#নীল_প্রহর
আফরা নূর
১৬.
পিহু তখন বারান্দায় বসে আছে উদাস হয়ে। চোখে মুখে তার বিষন্নতা। মনটা তার বিশেষ ভালো নেই আজ। কারণটা তার অজানা। এভাবেই তার ভালো লাগছে না। অজানা কারণেই মনটা কেমন ভার হয়ে আছে। অভ্র ঘরে এসে দেখল তার বউ উদাস হয়ে আকাশ দেখছে। অভ্র এসে পিহুর পাশে বসল। পিহু একবার অভ্রকে দেখে আবারও আকাশ দেখায় মন দিল।
-“তারা গুনার চাকরি নিয়েছিস নাকি?”
পিহু কথা বলল না। আগের মতই নিশ্চুপ রইল সে।
-“মন খারাপ?”
অভ্রর কন্ঠ কোমল।
-“আমাকে কয়েকটা দিন থাকতে দিলে কী এমন হত?”
-“এত পাষাণের মতন কথা বলিস না। তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকতাম?”
-“তুমিও থাকে যেতে আমার সাথে।”
-“শ্বশুর বাড়িতে থাকতে লজ্জা লাগে আমার।”
পিহু গাল ফুলাল। অভ্র ভাই সবসময় এমন করে।
-“তুমি আমার চাওয়ার গুরুত্ব দাও না কেন?”
পিহুর কণ্ঠ উদাস।
-“কোনটার দেই নি?”
পিহু মনে করার চেষ্টা করল। মনে করতে পারল না কিছু। অভ্র তার সব চাওয়া পূরণ করে। কিছু কিছু জিনিস তো পিহু মুখ ফুটে চাওয়ার আগেই পেয়ে যায়।
-“কী হল, বল। কোন চাওয়াটা পূরণ হয় নি তোর?”
-“আমি মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলাম।”
-“আমার কাছে থাকতে ভালো লাগে না? পুরাতন হয়ে গেছি আমি?”
পিহু অভ্রর দিকে তাকাল এবার। একটু যে মন খারাপ করবে, ঝগড়া করবে তার উপায় নেই।
-“এসব কী ধরনের কথা? মানুষ পুরাতন হয় নাকি?”
-“তাহলে বলতে চাইছিস আমাকে আর ভালো লাগে না? নতুন কাউকে লাগবে তোর?”
-“এই কথা কখন বললাম?”
-“তাহলে শুধু চলে যেতে চাস কিসের জন্য? এমন ভাব করিস আমার ছোঁয়াছে রোগ হয়েছে কোন। আমার সাথে থাকলে এখন তোরও হবে। পরে অকালে মরে টরে যাবি।”
পিহু আর কথা বলে না। এই লোকের সাথে সে কথায় পারে না। অভ্র পিহুর কোমল হাত দুটো নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি করল। পিহুকে নিজের কাছে কিছুটা টেনে এনে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচাল।
-“তুই বুঝিস না কেন, আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারি না। হাসফাস লাগে আমার।”
-“ওই দিন যদি গুলি খেয়ে মরে যেতাম তখন কী করতে?”
-“কী আবার করতাম? আরেকটা বিয়ে করতাম। সংসার করতাম। বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিতাম তিন চারটা। ওদের কে বিয়ে দিতাম। ওদের বাচ্চা কাচ্চা হত দশ বারোটা। পরে একদিন ঠুস করে মরে টরে যেতাম।”
পিহু ভেবেছিল অভ্র সিনেমার হিরোদের মতন করে বলবে, আমিও তোর সাথে মরে যেতাম পরে পাপী বউ আমার। কিন্তু ব্যাটা তো একটা আস্ত বদ। এসব কেন বলবে সে? বলবে তো সব মাথা গরম করে দেওয়ার কথা।
-“তাহলে এখনই যাও। বউ নিয়ে আসো আরেকটা।”
পিহু উঠে যেতে নিল। অভ্র পিহুকে এবার নিজের কোলের মাঝখানে বসাল। পিহুর কাঁধের উন্মুক্ত অংশে চুমু খেল শব্দ করে।
-“এখন তো সম্ভব নয়। তুই থাকতে দ্বিতীয় নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোও হারাম।”
পিহুর এবার মন গলল যেন। দু’জনেই কিয়ৎপল নিরব রইল। নিরবতা ভেঙে পিহু বলল,
-“অভ্র ভাই..।”
-“হু।”
-“আমায় ভালোবাসো?”
-“না। যারা স্বামীকে ভাই বলে ডাকে তাদের আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না। তাদের দেখলেই বমি আসে আমার। মন চায় তাদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। তোর ভাগ্য ভালো আমি মহান মানুষ তাই তোকে ছাড় দেই। একটু আধটু আদর সোহাগ করি তোকে। তাছাড়া আর কিছুই না।”
পিহু গাল ফুলাল। অভ্র যে তাকে টন্ট মারল তা সে স্পষ্ট বুঝতে পারল। লোকটা কখনই সোজা ভাবে কথা বলে না।
-“আজকে তোর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল।”
-“কী বল এইসব? আমার বিয়ের প্রস্তাব কেন আসবে? আমি না বিবাহিত।”
-“তুই যে বেয়াদব আর পাপী। রাস্তা ঘাটে জামাইরে ভাই ডাকলে তো প্রস্তাব আসবেই।”
পিহু ঠোঁট উল্টাল। এই জন্যই তার কাজিন ম্যারেজ ভালো লাগে না। ছোট বেলা থেকে একটা মানুষকে মনে প্রাণে ভাইয়া ভেবে এসে হুট করে সাইয়্যা হয়ে গেলে তো ঝামেলা হবেই। এত দিনের অভ্যাস কি এত সহজে যায়? একটু তো সময় লাগবেই।
-“ভাবছি তোর গলায় একটা প্লেকার্ড ঝুলিয়ে দিব। সেখানে লেখা থাকবে ‘আমি বিবাহিত। আমার চারটা বাচ্চা আছে। আমি আমার বরকে ভালোবেসে ভাই বলে ডাকি।’ কেমন হবে বল তো বিষয়টা?”
