#নীল_প্রহর
আফরা নূর
১২.
সকাল নয়টা। অভ্র এখনও ঘুমাচ্ছে। সারারাত কোমড়ের ব্যথায় ঘুম হয় নি তেমন৷ এমন ধিঙ্গি মেয়ে বিয়ে করলে আরও কত রাত যে ঘুম হারাম হবে!
-“কিরে পিহু, অভ্র উঠেনি এখনও?”
-“না খালা। ঘুমাচ্ছে এখনও।”
-“বলিস কী? শরীর খারাপ করল নাকি? এতক্ষণ ঘুমানোর ছেলে তো অভ্র নয়।”
-“রাতে ভুতে ধরেছিল তোমার ছেলেকে। তাই এত দেরি পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে সে।”
-“আলিজা বেয়াদবের ভুত মনে হয় এসেছিল।”
বিরবির করে বললেন আয়শা আহসান। তাদের কথার মাঝে অভ্র হেলেদুলে ড্রয়িং রুমে আসল। এক হাতে মাথা চুলকাচ্ছে আরেক হাতে কোমড় মালিশ করছে।
-“এই পিহু, তোর মাথায় কী উকুন আছে নাকি রে?”
-“না।”
-“তোরে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না। আমি শিউর তোর মাথায় উকুন আছে। তা না হলে আমার মাথা চুলকায় কেন?”
-“এটা কেমন কথা? ওর মাথায় উকুন থাকলে তোর মাথা কেন চুলকাবে?”
-“মাথামোটার সাথে থাকতে থাকতে দেখি তোমার বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে। এর জন্যই বলি বেশি করে বাদাম খাও। কথা তো শুনে না কেউ আমার।”
-“আসলেই মনে হয় একে ভুতে ধরেছে রে পিহু।”
-“ওঝা ডাকবে নাকি খালা?”
-“দাঁড়া তোর খালুকে বলি। একটা মাত্র ছেলে আমার।”
অভ্র সোফায় বসে টিভি চালাল। চেচিয়ে বলল,
-“রহিমা খালা চা দিয়ে যাও।”
একটু পর পিহু চা নিয়ে আসল। অভ্র পিহুর মুখের দিকে তাকিয়ে কাপখানা নিল।
-“রহিমা খালার এসিস্ট্যান্ট পিহু খালা!”
-“রহিমা খালা আসে নি, তাই নিয়ে এসেছি।”
চোয়াল শক্ত করে বলল পিহু। তারপর মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল পিহু।
-“দুই-তিন দিনের জন্য একটা ছুটা বুয়া দেখিস তো অভ্র।”
-“কেন? রহিমা খালা কই?”
-“ওর মেয়ের জামাইয়ের ডেঙ্গু হয়েছে তাই দুই-তিন দিন আসবেন না।”
-“কী আশ্চর্য! ডেঙ্গু হয়েছে মেয়ের জামাইয়ের তো উনি আসবেন না কেন? চিকিৎসা করবেন নাকি? রহিমা খালা ডাক্তার কবে হয়ে গেল?”
পিহুর মনে হচ্ছে অভ্র ভাই আসলেই পাগল টাগল হয়ে গেছে। কালকে রাত থেকে উল্টা পাল্টা বলে চলেছে। ভালো লক্ষ্মণ নয়। বড় খালার সাথে কথা বলতে হবে। সমস্যাটা গুরুতর।
আজকে আর অফিস গেল না অভ্র। সারাদিন শুয়ে বসে কাটাল। শুধু যে শুয়ে বসে কাটাল তা নয়। মা আর পিহুকে জ্বালিয়ে মেরেছে। ঘরে থাকলে পিহুকে ফরমায়েশ দিয়েছে বাইরে আসলে মাকে। অভ্রর অত্যাচারে দুই রমণী-ই অতিষ্ঠ। আজকে আবার রহিমা খালা নেই। কাজেরও শেষ নেই যেন।
বিকেলের দিকে আসিফ এলো একজনকে নিয়ে। অভ্র ফোন করে বলেছিল আসিফকে একটা বুয়া নিয়ে আসতে। আসিফ অভ্রর চোখের দিকে তাকাল। দু’জন চোখে চোখে মত বিনিময় করল কিয়ৎক্ষণ। তারপর ঘরে গিয়ে দোর দিল।
বন্ধ দরজার দিকে আয়শা আহসান তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কোন দিন তো বউ নিয়ে এভাবে ঘরে খিল দেয় নি। না জানি কি খিচুড়ি পাক্কাচ্ছে দুটোতে মিলে।
