নীল প্রহর পর্ব-১৪

0
15

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

১৪.
হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে আছে পিহু। তিন দিন যাবত তার জ্ঞান নেই। অপারেশন সাকসেসফুল হলেও এখনও জ্ঞান ফেরে নি তার। এত ধকল তার ছোট শরীর নিতে পারে নি। পিহুর হাত ধরে বসে আছে তার মা। কেবিনের বাইরে বসে আছে অভ্র আর পিহুর বাবা। অভ্র এই তিন দিন বাড়ি যায় নি। এখানেই পড়ে ছিল। তিন দিন যাবত পানি ছাড়া আর কিছু খাওয়াও হয় নি তার। যেখানে তার প্রাণটাই যেতে বসেছে সেখানে গলা দিয়ে খাবার নামবে কীভাবে? এই তিন দিন সে ডাক্তারদের জ্বালিয়ে মেরেছে। প্রতি দশ মিনিট পর পর গিয়ে জিজ্ঞেস করে পিহুর জ্ঞান কখন ফিরবে? তার বউ কথা কেন বলে না? তারা তার বউকে কী উল্টা পাল্টা মেডিসিন দিয়েছে? ইনজেকশন দিতে আসলে আরেক কাহিনি করেছে। কেন ঘন্টা যেতে না যেতেই ইনজেকশন দিতে হবে? এই ছোট শরীরে এত ইনজেকশন কেন দিতে হবে? না পারতে কালকে রাতে ডাক্তাররা অভ্রকেও ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল।

ফিনাইলের তীব্র গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে বারবার। পাশেই যান্ত্রিক মেশিনের বিপ বিপ শব্দ। খুব কষ্টে চোখ দুটো খুলে তাকাল পিহু। চোখের সামনে সব কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আছে। সে নড়তে গিয়ে বুঝল ডান হাতটা সে নাড়াতে পারছে না।
-“পিহু, জ্ঞান ফিরেছে তোর?”
মায়ের উদ্বিগ্ন স্বর। পিহু খুব কষ্টে চোখ খুলে তাকাল। মায়ের গলায় বাইরে থেকে বাবা আর অভ্রও ভেতরে এল।
মা-বাবা কত কথা বলছে। পিহু সেসব শুনছে। তার চোখ জ্বলছে, ঠোঁট কাঁপছে। কিন্তু কথা বলতে পারছে না।
অভ্র ডাক্তার নিয়ে এলো একটু বাদেই। ডাক্তার পিহুকে দেখলেন। দূর্বলতা রয়ে গেছে। হাতের ঘাটাও একটু শুকিয়েছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

পিহুর জ্ঞান ফিরেছে শুনে সকলে তাকে দেখতে এল। এখন সে কথাও বলছে, হাসছেও। বড় খালা তো কেঁদে কুটে একাকার।
জ্ঞান ফেরার পর অভ্রর সাথে দেখা হয় নি পিহুর। পাষাণ লোকটা আসে নি তাকে দেখতে। পিহুর মন খারাপ হল ভীষণ। একটু দেখতে আসলে কী এমন ক্ষতি হত? হুট করেই অভিমানেরা ঝেঁকে ধরল তাকে। অভিমানে গাল ফুলাল পিহু।

হাসপাতালে পিহুর আরও চারটা দিন এভাবেই কেটে গেল। সে এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে হাতটা এখনও ঠিক মতন নাড়াতে পারে না সে। এই চারদিন হাসপাতালে তার সাথে অভ্রই ছিল। শত বলে কয়েও তাকে কেউ বাড়িতে পাঠাতে পারে নি। আজকে পিহুকে ডিসচার্জ করা হবে। পিহু আজকে বাপের বাড়ি যাবে। যতদিন না সুস্থ হয় বাপের বাড়িতেই থাকবে। এমনটাই বাবা বলে দিয়েছেন। বড় খালা অমত করলেও পিহুর বাবা আর ভাইয়ের কাছে ঠিকতে পারেন নি।
বাবা-মায়ের প্রতি পিহুর আর রাগ নেই। সে সবটাই জেনেছে। জেনে খুব খারাপও লাগছে তার। পিহু অজ্ঞান থাকা অবস্থায় অভ্র কী কী পাগলামি করেছে সেসবও জেনেছে পিহু। বড় খালা এগুলো বলে তাকে কম লজ্জা দেয় নি।

