#নীল_প্রহর
আফরা নূর
-“পিহু চল, শ্বশুর বাড়ি চল।”
-“শ্বশুর বাড়ি? কিসের শ্বশুর বাড়ি? কার শ্বশুর বাড়ি? কে বিয়ে করলো?”
-“কার আবার তোর৷ বিয়ে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি যাবি না।”
পিহু অবাক হয়ে শুধায়,
-“বিয়ে কখন হলো?”
বড় খালা দ্বিগুন অবাক হয়ে বলে,
-“ওমা ভুলে গেলি? সকালেই তো হলো বিয়ে। তুই বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করলি। মনে নেই।”
রেজিস্ট্রি পেপার? পিহু মনে করতে পারলো না সে কখন বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করলো। সে মস্তিষ্কে জোর দিলো। পিহুর মনে পরলো সকালে বড় খালা পিহুকে দিয়ে দুটো কাগজে সই করিয়ে ছিলো। তাহলে কি এগুলোই ছিলো বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার? পিহু বিশ্বাস করতে পারলো না। পিহু এবার কথা বলতে ভুলে গেলো যেন। এত বড় ধোঁকা! পিহুর চোখের সামনে সকালের ঘটনা ভাসতে শুরু করলো….
আজকে সকালে পিহুর বড় খালা ঝগড়া করে তাদের বাড়ি চলে এসেছে। বড় খালা আসার পর খালু অনেক বার ফোন করেছেন কিন্তু খালা ফোন তুলছেন না। তার এক কথা যেই সংসারে তার কোন মূল্য নেই সেই সংসারে তিনি ফিরবেন না।
বড় খালার এসব নাটুকে কথায় কেউ বিশেষ পাত্তা দিলো না। বড় খালা মানুষটা বড্ড নাটুকে। এন্টিবায়োটিক কোর্সের মতন সকাল বিকাল রাতে তার এইসব নাটক গিলতে হয় সকলকে। পিহু কিছু সময় বড় খালার কাছে বসে থেকে চলে গেলো নিজের বাগানে। বাগানটা পিহুর বড্ড শখের। প্রতিদিন একবার করে সে বাগানে কাজ করে। গাছে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে। আজকেও সে এক ঘন্টা বাগানে কাজ করলো।
পিহু বাগানে কাজ শেষে ঘরে আসলো। হাত-মুখ ধয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই বড় খালা হাতে দুটো কাগজ নিয়ে তার কাছে ছুটে আসলো। পিছনে পিহুর বাবা-মা আর ভাইও আছে। খালা পিহুর কাছে এসেই পিহুর দিকে কাগজ দুটো এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“পিহু, মা আমার এই দুটো কাগজে সই করে দিয়ে আমাকে বাঁচা মা।”
পিহু গামছায় হাত মুছতে মুছতে বললো,
-“কিসের কাগজ বড় খালা?”
-“কিসের কাগজ পরে বলছি আগে সইটা করে দে। এই ছেলের যন্ত্রণায় দেখবি আমি একদিন মরেই যাব বোধহয়। এই ছেলে আমার পেটে কিভাবে হলো বুঝি না আমি। না জানি কোন পাপের ফল আমার।”
পিহু বুঝলো বড় খালার ছেলে কিছু করেছে। বড় খালার একটাই ছেলে। নাম অভ্র আহসান। অভ্র ভাইকে পিহুর একদম পছন্দ নয়। দেখলেই পিহুর গা জ্বলে যায়। এই ছেলের জন্য এখনো মায়ের কাছে কথা শুনতে হয় পিহুর। অভ্র ভাই সবকিছুতে এক্সপার্ট। তার সব কাজ পার্ফেক্ট। আর অপর দিকে পিহু, সে সবকিছুতে অকর্মা। তার তেমন কোন এচিভমেন্ট নেই জীবনে। না পড়ালেখায় আর না অন্য কিছুতে।
খালার মুখে অভ্র ভাইয়ের গাল-মন্দ শুনতে খারাপ লাগে না পিহুর। তার কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ লাগে। মনের কোণে জ্বলতে থাকা আগুন যেন কিছুটা প্রশমিত হয়। পিহু হাত বাড়িয়ে কাগজ দুটো নিলো। পিহু কাগজ পড়তে যাবে ওমনি তার বড় বলে উঠলো,
