#নীল_বনের_চাঁদ – [০২]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
০৩.
দীর্ঘ আট ঘণ্টা পর প্লেন কিছুক্ষণ আগে ল্যান্ড করেছে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে। আমার আগে কখনো তুর্কি আসা হয়নি, এবারই প্রথম। আমি আমার লাগেজ নিয়ে এক আসনে বসে আছি। রিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে খাম্বার মতো। কতকগুলো বসার সিট ফাঁকা থাকলেও ওর বসার অনুমতি নেই। আমি অনুমতি দেইনি। এখন ও বসবে মানেই ওর এক মাসের বেতন কেটে নিব। রিনি আমার এই কাজে ভয় না পেয়ে উলটো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে। নড়চড় করলেও বিশেষ কিছু বলছে না। আমি তো তার দিকে বিন্দুমাত্র না চেয়ে আশপাশটা ভালো ভাবে দেখছি। এখনো আমার ইমিগ্রেশন বাকি। কিন্তু আমি এখানে বসে ভাবছি আফরিদের কথা। তার জন্য আমার মাথায় অত্যন্ত রাগ চেপে আছে। আমার রাগের মাঝে রিনি বাম হাত ঢোকাতে বেশি দেরী করল না। সে সহসা বলে উঠল,
–“ম্যাম, আমাকে একটু বসতে দিন। আমার অপরাধ কী?”
–“তোমার অপরাধ আমার লেজ ধরে তুর্কি পর্যন্ত আসা। তুমি আবার অপরাধ খুঁজছ? আনবিলিভেবল।”
–“কী করব ম্যাম বলুন, আপনার সেক্রেটারি হওয়ার সময়ই শপথ নিয়েছিলাম আপনাকে কখনো একা ছাড়ব না। ছায়ার মতো পাশে থাকব।”
–“তুমি আমার বিজনেসে সম্পৃক্ত এমন ব্যাপারে কাজে আসো। কিন্তু আমার পার্সোনাল লাইফে তোমাকে তো আর বডিগার্ড রাখিনি। তুমি মেয়ে মানুষ, আমি কিডন্যাপ হয়ে গেলেও তুমি হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকবা।”
রিনির রাগী নজরে তাকাল আমার দিকে। আমি গুরুত্ব দিলাম না, জানি তো.. ও নিশ্চয়ই ভাবছে আমি একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছি। কিন্তু আমি তো ভুল কিছু বলিনি। আমাকে হুট করে পাঁচ ছয়জন বড়োসড়ো লোক এসে পাকড়াও করলেও রিনি কিচ্ছু করতে পারবে না। মা*পিট তো আরও দূরের বিষয়। রিনির স্বভাব আমি জানি। সে হাতের চাইতে মুখ চালাতে বেশি পারদর্শী! এই বাইরের দেশে ওর মুখের চালানো কাজে দিবে না। ওর এই অতিরিক্ত মুখ চালানোর চক্করে আমার ব্যাগে কস্টেপ নিয়ে ঘুরতে হয়।
রিনি রাগ দেখিয়ে বলল,
–“ম্যাম, আপনি হয়তো জানেন না আমার ক্যারাটে-তে রেড বেল্ট আছে।”
–“আমার গু কালারের বেল্ট আছে।”
রিনি ঘাবড়ে গেল কিছুটা, সঙ্গে অবাকও হলো। হয়তো ভাবতে পারেনি ইস্তানবুল এয়ারপোর্টের মতো এত সুন্দর জায়গায় বসে এমন মুখ খারাপ করে ফেলব। আমার মুখের লাগাম ছুটে না সহজে। তবে আমি রেগে গেলে উগ্র হয়ে যাই। অবশ্য অপরিচিতদের সামনে না। আমার বেশিরভাগ রাগ রিনিই দেখেছে, তাও যদি এই মেয়ে কখনো শুধরিয়েছে। সে আমাকে রাগ দেখায়, কত বড়ো সাহস। আমি থেমে আবার দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
–“রেড বেল্ট না, ব্ল্যাক বেল্ট হবে মূর্খ!”
