নীল প্রহর পর্ব-০৭

0
48

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

৭.
পিহু তখন টেবিলে বসে ঝিমাচ্ছে। কালকে থেকে তার সেমিস্টার ফাইনাল। আজকে বড় খালাকে বলে ওই বাড়ি থেকে বইপত্র আনিয়েছে সব। বড় খালা তাকে গিয়ে আনতে বলেছিলেন। পিহু যায় নি। অভিমান কমে নি তার। ভাইয়ের সাথেও কথা বলে নি সে। বাবা-মায়ের অভিমানটা ভাইয়ের উপরও পড়ল যেন।

অভ্র রুমে এসে দেখল পিহু বই সামনে রেখে ঘুমাচ্ছে। পিহুকে দেখে মুখ ব্যাঁকাল সে। বিরবির করে বলল,
-“বিদ্যা সাগরের নাতি এসেছে, টেবিলে বসে ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পড়াশোনা করে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছে। অসহ্যকর!”
অভ্র সোজা ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল পিহু এখনো টেবিলেই ঘুমাচ্ছে। অভ্র বাতি নিভিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে গেল। পিহুকে ডাকল অবদি না। থাকুক এই মেয়ে এভাবেই। ঘাড়, কোমড় ব্যথা হলে বুঝবে তখন।
অভ্র বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল। ঘুম ধরা দিল না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসল। পিহুর দিকে তাকাল সে। মন অমানবিক হতে বললেও মস্তিষ্ক তাতে সায় দিল না। মন বলছে থাক এই মেয়ে এখানে তাতে তার কী? আর মস্তিষ্ক বলছে এভাবে ঘুমালে ঘাড়, কোমড় ব্যথা হবে। তখন তাকেই ঔষধ এনে দিতে হবে। টাকা খরচা হবে। টাকা খরচা করতে মন সায় দিল না। সে উঠে পিহুর সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পিহুকে দেখল। এই মেয়ের সাথে অভ্রর কোন দিক দিয়েই যায় না। এই মেয়েকে অভ্র তেমন পছন্দ করে না। অভ্র জানত ছেলে মানুষ ভন্ড হয়। তবে এই মেয়েকে দেখে সে বুঝেছ ভন্ডদের কোন জেন্ডার হয় না। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে ভন্ডামি করতে পারে। অভ্র লম্বা দুটো শ্বাস নিল। তার পর পিহুকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় এনে শুইয়ে দিল ভালো মতন। গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে এসির পাওয়ারটা একটু কমাল। নিজেও শুয়ে গেল পিহুর পাশে। খেয়াল রাখল যেন পিহুর গায়ে স্পর্শ না লাগে। আগের দিন লাথি খেয়ে শিক্ষা হয়েছে। মানুষ নতুন নতুন বিয়ে করলে আদর পায় অভ্র পায় লাথি! আহা জীবন!

**
তখন সকাল আটটা। পিহুর ঘুম ভাঙ্গল বড় খালার ডাকে। সে পিটপিট করে তাকাল।
-“আজকে তোর পরীক্ষা। মনে নেই? এখনও উঠছিস না কেন? উঠ তাড়াতাড়ি।”
পিহু তরাক করে উঠে বসল। সে বেমালুম ভুলে গেছিল। রাতে পড়া শেষ হয় নি তার। পিহুর মনে পড়ল সে রাতে পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে গেছিল। এখন সে বিছানায়। কিভাবে আসল? পিহু ভাবনায় ডুবতে পারল না। সময় নেই। পরীক্ষা সাড়ে নয়টায়। এখান থেকে ভার্সিটি কম হলেও চল্লিশ মিনিটের পথ। পিহু ওয়াশরুমে দৌড় দিল। কোন রকমে গোসলটা করে বের হল। গোসল ছাড়া পিহু পরীক্ষায় বসতে পারে না। তার প্যানিক এট্যাক হয়। এটা গোসল না করার কারণে নয় অবশ্য। পড়াশোনা না করে পরীক্ষার হলে গেলে যে কারও প্যানিক এট্যাক হবে। তবে পিহু তা মানতে নারাজ!

রেডি হয়ে বাইরে আসতেই অভ্রর দেখা পেল পিহু। কখন আসল সে? তাকে ডাকল না কেন? পিহুর নিজেকে আগাছা মনে হল যেন। অভ্র ভাই অন্য কাউকে ভালেবাসে। দুই দিন হয়ত তার সাথেই ছিল। পিহুর মনটা কেমন বিষিয়ে উঠল। মন খারাপ হতে লাগল তার। মন চাইল অভ্রর চুলগুলো সব ছিড়ে ফেলতে। সে টাকলা হয়ে গেলে হয়ত সেই মেয়ে আর পাত্তা দেবে না। নিজের ভাবনা বাদ দিল পিহু। এমনিতেও সে সুযোগ পেলে পালাবে।
বড় খালা নাস্তা দিলেন। পিহু নাস্তা করতে চাইল না। বড় খালা জোর করে দুই টুকরো পরোটা খাইয়ে দিলেন পিহুকে।

পিহু অভ্রর সাথে যাচ্ছে ভার্সিটি। যদিও পিহু অভ্রর সাথে আসতে চায় নি। বড় খালা তাকে জোর করে পাঠিয়েছে। বলেছে স্বামীকে হাতে রাখতে হয়। বিয়ের পর স্বামীর কাছাকাছি থাকলে মায়া বাড়ে। পিহু অভ্রকে হাত করতে চায় না। যাকে সহ্য করতে পারে না তাকে বশ করে করবে টা কী সে? লুডু খেলবে? তবে পিহু বুঝল না যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে মায়া দিয়ে কী হবে? ভালোবাসা বড় নাকি মায়া? সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা ফুঁড়িয়ে যায় নাকি মায়া কেটে যায়?