আয়শা আহসান মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে দিলেন। মেয়েটার নাম মিতু। বয়স বেশি না। পচিশ হবে হয়ত। বিয়ে হয়েছিল। স্বামী কোন এক মাঝ বয়সী মহিলা নিয়ে পালিয়েছে। দুটো বাচ্চা নিয়ে এখন তার সংসার। আজকে তেমন কাজ নেই। তাই তাকে বলা হল কালকে থেকে আসতে।
***
পরদিন শুক্রবার। সকাল বেলা রান্নাঘরে মিতু আর আয়শা আহসান কাজ করছেন। আনোয়ার আহসান গোসলের জন্য গরম পানি চেয়েছেন। গিজার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চুলাতেই পানি গরম করতে হচ্ছে। আয়শা আহসান মিতুকে বললেন পানিটা বলতিতে ঢেলে দিতে। মিতু কথা মতন পানি বালতিতে পানি ঢালতে গিয়ে অসাবধানতা বশত তা ফেলে দিল। ঠিক সময় অভ্র এসে মাকে সরিয়ে নিল। তা না হলে পানি পুরোটা উনার উপরই পড়ত। মিতু ভয় পেল ভীষণ। ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে গেল মেয়েটা। আয়শা আহসান মিতুকে আশ্বস্ত করলেন। এক্সিডেন্ট হতেই পারে। কোন বড় ব্যপার নয়। মিতু তাও কয়েকবার মাফ চাইল।
দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে আসল অভ্র। উদ্দেশ্য একটা ভাতঘুম দেবে সে। যেই বিছানায় পিঠ ঠেকাল ওমনি রুমে আসলেন মা।
-“আজকে বিকালে পিহুকে নিয়ে ঘুরতে যাস তো।”
-“কোথায় যাব?”
-“আমার মাথায় উঠে বসে থাক ছাগল। কোথায় যাবি মানে কী? সারাদিন তুই কোথায় টই টই ঘুরে বেড়াস? সেখানেই নিয়ে যাবি।”
-“আচ্ছা যাব। এখন ঘুমাতে দাও।”
-“যদি না নিয়ে যাস তোকে কিন্তু বাড়ি থেকে বের করে দেব বলে দিলাম।”
অভ্র উত্তর দিল না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেল।
******
বিকেলবেলা রেডি হয়ে সোফায় বসে আছে অভ্র। পিহুর আসার নাম গন্ধ নেই। বসে বসে অভ্রর ঘুম চলে এসেছে অথচ পিহু এলো না।
-“রাণী ভিক্টোরিয়া, আপনার হল? আর কতক্ষণ বসে থাকব আমি?”
পিহুর জবাব এল না। এর দশ মিনিট পর পিহু নিজে এল। লেমন কালার থ্রি-পিস পড়েছে সে। একটা থ্রি-পিস পরতে এই মেয়ের এক ঘন্টা সময় লেগেছে। ভাবা যায়? থ্রি-পিসটা মনে হয় ধন্য হয়ে গেছে।
অভ্র ড্রাইভ করছে আর পাশে বসে বসে রং ঢং করে ছবি তুলছে পিহু। অনেক দিন স্টোরি দেওয়া হয় না। আজকে ভালো ছবি আসলে স্টোরি দেবে সে। অভ্র পিহুর রং ঢং দেখল। তারপর টুপ করে পিহুর সেলফিতে ঢুকে গেল। পিহু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই হেসে উঠল অভ্র। পিহু হাসল না। ছবিটাই নষ্ট করে দিল।
-“শোন একটা কথা বলি।”
-“বলো।”
ফোনে চোখ রেখেই বলল পিহু।
-“কেউ কোন কাগজ টাগজ দিলে ঠাস করে সই করে দিস না। পড়ে দেখিস। পড়তে মন না চাইলে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করিস।”
-“তোমার কেন মনে হল আমি এক ভুল দুইবার করব?”
-“মাথামোটাদের বিশ্বাস নেই।”
পিহু গাল ফুলাল। সবসময় তাকে অপমান করে। নেড়া কী বেল তলায় বার বার যায়?
