নীল প্রহর পর্ব-০৬

0
42

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

৬.
অভ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। তার মাথায় বাবার বলে যাওয়া কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কী এমন থাকতে পারে যা সে জানে না? তার জানার বাইরে কী রয়েছে যার জন্য এতকিছু ঘটল? বিয়ের পনেরো দিন আগে সে সাত দিনের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিল ব্যবসার কাজে। যা ঘটেছে তা এই সাত দিনেই ঘটেছে।

অভ্রর সাথে আলিজার ছিল দুই বছরের সম্পর্ক। ওদের সম্পর্কে কোন জটিলতা ছিল না। একে অপরকে বুঝত বেশ, সময় দিত। দুই বছরে তাদের মধ্যে তেমন বড় ঝগড়া হয় নি কখনও। আলিজা ছিল অভ্রর প্রথম প্রেম। তার প্রথম ভালোবাসা।

সেদিন ছিল ঝুম বৃষ্টি। একটা মেয়ে কালো শাড়িতে ভেজা চুলে অভ্রর সামনে আসল। সাদা শরীরে কালো শাড়িটি যেন মুক্তার মতন ফুটে আছে। অভ্র পলক ফেলতে ভুলে গেল। কয়েকটা নিঃশ্বাসও ফেলল না বোধহয়। হৃদপিন্ডটা কেমন ধকধক করছে। মনে হচ্ছে বেরিয়ে এসে এখনই সামনে থাকা রমণীর পায়ে আত্মসমর্পন করবে! কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলল সে। মানুষ এত সুন্দর কিভাবে হয়? কজল কালো টানা চোখ দুটো যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলল কয়েকগুন। কাজল টানা সেই চোখ দুটোতে কী মায়া যে ছিল। এগুলো অভ্রকে টানে নি। অভ্রকে সেদিন টেনেছিল কপালের পাশে থাকা কালো কুচকুচে তিলটা। ফর্সা গায়ে কি অপূর্ব লাগছিল দেখতে। এই সৌন্দর্যকেই বুঝি মানুষ হুর পরী বা অপ্সরার সাথে তুলনা করে! অভ্রর মনে হল স্বর্গ থেকে অপ্সরা নেমে এসেছে তার সামনে।
সেদিন অভ্র নিজের অজান্তেই আলিজাকে নিজের মনখানা দিয়ে বসেছিল। ছাব্বিশ বছরের এক যুবক ছেলে সেদিন প্রথম প্রেমের স্বাদ পেয়েছিল৷ আহা প্রেম! মরণ প্রেম! সর্বনাশা প্রেম!
অভ্র প্রেমে মাতোয়ারা হলেও তা আলিজাকে বলতে পারে নি। পাছে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। অভ্র আলিজাকে হারানোর ভয় পেত। সে আলিজাকে হারাতে চাইত না। থাক না সে বন্ধু হিসেবেই। ক্ষতি কী? আসিফ অনেক বুঝিয়েছিল তাকে। ভালোবাসলে বলে দে। প্রত্যাখানের ভয়ে ভালোবাসা বুকে চেপে রাখা বোকামি। অভ্র তখনও বলতে পারে নি কিছু।
তাদের সম্পর্কের প্রথম কদম অবশ্য আলিজা নিজেই উঠিয়েছিল। অভ্রর আচার-আচরণে আলিজা ঢের বুঝতে পেরেছিল অভ্রর মনের কথা। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় একটু বেশি সচল কিনা! প্রথম প্রথম আলিজা সেসবে তেমন গুরুত্ব দিত না। ছেলে মেয়ে কখনও শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না, আলিজা তা জানে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় আরেকটা না বলা সম্পর্ক থাকে। হয়ত সেটা একতরফা হয়! ওদের ক্ষেত্রেও তা ছিল।
আস্তে আস্তে আলিজা নিজেও অভ্রর প্রতি দূর্বল হয়ে গেল। তারপর নিজেই মনের কথা জানাল অভ্রকে। সেদিন থেকে তাদের পথচলার শুরু। জার্নিটা মন্দ ছিল না। তারা কত এঞ্জয় করেছে। ঘুরেছে, ফিরেছে। সম্পর্কের শুরুটা যত সুন্দর ভাবে হয়েছিল শেষটা ততটাই বেদনাদায়ক। আলিজা এখনও জানে না অভ্র বিয়ে করেছে। জানলে মেয়েটা কষ্ট পাবে ভীষণ। এই কষ্ট মেয়েটা কিভাবে সইবে?
অভ্রর বুক ভারী হয়ে উঠল। ছটফট করতে লাগল সে। সে আলিজাকে ভীষণ ভাবে ঠকিয়েছে। খুব বিশ্রী ভাবে মেয়েটার বিশ্বাস আর ভরসা ভেঙ্গেছে।