বেডে বসে পা দুলচ্ছে পিহু। পাশে বড় খালা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ছেলের প্রতি তিনি প্রচুর বিরক্ত। ছেলে কী পারল না একবার বউকে আটকাতে? বউ যখন হসপিটালের বেডে ল্যাটকা মেরে পড়ে ছিল তখন তো দরদ উথলে পড়ছিল। তখন তো মনে হয়েছিল বউ ছাড়া তার দুনিয়া অচল। এখন কী হল? তিনি বুঝে পান না অভ্রর মতন এমন পল্টিবাজ ছেলে কী করে তার পেটে হল? হাও?
অভ্র ডিসচার্জ পেপার হাতে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল। অভ্রকে দেখেই মুখ ব্যঁকালেন মা। অভ্র দেখেও না দেখার ভান করল। এতে যেন মা আরও রুষ্ট হলেন। পিহুও কিছুটা রুষ্ট হল। অভ্র ভাই একবার বললেই হয়ত সে যেত না। থেকে যেত। পিহুর এখন মনে হচ্ছে অসুস্থ থাকলেই ভালো হত। অভ্র তার সাথে থাকত।
পিয়াল পিহুকে ধরে ধরে গাড়িতে বসাল। অভ্র পেছন পেছন গেল। মাকে বলল পিহুদের সাথে যেতে। সে সন্ধ্যায় গিয়ে নিয়ে আসবে। মা অভ্রর দিকে কিছুক্ষণ রাগত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়িতে উঠে বসল।
-“তুই এখন কোথায় যাবি?”

-“আলিজার কাছে।”

মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিল অভ্র। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় মা তাকে আর কিছু বলতে পারল না। অভ্র নিজেও গাড়ি স্টার্ট দিল।
*****
আসিফকে নিয়ে আলিজার সাথে দেখা করতে এসেছে অভ্র।
-“কেমন আছো আলিজা?”
আলিজা চোখ তুলে তাকাল। অভ্রর মায়া হল ভীষণ। চেহারায় সেই জৌলুশ, সেই দম্ভ কিছুই নেই। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চুলগুলো না জানি কতদিন ধুয়ে না। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অহংকার আর হিংসা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়।

-“কেন এসেছো? মজা নিতে এসেছো?”

অভ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। অভ্রর হাসি দেখে গা জ্বলে উঠল আলিজার। সে তেড়ে এল অভ্রর দিকে। তবে সুবিধা করতে পারল না। গাড়দের পেছনে থেকে কতটুকুই বা সুবিধা করতে পারবে?
-“তোমাকে দেখে আমার খুব করুনা হচ্ছে আলিজা। কী ছিলে আর কী হলে। কেন লাগতে এসেছিলে বল তো? কী পেলে এখন? আমাকে ভিখারি বানানোর চক্করে নিজেই ভিখারি হয়ে গেছ। দেখ নিজেকে একবার। দয়া হচ্ছে আমার তোমাকে দেখে।”
আলিজা চুপ রইল। তবে চোখ দিয়ে তার আগুন বের হচ্ছে।
-“আমি এটা বুঝলাম না তুমি আমার পেছনে কেন পড়লে? দুই দুইটা বছর প্রেমের নাটক কেন করলে? তুমি চাইলে অন্য ভাবেও আমার ব্যবসা নিতে পারতে।”

-“তোমার কাছে চাইলে তুমি দিতে?”

-“একদম না।”

-” আমি তোমার থেকে বাদলা নিতে চেয়েছিলাম।”

-“অভ্র তোমার কী করেছিল?”
প্রশ্নটা আসিফ করল।

-“মনে আছে তিন বছর আগে তুমি একটা সুইজারল্যান্ডের প্রজেক্ট পেয়েছিলে? ওই প্রজেক্টার জন্য আমি আর ভাই গাধার মতন খেটেছিলাম। তিন তিনটা মাস নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজে ডুবে ছিলাম। কিন্তু তোমার জন্য সেই প্রজেক্টটা আমরা পাই নি। ওই প্রজেক্টের জন্য আমাদের একশো কোটি টাকার লস হয়েছে। এত বড় লস বাবা নিতে পারে নি। স্ট্রোক করেছিলেন।”

-“তুমি সাথে সাথেই বদলা নিতে পারতে। এত অপেক্ষা করার কী ছিল?”

