#নীল_প্রহর
আফরা নূর
৮.
অভ্র গটগট পায়ে পিহু আর সায়মনের পাশে এসে বসল। কোন কথা না বলে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল,
-“তুমি তলে তলে টেম্পু চালাও, আমি করলে হরতাল।”
অভ্রর গান শুনে পিহু বিষম খেল। অভ্র জায়গা থেকে নড়বে তার আগেই সায়মন পিহুকে নিয়ে ব্যস্ত হল। অভ্র নড়ল না আর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখল। তার পর পকেট থেকে ফোনখানা বের করে চুপিচুপি দুয়েকটা ছবি তুলে নিল সায়মন আর পিহুর। এগুলো দিয়ে ছোট খালু আর তার মেয়ের মুখে ছামা ঘষে দেবে সে। এরপর থেকে খালি বলতে আসুক কিছু।
পিহু পানি খেয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে অভ্রর দিকে তাকাল। সে নির্বিকার। তার বউ অন্য একটা ছেলের সাথে বসে ফুসকা খাচ্ছে, গপ্প করছে অথচ সে নির্বিকার। এখানে এসেছে কেন সে?
-“তুমি এখানে কী করো?”
-“তোর রঙ্গলিলা দেখিরে পিহু। তুই যে তলে তলে টেম্পু চালাস বলিস নাই তো। তোর বাপ জানে?”
অভ্রর কণ্ঠের তাচ্ছিল্যতা পিহু যেন স্পষ্ট টের পেল।
-“এসব কী ধরনের কথা অভ্র ভাই? টেম্পু চালাই মানে কী? সবাই কে কী নিজের মতন মনে কর নাকি?”
অভ্র এবার আর অবাক হওয়ার জায়গা পেল না। দুনিয়াটা কোথায় গেছে? মেয়েটা রীতিমতো রেড হ্যান্ডেড কট! হাতেনাতে কট খেয়েও এই মেয়ে তাকে দোষারোপ করছে। জমিন ফেটে কেন যাচ্ছে না? অভ্র বুঝল এই জালিম দুনিয়া তার মতন ভালো মানুষের জন্য না। এই দুনিয়া তার যোগ্য না।
-“বুঝলি পিহু, একেই বলে চোরের মায়ের বড় গলা। হাতেনাতে কট খেয়েছিস। তারপরেও স্বীকার করিস না কেন?”
সায়মন এতটা সময় চুপ ছিল। অভ্রকে সে চেনে না। পিহুর কী হয় তাও জানে না।
-“পিহু, উনি কে? চেনো তুমি এনাকে?”
সায়মনের প্রশ্নে অভ্র তাকাল সায়মানের দিকে। অভ্রর বলতে ইচ্ছে হল, যার সাথে প্রেমলিলা চালাচ্ছিলি আমি তার না হওয়া বাচ্চার বাপ হইরে শালা।
অভ্র বলল না। সে পিহুর উত্তর শুনতে চাইল। অভ্র আর সায়মন দুইজনেই পিহুর উত্তরের আশায় আছে। পিহু কিছুক্ষণ আমতা আমতা করল। সে অভ্রকে নিজের স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে চায় না। অভ্রকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিলে তার ইগোতে লাগবে। পরিচয় দিলে হয়ত সায়মন আর তার পিছনে আসবে না। পিহু এখন অনিশ্চিত জীবনে আছে। আগে হলে একটা কথা ছিল। এখন সে বিবাহিত। এটাই সত্যি। সে চায় না সায়মন তার আশায় বসে থাকুক। পিহু নিজের ইগোকে সাইডে রাখে জবাব দিল,
-“বড় খালার ছেলে।”
অভ্র ভ্রুকুটি করে বলল,
-“এটুকুই?”
-“আর আমার হাসবেন্ড।”
পিহুর উত্তরে অভ্র মুখ ব্যাঁকাল। এই ছোট্ট কথাটা বলতে এতক্ষণ সময় লাগে? সায়মনের মুখটা চুপসে গেল। বিশ্বাস করল না কী বুঝা গেল না।
-“তুমি মজা করছো? তুমি বিবাহিত কিভাবে হতে পার?”
