নীল প্রহর পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
15

#নীল_প্রহর
আফরা নূর
অন্তিম পর্ব

আজকে পিয়ালের বিয়ে। এখন অনুষ্ঠান হবে না। শুধু ঘরোয়া ভাবে আকদ হবে। পিহু নতুন জামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। ওড়নাটা এক সাইডে রেখে চুলে বেণী করে নিল সে। বেণীটা সামনে এনে একটা ক্লিপ ঠুকে দিল মাথায়। অভ্রর দিকে ঘুরে বলল,
-“আমাকে কেমন লাগছে।”

অভ্র একপলক পিহুর দিকে দেখে বলল,
-“সুন্দর।”

-“ভাবছি আজকে এভাবেই যাব।”

অভ্র এবার ঘড়ি পরা বাদ দিয়ে ভালো করে পিহুর দিকে তাকাল। পিহুর জামাতে ঘাড়ের উপরে বোতম দেওয়া একটা। বোতামের নিচে অনেকটা অংশ ফাঁকা। অভ্র ঢোক গিলল। কী সর্বনাশা কথা বলে এই মেয়ে! এভাবে বিয়েতে যাবে মানে কী? অভ্র হার্ট অ্যাটাক না করে বসে। অভ্র বুঝে পায় না, বউদের এসব জামা কাপড় কেন পড়তে হবে যা স্বামীদের হার্ট অ্যাটাক দেয়।

অভ্র নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“যা। যদি অকালে বিধবা হতে চাস তাহলে অবশ্যই এভাবে যাবি। তোকে কে নিষেধ করেছে?”

পিহু মুখ ব্যাঁকাল। আয়নার দিকে ঘুরে বলল,

-“সোজাসাপটা মানা করে দিলেই পারো। এত নাটক করার কী আছে। এত নাটক যে তুমি কীভাবে করতে পার।”
পিহু নিজেও কখনও এভাবে যেত না। আর সে যেতে চাইলেও অভ্র দেবে না। সরাসরি মানাও করবে না। একটা ‘না’ না বলে সে ইতিহাস রচনা করবে এই লোক। তারপর ইনোসেন্ট ফেইস বানিয়ে বলবে, আমি কী মানা করেছিলাম নাকি?
পিহু সুন্দর মতন চুলগুলো খোঁপায় আটকে মাথায় হিজাব বেঁধে নিল। এবার অভ্রর জানে পানি এলো কিছুটা। অভ্র বুঝে পায় না এসব জামা বানাতে হবে কেন? হাই নেক জামা পরা যায় না?

এর মাঝেই পিহুর বাবা ফোন দিল। তারা একটু পরেই মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবে। পিহুরাও যেন বেরিয়ে পড়ে। বিয়েটা মেয়ের বাড়িতেই হবে। অভ্রদের বাড়ি থেকে তারা চার জনই গেল।
বিয়ে বাড়িতে অভ্র সারাক্ষণ পিহুর পিছন পিছন ঘুরেছে। তাকে একা কোথাও যেতে দিছে না। বাথরুমে গেলেও সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অভ্রর এসব আদিখ্যেতা পিহুর বিরক্ত লাগতে শুরু করল।

-“এমন করে পিছন পিছন ঘুরছো কেন?”

-“তোকে পাহারা দিচ্ছি।”

-“তুমি পাহারাদার? আর পাহারা দিচ্ছ মানে কি? আমাকে পাহারা কেন দিতে হবে শুনি?”

-“তুই এসব বুঝবি না। সুন্দরী বউ থাকলে আমার জ্বালাটা বুঝতি।”
পিহু হতাশ হল। তবে কিছু বলল না। সে নিজেও এর ভুক্তভোগী। সুন্দর বর থাকার কষ্ট কী কম? এই-যে বিয়ে বাড়ির একেকটা মেয়ে অভ্রকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে, এগুলো সহ্য করা মুখের কথা?

