নীল প্রহর পর্ব-১৭

0
17

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

১৭.
-“কেমন আছো পিহু?”

অভ্র পিহু দু’জনেই মাথা তুলে তাকাল। সায়মনকে দেখে অভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো যেন। এত দিনেও এই ছেলের পিরিতি যায় নি? পিহু একবার অভ্রকে দেখে সায়মনের দিকে তাকাল। আলতো হেঁসে বলল,
-“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

-“আমিও আছি আলহামদুলিল্লাহ। শুনলাম, তোমার নাকি গুলি লেগেছিল? এখন ঠিক আছো?”

-“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছি।”
হাসি মুখেই উত্তর দিল পিহু। পিহুর হাসি দেখে যেন অভ্রর গা পিত্তি জ্বলে গেল। সকাল থেকে তার সাথে কথা বলছে না ঠিক করে আর এখন কোথাকার না কোথাকার ছেলের সাথে বত্রিশ পাটি বের করে হেসে হেসে কথা বলছে। এই মেয়ে আসলেই বেয়াদব, আসলেই পাপী। বউ বলে সহ্য করে সে। নাহলে কবেই ছেড়ে ছুঁড়ে বনবাসে চলে যেত! এত অত্যাচার কী মেনে নেওয়া যায়?
সায়মন পিহুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো, পিহুর ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিল। তারপর নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়ে চলে গেল। তার চোখে পিহুর জন্য আজকেও সেই আগের দিনের মতোই ভালোবাসাটা দেখতে পেল অভ্র। এতে যেন তার আরো রাগ হল। সে কী তার বউকে ভালোবাসতে পারে না? তার ভালোবাসা কী তার বউয়ের জন্য পর্যাপ্ত নয়? সে থাকতে অন্যকেউ কেন তার বউকে ভালোবাসবে?
অভ্র আর কিছু মুখে দিল না। খেতে মন চাইছে না তার। ক্ষুধাটা যেন মরে গেছে। অন্য ছেলের চোখে নিজের বউয়ের জন্য ভালোবাসা দেখলে কোন স্বামীর ক্ষুধা থাকে? কোন স্বামীর গলা দিয়ে খাবার নামে?

পিহু সময় নিয়ে খাওয়া শেষ করল। অভ্র শুধু তাকিয়ে থেকে দেখল তার বউয়ের কাজ কারবার। অভ্র যে খেল না তা নিয়ে পিহুর মাথা ব্যথা নেই। এই লোক বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে না। পিহু হসপিটালে থাকার সময় কীভাবে যে তিন দিন না খেয়ে থাকল তাই সে বুঝতে পারে না। মাঝেমধ্যে পিহুর মনে হয় অভ্র চুরি করে হয়ত খেয়েছে। এই লোকের জন্য অসম্ভব কিছু না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতে। তবে সহসে কুলোয় না। দেখা গেল মেরে আবারো তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।

পুরো রাস্তা অভ্র গাল ফুলিয়ে বসে রইল। কোন কথা বলা দূর পিহুর দিকে তাকাল অবদি না। এবার পিহুর যেন টনক নড়ল। বুঝল তার স্বামীর অভিমানটা বেশ প্রগাঢ়। ফোস করে দুটো নিঃশ্বাস নিল পিহু। তাকে অসহায় লাগল খুব। অভ্রর অভিমান ভাঙ্গানো মুখের কথা নয়। এই লোক মেয়ে মানুষের থেকেও বেশি নাটক জানে। নাটক তার শিরায় শিরায় বহমান।

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তারা বাসায় পৌঁছাল। সবসময়ের মতন এবারও পিহুকে পৌঁছে দিয়ে অভ্র গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। অভ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পিহু হতাশ হল। পিহু ঘরে এসে দেখল বড় খালা বসে বসে টিভি দেখছেন। পিহুকে দেখে মিষ্টি হাসলেন তিনি। পিহু গিয়ে খালার পাশে বসল। খালার শরীর থেকে কেমন মা মা একটা ঘ্রাণ আসছে। পিহু কোন কথা না বলে খালাকে জরিয়ে ধরল।

-“কী হয়েছে পিহু? মন খারাপ? অভ্র বকেছে?”

-“বকবে কীভাবে? কথাই তো বলছে না।”

বড় খালা হাসলেন যেন। ছেলে মেয়ে দুটো গায়ে গতরে বড় হলেও স্বভাবে বড় হল না। কিছু থেকে কিছু হলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। একজন আরেকজনের সাথে কথা টথা বলবে না কিছু।

-“আমি অভ্রকে বকে দেব।”

-“উনি আমার সাথে কথা না বললে আমার কষ্ট হয়।”
আয়শা আহসান আবারো হাসলেন। তৃপ্তির হাসি। বিয়েটা দিয়ে তিনি আসলেই কোন ভুল করেন নি। অভ্র পিহু একে অপরের পরিপূরক!

