#নীল_বনের_চাঁদ
লাবিবা ওয়াহিদ
|পর্ব ০১|
০১.
এবার যেখান থেকে প্রস্তাব এলো সেই ছেলেটা কেবিন ক্রু। সুন্দর, হ্যান্ডসাম এবং পরিপাটি। কিন্তু ছেলের আইডি ঘাটতে গিয়ে দেখা গেল ছেলের বায়োতেই অঘটন। বায়োতে লেখা “রোমান্টিক বয়”! বড়োলোকের ছেলে হিসেবে পাইলট হলেও মানা যেত, তাই বলে কেবিন ক্রু? বড়োলোক বাপের বিগড়ানো ছেলে হলে যা হয়, এদের যখন যা মর্জি হয় তাই করে। খাঁটি বাংলা ভাষায় টাকায় ছিনিমিনি করলে চায়ের দোকান খুলেও বসা যায়। এতে আমার বিশেষ আপত্তি না থাকলেও ছেলের আইডির বায়োর ওই দুইটা শব্দই যথেষ্ট ছিল একে “চরিত্রহীন” তকমা দেওয়ার জন্য। এই চরিত্রহীনের নাম আফরিদ। আফরিদ চৌধুরী। আইডি জুড়ে তার বাহারি ছবি, হাইলাইটে বিভিন্ন দেশের নাম করে কতশত ছবি দেওয়া। আর সব পোস্টে মেয়েদের হুড়োহুড়ি তো আছেই। আমার ভীষণ লজ্জা করে যখন দেখি কোনো মেয়ে র্যান্ডম কোনো ছেলেকে নিয়ে পাবলিকলি বেহায়াপণা করছে।
পরিচিতদের থেকে শুনেছি এই কেবিন ক্রু মেয়ে-ছেলেরা সুবিধের হয় না। এদের কারো না কারো সাথে এফেয়ার চলেই। এই ধারাবাহিকতা দিনকে দিন চলতেই থাকে। এফেয়ার অনেক সময় বেশ গভীরও হয়। এই যেমন, বিছানা অবধি চলে যাওয়া। আমার নিজের মুখে কথাটা বলতে বাঁধলেও এটাই আজকের জীবনের তেতো বাস্তবতা। ছেলেটার বর্ণনা দিতে গেলে তার ছবি দেখে মনে হলো বেশ এটিটিউড পোষা ছেলে। কিন্তু সে ছিলা মুরগীর ন্যায়, মুখে এক ফোঁটা দাঁড়ি নেই। নাকটা খাঁড়া, কপাল দেখলে মনে হয় একটা মস্ত গাড়ি সেখানে আরামেই চালানো যাবে। চুল দেখলে মনে হয় যেন ঝাউবন দেখছি। আমি কাউকে বাহিক্য রূপ ধরে বিচার করি না। কিন্তু কেউ যদি চরিত্রহীন হয় তাকে নিয়ে আমার বিদঘুটে বর্ণনা করলে পৈশাচিক আনন্দ লাগে। আর বিয়ের ব্যাপারে হলে তো কথাই নেই। বাবাকে আমি শক্ত করে এই প্রস্তাবও নিষেধ করে দিলাম। এ তো আগেই “না” ছিলই, বায়োর জন্য আরও আগে রিজেক্ট। কিন্তু এবার বাবা কিছুতেই আমার না শুনতে রাজি নন। সেঁ যেকোনো মূল্যেই আমাকে বিয়ে দেবেন, তাও এই চরিত্রহীনটার সঙ্গেই। মশিউর খালেদ নামের এই ব্যক্তিটি আমার সৎ বাবা, তাই আমি উচ্ছন্নে গেলেও তার বিশেষ যায় আসে না। আমিও কখনোই তাঁর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। কিন্তু আমার মায়ের জন্য আমি বারবার এই লোকের ফাঁদে আটকে যাই। এইযে এখন, আমার মা আমাকে এতটাই ইমোশনালি ব্লেকমেইল করলেন যেন আমি শক্ত হতে পারছি না। মায়ের বেলায় আমি বরাবরই নরম। মা আমার সবচেয়ে উইক পয়েন্ট। শত্রু থাকলে সে আমার মাকে দিয়েই সর্বপ্রথম আমাকে কুপোকাত করত। যা বারংবার আমার সৎ বাবা করে যাচ্ছেন। তবে এবারের গল্পটা ভিন্ন। এবার সেই চরিত্রহীনের বাপের সাথে সৎ বাবার বেশ মোটা অংকের আর্থিক দ্বন্দ্ব হয়। এই অর্থের পরিমাণ এতটাই যে আমি নিজেও কখনো এত টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারব না। এই