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা নদীর কাছে আসল। ছোট মতন মেলা বসেছে এখানে। মানুষজন আছে মোটামুটি ভালোই। ছুটির দিন বলে হয়ত। অভ্র পিহুকে কিছু ছবি তুলে দিল। ছবি তোলা শেষ হতেই পিহু বায়না ধরল সে ফুচকা খাবে। দোকানে মানুষ বেশি থাকায় পিহু গাড়িতে রইল। পিহুর আবার সোস্যাল এনজাইটি আছে। বেশি মানুষের মাঝে থাকলে ওর এনজাইটি এ্যাটাক হয়। এমনিতে বাচাল হলেও বেশি মানুষের মাঝে গেলে তার কাঁপাকাপি শুরু হয়। অভ্র পিহুকে গাড়িতে বসিয়ে ফুচকা নিতে আসল। মামা জানালেন একটু বসতে হবে। অভ্র চেয়ার টেনে বসল। দৃষ্টি পিহুর দিকে। তার জায়গা থেকে গাড়ি দেখা গেলেও গাড়ির কাছ থেকে তাকে দেখা যাবে না। একটু আড়াল হয়েই বসল সে। কিয়ৎক্ষণ পরেই গাড়ির কাছে আরও একটা গাড়ি এসে থামল। অভ্র নম্বর প্লেটটা দেখল ভালোমতন৷ মিনিট দুয়েক পরেই গাড়িটা চলে গেল। পিহুকে নিয়ে। পিহু নেই তার আগের জায়গায়। অভ্র বুঝল কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। সে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ফুচকাওয়ালাকে টাকা পরিশোধ করে দিয়ে বলল ফুচকার আর দরকার নেই। তারপর অলস ভঙ্গিতে আসিফকে কল করল। রিং হতে না হতেই ফট করে রিসিভ হল।
-“আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলি নাকি?”
-“কাজ হয়েছে?”
-“হয়ে গেছে।”
-“যদি পিহুর ক্ষতি করে?”
-“করুক গিয়ে। আমার কী? আমার কাজ হওয়া নিয়ে কথা।”
-“ও তোর বউ হয় অভ্র।”
ধমক দিয়ে কথাটা বলল আসিফ।
-“ছাড় সেসব। ওই দিকে কাজ কতদূর?”
-“অলমোস্ট ডান।”
-“গ্রেট! তুই তাহলে আমাকে লোকেশন সেন্ট করে দে। আর তমালকে নিয়ে বেরিয়ে পর।”
-“ওকে।”
আসিফের ফোন কাটতেই মায়ের ফোন এল। ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই মায়ের উদ্বিগ্ন স্বর কানে এল।
-“সর্বনাশ তো একটা হয়ে গেছে রে।”
-“কী হয়েছে? কে মরেছে?”
-“এখনও মারা যায় নি। তবে বাঁচবে কী না বুঝতে পারছি না।”
-“এত না পেঁচিয়ে বল হয়েছে কী?”
-“তোরা যাওয়ার পর মিতুর ছোট ছেলেটা এসেছিল। বলল বাথরুমে যাবে। আমি বললাম আমাদের রুমেরটায় যেতে। বাথরুমে মনে হয় পাউডারের পানি ছিল। ছেলেটা বাথরুমে পড়ে মাথা ফেটে একাকার হয়ে গেছে। রক্তে সাদা টাইলস ভেসে গেছে।”
-“বাথরুমে ডিটারজেন্টের পানি আসল কীভাবে?”
-“মিতু কাপড় কেচেছিল। পরে আর পানি ধুঁয়ে দেয় নি।”
মায়ের কণ্ঠ কাঁপছে। ভয় পেয়েছে হয়ত। অভ্র হাসলো। একেই বোধহয় বলে অন্যের জন্যে গর্ত তৈরি করলে সেই গর্তে নিজেকে পড়তে হয়।
-“ভয় পাচ্ছ?”
-“একটু। বাসায় কেউ নেই। তোর বাবা ওদের নিয়ে হসপিটাল গেছে।”
কলিং বেজ বেজে উঠল। চমকে উঠলেন আয়শা আহসান।
-“যাও দরজা খুল গিয়ে।”
তিনি দরজা খুললেন। রহিমা খালা এসেছে।
-“রহিমা! তোমার না মেয়ের জামাই অসুস্থ।”
-“অভ্র বাবা ফোন করে বললেন আজকে যেন একবার আসি।”
আয়শা আহসান আবার ফোন কানে দিলেন।
-“বাবা না আসা অবদি রহিমা খালার সাথে থাক।”
-“তোরা কখন আসবি?”
-“বলতে পারছি না। আজকে নাও আসতে পারি।”
-“সাবধানে থাকিস।”
আয়শা আহসান ঘাটলেন না। ছেলে-মেয়ে দুটো একসাথে থাকলে মায়া-মহম্মত বাড়বে।
অভ্র ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোকেশন অন করে গাড়ি স্টার্ট দিল। পিহুর কিছু না হলেই হয়।
চলবে….