রিনি ধরা খেয়ে চুপসে গেল। সে আচমকা কথা ঘুরিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
–“মেয়েটাকে খুব মনে পড়ছে ম্যাম। ভিডিও কল দিলাম, আম্মা রেগে বললেন তুই তুর্কিতেই মর!”
আমি আরও বিরক্ত হলাম রিনির ফালতু বকবকে। বললাম,
–“ভুল কী বলেছে? থেকে যেতে মেয়ের সাথে। তোমাকে আমি আসতে বলেছি নাকি?”
রিনি তড়িৎ মাথা তুলে চেয়ে ঘনঘন মাথা নাড়ায়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
–“মেয়ের জন্যই তো সব করছি, তাই এটুকু বিরহ সহ্য করাই যায়।”
–” আন্টি তো আমাকে ক্রিমিনাল ভাবে! তার ভোলাভালা মেয়েকে দিয়ে নাকি আমি কামলা খাটাই! অথচ উনি জানেন না তাঁর এই ভোলাভালা মেয়েটা আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায়।”
রিনি এই কথায় বোকা হাসল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। রিনির ওপর আমার রাগের পারদ ওঠানামা করলেও ওর মেয়েকে আমার নিজের মেয়ের মতোই লাগে। মেয়েটা কী আদুরে, অথচ এই মেয়েটার ভাগ্যে বাবার আদর সইলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলার আগেই আফরিদ বদটার কথা মনে পড়ল। রাগটা আর মাথা থেকে ঝাড়া গেল না। তখন আমি শরমকে জলাঞ্জলি দিয়ে আফরিদের কাছে নাম্বার চেয়েছিলাম, ছেলেটা আমাকে পাত্তা না দিয়েই চলে গেছে। কত বড়ো সাহস! আমি নাম্বার নিলেও তো কোনোদিন কল দিতাম না। ওটা শুধু তাকে জ্বালানোর ফন্দি ছিল। এই অপমান আমি এখনো নিতে পারছি না। তার ওপর দেখলাম একটা মেয়ের সাথে তার ভীষণ ঘনিষ্ঠতা। এটা সেই পেসেঞ্জার মেয়েটা। হবে হয়তো কোনো বাপের আদরের দুলালী। আর এমন দুলালী হাতছাড়া করা মানে তো আফরিদেরই লস। ছিলা মুরগী তো আর এমনি এমনি বলিনি। আগে তো সন্দেহ ছিল, এখন পুরোপুরি ক্লিয়ার যে এই ছেলে চরম চরিত্রহীন। আমি তো আমার সিটে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই ছেলে রিজেক্ট। ওর থেকে কত ভালো ভালো প্রপোজাল এসেছে আমার। লাগলে আমি রিকশাওয়ালাকে বিয়ে করব, তাও এই ছিলা মুরগীকে একদমই না। এই সিদ্ধান্তে আসার পর থেকেই একটু শান্তি অনুভব হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই তিন রাত চার দিন আয়েশ করে কাটাব ইস্তানবুলে। তুর্কিতে আগে কখনো আসা হয়নি, এবারই প্রথম। এবার অল্প সময়ের জন্য এলাম, শহর পছন্দ হলে পরেরবার লম্বা সময় নিয়ে আসব।
ইমিগ্রেসন পার হতেই রিনির হুট করে কিছু একটা মনে পড়ল ভাব নিয়ে বলল,
–“ম্যাম, আপনার ওই ক্যারেক্টারলেসের কথা তো ভুলেই গেছি। তার সাথে আপনার ট্রিপ কেমন ছিল?”
দিল আবার মেজাজটা খারাপ করে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
–“ছিলা মুরগীর কথা বলে আবার মুড খারাপ করছ কেন?”
–“ও! এর মানে ওই বান্দাই আপনার অসময়ের রাগের কারণ। শুনেছি কেবিন ক্রুরা অনেক স্যালারি পায়, আমার চাইতেও বেশি।”
আমি রাগী চোখে তাকালাম রিনির দিকে। রিনি চুপসে যায়। তবে সেই চুপ থাকা বেশিক্ষণ স্থির রইল না। সে আবারও গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“শেষ একটা কথা বলব ম্যাম?”
