#নীল_প্রহর
আফরা নূর
৩.
পিহুর শ্বশুর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেলো রাত এগারোটা। বড় খালা পিহুকে বরণ করে ঘরে নিলেন। সাথে অবশ্য অভ্রও ছিলো। তবে নির্বিকার। পিহুকে সে আনতে চায় নি। পিহুকে সময় দিতে চেয়েছিলো। পিহু এক প্রকার জোর করেই এসেছে। এই নিয়ে তর্কা তর্কিও হয়েছে। আসার সময় অভ্র গাড়িতে পিহুকে জিজ্ঞেসও করেছিলো এ ব্যপারে। পিহু কথা বলে নি। ভাবটা এমন ছিলো তার পাশে কেউ নেই। অভ্রও আর কথা এগোয় নি। কী এত দায় তার?
ঘড়িতে তখন বারোটা বাজে। অভ্র নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। পিহু ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেছে। অভ্র আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে কালো মেঘেরা ছুটোছুটি করছে। মৃদুমন্দ বাতাসও বইছে। সম্ভবত বৃষ্টি আসবে। অভ্রর ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট ধরাতে। কিন্তু তার কাছে সিগারেট নেই। সে সিগারেট খায় না। তার তেমন কোন বদঅভ্যেস নেই। একটু যা রাগের সমস্যা আছে। তবে রেগেমেগে ভয়ানক কিছু সে করে না। ভয়ানক কিছু সে ঠান্ডা মাথাতেই করতে পারে। অভ্র রুমে আসলো। পিহু তখনো বের হয় নি। অভ্র কিছুক্ষণ বিছানায় বসে পা দুলালো। করার মতন কোন কাজ সে পাচ্ছে না। সে উঠে এবার ওয়ারড্রব থেকে নতুন একটা বিছানার চাদর বের করলো। সাথে একটা বালিশও নামালো। অভ্রর বিছানায় একটাই বালিশ থাকে। সাথে একটা কোলবালিশ। অভ্র আগের চাদরটা উঠিয়ে নতুন চাদর বিছিয়ে দিল। এর মধ্যে পিহু বের হল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিহু চুল মুছতে মুছতে নিজের জিনিসপত্র নামিয়ে রাখছে। অভ্র একবার পিহুর দিকে তাকিয়ে সেও চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
অভ্র চলে যেতেই পিহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অভ্রর সাথে এই ঘরে তার দম আটকে আসছে। তারা কাজিন হলেও তাদের তেমন সাখ্যতা নেই। গড়ে উঠেনি কখনো। যতটুকু যা সম্পর্ক ছিল তাও ছিল শীতল। মাঝখান দিয়ে শুধু পিহু অভ্রকে দেখতে পারতো না। যদিও তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণও ছিলো না। কোন কারণ ছাড়াই লোকটা ছিল পিহুর চোখের বিষ।
অভ্র বেরিয়ে আসলো মিনিট দশেক পর। অভ্রকে বের হতে দেখে পিহুকে যেন অস্বস্তিরা আবারও ঝেঁকে ধরলো। সে হাসফাস করতে লাগল। ক্ষিধেও পেয়েছে প্রচন্ড। পিহু কিছু খাওয়ার কথা চিন্তা করল। এই বাসার প্রয় সব কিছুই পিহু চেনে। পিহু এটাও জানে তার খাবারটা সে টেবিলে না হয় ফ্রিজে ঠিক পেয়ে যাবে। পিহু বাইরের দিকে পা বাড়াল। দরজার হাতলে হাত রাখতেই অভ্র বললো,
-“এই, কই যাস?”
-“জাহান্নামে যাই।”
পিহুর কণ্ঠে স্পষ্ট ক্ষোভ। এতক্ষণে মেয়ে রা কেটেছে। অভ্র পিহুর ক্ষোভ পাত্তা দিলো না। পিহুর মতন ল্যাদা বাচ্চাকে অভ্র আহসান পাত্তা দেয় না।
-“ওইখানেই তো যাবি। জীবনে তো পাপ কম করিস নাই। ওইখানেই তোর জায়গা হবে। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।”
অভ্র কথা শেষ হতেই জ্বলে উঠলো পিহু। এতক্ষণ অন্তরে পুষে রাখা সকল রাগ, সকল ক্ষোভ, সকল অভিমান বেরিয়ে আসলো যেন।
-“ঠিক বলেছ। জীবনে পাপের পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। তাইতো তোমার মতন একজনকে বিয়ে করে এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করছি। পাপী না হলে তোমার মতন একজন জীবনসঙ্গী কিভাবে হয় আমার?”