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসিফ বলেছিল একবার, মানুষের প্রথম প্রেম পূর্ণতা পায় না। অভ্র ওর কথা গায়ে মাখে নি। আজকে মনে হচ্ছে ব্যাটা ভুল বলে নি। প্রেম বিশেষজ্ঞ বলে কথা। সে ভুল বলতে পারে?
অভ্র ফোনটা অন করল। ফোন অন হতে না হতেই মিসড্ কল আর ম্যাসেজের নোটিফিকেশনে ভরে উঠল ফোন। সবগুলো কল আর ম্যাসেজ আলিজার। আলিজা! তার প্রথম প্রেম! তার প্রথম ভালোবাসা! মায়ের পর একমাত্র নারী যাকে অভ্র ভালোবাসে। যার কদমে পৃথিবী এনে দিতে অভ্র দ্বিধাবোধ করত না। অভ্রর নিজেকে কেমন ব্যর্থ মনে হচ্ছে। সে একজন ব্যর্থ প্রেমিক। দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ছেলে হতে গিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য প্রেমিক হয়ে গেল সে!

অভ্র আর অফিসে থাকল না। সে বেরিয়ে গেল। নিজেরবাসায় না গিয়ে আজকেও আসিফের বাসায় গেল। বাসা তালা দেওয়া৷ অভ্র চাবি বের করল। কাজ হল না। আসিফ তালা চেঞ্জ করেছে। অভ্র আসিফকে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে ওকে কল করল।

-“শালা তুই বাসার তালা চেঞ্জ করেছিস কেন?”

-“আমি না চাইলে তুই আর এখন থেকে আমার বাসায় আসতে পারবি না।”
গম্ভীর গলায় বলল আসিফ। অভ্র তাকে আরো একটা গালি দিল।
-“তুই এক্ষুনি চাবি নিয়ে আয়।”

-“আমি আসতে পারব না। তুই নিজের বাসায় যা।”

-“তুই আসবি? নাকি আমি আসব?”

-“শুধু শুধু আমার সাথে এমন করিস কেন? আন্টি বলেছে আজকে তুই বাড়ি না গেলে আমাকে বাড়ি ছাড়া করবে। রিয়াকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেবে। আমার একটা কথা শোন ভাই, নতুন বিয়ে করেছিস। বউয়ের সাথে সময় কাটা। তোর সুন্দরী মাথামোটা বউ তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
অভ্র আসিফকে আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ফোন কাটল। মা তাকে ভালোই চিপায় ফেলেছে। সে আসিফের এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসল। এর মধ্যে মায়ের কল এল। অভ্র রিসিভ করে কানে ফোন ধরতেই মা কোন ইতিউতি ছাড়া বললেন,

-“আজকে যদি তুমি বাড়ি না আসো তবে তোমায় আমি ত্যাজ্য পুত্র করব।”
ব্যাস! এতটুকুই। তারপর খট করে ফোন কেটে দিলেন। অভ্র গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা এলিয়ে দিল। তার সবকিছু কেমন বিষাক্ত লাগছে। মন চাইছে সকল কিছু থেকে পালিয়ে যেতে। অভ্র গাড়ি স্টার্ট দিল। তবে বাড়ি গেল না। সে সোজা মাওয়া ঘাটে গেল। কিছুক্ষণ সময় কাটাল। ইলিশ ভাজা, ইলিশ ভর্তা দিয়ে পেট ভরে ভাত খেল। ঢ়েন কত দিনের ক্ষুদার্ত সে। তারপর আরও কিছুক্ষণ ঘুর ঘুর করল। যখন দেখল রাত দশটা বাজে তখন সে বাড়ির উদ্দেশ্য গাড়ি স্টার্ট দিল।

বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বাজলো এগারোটা। অভ্র হেলেদুলে কলিংবেলটা চাপল। ফট করে দরজা খুলে দিলেন মা। অভ্রর মনে হল মা দরজার পাশে ঘাপটি দিয়ে বসে ছিলেন। অভ্র কিছু বলল না। আবারও হেলেদুলে চলে গেল নিজের রুমে।
অভ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকালেন মা।
-“এই বেয়াদব এদিকে শোন।”
অভ্র এলো তবে মুখে রা নেই।

-“কোথায় ছিলি কালকে থেকে?”

-“আসিফের বাসায়।”

-“আসিফ তোর বউ হয়?”

-“উমম! চাইলে করা যেত। আসিফ মন্দ নয়। তবে আ’ম স্ট্রেইট পার্সন।”

-“যেভাবে একটা আরেকটার সাথে চিপকে থাকিস মনে তো হয় না তা।”

অভ্র কিছু না বলে পানি খেল। মা রাতে খাবারের কথা বললে সে জানল খেয়ে এসেছে। মা আর কিছু বললেন না। তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে। তবে চিন্তা কমলো না। আসিফকে তিনি ফোন করেছিলেন। আজকে সকালের পর আসিফের সাথে অভ্রর দেখা হয় নি। মাঝ খানের চার ঘন্টা অভ্র কোথায় ছিল তারা কেউ জানে না। তার মনে ভয় ঢুকল। আবার ওই মেয়ের কাছে গেল নাকি?
তিনি চিন্তিত হয়ে স্বামীর কাছে আসলেন।
-“অভ্র কী আবার আলিজার কাছে গেলো?”

-“মনে হয় না গেছে। আর আলিজা এখন দেশে নেই।”

-“আমার ভয় করছে। যদি আলিজার কাছে ফিরে যায়?”

-“মনে হয় না যাবে। তুমি চিন্তা করো না।”

-“তুমি বুঝতে পারছো না। অভ্র এখনও কিছু জানে না। যদি জানত তবে না হয় নিশ্চিন্ত হতাম। যদি ওই মেয়ে নিজের কথার জালে ফাঁসায় ওকে?”

-“অভ্র এমন ছেলে নয় যে ঘরে বউ রেখে পরকীয়া করে বেড়াবে। আর আজকে আমার কথা হয়েছে ওর সাথে। বলেছি ওকে আলিজার উপর একটু নজর দিতে।”

-“কেমন বাপ তুমি? ছেলেকে বউ রেখে অন্য মেয়ের উপর নজর দিতে বল? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি চিন্তায়?”

ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। তার বউয়ের এই এক সমস্যা। কথা না বুঝে রিয়েক্ট করে বেশি। এখন তার মনে হচ্ছে উনাকে এত কিছু জানানো ঠিক হয় নি। সব কেমন ঘেটে ঘ করে দিল! ছেলে মেয়ে দুটোকে জোর করে বিয়ে দিয়ে যা তা কান্ড করেছে। এখন ছেলে মেয়ে দুটোই নারাজ! বিয়ে ছাড়া কী এই সমস্যার সমাধান করা যেত না? একটু ভাবতেও সময় দেয় নি এই মহিলা।
তিনি স্ত্রীকে বুঝালেন। অভ্র বুদ্ধিমান ছেলে। বাবার ইশারা বুঝতে সময় লাগবে না তার।
স্বামীর কথায় শান্ত হতে পারলেন না আয়শা আহসান। কথায় আছে ভালোবাসা অন্ধ। যদি ছেলে ওই মেয়ের ফাঁদে পা দেয় তবে তিনি ছেলেকে হারাবেন। ছেলের সাথে পিহুকেও!
ভয়ে বুকটা ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে তার। কী জানি সামনে কী হয়!

চলবে……