পর্যায়ে এসে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়, কেন এত লোভ আমার বাপটার? লোভে পড়ে এতগুলা টাকা এদিক ওদিক করা কী মুখের বিষয়? এখন এই অর্থের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ চাচ্ছে আমাকে ছেলের বউ হিসেবে, মগের মুল্লুক? কিন্তু মাঝে দিয়ে মা আসতেই আমি আবারও দমে গেলাম, কিন্তু হার মানলাম না। মাথায় আমি তখনো নীল ছক বানাতে ব্যস্ত। আমার জীবনের এই আফরিদ নামক ঝড়কে আমি চ্যাঙ্গোলা করে দূরে ছুঁড়ে মা*লেই শান্তি পাব।
আমার ভাবনার মাঝে কোত্থেকে বাঁদুড় এসে বারি খেল আমার সাধের ফুলের টবের সাথে। আমি চমকে দ্রুত বারান্দার অন্যদিকে চলে গেলাম। লোকালয়েও যদি বাঁদুর শান্তিতে থাকতে না দেয়, তবে কোথায় গিয়ে থাকব? আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম রিনিকে।
–“রিনি! এই বাদুর আর ফুলের টবটা এখান থেকে সরাও। এটা ঘেন্না লাগছে আমার।”
সেদিন উপলব্ধি করল, আফরিদ তার জীবনে এই বাঁদড়টার মতোই আচমকা ঢুকে পড়েছে। যাকে উগলে ফেলা না অবধি আমার জীবনের অশান্তি থামবে না।
০২.
বিয়েতে মত না দিয়ে আচমকাই আমি তুর্কির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। ইস্তানবুল অবধি ডাইরেক্ট ফ্লাইট প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টার। আমার এই ট্যুর প্ল্যান আচমকাই হয়েছে, তিন রাতের জন্য।
আমি বিজনেস ক্লাসে থাকলেও আমার সেক্রেটারি রিনি ইকোনমিতে আছে। আমি ওকে এই ট্যুরে আনতেই চাইনি, একটা সোলো ট্রিপের প্ল্যান ছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রচন্ড নাছোড়বান্দা। মাঝেমধ্যে ভেবেই পাই না আমি ওর বস নাকি ও আমার বস! কবে যেন ওকে চাকরিচ্যুত করি বলা যায় না। আমার এই ট্যুরের প্রধান কারণ আফরিদ চৌধুরী নামে ছিলা মুরগী। একে আমি নিজ চোখে দেখে চরিত্রহীন তকমাটা দিতে চাই। এখনো দেখা হয়নি, টেক অফের পর সম্ভবত দেখা মিলবে। অন্যান্য মে কেবিন ক্রুরা তাদের সুযোগ সুবিধা বর্ণনা করল সংক্ষিপ্ত সময়ে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভদ্রলোকের দেখা পেলাম আমি। সেই নাকউঁচু ভাবটা নেই, পেসেঞ্জারদের বিনয়ের সাথে সাহায্য করছে। এর মাঝে আমার ব্রেকফাস্ট এলো। আফরিদই সার্ভ করল। বিজনেস ক্লাসে ভালো শেফের হাতের খাবার পাওয়া যায়। এবারের আইটেম কোনো রকম দেখালেও খেতে দূর্দান্ত ছিল। আমি ইচ্ছে করেই আফরিদকে ডেকে পাঠালাম, ওকে নানান অজুহাতে বিরক্ত করার ফন্দি আঁটলাম। ছেলেটা যথাসম্ভব তাই করল। কেবিন-ক্রু অথচ বড়োলোক বাপের বিগড়ে যাওয়া ছেলের কোনো ছাপই নেই। কী আশ্চর্য! দুবার এভাবে বিরক্ত করে আমি থামলাম। সন্দেহে পড়তে চাই না, যতটুকু শুনেছি আফরিদ এখনো আমাকে দেখেনি। এটাই বেশি অবাক লেগেছিল আমার, বিয়ে করতে যাচ্ছে অথচ পাত্রীকেই দেখল না! অবশ্য, যার দু’চার জন গার্লফ্রেন্ড আছে সে আর মেয়ে দেখে কী করবে?