-“হুয়াট ডু ইউ মিন বাই আমার মতন ছেলে? কী করেছিটা কী আমি?”
অভ্রর কণ্ঠে রাগের আভাস। এরা বাপ-মেয়ে পেয়েছেটা কি? জীবনে তো একটা প্রেমই কেবল করেছিলো। এই জন্য এরা বাপ-মেয়েতে মিলে তো কথায় কথায় তাকে চরিত্রহীন বলতে পারে না। পিহুর বাবা নিজেও তো ছোট খালাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে৷ বিয়ের আগে কত কি কাহিনি করেছে তা কি অভ্র জানে না? অভ্রতো উনাকে কখনো কিছু বলে না। তাহলে তারা বাবা-মেয়ে কেন অভ্রকে আকারে ইঙ্গিতে চরিত্রহীন বলে? হুয়াই?
-“তোমার মতন ছেলে মানে বুঝো না? যার চরিত্রের ঠিক নেই। যে বাইরে প্রেমিকা রেখে এসে বিয়ে করে। যারা একজনকে কথা দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করে। যারা মানুষ ঠকায়।”
অভ্র পিহুর দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি শীতল শান্ত। সে এটা মানছে সে একটা মেয়েকে ঠকিয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সে এই কারণে যথেষ্ট অনুতপ্ত। কিন্তু এটা ছাড়া তার কাছে করারও কিছু ছিল না। মা এমন করবে কে জানত? তার মা কী এমন ছিল?
তখনও অভ্রর দৃষ্টি শীতল। অন্য সময় হলে পিহু এই দৃষ্টি দেখে ভয় পেতো। এখন ভয় হচ্ছে না। পিহুর রাগে শরীর কাঁপছে।
-“মনে হচ্ছে না একটু বেশি বলে ফেলেছিস?”
-“একদম না। মনে হচ্ছে তোমার জন্য এগুলো কম হয়ে গেছে। তুমি এর চেয়ে ভয়ানক কিছু কথার যোগ্য। কিন্তু আফসোস আমি এর চেয়ে ভয়ানক কথা বলতে পারি না।”
পিহু আর দাঁড়ালো না। অভ্রর সাথে কথাও বলল না। বাইরেও গেল না। পা ঘুরিয়ে চলে গেল বারান্দায়। অভ্র পিহুর যাওয়ার দিকে দেখল। কি যে এক গ্যারাকলে ফাঁসলো সে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে এখন। অভ্র তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে চলে গেলো।
অভ্র ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে গিয়ে দেখল খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা। তার মনে পড়লো পিহু কিছু খায় নি। পিহু ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না মনে হতেই অভ্র ফ্রিজ থেকে খাবার নামিয়ে গরম করল। প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে গেলো রুমে। এখন আরেক যুদ্ধ করতে হবে। অভ্র জানে পিহু খেতে চাইবে না। ত্যাড়া তো আর কম নয় সে।
পিহু উদাসীন হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ বর্ষার নদীর জলের মতন টইটম্বুর। পিহু তা গড়িয়ে পড়তে দিলো না। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিলো অযত্নে। পিহু যখন উদাস মনে আকাশ দেখতে মগ্ন, অভ্র তখন নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো পিহুর পাশে। কাশি দিয়ে মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করলো। অভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে পিহু রুমে চলে গেলো। নজরে এলো টেবিলে রাখা খাবারের উপর। বুঝল তার জন্যই আনা হয়েছে। পিহু চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো। পিহুর খাওয়া শেষ হতেই অভ্র রুমে আসলো। পিহু ততক্ষণে বিছানায় গিয়ে বসেছে। তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। সারা দিনে ধকল কম যায় নি তার। ঘুম পেলেও ঘুমানোর সাহস করতে পারছে না পিহু। অভ্রর সাথে এক বিছানায় থাকতে হবে ভেবেই তার গা গুলিয়ে আসছে। যদি অভ্র ঘুমের সুযোগ নিতে আসে?
-“আমি তোমার সাথে থাকব না।”
-“তাহলে পাশের রুমে চলে যা। সব গোছানো-ই আছে।”
-“এই থাকা ওই থাকা না। আমি একবারেই থাকবো না।”
-“ইউ মিন, সেপারেশন অর সামথিং?”
পিহু তুমুল বেগে মাথা ঝাকালো। গতি আরেকটু বাড়ালে হয়তো মাথাখানা এখনি ঘাড় থেকে ধসে পড়বে।
অভ্র পিহুর দিকে নিরস চোখে তাকালো। একটা মানুষ এতটা বেয়াক্কেল কিভাবে হয়? এতটা মূর্খ কিভাবে হয়?
