নীল প্রহর পর্ব-১৫

0
12

#নীল_প্রহর
আফরা নূর
১৫.
তখন সকাল। বাইরে শীতল বাতাস বইছে। বৃষ্টি সেই কখন থেমে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও রয়ে গেছে তার শীতলতা। সূয্যি মামাও উঠে গেছে সেই কখন। অভ্রর বুকে গুটিশুটি মেরে বেড়াল ছানার মতন করে ঘুমিয়ে আছে পিহু। সূর্যের রশ্মি চোখে মুখে এসে পড়তেই ঘুম হালকা হল অভ্রর। সে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচঁকে নিল। নড়তে গিয়ে বুকের উপর ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ খুলে তাকাল সে। চোখ খুলতেই পিহুর মুখটা দৃশ্যমান হল। অভ্র ঠোঁট এলিয়ে আলতো হাসলো। পিহুর চোখেমুখে চুল লেপ্টে আছে। অভ্র সযত্নে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। আলতো করে পিহুর কপালে ছোট করে চুমু দিল। পিহুকে নিজের থেকে আলাদা করল আস্তে করে। তারপর তাকে পাঁজা কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। কালকে তারা মেঝেতেই ঘুমিয়েছে। পিহুকে ভালো মতন শুইয়ে দিয়ে সে গেল ফ্রেশ হতে।
অভ্র ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল পিহু জেগে গেছে। বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে। চুলগুলো উস্কখুস্ক। পিহুকে দেখে অভ্র মিষ্টি হাসল। প্রতিত্তোরে পিহু নিজেও হাসল।

-“বুঝলি পিহু, তুই দেখতে চিকনি চামেলি হলে কী হবে। তোর ওজন নেহাৎ কম নয়। দেখ আমার বুকের বা পাশটা কেমন দেবে গেছে।”

পিহু নাক ফুলল।
-“সকাল সকাল বাজে কথা বলে মুড খারাপ করবে না একদম।”

-“তুই করলে দোষ নেই আমি বললেই দোষ তাই না?”

-“ভালো কথা তো বলতে পার না। সবসময় আজেবাজে কথা।”

-“এখন কী তোর মতন ফেলুর কাছ থেকে আমাকে কথা বলা শিখতে হবে? এত খারাপ দিন এলো বুঝি আমার?”

সকাল সকাল আবারো একটা অপমান জনক কথা বলে ফেলল লোকটা। পিহুর রাগ হল ভীষণ। তবে সে উত্তেজিত হল না একটুও। কথায় আছে যে রেগে গেল সে হেরে গেল। পিহু সকাল সকাল অভ্রর কাছে হারতে চায় না। সে বিছানায় উঠে দাঁড়াল। মিষ্টি হেঁসে অভ্রকে কাছে ডাকল। অভ্র খুশি হল। সকাল সকাল বউ কাছে ডাকলে কে না খুশি হয়?

-“সকাল সকাল বুঝি প্রেম প্রেম পাচ্ছে তোর?”

-“হ্যাঁ। তোমাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পায়।”

অভ্র খুশি হল। জিম করে ভালো একটা কাজই হয়েছে। অভ্র পিহুর কাছে যেতেই পিহু অভ্রর চুল টেনে ধরল। অভ্র চেঁচিয়ে উঠল।
-“পিহুর বাচ্চা কী করছিস এসব? ছাড় বলছি আমার চুল।”

-“ছাড়ব না। কথায় কথায় আমাকে ফেলু বলে অপমান কর কেন তুমি?”

-“আমি কী মিথ্যা বলি। বুকে হাত রেখে বল তুই ফেলু না কি।”

পিহু নিজের মুঠো শক্ত করল।

-“খবরদার আমাকে ফেলু বলবে না। রোমান্স করার সময় মনে থাকে না আমি ফেলু? ফেলুর সাথে রোমান্স কর?”

-“রোমান্সের সাথে পাশ ফেলের কী সম্পর্ক?”

-“আমাকে আবার ফেলু ডাকলে কাছে আসতে দেব না।”

-“তুই আগে আমার চুল ছাড়। আমার মাথা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”

-“ছাড়ব। আগে প্রমিস কর আমাকে আর ফেলু বলবে না।”

-“তুই আগে চুল ছাড়।”

-“আগে প্রমিস কর।”

-“আচ্ছা আর ডাকব না। ছাড়।”

-“প্রমিস?”

-“প্রমিস।”

পিহু এবার নিজের মুঠো ছাড়ল। ছাড়া পেয়ে অভ্র দাম ফেলল। উফ! কী খায় এই মেয়ে? এত শক্তি আসে কোথা থেকে এই চার ফুটের শরীরে?

-“তুই আসলেই পাপী। তোর নামে আমি পুরুষ নির্যাতনের মামলা করব দেখিস।”

পিহু মুখ ব্যাঁকাল। চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে সে ওয়াশরুমে চলে গেল। অভ্র পিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তার বউটা যে বেয়াদব তা সে জানত। সেই সাথে যে এতটা পালোয়ান তা সে জানত না। অভ্র মাথায় হালকা হাতে ম্যাসাজ করতে লাগল। মাথাটা কেমন ব্যথা করছে।

****
নাস্তার টেবিলে বসে আছে সকলে। ছোট খালা অভ্রর জন্য আলুর পরোটা বানিয়েছে। নাস্তায় আলুর পরোটা অভ্রর পছন্দের একটি খাবার। জিম করলেও সে খাওয়ায় কম্প্রোমাইজ করে না। খেতে খেতে অভ্র পিহুকে বলল,
-“নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে নে। তোকে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাব।”

-“কোথায় যাবে ও?”
জানতে চাইলেন পিহুর বাবা। পিহু নিজেও কৌতুহলী হল। কোথায় যাবে সে?