-“আমি চেয়েছিলাম তোমাকে একটু একটু করে শেষ করতে। তার জন্য তোমার কাছাকাছি যাওয়াটা খুব দরকার ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার বন্ধু হয়েই কাজটা করব। যখন বুঝতে পারলাম তুমি আমার প্রতি দূর্বল তখন অন্য প্ল্যান করলাম। ভাবলাম তোমাকে এভাবেও মারব ওভাবেও মারব।”
অভ্র মাথা নিচু করে দুটো নিঃশ্বাস নিল। এই দুই বছরে তাদের কোম্পানি অনেক লসের মুখে পড়েছে। ম্যানেজারকে সন্দেহ হলেও আলিজাকে সে কোনদিন সন্দেহ করে নি। সে ভাবতেই পারে নি এত মিষ্টি একটা মেয়ে এত ঘৃণ্য কাজ করবে।

-“তেমার প্রতি আমার আসলেই খুব দয়া আসছে আলিজা। ”

-“এত দয়া ভালো নয় অভ্র। এই দয়া মায়ার চক্করেই এই দশা তোর।”

-“তুই চুপ থাক।”
ধমক খেয়ে আসিফ মুখ ভেঙ্গাল।

-“আয়ানের কাছে যাবি না আজকে?”

-“না থাক। আজকে মুড নেই। আজকে বউয়ের কাছে যাব।”
আসিফ আবারো মুখ ভেঙ্গাল। এই কয়দিন অভ্র প্রতিদিন এক বেলা করে আয়ানকে পিটিয়ে গেছে। যতক্ষণ ক্লান্ত না হয়েছে ততক্ষণ পিটিয়েছে।
আলিজা আর আয়ানকে জালিয়াতি, কিডন্যাপিং আর এটেম টু মার্ডারের কেসে গ্রেফতার করা হয়েছে। হয়ত খুব তারাতাড়ি আদালতেও তোলা হবে তাদের।

দেখতে দেখতে অতিবাহিত হল আরও কয়েক মাস। পিহু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। অভ্রর সাথে তার সম্পর্কও উন্নত হয়েছে বেশ। এখন তাদের সম্পর্ক আর দশটা স্বামী-স্ত্রীর মতই। সম্পর্কের ধারা পাল্টালেও পাল্টায়নি অভ্র। সে এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই পিহুর পিছনে লাগে। সারাক্ষণ পিহুকে খুঁচায়। এতে যেন সে আলাদা শান্তি পায়। দুইদিন আগে পিহু অভ্রর সাথে রাগারাগি করে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। এমনিতেও আসার কথা ছিল। পিয়ালের বিয়ে করেক দিন পরে। পিহু আরও আগেই আসতে চেয়েছিল। অভ্র দেয় নি। তার এক কথা, বিয়ে করেছি কী বউ ছাড়া থাকতে? বউ কেন বাপের বাড়ি থাকবে? সে যেখানে থাকবে তার বউ-ও সেখানে থাকবে।
পিহু ভেবেছিল অভ্র তাকে নিতে আসবে। বদ লোক নিতে আসা তো দূর একটা ফোন অবদি করে নি।
****
সোফায় বসে টিভি দেখছে আর পপকর্ন খাচ্ছে পিহু। মন মেজাজ ভালো নেই তার। এমন সময় কলিং বেল বাজল। পিহু ভাবল বাবা এসেছে। সে হেলেদুলে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে অবাক হল বটে।

-“অভ্র ভাই…!

-“আল্লহ্ তায়ালার গজব পড়বে তোর উপর। এত কাহিনির পরে বিয়ে হইছে আমাদের। তারপরেও তুই আমারে ভাই কেমনে ডাকিস? বুকে লাগে না? মুখে বাজে না তোর? বেয়াদব মেয়ে।”
পিহু প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে অভ্র ভাই এসেছে। তবে এখন বিশ্বাস হয়েছে বটে।

-“তুমি এখানে কেন?”