-“ঠিক আছে। থাকতে হবে না। চলে যা। তবে যাওয়ার আগে নিজের কিডনি দুটো আমাকে দিয়ে যাস।”
-“কিডনি? কিডনি দিয়ে কী করবে তুমি? অর্গান স্ম্যাগলিং কর নাকি?”
-“করি না। তবে ভাবছি শুরু করব। তুই যদি ছেড়ে যাস তাহলে অনেকগুলো হিউম্যান অর্গানই পাব। এগুলো বিক্রি করে ভালোই টাকা পয়শা পাব। সারাজীবন কিছু না করলেও চলবে।”
অভ্র কথা পিহুর বোধগম্য হচ্ছে না। অভ্রকে দেখে মনেও হচ্ছে না অভ্র মজা করছে। তবে কণ্ঠে কৌতুক রয়েছে।
অভ্র কিছু বলল না আর। উঠে গিয়ে দুটো কাগজ নিয়ে আসলো। কাগজ দুটো পিহুর হাতে দিয়ে পড়তে বলল।
-“সই করার আগে তো পড়িস নি। এখন পড়ে দেখ সই কোথায় করেছিস।”
পিহু হাত বাড়িয়ে নিল কাগজ দুটো। একটা চেনে ওইটা বিয়ের রেজিষ্ট্রি পেপার। অন্যটা পিহু চেনে না৷ পিহু ওইটাই পড়তে নিল।
এটা একটা কনট্যাক্ট পেপার। পিহু আর অভ্রের বিয়ের কনট্যাক্ট পেপার! পিহু একবার অভ্র দিকে তাকালো। অভ্র চোখ দিয়ে ইশারা করল পড়তে। পিহু একেকটা শর্ত পড়ছে তার অকাশ থেকে মাটিতে পড়ছে অবস্থা তার। এগুলো কেমন শর্ত? পিহু বা অভ্র, যে ছেড়ে যেতে চাইবে বা ছেড়ে যাবে তাকে অপরজনকে নিজের দুটো কিডনি দিয়ে যেতে হবে! শুধু কিডনি নয় অপরজন চাইলে তার চোখও রেখে দিতে পারে! এসব কী? তার মাথা ঘুরে এল যেন।
পিহু বুঝলো এগুলো বড় খালার কাজ। উনি ছাড়া এমন আজব শর্ত কেউ দিতে পারবেন না। এখানে এমন আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত আছে। পিহুর সবগুলো পড়তে ইচ্ছে করল না। আবারও ক্ষিধে পেয়ে গেছে। সে এত টুকু বুঝল যে অভ্রকে ছেড়ে যাওয়া সহজ হবে না। অভ্রকে ছেড়ে গেলে তার দুনিয়া ছাড়তে হবে! কিডনি ছাড়া কী মানুষ বাঁচে?
পিহু আর ভাবল না। প্লেটে যেটুকু খাবার বাকি ছিল তা নিয়ে খেতে থাকল। এক দিনে মস্তিষ্কে এত চাপ দিতে পারবে না৷ আস্তে আস্তে ভাবতে হবে এই গ্যাড়াকল থেকে কিভাবে বের হওয়া যায়।
পিহু অবশিষ্ট খাবার শেষ করে লাইট অফ করে দিল। অভ্র ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে । তারও ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। কিন্তু অভ্রর সাথে বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না। অভ্রর রুমে বিছানা ছাড়া শোয়ার মতন আর কোন জায়গাও নেই। অগত্যা পিহুকে বিছানায় শুতে হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও ঘুমিয়ে গেল।
তখন মাঝ রাত। আকাশে চাঁদ নেই। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। কারও লাথি খেয়ে ঘুম ভাঙ্গল অভ্রর। পিট পিট করে চোখ খুলতেই দেখল পিহুর পা দুটো তার বুকের উপর। হতাশ হলো অভ্র। হিসেব মত আজকে তাদের বিয়ের প্রথম রাত ছিল। এই মেয়ে করল কী? বাসর রাতে স্বমীর বুকে মেয়ে মানুষ মাথা রাখে। এই পেয়ে ডিরেক্ট পা তুলল দিল। অভ্র বিরবির করে বললো,
-“হোপলেস।”
পিহুর পা দুটো সরিয়ে অভ্র আবারও ঘুমিয়ে গেল।রাত জেগে বউয়ের চেহারা দেখার সময় তার নেই এখন। কালকে অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে অভ্রর।
চলবে……