নীল প্রহর পর্ব-০৫

0
45

#নীল_প্রহর
আফরা নূর
৫.
তখন ঘড়িতে সময় বারোটা আট। সকলে রাতের খাবার খেয়ে রুমে চলে গেছে ঘুমাতে। আয়শা আহসান বসে আছেন ডাইনিং টেবিলে। ছেলের অপেক্ষায়। অভ্র এখনও বাসায় আসে নি। ফোনটাও অফ। চিন্তায় তার নাজেহাল অবস্থা। উপায় না পেয়ে তিনি ফোন করলেন আসিফকে। অসিফ অভ্রর বন্ধু। ওর কাছে অভ্রর সকল খবরাখবর পাওয়া যায়। আপদে বিপদে অভ্র ওর কাছেই দৌঁড় দেয়।

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
ভদ্র স্বরে সালাম দিল আসিফ। আয়শা আহসান সালামের উত্তর দিয়ে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“অভ্র কেথায় আসিফ? তোমার সাথে আছে? ফোন বন্ধ কেন ওর?”
আসিফ একবার তাকালো অভ্র দিকে। খাটে চার হাত পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। দিন দুনিয়ার কোন হুঁশ তার নেই।

-“আন্টি, চিন্তা করবেন না। অভ্র আমার সাথেই আছে। আর ঠিক আছে ও।”
আয়শা আহসান স্বস্তি পেলেন যেন। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী করছিলে তোমরা? ওর ফোন অফ কেন? ফোন অফ করে মদ টদ গিলছিলে নাকি?”
এমন প্রশ্নে ভরকাল আফিস। তারা মদ খায় না। আসিফ যা একটু সিগারেট খায়। অভ্র তো তাও ছোঁয় না। মা জানলে বাসায় জায়গা হবে না। একবার ইন্টারে পড়ার সময় ট্রুথ ডেয়ার খেলায় হেরে অভ্র সিগারেটে দুটো টান দিয়েছিল। ওইদিন সারা রাত অভ্রকে তার মা বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেদিন রাতে বৃষ্টিও হয়েছিল খুব। তার পরেও মার মন গলে নি।
-“এসব কী বলেন আন্টি? আপনারা জানেন আমরা এসব ধরিও না।”

-“এত সাধু সেজো না। তলে তলে কী কর জানি না ভেবেছ। মদন মনে হয় আমাদের?”
আসিফ কিছু বলল না। উনাকে আসিফ ভয় পায় খুব। শুধু যে আসিফ ভয় পায় তা নয়। তাদের ফ্রেন্ড গ্রুপের সকলেই আয়শা আহসানকে ভয় পায়। তাকে দেখলেই হাঁটু কাঁপে সকলের। তারা নিজের বাপ-মাকেও মনে হয় এতটা ভয় পায় না যতটা অভ্রর মাকে পায়।
-“আন্টি, অভ্র ঘুমের ঔষধ খেয়েছে। দুই দিন নাকি ঠিক করে ঘুম হয় নি তার। তাই এভাবে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গলেই ওকে পাঠিয়ে দেব।”

-“সত্যি করে বল তো আসিফ, তোমাদের মধ্যে কিছু চলে? ঘাপলা আছে কোন তোমাদের? শোন, কথা লুকাবে না একদম।”
সন্দিহান হয়ে শুধায় আয়শা আহসান। এমন প্রশ্নে কেশে উঠল আসিফ। সে একজন স্ট্রেইট পার্সন। তার কোন সমস্যা নেই। তবে অভ্রর সমস্যা আছে না কি সে জানে না।
-“আস্তাগফিরুল্লাহ্! এসব কী বলেন আন্টি।”

-“যদি না-ই থাকে তবে বিয়ের পর দিনই সে তোমার কাছে কী করে? উনিশ থেকে কুড়ি হলেই তার তোমাকে কেন লাগবে।”

-“আমি জানি না আন্টি কেন এসেছে। উনিশ থেকে কুড়ি হলেই কেন তার আমাকে। আমি ওকে অনেক বার চলে যেতে বলেছি। শুনে নি আমার কথা। বিশ্বাস করুন আন্টি তেমন কিছু নেই।”
নিরস গলায় বলল আসিফ। যদি আন্টি বিশ্বাস করে!