আমি জানি, আমি অনুমতি না দিলেও এ বলবেই। এজন্য হিলে ঠকঠক শব্দ করতে করতে সামনের দিকে আগাচ্ছি। রিনি আবারও বলল,
–“আমি এই ফ্লাইটেই দেখেছিলাম মি. আফরিদ চৌধুরীকে। মিথ্যে বলব না, একে দেখলেই কেমন লুইচ্চা লুইচ্চা লাগে।”
আমি থেমে আবার তাকালাম। হঠাৎ আমার অদূরে আফরিদের দিকে চোখ গেল। বেশ কিছু কেবিনক্রু মেয়ের সাথে অন্য একটা মেয়ে আছে। মেয়েটা ওয়েস্টার্ন পরা। আরও দেখলাম আফরিদ সবার থেকে বিদায় নিয়ে সেই মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কী মনে করে আমিও পিছু নিলাম। আফরিদের পিছে আমিও ট্যাক্সি নিলাম। রিনি বেচারী এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। যার প্রসঙ্গ এয়ারপোর্টেই ইতি টেনেছিলাম সেখানে আবার এই নতুন কৌতুহল কেন? শেষ বিকালে শহরে পৌঁছাতে হলো জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে। এই শহর সৌন্দর্যের পাশাপাশি জ্যামেরও শহর। কতবার যে আফরিদদের গাড়ি হারিয়েছি। পরে আবার খুঁজতেও হয়েছে। শহরের এক পাঁচ তারকা হোটেলে পৌঁছাল ওরা। মেয়েটার সাথেই আফরিদ তার লাগেজ নিয়ে নামল। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। ঘেন্নায় আমার গা ছমছম করছে। রিনি তো অবাক হয়ে বলল,
–“হায় আল্লাহ, এরা কী এখানে রুমডেট করতে আসছে নাকি? মেয়েটাকেও তো অনেক বড়োলোক লাগছে।”
আমি কথা বাড়াই না। প্রচন্ড ঘেন্না নিয়ে ড্রাইভারকে আমার বুকিংকৃত হোটেলের এড্রেস দিলাম। নিজের হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করে নিজের রুমে চলে গেলাম৷ রিনি আর আমার রুম আলাদা। আমি আমার রুমে ফিরে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। লম্বা জার্নিতে গা কেমন করছিল, যেন কত ধুলোবালি গায়ে লেগে ছিল। ফ্রেশ হতেই চরম হালকা লাগল আমার। যার ফলস্বরূপ ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। দীর্ঘ জার্নির চক্করে চোখে ক্লান্তির ঘুম নামল।
০৪.
ঘুমালাম দুই ঘণ্টার মতো। রাত সাড়ে আটটায় আচমকা রিনিকে কিছু না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমার কেন যেন রাতের শহর খুব পছন্দ। তাই একা একা পছন্দের কাজটা করতে দ্বিধা করলাম না। নিজের এই সময়ে রিনির আজারে বকবক শুনে মাথা খারাপ করার ইচ্ছে নেই। সাথে ম্যাপ রেখেছি, আশা রাখছি ফেরার রাস্তা ভুলব না। হোটেলের কাছাকাছি একটা সুন্দর এরিয়া আছে।
এখানটায় লোক সমাগম ভালোই। এই এরিয়াতে লম্বা একটা গলি। গলির দুই পাশে নানান রেস্তোরা, বেকারি শপ, ক্যাফে, লাইব্রেরী কিংবা অন্যান্য শপ। আমি মুগ্ধ চোখে নানান মানুষ, নানান দোকানে নজর বুলালাম। কয়েকটা ছবিও তুলে ইন্সটাতে আপলোড করে দিলাম। আমার নিজের ছবির চাইতে আশেপাশের ছবি তুলতে বেশি ভালো লাগে। আমার হঠাৎ নজর আটকাল একটা অদ্ভুত ক্যাফেতে। এটার বাহিরটা ডেকোরেশন করা নানান ওল্ড পেপার এবং চিঠি দিয়ে। ভেতর থেকে হলুদ আলো বাইরে টিকরে পড়ছে। আমার ক্যাফেটা এতটাই মন কাড়ল যে আমি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ক্যাফেতে ঢুকে পড়ি। ভেতরটা দেখা গেল বাহিরের থেকেও সুন্দর। বাদামী রঙের ভিন্টেজ রেশ চারপাশ জুড়ে। গোল টেবিলের সাথে কফি কালারের কারুকার্জের চেয়ার। মনে হচ্ছে যেন নব্বই দশকে ঢুকে গেছি। আমার সবথেকে ভালো লাগল ক্যাফের ঠিক মাঝামাঝিতে