–পিহু পেপার পড়ার সময় নেই। তারাতাড়ি সই করে দে। নইলে বিপদ। এত সময় নেই আমাদের হাতে।
বড় খালার কথায় বাবা-মাও সায় দিলেন। অগত্যা পিহু কাগজ দুটো না পড়েই সই করে দিলো। এটাই ছিলো পিহুর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। পিহু যেন নিজ হাতে নিজের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলো।
পিহু সই করতেই বড় খালা পিহুর কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে আবারো বাইরের দিকে ছুটলেন। বড় খালার পিছন পিছন মা আর ভাইও বের হয়ে গেলো। পিহু খালার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে অভ্র ভাইকে কয়েকটা গালি দিলো। বড় খালাকে জ্বালিয়ে মারলো একেবারে।
পিহুর বাবা যাওয়ার আগে পিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আলতো হাসলেন। সেই হাসিতে কিছু একটা ছিলো যা পিহু আন্দাজ করতে পারলো না। বাবা এমন করে হাসেন না কখনো। তার হাসিতে সবসময় প্রাণ থাকে যা আজকের হাসিতে ছিলো না। বাবা কি অসুস্থ? দেখে তো তা মনে হয় নি। তাহলে মনে হয় অভ্র ভাইকে নিয়ে চিন্তিত। লোকটা সকলকে জ্বালিয়ে মারলো এই কয়দিনে। পিহু আর মাথা ঘামালো না এসব নিয়ে। অভ্রকে মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
……….
সোফায় বসে আছে পিহু। একপাশে তার বাবা আর অপর পাশে বড় খালু। বাবা আর বড় খালু পিহুকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছেন তখন থেকে। কিন্তু পিহুর সেদিকে মন নেই। তার মনে বয়ে চলেছে উথাল-পাতাল ঢেউ। যেই লোকটাকে পিহু দুচোখে দেখতে পারে না সেই লোকের সাথে কি করে থাকবে সারাটা জীবন? সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে ওই বিরক্তিকর মানুষটার মুখ দেখে। রাতে ঘুমাতে যেতে হবে ওই বিরক্তিকর মানুষটার মুখ দেখে। এর চেয়ে কষ্টের, এর চেয়ে অপমানের এই পৃথিবীতে আর কি হতে পারে? পিহুর যেন এবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেলো। তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। আচমকা জ্ঞান হারিয়ে বাবার কাধে ঢলে পড়লো পিহু।
আচমকা পিহুর জ্ঞান হারানোতে বাড়ির সবাই বিচলিত হলো। পিহুকে সোফায় সোজা করে শুইয়ে দেওয়া হলো। বাড়ির সকলে মূহুর্তের মধ্যেই অস্তির হয়ে উঠলো। সকলে পিহুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। সকলের এই ব্যস্ততার মাঝে ব্যস্ততা নেই কেমন অভ্র নামের মানুষটার। সে সিঙ্গেল সোফায় আগের ভঙ্গতেই বসে আছে। তার চোখে মুখে নেই কোন অস্থিরতা। পিহুকে নিয়ে নেই কোন ভাবাবেগ। উল্টো পিহুর জন্য সকলের চিন্তা, অস্থিরতা অভ্রর নিকট নিছকই নাটক বলে মনে হলো। হ্যাঁ সব নাটক। এগুলো নাটক না হলে সকালে পিহুর সাথে তারা এমন একটা কাজ করতে পারতো না। এত বড় ধোঁকা তারা দিতে পারতো না মেয়েটাকে। কিভাবে পারলো তারা পিহুকে তার মতন একটা মানুষের সাথে বেঁধে দিতে? তারা কি জানে না অভ্র কেমন?
