#নীল_প্রহর
আফরা নূর
১৩.
আন্ধকার একটা রুম। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসে আছে পিহু। হাত-পায়ের সাথে চোখটা আর মুখটাও বাঁধা। পিহু বুঝতে পারছে না হচ্ছেটা কী? কেউ তাকে কেন কিডন্যাপ করবে? পিহুর জানা মতে তার কারো সাথে শত্রুতা নেই। মুক্তিপণের জন্য হলে অন্য কথা। কিন্তু অভ্র ভাই তো জীবনেও মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিতে আসবে না। পারলে কিডন্যাপারকে টাকা দিয়ে বলবে ‘আপদ নিয়ে যাওয়ার খুশিতে দিলাম বস।’ বাবা আর ভাই দিতে পারে। ওরা পিহুকে যথেষ্ট ভালোবাসলে। মাঝখান দিয়ে একটু মীরজাফর হয়ে গেছিল এই আরকি।
পিহু বসে বসে বিরক্ত হচ্ছে। চোখ বাঁধা থাকুক, মুখটা অন্তত খুলে দিক। বাচাল মানুষ কতক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে? পেটে ব্যথা হয় না?
পুরনো একটা গুদাম ঘরের সামনে এসে গাড়ি থামাল অভ্র। পিহুকে এই গুদাম ঘরেই রাখা হয়েছে। অভ্র ধারণা করেছিল এমন কিছু হবে। তাই আগে থেকেই পিহুর ঘড়িতে ট্র্যাকার সেট করে দিয়েছিল। এই কয়দিন অনেক খেটেছে সে। লোক দিয়ে সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে। নিজে খোঁজ নিয়েছে। এত কিছু হয়ে গেল তার আড়ালে ভাবতেই গা গুলায় তার। ভালোবাসায় কতটা অন্ধ ছিল সে।
আসিফ আর তমাল আসল আরও দশ মিনিট পরে। তমাল একজন পুলিশ অফিসার। অভ্রদের সাথেই পড়ত। সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে আসল আসিফ। জিজ্ঞেস করল,
-“ওইদিকের কী অবস্থা? আন্টি ঠিক আছে।”
-“হ্যাঁ মা ঠিক আছে। মিতুর ছেলের নাকি মাথা ফেটেছে। আজকে আর কিছু করবে বলে মনে হয় না।”
-“ঠিক হয়েছে। আরও আসুক অন্যের ক্ষতি করতে।”
-“গাড়ি এত দূরে দাঁড় করিয়েছিস কেন?”
বলল তমাল।
-“দেখি কী হয়।”
-“এখানে দেখার কী আছে? যাব আর পিহুকে নিয়ে আসব। ব্যাস!”
-“এখন যাওয়ার দরকার নেই। একটু বস। এখন মনে হয় না ভেতরে পিহু আর চ্যালা প্যালা ছাড়া কেউ আছে বলে।”
-“দেরি করলে যদি পিহুর ক্ষতি করে?”
বলল আসিফ।
-“করবে না।”
নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে বলল অভ্র। অভ্রর এসব নির্লিপ্ততা পছন্দ হল না আসিফের।
-“তুই এত শিউর কিভাবে? যদি কিছু না-ই করে তাহলে কিডন্যাপটা করিয়েছে কেন?”
-“কিডন্যাপ আলিজা করে নি।”
অভ্রর কথায় আসিফ আর তমাল দু’জনই অবাক হল।
-“কী বলিস? তাহলে কিডন্যাপ করলটা কে? থার্ড পার্টি আসল নাকি?”
-“আয়ান করেছে।”
অভ্রর কণ্ঠ আগের মতই স্বাভাবিক।
-“আয়ান কিডন্যাপ করা যে কথা আলিজা করা তো একই কথা।”
-“আয়ান লাভস পিহু। ও পিহুকে নিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। মিতুকে দিয়ে পিহুর পাসপোর্ট চুরি করিয়েছে।”
অভ্রর কণ্ঠে জড়তা নেই। আসিফ, তমাল যেন আরও অবাক হল।
-“আলিজা এসব মেনে নিল?”
-“আলিজা জানে না এসব। আলিজা আয়ানকে বলেছে পিহুকে জানে মেরে দিতে।”
-“এত কাহিনি কখন ঘটল? তুই এত সব জানিস কীভাবে? আর কবে থেকে জানিস?”
অভ্র জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে গুদাম ঘরের দিকে। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। মিনিট পাঁচেক পরেই গুদামের বিশাল দরজার সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামল। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসল আয়ান। ছেলেটা যথেষ্ট সুন্দর। সায়মনটাও বেশ সুদর্শন ছিল। অভ্র বুঝল না এসব সুন্দর ছেলেদের চয়েস এত খারাপ হয় কেন? ওরা কী পিহুর একাডেমিক রেজাল্ট জানে না? ওরা জানে না পিহু একটা অপকর্মার ধারি?
***
পিহু যখন বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল তখন একটা পায়ের আওয়াজ ভেসে আসল। মনে হচ্ছে কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। পিহু নড়েচড়ে উঠল। মানুষটা এসে পিহুর সামনে বসল। পিহু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ-মুখ খোলা হবে।
-“পিহু…!”