বুকশেল্ফ রাখা। আমি সবার আগে সেদিকেই ছুটলাম। সেখানে নানান বই রাখা। তুর্কিশ নোভেল, ম্যাগাজিন। ইংরেজীও কতগুলা দেখা গেল। আমি বই হাতানোর আগে একটা ক্যাপারচিনো অর্ডার করলাম৷ অর্ডার প্রদান করে আবার শেল্ফের সামনে এসে বই বাছতে শুরু করলাম। এমন সময়ে কী মনে করে ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলাম। আফরিদ ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে। সে বসেছে জানালা ঘেঁষে নরম সিঙ্গেল কাউচে। তার এক হাতে কাপ আরেক হাতে একটা ম্যাগাজিন। এই অসময়ে একই ক্যাফেতে আফরিদকে একদমই আশা করিনি আমি। হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্স! আচমকা আমার মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল পাঁচ তারকা হোটেলের দৃশ্য। আমি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে আবার বই ঘাটতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি যে তাকে দেখে অবাক হয়েছি সেই রেশটা মুখে আর রইলো না। আমরা যেহেতু একই শহরে আছি, দেখা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আচমকা পুরুষালি, পরিচিত ভরাট কণ্ঠস্বর কানে এলো, “এক্সকিউজ মি।”
আফরিদ হয়তো কোনো ওয়েটারকে ডাকছে, আমি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের মনমতো একটা বই পেলাম। বইটা হাতে নিয়ে পিছে ঘুরতেই ধাক্কা খেলাম কারো শক্ত বুকে। চমকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখি আফরিদ দাঁড়িয়ে। আমি ভড়কে গিয়ে দুই ধাপ পিছে গেলাম। আফরিদ আমার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলল,
–“আমি ডেকেছি শুনতে পাওনি?”
–“আমি কী করে জানব আপনি আমাকে ডেকেছেন? ক্যাফেতে তো কত মানুষই আছে।”
আফরিদ তার ডান ভ্রু নাচাল। আপাদমস্তক আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি বলতে চাইছ তোমার নাম ধরে ডাকতাম? কিন্তু আমি তো তোমার নামই জানি না।”
–“আমাদের মধ্যে এমন কোনো ধরা-বাঁধা সম্পর্ক নেই যে আমার নাম জানাটা আপনার জন্য বাধ্যতামূলক!”
এবার আফরিদের ঠোঁটের ফাঁকে হাসি উঁকি দিল। কেমন মিচকে টাইপ হাসি, এই হাসির অর্থ তীব্র অঘটন কিছু। হঠাৎ আফরিদ আমার দিকে ধীরে-সুস্থে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি চোখ কপালে তুলে পেছোতে পেছোতে শেল্ফে গিয়ে আটকালাম। আশ্চর্য, এই ছেলের মতলব কী? আমি সতর্ক নজরে তাকালাম আশেপাশে— কেউ দেখছে কি না আমাদের। আমরা ছাড়াও আরেকজন কাস্টমার আছে শুধু। তার গভীর নজর ম্যাগাজিনে। বাকিদেরও আমাদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আফরিদ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে অস্বাভাবিক নরম গলায় বলল,
–“নাম বলো।”
কথা বলতে গিয়ে অনুভব করলাম আমার গলা কাঁপছে। আমি কোনোমতে বললাম,
–“বলব না।”
আফরিদের মুখে আবারও হাসি ফুঁটে। সে আরেকটু ঝুঁকে বলল,
–“যে আমার কাছে কন্টাক্ট নাম্বার চাইতে পারে, আমাকে হ্যান্ডসাম হট বলতে পারে তার নাম বলতে এত প্রব্লেম? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।”
আমি ধাক্কা দিলাম, সে সরল না নিজের জায়গা থেকে। আচ্ছা ফালতু ছেলে তো। আমি এবার গরম চোখে তাকিয়ে বললাম,
–“আপনি আমার টাইপেরই না।”
–“এইযে, ধরাটা খেয়ে গেছ। তোমার চোখই বলছে তুমি মিথ্যে বলছ!”