-“নালায়েকটা ঘুম থেকে উঠলেই পাঠিয়ে দেবে। আর এটাও বলে দেবে বাড়ি আসলে ওর পিঠে আমি ঝাড়ু ভাঙ্গব। বউ রেখে বন্ধুর কাছে যায়। কত বড় বেয়ারা ছেলে হয়েছে।”
খট করে ফোন কেটে দিলেন আয়শা আহসান। অপরদিকে ফোন হাতে নিয়ে অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে রইল আসিফ। মা ছেলের ঝামেলায় সবসময় সে ঝাড়ি খায়। মাঝে মাঝে মনে হয় অভ্রর সাথে তার পরিচয় না হলেই বুঝি ভাল হত। আবার মনে হয় বন্ধুটা নেহাৎ খারাপ নয়!

****
অভ্রর ঘুম ভাঙ্গল পরদিন সকাল দশটায়। অভ্র আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল। সোফায় শুয়েছে আসিফ। তার শরীর অর্ধেক সোফায় বাকি অর্ধেক ফ্লোরে। অভ্র ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। এখন আবার অফিস যেতে হবে। আসিফের বাসায় মনে হয় না নাস্তা পাওয়া যাবে। খাবার কিছু থাকলেও যে আসিফ তাকে দেবে তাও মনে হয় না। অভ্র জানে কালকে আসিফ মায়ের ঝাড়ি খেয়েছে খুব। প্রতিশোধ তো নেবেই ব্যাটা।
অভ্র একেবারে গোসল সেরে বের হয়ে আসল। কোমড়ে তার সাদা টাওয়াল। আসিফ এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অভ্র আসিফকে ডাকল। দুইটা ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তার। অভ্র তখন মাথা মুছছে। আসিফ হা করে তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকে।

-“এভাবে পাবদা মাছের মতন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?”

-“সত্যি করে বল তো তোর কোন সমস্যা আছে নাকি?”

-“সমস্যা তো অনেক আছে। তুই কোনটা জানতে চাইছিস তাই বল।”

-“তুই কী আমার প্রতি ইন্টারেস্টেড?”
আসিফের সোজা প্রশ্ন। আসিফের প্রশ্নে অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। আসিফ প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল নিজেকে।
-“না মানে বিয়ের পরের দিন এখানে এসে হাজির হয়েছিস তো তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
আমতা আমতা করে বলল আসিফ। আসিফের কথায় অভ্র আলতো হাসল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আসিফের দিকে। আসিফ সোফার সাথে চিপকে গেল। যাওয়ার জায়গা নেই। অভ্র মাথাটা নামিয়ে মুখটা আসিফের মুখের কাছে এনে বলল,
-“এই কথাটা তুই এতদিনে বুঝলি আসিফ?”

অভ্রর কণ্ঠে হতাশা। আসিফ ঢোক গিলল।

-“দেখ ভাই, তুই আমার ভাই। আমি তোকে ভাইয়ের চোখে দেখি। আর আমার একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। ও ছাড়া আমার জীবনে কাউকে ভালো টালো বাসতে পারব না। এখন সিদ্ধান্ত তোর। তুই আমার দেহ পেলেও মন পাবি না।”
অভ্র আসিফের গলা চেপে ধরল।
-“শালা, আমাকে তোর গে মনে হয়? ঘরে সুন্দরী মাথামোটা বউ রেখে তোর সাথে এখানে পুতুপুতু করব আমি? এইসব চিন্তা করিস দেখেই বিয়ে হয় না তোর। দেখিস আমি আজকেই রিয়াকে গিয়ে বলে আসব তুই শালা লুজ ক্যারেক্টার। ছেলে মেয়ের বাছবিচার নেই। ”
অভ্র গলা ছেড়ে দিতে কাশতে লাগল আসিফ। একটু সময় নিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করল সে।
-“তুই কি সেটা তুই ভালো জানিস। আর খবরদার রিয়াকে মাঝখানে টানবি না৷ ওকে আমি অনেক কষ্টে পটিয়েছি। আর এখন তোর বিয়ে হয়েছে। এভাবে হুটহাট আসবি না আমার কাছে।”