কেউ একজন গভীর আবেগে ডাকল। পিহুর ভেতরটা কেঁপে উঠল কিঞ্চিৎ। এর আগে এমন ভাবে কেউ তাকে ডাকে নি। পিহু আবারও নড়ে উঠল। সামনের মানুষটার মায়া হল বোধহয়। সে পিহুর চোখ খুলে দিল।
চোখ থেকে কাপড় সরতেই পিহু পিটপিট করে তাকাল। সামনে একটা অচেনা মানুষ বসে আছে। পিহু তাকে চেনে না।
-“আমার হলে না কেন পিহু?”
এবার সেই কন্ঠে তীব্র বিষাদ। না পাওয়ার আক্ষেপ। পিহু তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। কে এই লোক? তাকে কীভাবে চেনে? পিহু কথা বলতে চাইল। কিন্তু মুখে কাপড় বাঁধা থাকার কারণে পারল না।
-“আমার হবে পিহু?”
পিহুর এবার ভ্রু কুঁচকে আসে। কথা বলতে পারলে হয়ত বলত, ‘আমি তো নিজেরই হতে পারলাম না, আপনার হব কী?’
আয়ান একটা কাগজ বের করে পিহুর কোলে রাখল। পিহুর চোখে কৌতুহল।
-“এটা তোমার আর অভ্রর ডিভোর্স পেপার। সই করে দাও। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।”
পিহু হতাশ হল। আরে ব্যাটা ছাড়াছাড়ি যদি এতই সহজ হত তাহলে কী সে পরেরদিনই ছেড়ে দিত না?
-“আমি তোমার হাত খুলে দিচ্ছি। ভদ্র মেয়ের মতন সই করে দেবে। তারপর আমরা দেশ ছাড়ব।”
পিহু সরল চোখে সব দেখে যাচ্ছে। আহারে বেচারা। সব কিছু কী এতই সোজা রে পাগলা? অভ্র ব্যাটা এত সহজে সব হতে দেবে বুঝি?
আয়ান পিহুর হাত খুলে দিল। হাত খুলতেই পিহু ফট করে নিজের মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিল। বড় বড় করেকটা নিঃশ্বাস নিল সে।
-“এতক্ষণে একটা কাজের কাজ করেছেন। উচিত ছিল এসেই আগে মুখ খুলে দেওয়া। এতক্ষণ কথা না বলে থাকা যায়?”
আয়ান হাসল। এই মেয়েকে তার অকারণেই ভালো লাগে। মনে চায় বুকের মধ্যিখানে বন্দি করে রাখতে যেন পালাতে না পারে।
***
পায়ের উপরে বসা মশাটাকে খুব অবহেলায় মারল আসিফ। এতক্ষণে কতগুলো মশার কামড় যে খেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। এখন ডেঙ্গুর সিজন। যদি তার ডেঙ্গু হয়? যদি সে মরে যায়? অভ্রর উপর সে বেজায় বিরক্ত। বিয়েশাদি কিছু করা হয় নি এখনও। এভাবে জোয়ান কালে বিয়েশাদি না করে মরে গেলে ভালো দেখায়?
-“আর কতক্ষণ এভাবে বসে বসে মশার কামড় খাওয়ার চিন্তা করছিস? বউয়ের লাভ বাইটের জায়গায় মশার জীবাণু বাইট পেতে ভালো লাগে?”
-“বাজে বকা অফ কর। আর অভ্র, কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব? এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
অভ্র উঠে দাঁড়াল। আসলেই এবার যাওয়া উচিত। পরে পিহুর করে দিলে সমস্যা। তার একটা মাত্র বউ। তমাল তার ফোর্সকে অর্ডার করল বাইরে থাকা লোকগুলোর ব্যবস্থা করতে।
****
-“দেখ পিহু, ত্যাড়ামি করিও না। ভালোয় ভালোয় সই করে দাও।”
-“আহা আপনি বুঝতে পারছেন না। এখানে সই করলে আমাকে দুনিয়া ছাড়তে হবে।”
-“এত ভালোবাসো অভ্রকে? কিন্তু তোমাদের বিয়ে তো নরমাল সিচুয়েশনে হয় নি।”
-“আরে কোথাকার ভালোবাসা? এত খারাপ দিন আমার আসে নি ওই বেয়াদব ব্যাটাকে ভালোবাসতে যাব আমি।”
-“হ আমারে কেন ভালোবাসবি তুই? তুই তো ভালোবাসবি তোর প্রেমিক রে। কী যেন নাম ছিল মালটার? ও হে মনে পড়েছে, সায়ময়।”
বলতে বলতে প্রবেশ করল অভ্র। তার পেছনে আসিফ আর তমাল। অভ্রকে দেখে ত্বরিত গতিতে উঠে দাঁড়াল আয়ান। অভ্রকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সে। তাদের লোকেশন এত তারাতাড়ি অভ্রর জানার কথা না।
-“এই আয়ান, তোমাদের কী চোখে রগ নেই? ভালোটালো বাসার আগে পরখ করে নেবে না? যত্তসব ফেলুকে কেন ভালোবাসতে যাও বল তো?”