পিয়ালের বিয়ে শেষ হতেই অভ্র পিহুকে বগলদাবা করে বাড়ি চলে এল। পিহু থাকতে চেয়েছিল। অভ্র শোনেনি। পিহুর সব কথা শুনলে দেখা যাবে সে অকালে প্রাণ ত্যাগ করেছে। তার বউয়ের তো আর ছোট খাটো কোন চাওয়া থাকে না।

*****

একটা কফি শপে বসে আছে আসিফ আর অভ্র। অনেক দিন পর তাদের আজকে দেখা হয়েছে। আসিফ বিয়ে করেছে গত মাসে। হানিমুনে ছিল এই কয়দিন। চেহারায় বরকর্তার ছাপ স্পষ্ট!

-“দেখছিস তোর পরে বিয়ে করে আমার হানিমুন হয়ে গেল তোর হল না এখনও। লজ্জা লাগে না?”

আসিফর কথায় মনটা দুঃখী হয়ে গেল অভ্রর। তার যে বউ হানিমুনের কথা বললে দেখা যাবে এসে বলবে, ‘চল আমরা চাঁদে যাই। পৃথিবী তো সবাই ঘুরে।’ অভ্র এই মেয়েকে বিশ্বাস করে না।
অভ্র কিছু না বলে কফিতে চুমুক দিতে লাগল। তার মনটা খুব খারাপ। বউ তিন দিন যাবত তাকে কাছে ঘেষতে দেয় না। কাছে গেলেই বলে তার শরীর থেকে নাকি শুঁটকি পঁচা গন্ধ আসে। এই চক্করে অভ্র কালকে একটা কসকো সাবান এনেছে। এটা দিয়ে ঢলে ঢলে গোসল করে কাছে গেলে তো আরো ভয়ানক গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। নিজের জন্য খুব মায়া হয় অভ্রর। আহারে বেচারা অভ্র। এই বয়সে বউ ছাড়া থাকা যায়? ভয় লাগে না বুঝি তার?

অভ্র বাড়ি এলো সন্ধ্যা পর। ড্রয়িং রুমে বাবা বসে বসে টিভি দেখছে। অভ্র ভ্রু কুঁচকালো। এমন সময় বাসা এত নিরব থাকে না সচরাচর। অভ্র বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা টথা বলে রুমে এলো।
এসে দেখল বউ তার ল্যাটকা মেরে শুয়ে আছে আর মা পাশে বসে আছে। রহিমা খালা নিচে বসে বসে পান বানাচ্ছে। পান দেখে অভ্র ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল,

-“পান কে খায়?”

-“আমি। আজ থেকে খাওয়া শুরু করব।”

-“এটাই বাকি ছিল। তা কোন আনন্দে? আর এই মেয়ে এমন অসময়ে শুয়ে আছে কেন?”
অভ্রর কথায় রহিমা খালা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। অভ্র বিরক্ত হল। এত হাসে কেন সবাই?

-“এভাবে হাসছো কেন রহিমা খালা? আমাকে বল আমিও একটু হাসি।
রহিমা খালা জবাব দিল না। মা রহিমা খালাকে নিয়ে চলে গেলেন। মাও তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সমস্যা কী এদের?

-“আমার দিকে তাকিয়ে সবাই এমন হাসছে কেন রে? শিং হয়েছে নাকি আমার?”

-“হয় নি। হবে। তবে শিং নয় অন্য কিছু।”

-“কী?”

-“ছেলে নয়ত মেয়ে।”

কথাটা বুঝতে অভ্রর একটু সময় লাগল। অভ্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। মুখের হাসিটা যেন জমে গেল ঠোঁটে। কথাগুলো ঢুকে যাচ্ছে মাথার মধ্যে, কিন্তু মগজ ঠিক করে ধরতে পারছে না ওগুলোকে।

-“কি বললি তুই?”