অভ্র পিহুকে ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে পরীক্ষা শেষ হলে যেন তাকে ফোন দেয়। সে নিয়ে যাবে এসে। পিহু মুখ ব্যাঁকালো। আসছে তাকে ফোন দিতে। কেন রে? তোকে ফোন কেন দেব? বাড়ি চিনি না আমি? দুই দিন তো ছিলি নিজের প্রেমিকার সাথে। এখন এসেছিস কেন পিরিতি দেখাতে? ব্যাটা চরিত্র খারাপ লোক। পরকীয়া করে বেড়ায়। ছিঃ ছিঃ।
মনে মনে কথা গুলো বললেও মুখে কিছু বলল না পিহু। তার এত সাহস নেই। রেগে থাকলে অন্য কথা।

দুই ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে বের হল পিহু। পরীক্ষা তার সবসময়ের মতই জঘন্য হয়েছে। তাই সে মন খারাপ করল না। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করলে পাশ করলেই জীবন বাঁচে।
হল থেকে বের হয়ে একবার ভাবল অভ্রকে ফোন দিবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বাতিল করল। তার কি ইগো নেই? পিহু হেলেদুলে গেইট দিয়ে বের হল। গেইটের কাছে ফুচকাওয়ালাকে দেখে লোভ জাগল তার। সে ঝাল দিয়ে এক প্লেট ফুচকা অর্ডার করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুচকা চলে আসল।
মামা ঝালটা বেশি দিয়েছে। ঝালে পিহুর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। ঝালে রীতিমত ফুপাচ্ছে সে। এমন সময় কেউ একজন তার সামনে পানির বোতল তুলে ধরল। পিহু দেখল না কে সে। সে ঢকঢক করে পানি খেল। ঝালটা একটু কমল এবার। পিহু চোখ তুলে তাকাল। সামনের জনকে দেখে অবাক হল বটে।
-“যখন ঝাল খেতে পার না তাহলে খেতে আসো কেন?”
তিরিক্ষি কন্ঠে বলল সায়মন। সায়মন পিহুর ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ভাই। দুই বছর যাবত পিহুর পেছনে আঠার মতন লেগে আছে। পিহু শত বার, হাজার বার মানা করেছে। সে শুনতে নারাজ। তার একটাই কথা, লেগে থাকলে একদিন ঠিক পিহু তার হবে।
কিন্তু হয় নি। সে তো আর জানে না তার হওয়ার আগেই তার পাখি অন্য ডালে বাসা বেঁধেছে।
-“এখন কথা বলছো না কেন? আর ফোন কই তোমার? কত কল দিলাম, এসএমএস দিলাম। একটারও রেসপন্স করো নাই কেন?”
সায়মনের কণ্ঠে রাগের আভাস। পিহু তখনও ঝালে ফুপাচ্ছে। সে কথা বলতে পারছে না। একটু সময় নিয়ে পিহু স্বাভাবিক হল। ঝালে পিহুর নাকটা লাল চেরির মতন হয়ে আছে। সায়মন এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে পিহুর দিকে। এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। এই মেয়ে সামনে থাকলে পুরো দুনিয়া ব্লার হয়ে যায় তার। শুধু মনচায় তার পিহুকে দেখতে। পিহু! তার পিহু!
সায়মন পিহুকে এটা ওটা বলে যাচ্ছে। পিহু শুনছে। তার উঠে যেতে মন চাইছে৷ কিন্তু পারছে না। সে বিরক্তি নিয়ে আশেপাশে তাকাল। চেনা পরিচিত কাউকে পেলেই দেবে এক দৌড়।
পিহু যখন আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে তখন চোখে পড়ল অভ্র ভাইকে। রাস্তার অপর পাশে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মনে হচ্ছে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। চোখে সানগ্লাস থাকায় তার দৃষ্টির গভীরতা বা তীক্ষ্ণতা ঠাহর করা যাচ্ছে না। পিহু ঢোক গিলল। বিয়ের দুই দিন যেতে না যেতেই সে একজন ছেলের সাথে স্বামীর কাছে কট খেল। এটা মোটেও ভালো কথা নয়। মন সম্মান থাকল তার?
অপরদিকে অভ্র তাকিয়ে আছে পিহু আর তার সাথে থাকা ছেলেটির দিকে। আহা কী প্রেম তাদের। প্রেমের ঠ্যালায় আশেপাশের কিছু তাদের চোখে ভাসছে না যেন। অভ্রর মেজাজ চটল। সে একটা প্রেম করেছিল বলে বাপ-মেয়েতে মিলে তার চরিত্রের দফারফা করে ছেড়েছে একেবারে। উঠতে বসতে তাকে কথা শুনিয়েছে। এখন যে সে স্বামী রেখে পরপুরুষের সাথে বসে খেইখেই করে হাসছে তার বেলায়? কী ভেবেছে, অভ্র ছেড়ে দেবে? মোটেই না।

চলবে…..