চোখ ভরে যায়।প্রত্যুষ তাকে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে গান ধরে-

“আজ মন চেয়েছে,আমি হারিয়ে যাবো।
হারিয়ে যাবো,তোমার সাথে।
সেই অঙ্গীকারের রাখি পরিয়ে দিতে,
কিছু সময় রেখো,তোমার হাতে।”

*

*

নীল কৃষ্ণচূড়া নামটা তেমন প্রচলিত না।এবং আমাদের কান কিংবা চোখ,কোনোটাই এই নাম শুনে অভ্যস্ত না।কারণ কৃষ্ণচূড়া শব্দটা শুনতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে থোকা থোকা র ক্ত লাল এক ঝাঁক ফুলের দৃশ্য।

তবে প্রকৃতিতে এই র ক্ত লাল কৃষ্ণচূড়ার ভীড়ে নীল কৃষ্ণচূড়ার অস্তিত্ব আছে।নিউ মার্কেটের পশ্চিমে কাইসার মেমোরিয়ালের পথ ধরে এগুলেই সেই থোকা থোকা নীলরাঙা ফুল চোখে পড়বে।যার নাম নীল কৃষ্ণচূড়া।ইংরেজিতে যাকে বলে-BLUE JACARANDA।

আসলে এই লাল নীল কৃষ্ণচূড়াদের উপস্থিতি মানব জীবনেও আছে।এরা দু’জনই সুন্দর।অথচ দুজনের আবেদন ভিন্ন।একজন নিয়ত।অন্যজন অনিয়ত।প্রজ্ঞা আপু আর জুয়েল ভাই হলেন টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া।প্রকৃতিতে হরহামেশা দেখা যায়।এবং দেখা মাত্র চোখ জুড়িয়ে যায়।একটা অমলিন অপার্থিব সৌন্দর্য মেশানো থাকে ঐ কৃষ্ণচূড়ার মাঝে।ঐরকম একটা সংসার সবাই চায়।এবং দিনশেষে সিংহভাগ মানুষই পেয়ে যায়।

আর আমি আর প্রত্যুষ হলাম কাইসার মেমোরিয়ালের সামনে থাকা ঐ নীল রঙের কৃষ্ণচূড়া।সচরাচর চারপাশে দেখা যায় না।মানুষ এর অস্তিত্ব মানতে চায় না।কিন্তু দিনশেষে আমরা ঠিকই প্রকৃতিতে বেঁচে থাকি যুগ যুগ ধরে।

এই ধরুন আমাদের কথা।প্রজ্ঞা আপু আর জুয়েল ভাইয়াদের গল্প আপনারা অহরহ শুনেছেন।তাই না?
গল্পগুলো সুন্দর।তবে অপ্রচলিত না।এটাই সাধারণত হয়,এবং হওয়া উচিত।

কিন্তু ভেবে বলুন তো,আমার আর প্রত্যুষের গল্প আপনারা আগে কখনো শুনেছেন?এমন অসম অনিয়ত প্রেমের কাহিনি আপনারা আগে প্রত্যক্ষ করেছেন?
করেন নি।কারণ আমরা হলাম নীল কৃষ্ণচূড়া।সুন্দর অসুন্দর মিলে আমাদের গল্পটা অনিয়ত।যখনই আমি আমাদের কথা ভাবি,আমার মাথায় সেই গাঢ় নীল কৃষ্ণচূড়ার কথাই মনে পড়ে।সাথে আরেকটা শব্দ মাথায় আসে-অদ্ভুত সু্ন্দর।
আমি যদি আমার আর প্রত্যুষের এই আধো আধো ভুং চুং গল্পের একটি নাম দেই,তবে সে নামটা নিঃসন্দেহে নীল কৃষ্ণচূড়াই হবে।