অভ্র বসে বসে তামাশা দেখতে লাগল। তার কাছে ব্যপক মজার লাগছে বিষয়টা। সে ভেবেছিল এই বিয়ের চক্করে শুধু সে নিজেই বিশ্বাসঘাতক হয়েছে। এখন দেখছে তার বউও কম বিশ্বাসঘাতক আর ছলনাময়ী নয়। অভ্র মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেল। অভ্র আশা করল সায়মন বাপ্পারাজের মতন করে বলবে, না আমি বিশ্বাস করি না। এ হতে পারে না। তুমি এমন করতে পার না।
তবে অভ্রকে হতাশ করে সায়মন তেমন কিছুই বলল না।
-“যেভাবে সবাই বিবাহিত হয় সেভাবেই।”
-“বিয়ে কবে করেছো? বল নি কেন আমাকে?”
-“আসলে অনুষ্ঠান হয় নি তো তাই কেউ জানে না। তবে তুমি চিন্তা কর না। বিয়ের প্রথম কার্ড টা আমি তোমাকেই দেব। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে খুব।”
জবাবটা অভ্র দিল। পিহুর হাতটা এবার সে শক্ত করে ধরল। পিহু বা সায়মন কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা হেঁটে চলে আসল গাড়ির কাছে। আপর দিকে সায়মন তাকিয়ে রইল পিহুর হাতের দিকে। দুইটা বছর ভালোবাসার পরেও সে পিহুকে স্পর্শ করে নি। আর আজকে হুট করে অন্য একজন পুরুষ কী নিদারুণ অধিকারের সাথে পিহুর হাত টেনে নিয়ে গেল। সায়মনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতরে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। ভালোবাসা হারিয়ে গেলে বুঝি এমনই হয়? এতটাই কষ্ট হয়? ভালোবাসা এত নিষ্ঠুর কেন হয়?
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। অভ্র পিহু দুইজনই নিশ্চুপ। ভাবখানা এমন, এখানে চুপ থাকার কম্পিটিশন চলছে। অভ্র ফাঁকে ফাঁকে পিহুর দিকে তাকাচ্ছে। পিহু তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কিছু ভাবছে। অভ্রকে নিয়েই যে ভাবছে তা তার চাহনিতে স্পষ্ট!
-“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? জীবনে সুন্দর ছেলে দেখিস নাই কখনও?”
পিহু বিরক্ত হল। যেই না চেহারা নাম রাখছে তার পেয়ারা।
-“তখন সায়মন ভাইকে এত কিছু বলার কী দরকার ছিল?”
-“সায়মন ভাইটা আবার কে?”
-“তখন যার সামনে এতকিছু বললে সে।”
পিহুর কণ্ঠে বিক্তির ছাপ স্পষ্ট!
-“ওহ ওইটা, তোর প্রেমিক! কেন প্রেমিক জেনে গেছে বলে কষ্ট হচ্ছে?”
-“উনি আমার প্রেমিক নয়।”
-“এত মিথ্যা কথা বললে জাহান্নামেও ঠায় হবে না তোর পাপী। হাতেনাতে ধরা পড়েছিস তুই। আর লুকিয়ে লাভ নেই কোন।”
পিহু কথা বলল না কোন৷ বেশি বুঝা মানুষকে বুঝিয়ে লাভ নেই। অভ্র পিহুর দিকে তাকাল। পিহুর দৃষ্টি তখন বাইরে।
-“থাক ভয় পেতে হবে না আর।”
-“ভয় কেন পাব?”
দৃষ্টি সরিয়ে জানতে চাইল পিহু।
-“আমি কাউকে বলব না। তোর বাপকে তো একদমই না।”
পিহুর বিরক্তি এবার আকাশ ছুঁল যেন। একটা মানুষ এত বেশি কিভাবে বুঝে?
-“যা মন চায় কর। শুধু আমাকে শান্তি দাও।”
অভ্র কিছু বলল না আর। সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। সে চায় সকলে শান্তিতে থাকুক!
অভ্র আজকেও পিহুকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আজকে আর আসিফের বাসায় গেল না। সোজা গেল আসিফের হসপিটালে। বাসায় গিয়েও তো লাভ নেই বিশেষ। বেয়াদবটা বেশি উড়ছে।
আসিফের কেবিনের সামনে পেশেন্টের লম্বা লাইন লেগেছে। ব্যাটা ভালোই টাকা কামায় করে। অভ্র দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। অভ্রকে দেখে আসিফ একটু ভয় পেল। নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নিতে এসেছে এই ছেলে।
আসিফ সামনে থাকা পেশেন্টকে ঔষধ লিখে দিয়ে বিদায় দিল। অভ্র আসিফের সহকারীকে ডেকে বলল এখন আর ডাক্তারসাব রোগী দেখবেন না। এখন তার লাঞ্চ টাইম। এখন আসলেই আসিফের লাঞ্চ টাইম। তাই সহকারী মাথা নেড়ে চলে গেল।
-“এখানে কেন এসেছিস?”