এ কথা ভাবতে না ভাবতেই দেখলাম এক মেয়ের সাথে বেশ খাতির জমিয়েছে ছিলা মুরগীটা। দূরে থাকায় কথা শোনা যাচ্ছে না। ওই মেয়েটাও পেসেঞ্জার, অল্পবয়সী। দূর থেকে মেয়ের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়ে আফরিদের সুন্দর চেহারা দেখে গলে গিয়েছে। আমি তখন গোয়েন্দা নজরে ওদের পরখ করছি। আফরিদ হেসে কী ভেবে আশেপাশে তাকাতেই আমি তড়িৎ মাথা সোজা করে বসলাম। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই আমিও আমার চাল ভালা শুরু করলাম। আমি একজন কেবিন ক্রুকে ডাকলাম। ওকে বললাম, “ওয়াইনের মধ্যে কী কী আছে?”
ফিমেইল কেবিন ক্রু বিনয়ের সাথে নাম বলতে শুরু করে। আমি এক পর্যায়ে মেয়েটাকে থামিয়ে বললাম, “ওই ছিলা মুরগীটাকে ডাকো!”
–“সরি?”
আমি নিজেকে সামলে বলল, “আফরিদ নাকি আবিদ কী যেন নাম? তাকে ডাকো!”
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। আফরিদ আবারও আমার সেবা করতে হাজির হয়। আমার সেবা করছে এই লোক ভাবলেই কেমন অহংকারে বুক ভরে যাচ্ছে। আমি বললাম, “ওয়াইন ট্রাই করে দেখেছ?”
আফরিদ থতমত খেলেও পরিস্থিতি সামলে নেয় আন্তরিকতার সাথে।
–“জি।”
–“কোনটা?”
–“আপনি কী ওয়াইন খেতে চাচ্ছেন?”
–“আপনি খেতে পারলে আমিও পারব। আনো দেখি তোমার পছন্দের কোনোটা!”
আফরিদ গেল, ওয়াইনের গ্লাস ভরেও আনল। তা দেখে আমার চরম বমি পেল। আমি কখনোই মদ-টদ গিলিনি। তবে এই মুরগীটা যে এসবে অভ্যস্ত আমি বেশ বুঝতে পারছি। আফরিদ বলল,
–“এটা ট্রাই করুন ম্যাম, এটা আমার ফেভারিট।”
আফরিদ সবাইকে স্যার, ম্যাম ডাকছে। এর মুখে ম্যাম শুনতে মন্দ লাগছে না। তবে এর জন্য শেষমেষ আমার মদও খেতে হবে? বিয়ে আটকাতে আর যে কী কী করতে হবে ভাবতেই আমার অসহায় অনুভব হচ্ছে। কিন্তু এত দ্রুত হার মানার পাত্রী তো এই ইধিরা নয়। এমনি এমনি তো আমি ফ্যাশন দুনিয়ায় নাম কুড়াইনি। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে নাক বন্ধ করে আমি ওয়াইনটা গিললাম। কিন্তু এটা মুখে দিতেই আমি চমকে গেলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম,
–“এটা তো এপেল জুস!”
আফরিদ হাসল। হাসি দিয়ে চলে গেল। আর আমি বোকার মতো নিজের জায়গাতেই ঠায় বসে রইলাম। রাগে-দুঃখে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলাম। সময় নিয়ে মুখে, মাথায় পানি দিলাম। এত বড়ো সাহস এই ছেলে আমাকে বোকা বানিয়েছে! একটা কেবিন ক্রু হয়ে কী চরম ভাব নিয়ে চলে এই ছেলে। এবার আমিও আমার লিমিট ক্রস করব। এই ছেলেকে আমি প্রমাণসহ ধরব। এরপর ছড়িয়ে দিব সে ঠিক কতটা চরিত্রহীন।
দুপুরে লাঞ্চ এলো সময়মতোই। ফিমেল কেবিন ক্রু আমার কাছে মেন্যু দেয়। সেখান থেকে আমি বিফ স্টেক, হোয়াইট পাস্তা, সালাদ আর ডেজার্ট অর্ডার করি। এবারও খাবার পৌঁছে দেয় আফরিদ চৌধুরী নিজেই। সে একবারের জন্যেও আমার দিকে তাকায়নি, কিন্তু আমি এক নজরে চেয়ে ছিলাম তার দিকে। আমি শুধু চাইছিলাম ও আমার দিকে তাকাক, চোখে চোখ পড়ুক! দেখুক এই চোখ দিয়ে ওকে কতটা ভষ্ম করে দিচ্ছি আমি। কিন্তু আফরিদ এবারও আমার আশায় পানি ঢেলে চলে যেতে নিল। আমি ওকে সরাসরি ডাকলাম, ও দাঁড়াল।
–“জি ম্যাম?”
–“তোমার নাম্বার পাওয়া যাবে? তুমি কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম, হট!”
চলবে~~