আসলে এই গল্পের মূখ্য চরিত্র অনিমা না।এক্সিডেন্টে বাকশক্তি হারিয়ে কিংবা তিন তালার ছাদ থেকে পড়ে চার চারটে বছর ঘুমিয়ে থেকে যে কেউ অনিমা হতে পারে।সেই অনিমা হওয়ার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই,কোনো মাহাত্ম্য নেই।

এই গল্পের মূল নায়ক হলো জনাব আহসানুল হক প্রত্যুষ।অনিমা এই গল্পের বড় সাধারণ এক চরিত্র।ঐ যে বললাম,অনিমা হতে গেলে খুব বেশি কিছু করতে হয় না।কিন্তু প্রত্যুষ হওয়ার জন্য চার চারটে বছর অপেক্ষা করতে হয়।চারটে চারটে শ্রাবণ,চার চারটে বসন্ত বিসর্জন দেওয়ার পরে প্রত্যুষদের গল্প হয়।

প্রত্যুষ রা কিসের অপেক্ষা করে বলুন তো?হাসপাতালের বেডে নিথর হয়ে মরণশয্যায় শুয়ে থাকা বাকশক্তি হারানো মেয়েটির জন্য প্রত্যুষদের পিছুটান কোথায়?
তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না।তারা চাইলেই একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ কে আঁকড়ে ধরতে পারে।তারা চাইলেই পারে প্রিয়তমার হাত ধরে তেপান্তরে পাড়ি জমাতে।অথচ তারা যায় না।তারা আঁকড়ে ধরে অনিমাদের মতো সর্বহারা মানুষদের।যাদের সাথে তেপান্তরে যাওয়া যায় না,যাদের সাথে খিলখিলিয়ে হাসা যায় না।

আচ্ছা,একটা শব্দ আছে না?বেসিক হিউম্যান নিড।শারিরীক সম্পর্ক নিয়ে বিরাট বড় বড় আর্টিকেল।ছেলেরা নাকি ঐসব ছাড়া ঘর করতে পারে না।তবে আমি বড় চিন্তিত।আমি ছেলের ঘর করছি তো?কারণ ঐ যে ছেলেটা,সে আটকায় সুদৃঢ় মজবুত আলিঙ্গনে।সে আটকায় একটা ত্রুটিপূর্ণ মেয়ের কোমল সাদামাটা আদলে।সে আটকায় একটা বাবুই সংসারের স্বপ্নতে।সে আটকায় আমায় কালো রঙের ডায়েরিতে।ধ্যাত! প্রত্যুষ সাহেব পুরুষজাতির জন্য কলঙ্কই বটে।

তবে বলি হারি,এমন দু একটা কলঙ্ক না থাকলে অনিমাদের কি হতো বলুন তো?আমরা যখন চার বছরের গভীর নিচ্ছিদ্র নিদ্রার শেষে চোখ মেলতাম,তখন আমরা দেখতাম আমাদের পছন্দের মানুষটি আর আমাদের নেই।তারা বিয়ে করেছে,সংসার করছে।তবে কি আজ আমি আমাদের সাথে ঐ স্নিগ্ধ নীলাভ নীল কৃষ্ণচূড়ার মিল খুঁজে পেতাম?

থর থর লাল কৃষ্ণচূড়া খুব মনোরম দেখতে।মৃদু বাতাসে যখন কৃষ্ণচূড়া ঝরে,তখন চোখ দু’টো জুড়িয়ে যায় আবেশে।
কিন্তু এই লালের ভীড়ে নীল রাঙা কৃষ্ণচূড়া কি আলাদা আবেদন জাগায় না?
মনে হয় না,তারা যেন ভিন্ন রকম সুন্দর?
মনে হয় না,তারা যেন অনিমা আর প্রত্যুষ?
মনে হয় না,তারা খুব অনিয়ত,কিন্তু চমৎকার দৃষ্টিনন্দন?

মনে হয়।মনে হয়।

অনিমা আহমেদ
২৮শে বৈশাখ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

____________সমাপ্ত___________