-“তোর সাথে লাঞ্চ করব চল।”
অভ্রর কণ্ঠস্বার গম্ভীর। আসিফ আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। আসিফের হসপিটালের সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ওরা বসল এসে। অভ্র নিজের মতন খাবার অর্ডার দিল। অনেকগুলো খাবার। দুইজনের জন্য বেশি হবে।
-“এত অর্ডার করছিস কেন? রাক্ষস হয়ে গেলি নাকি?”
-“রাক্ষস হলে তোকে ধরে চিবিয়ে খেতাম শালা। আমার থেকে এখন আমার মা তোর আপন হয়ে গেল বেশি?”
-“আন্টিকে আমি শ্রদ্ধা করি। উনি কিছু বললে আমি ফেলতে পারি না।”
-“আহা এসেছে আমার বাধ্য ছেলে।”
অভ্র আসিফকে কতক্ষণ গালমন্দ করল। এর মাঝে খাবারও এসে পড়েছে। অর্ডার করা সব খাবার আসে নি। দুইজনের পরিমাণই এসেছে। খাবার এলে অভ্র খাওয়া শুরু করল। আসিফ খাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকে।
-“খাচ্ছিস না কেন? রোজা রেখেছিস নাকি?”
-“আচ্ছা অভ্র, তোর জীবনে বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি কী? তোর সাথে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে কি শাস্তি দিবি তুই?”
খাওয়া থেমে গেল অভ্রর। সে তাকাল আসিফের দিকে। শুকনো হাসল। সে নিজেই তো একজন বিশ্বাসঘাতক। তার সাথে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে কী শাস্তি দেবে সে? কয়দিন আগে হলে হিসেব অন্য ছিল। অভ্র বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারে না। মাথায় আগুন ধরে যায় তার।
-“যেই পাপ আমি নিজেই করেছি সেই পাপের কি শাস্তি দেব আমি?”
-“কী পাপ করেছিস তুই?”
-“জেনেও কেন এসব প্রশ্ন করছিস আসিফ?”
আসিফ থামল। অভ্র আবার খাওয়ায় মনযোগী হল। দুনিয়া উল্টে গেলেও এই ছেলের খাওয়া বন্ধ হয় না।
-“আমি স্যরি অভ্র।”
-“স্যরি বলছিস কেন? তালা চেঞ্জ করেছিস তাই?”
-“আমি তোকে প্রটেক্ট করতে পরি নি। আমি থাকতেও তুই এতকিছুর শিকার হয়েছিস। তোর সাথে এত কিছু হয়েছে।”
অভ্র বুঝল না আসিফ কিসের কথা বলছে। এখানে সে থাকলেও কিছু করতে পারত না। মাকে তো সে ভয় কম পায় না। ছেলেটা এমন মাঝেমধ্যেই করে। স্পষ্ট ভাবে কিছু বলে না। আসিফ নিজেও খাওয়ায় মন দিল। তার আজকে পেশেন্টের চাপ বেশি।
ওদের খাওয়া শেষ হতেই ওয়েটার এসে কতগুলো পার্সেল টেবিলে রাখল। অভ্র হাত ধুয়ে এসে টিস্যু দিয়ে হাত মুছল। তারপর পার্সেলগুলো নিয়ে সোজা বাইরের দিকে হাঁটা দিল। আসিফ হাত ধুয়ে এসে দেখল অভ্র চলে যাচ্ছে। সে অভ্রকে ডাকল। অভ্র এক হাতে দরজা ঠেলে বলল,
-“বিল দিয়ে সোজা হসপিটালে চলে যাস। কালকে আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।”
চলে গেল অভ্র। বলদের মতন দাঁড়িয়ে রইল আসিফ। তার সামনে বিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েটার। আসিফ বুঝল অভ্র তাকে ফাঁসিয়েছে। এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়ার লোক তো অভ্র আহসান নয়! আসিফ মুখ ফুলিয়ে বিল পে করল। তার কতগুলো টাকা গচ্ছা গেল আজ৷ এই দুঃখ কোথায় রাখবে সে? ব্যপার না তারও দিন আসবে। প্রতিশোধ সেও নিতে জানে। কায়দা মতন পাক একবার শুধু।
চলবে…