পিহুর জন্য তৈরি হওয়া খারাপ লাগাটা হুট করেই যেন রাগে পরিণত হলো। এখনকার দিনে এত বেয়াক্কেল মানুষও হয়? এমনিতে তো রাস্তাঘাটে মানুষ পিটিয়ে বেড়ায়। আর এখন? কেউ একজন হাতে দুটো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সই করতে বলবে আর সই করে দিতে হবে? বলি কেন? পড়তে শিখিস নি জীবনে? জানিস না কোন কাগজ না পড়ে সই করতে হয় না? নিজের সাথে সাথে এবার আমার জীবনটাও গেলো। বিতৃষ্ণায় অভ্রের যেন গলা শুকিয়ে আসলো। রাগে, ক্ষোভে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। এত ঝামেলা নেওয়া যায় না। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ধীরস্থির ভাবে। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গেলো ডাইনিং টেবিলের কাছে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পানি পান করলো রয়েসয়ে। একবার সোফায় সটান হয়ে পড়ে থাকা পিহুর দিকে তাকালো সে। তারপর বাড়ির সকলের দিকে একবার নজর ঘুরালো। সকলে তখনো চিন্তিত, অস্থির।
অভ্র পানির জগখানা হাতে তুলে নিলো। সোফায় শুয়ে থাকা পিহুর কাছে এসে জগ ভর্তি পানি ঢেলে দিলো পিহুর মুখের উপর। অভ্রর এমন আচমকা আক্রমণে সবাই চমকে উঠলো। বড় খালা উঠে অভ্রর বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
-“এমন অমানুষের মতন আচরণ করিস কিসের জন্য? মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এত সময় ধরে একবারো তো আসলি না কাছে। এখন এসে ওর উপর পানি ঢেলে দিলি? এত অমনুষ কবে হলি তুই অভ্র? নাকি আগে থেকেই এমন ছিলি শুধু আমি জানতাম না? ”
শেষের কথাটায় তিনি নিজের সব দুঃখ ঢেলে দিলেন যেন। এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা! সকাল বেলা নিজেরা এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে এখন রীতিমতো অভ্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ভাবটা এমন পিহু অভ্রর জন্য জ্ঞান হারিয়েছে।
মায়ের কথায় অভ্রর অবশ্য কোন হেলদোল হলো না। সে আগেকার মতোই নির্বিকার। অভ্র মাকে পিহুর দিকে ইশারা করলো। পিহু চোখ খুলছে। মানে ওর জ্ঞান ফিরেছে। পিহুকে চোখ খুলতে দেখে সকলে একটু স্বস্থি পেলো।
পিহু উঠে বসলো। সকলে তাকে ঘিরে আছে। সকলের চোখে-মুখে তার জন্য চিন্তা বিরাজমান। পিহু এবার বাবার দিকে তাকালো। অভিমানী গলায় বললে,
-“তুমি কিভাবে এটা করতে পারলে বাবা?”
পিহুর বাবা চোখ নামিয়ে নিলেন। মেয়েকে তিনি অনেক ভালেবাসেন। মেয়েটাও হয়েছে তার নেওটা। বাবাকে সে এক কথায় বিশ্বাস করে।
-“আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। এছাড়া আর কিছু করার ছিলো না আমার। তখন আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
বাবার কণ্ঠে অসহায়বোধ স্পষ্ট। পিহুর চোখে পানি টলমল করছে। এখনই যেন গড়িয়ে পড়বে। পিহু প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কান্না না করার।
-“কি এমন দায় পরলো তোমাদের যে আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলে? কেন এমন করে অভ্র ভাইয়ের মতন একটা লোকের সাথে আমাকে বেঁধে দিলে? তোমরা জানতে না তার জীবনে আগে থেকেই একজন আছে? সে কখনো আমাকে মেনে নেবে না তা একবারো মনে হয় নি তোমাদের?”
পিহুর কথায় কেউ উত্তর দিতে পারলো না। তারা জানে অভ্র পিহুকে মেনে নিবে। অভ্র বাধ্য পিহুকে মেনে নিতে। তবে মন বলেও একটা কিছু আছে। অভ্র কি পারবে কখনো পিহুকে মন থেকে মেনে নিতে? পারবে কখনো পিহুকে ভালোবাসার মতন করে ভালোবাসতে?
১.
চলবে……..