-“তুমি কিন্তু আমাকে আবারও অপমান করছো অভ্র ভাই।”
-“তুই চুপ থাক পাপী। জামাইকে ভাই ডাকিস কোন আক্কেলে? আর বড়দের কথার মাঝখানে ফেলুদের ঢুকতে হয় না।”
অভ্রর কথায় গাল ফুলাল পিহু। সে প্রথমে ভেবেছিল অভ্র তাকে বাঁচাতে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে তাকে অপমান করতে এসেছে।
অভ্র কথা বলতে বলতে এগিয়ে এল। অভ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে পকেট থেকে পিস্তল বের করে অভ্রর দিকে তাক করল আয়ান। পিস্তল দেখে পিহু ভয় পেল ভীষণ৷ ভয়ের চোটে বেচারি জ্ঞান হারাল।
-“এগোলে শ্যুট করে দেব একদম।”
-“ঠিক আছে দাও। এমনিতেও বেঁচে থেকে খুব একটা লাভ হচ্ছে না আমার।”
-“একদম কথার জালে ফাঁসাবে না বলে দিলাম। তোমাকে আমি ভালো মতই চিনি।”
অভ্র হাসল।
-“আমাকে যদি এত ভাল চিনতে তাহলে আমার বউকে কিডন্যাপ করতে না। আর না আমার মাকে মারার জন্য আমার বাড়িতে লোক পাঠাতে।”
ভরকাল আয়ান। অভ্রর মায়ের কোন ক্ষতি তাদের প্ল্যানে ছিল না। তারা মিতুকে অভ্রদের বাড়ি পাঠিয়েছিল শুধু বাড়ির ভেতরের খবর দিতে। আর সে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিল পিহুর পাসপোর্ট চুরি করতে। এটা কেউ জানে না।
-“আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য আমি হয়ত তোমাদের মাফ করে দিতাম আয়ান। কিন্তু তোমরা আমার বাড়িতে ঢুকে ভালো কর নি। কী ভেবেছিলে আমার বাড়িতে ঢুকবে আর আমি জানতে পারব না? আমার নাকের ডগা দিয়ে আমরা বউকে নিয়ে আসবে আর আমি জানব না?।”
একটু থাকল অভ্র। তার গলার স্বর কেমন হিম ধরা। আয়ানের ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দিল সেই শীতল স্বর।
-“তোমাদের ভাই-বোন দুটোকে কী করা যায় বল তো আয়ান? কয়টা অন্যায়ের শাস্তি দেব তোমাদের? তেমাদের মেরে পুতে দিলেও তো রাগ কমবে না আমার।”
আয়ান পকেট থেকে ফোন বের করল। আলিজাকে ফোন দেবে হয়ত।
-“বোনকে ফোন করবে? লাভ নেই। ধরবে না এখন ফোন। ওই অবস্থাতেই তো নেই।”
-“কী করেছ তুমি আলিজার সাথে?”
-“উনো রিভার্স!”
-“মানে?”
-“মানে টা হল, তোমরা আমার সাথে যা করতে চেয়েছ ওইটাই তোমাদের সাথে হয়েছে।”
-“তোমাদের সকল সম্পত্তি শহরের বিভিন্ন ট্রাস্টের হয়ে গেছে। তোমাদের এখন কিছুই নেই। চাইছিলে অভ্র আহসানকে পথে বসাতে এখন তোমরাই পথে বসে গেছো। আর হ্যাঁ কাজটা তোমার বোন নিজে করেছে।”
-“আলিজা! কিন্তু কেন?”
-“তোমার বাপকে বাঁচাতে।”
-“বাবা? কী করেছ তোমরা বাবার সাথে?”
-“যা তুমি আমার বউয়ের সাথে করেছ। আমার বউকে অপহরণ করবে আর আমি বুঝি ছেড়ে দেব তোমাদের?”
আয়ান পিহুর দিকে তাকাল এবার। জ্ঞান হারিয়ে এভাবেই পড়ে আছে। আয়ানের অভ্রর থেকে ধ্যান সরতেই অভ্র এগিয়ে এসে আয়ানের হাত ধরল। তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হল। এক পার্যায়ে আয়ান ট্রিগারটা চেপে দিল। গুলির শব্দে কেঁপে উঠল প্রতিটি প্রাণ। তার সাথে পিহুর ছোট্ট দেহখানা। অভ্র তাকাল পিহুর দিকে। হাত থেকে গলগল করে রক্ত ঝড়ছে। আয়ানের হাত থেকে বন্দুকটা নিচে পড়ে গেল। এটা সে করতে চায় নি। পিহুকে সে মারতে চায় নি। অভ্র আয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিহুর কাছে গেল। আয়ানকে আসিফ আর তমাল ধরে রাখল।
অভ্রর মনে হলো গুলিটা তার কলিজায় লেগেছে।সে তাড়াহুড়ো করে পিহুর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সময় ব্যয় না করে পিহুকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ছুটলো গাড়ির দিকে। অভ্রর পিছু পিছু আসিফও দৌড় দিল।
চলবে….