-“আমি বিয়ে করেছি বলে কী তোর মন পুড়ছে আসিফ?”
দুষ্টুমী করে বলল অভ্র। আসিফ বিরক্ত হল। সে এখানে ধেই ধেই করে আসবে আর সকলে তাকে উল্টা পাল্টা কথা বলবে। আসিফ কথা না বলে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল।
অভ্র নিজেও আর দাঁড়াল না। ওয়ারড্রব থেকে জামা কাপড় বের করে রেডি হয়ে নিল। আসিফের বাসায় তার জামা কাপড় থাকে সবসময়। কারণ বাসায় কিছু হলেই সে গোসা করে আসিফের বাসায় দুই তিন দিনের নাইওর চলে আসে।

অভ্র অফিসে গিয়ে নাস্তা করে নিল। এই সপ্তাহ সে ভীষণ ব্যস্ত। সামনে বড় একটা প্রজেক্ট আছে। যদিও প্রজেক্টটা এখনও তারা পায় নি। প্রজেক্টটা পেলে কোম্পানির লাভ হবে অনেক।
অভ্র যখন কাজে ব্যস্ত তখন তার কেবিনে আসল বাবা। অভ্র তাকে চা দিল। অফিসে অভ্র নিজের চা নিজে বানায়। ওর পিএর বানানো চা মুখে দেওয়া যায় না। একটা মানুষ এত পানসে চা কিভাবে বানায় অভ্রর বুঝে আসে না।

-“তুমি কিছু বলবে বাবা?”

-“বলার জন্যই তো এসেছিলাম। তোমার কী সময় হবে?”
অভ্র পিসি থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় বলল কী বলতে এসেছে বলতে।
-“দেখ অভ্র আমি জানি পিহুকে মেনে নিতে তোমার যথেষ্ট কষ্ট হবে। তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো আমি এটাও জানি। আমি তোমাকে বলব না তুমি এখনই পিহুকে মেনে নাও এখনই ওকে ভালোবাসো। আমি শুধু বলব তুমি যাকে ভালোবাসো তার সম্পর্কে খোঁজ নাও।”

-“তুমি কী ওর পিছনে স্পাইগীরী করতে বলছে আমাকে?”
বাবা হাসলেন। তিনি বেশি কথা বলেন না। অল্পভাষী মানুষ তিনি।

-“খোঁজ খবর নেওয়াকে স্পাই করা বলে না অভ্র। মানুষের দেখার বাইরেও আরও অনেক কিছুই থাকে। হয়ত এক্ষেত্রেও তেমন৷ অনেক কিছুই তুমি জানো না। আমি চাই সেগুলো তুমি জানে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।”
বাবা বেশি কিছু বললেন না আর। ব্যবসা নিয়ে টুকটাক দুয়েকটা কথা বলে চলে গেলেন নিজের কাজে।
অপর দিকে অভ্র চিন্তায় পড়ল। বাবা কখনও আলিজাকে নিয়ে কথা বলেন নি। সে যখন বাসায় জানাল আলিজার কথা মা প্রথমে একটু মনঃক্ষুণ্ন হলেও বাবা এক কথাতেই রাজি ছিলেন। মা নিজেও পরে রাজি ছিল। আলিজার সাথে দেখাও করেছিল দুই বার। সব ঠিক ঠাক ছিল। কিন্তু মাঝখান দিয়ে কী হল? কী এমন অনর্থ হল মা বদলে গেল। মা এমন ছিলেন না। মা হুট করে বদলে গেছে। অভ্র এই মাকে চিনতে পারে না।

কাজে আর মন বসল না অভ্রর। সে নিজের অপর ফোনটা বের করল ড্রয়ার থেকে। ফোনটা অফ করা আছে চার দিন থেকে। চার দিন যাবত তার সাথে আলিজার যোগাযোগ নেই। আলিজা এখন দেশে নেই। তার বাবার বিরাট ব্যবসা। অভ্রদের থেকেও বড়। আলিজার বাবার ব্যবসা আলিজা আর তার ভাই আয়ান দেখাশোনা করে। অভ্রদের কোম্পানি আর আলিজাদের কোম্পানি একসাথে দুইটা প্রজেক্টে কাজ করেছিল। তাদের পরিচয় সেখান থেকে। আর পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। আর এখন? প্রেম থেকে বিচ্ছেদ!

চলবে………