-“খুব খারাপ হবে। এমন কেউ করে?”
-“তুই আমাকে যেভাবে কথার শুরুতে একবার আর কথার শেষে একবার ভাই বলে ডাকিস, তা ছাড়া তো আর উপায় নেই।”
পিহু এবার শব্দ করে হাসল। অভ্রর বুকে হেলান দিয়ে নিজের মাথাটা অভ্রর কাঁধে এলিয়ে দিল। অভ্র এবার পিহুর কন্ঠনালীতে ঠোঁট ছুঁয়াল। রাতটা তাদের খুনসুটিতেই কেটে গেল। তাদের সম্পর্কটা কেমন টক-ঝাল-মিষ্টি আচারের মতন। বিষয়টা নেহাৎ মন্দ নয়।
***
পরদিন সকাল বেলা। অভ্র পিহুর পেছন পেছন ঘুরছে। উদ্দেশ্য পিহুকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবে। তবে পিহু যেতে নারাজ। সে যেতে চায় না।
-“তুই কিন্তু এখন বেশি বেশি করছিস পিহু। এভাবে থার্ড ইয়ারে উঠে ড্রপ ডাউট করার কোন মানেই হয় না।”
-“আমি বেশি বেশি করছি না। তুমি বেশি বেশি করছো। বলেছি না আর পড়ব না।”
-“কেন পড়বি না? সমস্যা কী তোর?”
-“দেখ নাই ছয় বিষয় পরীক্ষা দিয়ে চারটায় ফেইল করি। পড়াশোনা করে হবে টা কি আমার?”
-“কি হবে না হবে তা পরে দেখা যাবে। আমি যখন বলেছি তুই ভার্সিটি যাবি মানে যাবি।”
-“জোর জবরদস্তি নাকি?”
-“স্বামীর কথা না শুনে আর পাপ বাড়াস না৷ এমনিতেই তোর পাপের শেষ নেই।”
-“ভেবে দেখ, আমি ভার্সিটি গেলে সেই ফেইল করব। তখন তোমার টাকা খরচা হবে শুধু।”
-“আমার কেন খরচা হবে? রিটেকের টাকা তো তোর বাপই দিবে।”
-“টিউশন ফি তো তোমাকেই দিতে হবে নাকি?”
বেশ বিরক্ত হল পিহু। পড়াশোনার সাথে তার জাতি দুশমনি আছে। মেট্রিকটা দিয়েই বাসায় বলেছিল বিয়েটা দিয়ে দিতে। এত ব্রেন খরচ করে কেন পড়তে হবে পিহুর বুঝে আছে না। আরে, সে মেয়ে মানুষ। বিয়ে হয়েছে। কোথায় স্বামীর সেবা করবে, সংসার করবে, বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করবে। তা না করে তাকে নাকি এখন ধেই ধেই করে পড়তে যেতে হবে। কোন মানে হয় এগুলোর?
-“দেখ পিহু, আমি অত শত বুঝি না। তোকে আজকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসব। তুই পড়াশোনা কন্টিনিউ করছিস মানে করছিস। আমি লোকে লোকে বলে বেড়াতে পারব না যে আমার বউ ড্রপ ডাউট।”
অভ্র পিহুকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সবসময় এত লাই দিতে হয় না। লাই দিলে মাথায় উঠে নাচবে। পড়াশোনা ছাড়া এখন দাম আছে কোন? চাকরি বাকরি না করুক কিছু, পড়দশোনা করতে ক্ষতি কি? মানুষ কি পড়াশোনা শুধু চাকরির জন্য করে নাকি? পড়তে হয় নিজের জন্য। বিপদে আপদে কেউ কাজে না আসলেও পড়াশোনাটা আসে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে অভ্র পিহুকে এক বিন্দু ছাড় দিতে নারাজ। এই মেয়ে এমনিতেই এক নম্বরের ফাঁকিবাজ।
সকাল দশটায় অভ্র পিহু বের হল। পিহুর মুখ লটকে আছে। বড় খালা আর খালু দু’জনেই পিহুকে বোঝালেন অনেক। বিয়ে হয়েছে মানে এই না যে পড়তে হবে না। পিহু সারা রাস্তা অভ্রর সাথে কথা বলে নি। অভ্র নিজেও বলে নি। এখন কথা না বলাটাই শ্রেয়। বাসায় গিয়ে বউয়ের রাগ অভিমান ভাঙ্গানো যাবে ক্ষণ!
ভার্সিটির কাজ শেষ করতে করতে বেজে গেল দুইটা। অভ্র পিহুকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় বসল দুপুরের খাবার খেতে। অভ্র পিহুর পছন্দের খাবার অর্ডার করল। পিহু পুরোটা সময় নিরবই রইল। এমন জীবন সে চায় নি। যতবার তার মনে পড়ছে সে আবারো জৈব যৌগ নামক নিরব ঘাতকের কবলে পড়েছে ততবার তার চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলে আসায় ওরা খাওয়ায় মন দিল। এমন সময় সেখানে আগমন ঘটল সায়মনের। সে সোজা পিহুর সামনে এসে দাঁড়াল।
-“কেমন আছো পিহু?”
চলবে………