–“একজন রিকশাওয়ালাও আমার টাইপের হতে পারে, কিন্তু আপনি নন।”
আফরিদ এমন ভাবে হাসল যেন আমি কৌতুক বললাম। সে আমার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
–“হয়েছে অনেক বাজে কথা, এখন দ্রুত নাম বলো আর কন্টাক্ট নাম্বার দাও। আমি আবার সুন্দরীদের বঞ্চিত করি না।”
রিনি ঠিকই বলেছিল, এই ছেলে আসলেই লুচু। আমি নাক কুঁচকে অস্ফুট স্বরে বললাম,
–“ক্যারেক্টারলেস।”
–“ওটা একটু হতেই হয়।”
আমার ক্যাপারচিনো এসে গেছে অথচ এই লোক আমার নাম জানার জন্য ব্যাকুল। বুঝলাম আমার নাম না জেনে আমাকে এক পাও নড়তে দিবে না। বিরক্ত গলায় বললাম,
–“ইধ-ইধিরা।”
আফরিদ চট করে সরে যায় আমার সামনে থেকে। আমি তখনো অনুভব করছি আমার বুকে ঢোল বাজছে। প্রবল ভাবে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে! বুকের বা পাশটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। এই লোকটা বিচ্ছিরি, খুব বিচ্ছিরি। আমার গলা দিয়ে ক্যাপারচিনো নামার নাম নেই। কিন্তু তবুও মনে জোরে কোনোরকমে গিললাম। এ নিজের জানালার ধারের আসন ছেড়ে আমার পাশের চেয়ারে বসেছে। কেমন করে দেখছে আমার। আমার এতে অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। সে আচমকা নিজ থেকে নিজের নাম্বার এগিয়ে দিল। বলল,
–“এটা তুর্কিশ সিমের নাম্বার। তুমি চাইলে আমার সব দেশের সিমের নাম্বারই নিতে পারো, আই ডোন্ট মাইন্ড!”
আমি বিষম খেলাম। তিনি আমাকে পানি অফার না করে উলটো হাসল। ফ্লাইটে উঠেও বুঝিনি এই লোক এত বাটপার, অসভ্য। অথচ তখন ম্যাম, ম্যাম বলে মুখে ফ্যানা তুলছিল। আফরিদ বোধ হয় আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারল। মুখে তার ভেইনে ভরপুর হাত চেপে ঘাড় কাত করল। হাসি আটকে বলল,
–“তখন আমি ডিউটিতে ছিলাম, এজন্য হয়তো এখন ভিন্ন লাগছে।”
–“ভিন্ন নয়, ফালতু লাগছে।”
–“লাগতেই পারে, নাম্বার দিব না বললে সুন্দরী মেয়েরা তাই ভাবে।”
–“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।”
–“বাট আই লাইক ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ, মিস মাউস।”
অপমানে আমার মুখ থমথমে হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে চেঁচালাম,
–“এই এই, মাউস মানে? আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি ইঁদুর?”
–“এ বাবা, আমি তো নিকনেম দিলাম। অন্য মেয়েদের বাদর বললেও খুশি হয়ে যায়।”
–“আমি অন্য মেয়েদের মতো নই।”
–“হ্যাঁ জানি তো, তুমি ইধিরা। আর ইধিরা নামটা শুনলে আমার ইঁদুরের ফিল আসে, ডোন্ট মাইন্ড।”
©লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—