-“শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছি। সর সামনে থেকে।”
পিহুকে এক হাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল অভ্র। অভ্রকে দেখে ছোট খালা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যেন। রান্না বান্নার বিরাট আয়োজন করলেন। সেই রাতে অভ্র নিয়ম ভেঙ্গে প্রচুর খেল। খেয়ে দেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে পিহুর রুমে আসল সে। আজকে সে এখানেই থাকবে। কারণ? কারণ মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তাকে। বলেছে বউ নিয়ে না এলে বাড়িতে জায়গা দেবে না।
অভ্র পিহুর বেডটাকে দেখল। এই বেডে দুজনের জায়গা হবে বলে মনে হয় না। অভ্র নিজের কোমড়ে হাত দিল। ওই দিনের লাথির কথা মনে হলে কোমড়টা এখনও কেমন চিনচিন ব্যথা করে যেন।
একটু পর রুমে আসল পিহু এসে দেখল অভ্র গভীর মনযোগ দিয়ে খাট মাপছে।

-“কী এত দেখছো মনযোগ দিয়ে?”

-“এই খাটে তো দুই জনের জায়গা হবে না।”

-“তুমি নিচে ঘুমাও তাইলে।”

-“পাপী, পাষাণী নারী। এত পাপ রাখবি কোথায় তুই? আজকে প্রথম তোদের বাড়িতে এলাম আর তুই নিচে ঘুমাতে বলছিস?”

-“এর আগেও বহুবার এসেছো আমাদের বাড়িতে।”

-“ওইটা তো তোর বর হিসেবে ছিল না।”

‘তোর বর’ কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই পিহুর গাল দুটো কেমন লাল হয়ে উঠল। হুট করেই তার কেমন লজ্জা লাগছে। অভ্র পিহুর লাজে রাঙা গাল দুটো দেখল। কী আশ্চর্য! এখানে লজ্জা পাওয়ার কী আছে? সে কী নতুন বউ নাকি?
পিহু ঘোষণা করে দিল বিছানায় অভ্রর জায়গা হবে না। অভ্র কিছুক্ষণ জোরাজোরি করল। পিহুর মন গলল না। অগত্যা অভ্রকে নিচে শুতে হল। একটু বদেই বাইরে বৃষ্টি শুরু হল। অভ্রর শীত লাগতে শুরু করল। অভ্র পিহুর কাছে কাঁথা চাইল। পিহু দিল না। অভ্র উঠে এসে কাঁথা টানল। পিহু শক্ত করে ধরে রাখল। দুইজন কিছুক্ষণ দুই মাথা ধরে টানাটানি করল। এবার অভ্র একটু জোরেই টান দিল। টাল সামলাতে না পেরে পিহু এসে পড়ল অভ্রর উপর। ঘটে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত চুম্বন। ঘটনায় অভ্র পিহু দু’জনেই হতবিহ্বল। পিহু লজ্জা পেয়ে উঠতে গেলেই অভ্র হাতের বাঁধন শক্ত করল।
-“পিহু, এই ছিল তোর মনে? আমাকে চুমু খেতে চাস সোজাসাপটা বললেই হত। আমি কী এত পাষাণ যে বউকে চুমু দেব না? চুমুগুলো আমি রেখেছি কার জন্য তাহলে?”

পিহুর লজ্জা বাড়ল যেন। ইদানিং সে যে কেন এত লজ্জা পায়! পিহু ফিসফিস করে বলল,
-“ছা..ছাড়ো।”

-“তুই আসলেই পাপী। তোর বর এখানে শীতে কাঁপছে কোথায় তুই একটু এসে তাকে উষ্ণতা দিবি তা না করে এমন ফাউল কাজ কারবার করছিস।”
পিহুর গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। সে অভ্রর বুকে মুখ লুকাল। রাতটা তাদের এভাবেই পার হল। শরীরী উষ্ণতায়!

চলবে…..