*****
আজকে অভ্র তারাতাড়ি বাড়ি এলো। মা ফোন করেছিলেন। তারা বাবার কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছে। আজকে থাকবেন। অভ্র বিরক্ত হল। ব্যবসাটা তার উপর দিয়ে বাবা কেমন সারাটা দিন ঘুরে ফিরে বেড়ায়। আজকে এই বন্ধুর সাথে হ্যাং আউটে যায় তো কালকে আরেক জনের সাথে। অভ্র বুঝে পায় না উনার বুড়ো বয়সে এমন ভীমরতিতে ধরেছে কীভাবে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্র কয়েকবার কলিং বেল বজাল। পাঁচ মিনিট হয়ে গেলেও দরজা খুলল না পিহু। অভ্র ফোন করলে ফোনটাও ধরল না। এবার যেন অভ্র ভয় পেল। কিছু হয়ে টয়ে যায় নি তো? অজানা অতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল অভ্রর। সে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। পুরো বাসা অন্ধকার। কোথাও আলোর ছিটেফোঁটা নেই। অভ্রর ভয়টা বাড়ল যেন। সে গলা উঁচিয়ে পিহুকে ডাকল দুইবার। পিহুর সাড়া পাওয়া গেল না। ভয়টা গাঢ় হল তার। অভ্র দ্রুত পায়ে নিজেদের ঘরের দিকে গেল। দরজা চাপানো। হালকা হাতে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। অভ্র ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল। ঢুকে অবাক হল বেশ। পুরো রুম ছোট ছোট মোমবাতি দিয়ে সাজানো। সাজানো নয় ঠিক। মোম দিয়ে ইংরেজিতে স্যরি লেখা। অভ্রর ঠোঁট প্রশস্ত হল যেন। বোধহয় হাসছে। যাক বউটা তার এতদিনে বরের মান ভাঙ্গানো শিখেছে! অভ্র আবারো পিহুকে ডাকল। সাড়া পাওয়া গেল না। তবে এবার নূপুরের শব্দ শুনতে পেল অভ্র। পিহু সচরাচর নূপুর পরে না। অভ্র তাকে একবার নূপুর উপহার দিয়েছিল। মনে হয় ওটার শব্দই। অভ্র শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। জানালার পর্দায় এবার একটা ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হল।
অভ্র এগিয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তির দিকে। আলতো হাতে পর্দা সরিয়ে দিতেই পিহুকে নজরে এলো তার। অভ্রর চোখের পলক স্থির হল। নিঃশ্বাস থেমে গেল। অভ্র অনিমেষ তাকিয়ে রইল পিহুর দিকে।

অপরদিকে মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচাচ্ছে পিহু। তার বুকটা কেমন দুরু দুরু কাঁপছে। পরনে তার সাদা জর্জেট একটা শাড়ি। শাড়িটা মাস তিনেক আগে অভ্র কিনে দিয়েছিল তাকে। সাদা রঙ অভ্রর খুব পছন্দের। শাড়িটা আগে কখনো পরে নি সে। আজকেই প্রথম। এমনিতেই সে খুব নার্ভাস। তার উপর অভ্রর এমন ঘোর লাগা দৃষ্টি! পিহুর অবস্থা যেন মরি মরি।

অভ্র পিহুর দিকে এগিয়ে এল। অভ্রকে এগোতে দেখে পিহু দুই পা পিছালো। তার পিঠ ঠেকল গিয়ে দেয়ালে। অভ্র পিহুর দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিজের কাছে আনল। তাদের মধ্যকার সকল দূরত্ব যেন মিলিয়ে গেল। অভ্রর গরম নিঃশ্বাস পিহুর চোখে মুখে আঁচড়ে পড়ছে। পিহু চোখ খিঁচে নিল। অভ্র হাসলো।
-“আমাকে এভাবে পাগল বানানোর ধান্ধা করলি কেন রে মেয়ে? আমাকে এমন পাগল বানিয়ে কি লাভ হলো? সেই তো নিজের ক্ষতিখানা করে দিলি।”
পিহু তখনো চোখ খুলল না। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। লজ্জায় তার হাত পা কাঁপছে। অভ্র পিহুর চোখের পাতায় চুমু দিল। পিহুর ছোট্ট দেহখানা কেঁপে উঠল। অভ্রর মায়া হলো না যেন। সে নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে পিহুর লিপস্টিক মুছে দিল অবহেলায়, অযত্নে।
-“কতবার বলেছি আমার সামনে লিপস্টিক দিয়ে আসতে না? তুই জানিস না আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না? আমাকে বেপরোয়া বানাতে ভালো লাগে বুঝি?”

পিহুর এবার নিজের জন্য মায়া হতে লাগল। কী দরকার ছিল পাগল ক্ষেপিয়ে, কী দরকার ছিল নিজের কফিনে নিজ হাতে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার? অভ্র এবার যেন আরেকটু বেসামাল হল। এক হাত পিহুর পিছনের দেয়লে রেখে অন্য হাত রাখল পিহুর উন্মুক্ত পেটে। অভ্রর আঙুলের উষ্ণ ছোঁয়া যেন পিহুর ভেতরে আলোড়ন তুলল। তার ছোট্ট দেহখানা বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে অভ্রর ছোঁয়ায়।

-“অভ্র….!”
পিহুর স্বর নিচু। যেন তা অভ্রকে বাঁধা দিতে চাইল। কিন্তু অভ্র কী তা মানে? অভ্র এবার নিজের এক হাত পিহুর ঘাড়ে রেখে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। কাঁধে দুটো চুমু দিয়ে কাঁধে মুখ গুজে দিল। অপর হাত বিচরণ করছে পিহুর কোমড়ে। সময়ের সাথে সাথে যেন অভ্রর স্পর্শ গুলো তীব্র হচ্ছে। সেই সাথে বেপরোয়া হচ্ছে দুটি হৃদয় আর দুটি মন।

চলবে…..