গলার স্বরটা একটু কেঁপে উঠল যেন। পিহু কিছু বলল না। শুধু চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলল।

অভ্রর পায়ের নিচের মাটি নড়বড়ে হয়ে গেল যেন। সে এক পা এগিয়ে এল। বসে থাকা পিহুর দিকে তাকাল কিছুক্ষণ।

-“সত্যি?”

পিহু চোখ খুলল না। হাত বাড়িয়ে দিল অভ্রর দিকে। অভ্র পরম যত্নে হাত দুটো আগলে নিল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এত আনন্দ আগে কোনদিন হয় নি তার। অভ্র কিছুক্ষণ পিহুকে জরিয়ে ধরে বসে থাকল এভাবেই।
********

চলে গেল আরো এক সপ্তাহ্। রাতের বেলা হেলেদুলে বাড়ি এলো অভ্র। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজকে সে চরম খুশি। হবে না-ই বা কেন? আসিফকে যে আচ্চা মতনে দিয়েছে। ব্যাটা আগে হানিমুন করে কী ভাবটাই না নিল। হুহ। অভ্র কী কম যায় নাকি? কেমন হানিমুন ছাড়াই বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছে সে। বাচ্চাটা খালি দুনিয়ায় আসুক। তিনজন মিলে হানিমুনে যাবে। মাসে মাসে যাবে দরকার হলে।
অভ্র রুমে ঢুকে দেখল পিহু কাপড় ভাজ করছে। সে পিহুকে দেখে মিষ্টি হাসল। মেয়েটা আগের থেকে একটু গলুমলু হয়েছে। পিহুকে দেখে তার কেমন প্রেম প্রেম পেল। সে হাত দুটো পিহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” আজকে আমি অনেক খুশি। পিহু, আয় তোকে একটা চুমু দেই।”

-“এত খুশি কেন অভ্র ভাই?”

এমন প্রেম প্রেম মূহুর্তে পিহুর ভাই ডাকে অভ্র বিরক্ত হল। প্রেমের সময় ভাই ডাকলে ভেতরে প্রেম না এসে অন্যকিছু আসে। এই যেমন অভ্রের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। ভেতরের সত্তা যেন জোরে জোরে বলছে, ছিঃ অভ্র ছিঃ। তুই তোর বোনের সাথে রেমান্স করছিস? তারপর তাকে তোর বাচ্চার মাও বানিয়ে দিয়েছিস? তোর তো এক জগ পানিতে ডুবে মরা উচিত।

-“জাহান্নামী, পাপী। ভাই ভাই ডেকে আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে দেয় শুধু। এমন করলে জীবনেও স্বামীর আদর পাবি না বেয়াদব। আমার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছিস তাও ভাই ডাকার শখ মেটে না তোর?”
পিহু গাল ফুলাল। যেন এক্ষুণি কেঁদে দেবে সে। তার ইদানিং খুব মুড সুইং হয়। অল্পতেই কান্না পেয়ে যায়।
অভ্র মাথা ঠান্ডা করল। মাথা গরম করে কিছু হবে না। সে পিহুকে দু’হাতে আগলে নিল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা মাফ করে দিলাম। এত কাঁদতে হবে না। তুই এমন কাঁদলে আমার মেয়েটাও এমন ছিঁচকাদুনে হবে। পরে আরেক বিপদ।”
পিহু এবার হাসল বোধহয়। তার শরীরটা হালকা দুলে উঠল।
অভ্র পিহুকে নিয়ে বারান্দায় বসল। পিহু তখনও অভ্রর বুকে মুখ গুজে আছে। অভ্র থেকে থেকে পিহুর চুলে ছোট ছোট চুমু দিচ্ছে। পিহুর চোখ বন্ধ। সে সময়টা উপভোগ করছে। এই মূহুর্তটা তার জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলোর মধ্যে একটা। পিহু মনে মনে প্রার্থনা করল তাদের এই নীল প্রহর যেন না ফুরায়। থেকে যায় চিরকাল। অমলিন!

সমাপ্ত।