-“বাসায়।”

-“বাসায়?”

-“হ্যাঁ। দুই দিন তো থাকল। আর কত?”

-“কী বলিস অভ্র? এত দিন পর মেয়েটা এলো। দুই দিন থেকেই চলে যাবে? আরও কয়েকটা দিন থাকুক। তাছাড়া পিয়ালের বিয়েটাও তো কাছে।”

ছোট খালার কথায় অভ্র গাল ফুলাল। মেয়েকে যদি শ্বশুর বাড়ি এতই যেতে দিতে মনে না চায় তাহলে বিয়ে কেন দিয়েছে? মেয়েকে শোকেসে সাজিয়ে রাখলেই পারত।

-“মা বলেছে পিহুকে নিয়ে যেতে। উনার একা একা নাকি ভালো লাগে না।”
সকাল সকাল ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলে দিল অভ্র। মা তাকে এসব কিছুই বলে নি। পিহু ঝগড়া করে এসেছে বলে একটু বকেছে শুধু। সে তো আর বলতে পারে না, বউ ছাড়া কাজে তার মন বসে না। এসব কী বলা যায়? তার কী লাজ শরম নেই কিছু?
-“আমি বড় খালার সাথে কথা বলে নেব। আর কিছু দিন থাকি।”

অভ্র পিহুর দিকে চোখ গরম করে তাকাল। এ যেন তার বউ ঘরের শত্রু বিভীষণ।
নাস্তা শেষ করে রুমে এসে বসে রইল অভ্র। একটু পর পিহু আসল। পিহুর মুখ লটকে আছে। অভ্রর মায়া হলেও প্রকাশ করল না। সে পিহুকে সাথে নিয়েই শ্বশুর বাড়ি ছাড়ল। পিহুকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে সে আসিফের সাথে দেখা করতে গেল।

*****
আসিফের কেবিনে বসে আছে অভ্র। আসিফ পেশেন্ট দেখছে আর অভ্র বসে বসে ফোনে গেম খেলছে। এর মাঝেই একজন পেশেন্ট এলো। অভ্রকে দেখে তার দিকে এগিয়ে এল।

-“আপনি কিছুদিন আগে আপনার বোনকে নিয়ে মার্কেটে এসেছিলেন না?”
অভ্রকে উদ্দেশ্য করে একজন আগন্তুক কথাটা বলল। অভ্র চোখের সামনে থেকে ফোনটা নামিয়ে লোকটার দিকে তাকাল। বয়স বেশি না। লম্বা, চওড়া, ফর্সা। যথেষ্ট সুদর্শন!

-“অভ্র, তোর বোনও আছে? এত দিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলিস ভাই? তোর বোন আছে জানলে তো আমি যেভাবেই হোক তোর বোনকে বিয়ে করতাম। তোকে নিজের শালা বানানোর সুযোগ জীবনেও হাতছাড়া করতাম না।”
অভ্র বিরক্ত হল। তার কোন বোন নেই। সে ছোট বেলায় মেঝেতে গড়াগড়ি করে কেঁদেছে একটা বোনের জন্য। বাবা-মা তাকে পাত্তা দেয় নি। বেশি জেদ করলে পিহুকে কোলে এনে বসিয়ে দিয়ে বলেছে, এই নাও তোমার বোন। এটা দিয়ে কাজ চালাও।
-“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বোন নেই। আমার বাপ-মায়ের আমি একটাই ছেলে।”

-“ওইদিন যে আপনি একটা মেয়ের সাথে মার্কেটে গেলেন, আপনাকে ভাই ভাই বলে ডাকছিল। কে ছিল সে?”
অভ্র মস্তিষ্কে জোর দিল। মেয়ে বলতে সে পিহুকে নিয়েই বের হয়। কয়েকদিন আগেও পিহুকে নিয়েই বের হয়েছিল সে। তার নাকি কি সব জিনিসপাতি কেনা লাগত। অভ্র লোকটার দিকে সুক্ষ্ম নজরে তাকাল। পকেট থেকে ফোন বের করে লোকটাকে পিহুর ছবি দেখাল। পিহুর ছবি দেখতেই লোকটার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

-“হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই মেয়েটাই। আপনি তখন মানা করলেন কেন?”

আসিফ এবার শব্দ করে হেঁসে উঠল। অভ্র কটমট করে তাকাল তার দিকে।

-“শুনন, এই মেয়ে আমার বোন নয়। এই মেয়ে আমার বউ। আমাদের চারটা বাচ্চাও আছে। আরেকটার প্ল্যানিং চলছে। ছোটটার ছয় মাস হলেই প্রসেস শুরু করব।”
লোকটাকে দেখে মনে হল না সে বিশ্বাস করেছে।
-“তাহলে আপনাকে ভাই কেন ডাকছিল?”

-“আমার বউ আমাকে ভালোবেসে ভাই বলে ডাকে। আপনার কোন সমস্যা আছে?”
বেশ রাগত স্বরে কথাটা বলল অভ্র। অভ্রর রাগের কাছে লোকটা আর কিছু বলল না। অপরদিকে আসিফ খেক খেক করে হেসেই চলেছে। অভ্র বিরক্ত হয়ে উঠে আসল। বউটাকে শায়েস্তা করতে হবে। এভাবে রাস্তা ঘাটে ভাই ভাই বলে চেঁচালে তো সমস্যা।

চলবে……..