নীল বনের চাঁদ পর্ব-০৩

0
1

#নীল_বনের_চাঁদ – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
০৫.
আমার পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা ছিল সারাদিন ইস্তানবুল চষে বেড়াব। আজ আপাতত মশলা বাজার, ইস্তানবুলের পুরাতন শহর ঘোরার ইচ্ছে আছে। এজন্য তৈরি হয়ে রিনিকে নিয়ে হোটেলের নিচে আসতেই রিনি আচমকা থামিয়ে দেয়। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রিনি হাসল। এই হাসির অর্থ আমার একদমই সুবিধার লাগেনি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলে রিনি তড়িঘড়ি গলায় বলল,
–“আরেকজন আসছে ম্যাম। উনি আমাদের সঙ্গে যাবেন।”

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। আমার জানামতে ইস্তানবুলে আমার পরিচিত কেউ নেই, কোনো জাস্ট ফ্রেন্ড পর্যন্ত নেই। সেখানে রিনি যাওয়ার মুখেই কার কথা বলছে? আচমকা আমাদের সামনে এক ট্যাক্সি এসে থামল। সেই ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়াল আফরিদ চৌধুরী। আফরিদকে দেখে আমার চোখ কপালে উঠে যায়। এ এখানে কী করছে? আফরিদ রোদ চশমার ফাঁকে আমাদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক মুখে হাত নাড়িয়ে হাই জানাল। এরপর ড্রাইভারকে পেমেন্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আমি সম্ভবত আফরিদের কাঁধের সমান। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হয়েও এর সাথে লম্বার খেলায় হেরে গিয়েছি আমি। গতকাল আফরিদের সাথে আমার দেখা হওয়া জীবনের বিশ্রী অভিজ্ঞতাগুলোর তালিকায় পড়ে গিয়েছে। ক্যাফে থেকে বের হওয়ার পরেও এই ছেলে আমার পিছু পিছু এসেছে। আমি যখনই বললাম আমি একা যেতে পারব তখন সে দায় সারা গলায় বলেছিল,
–“পারবে না, রাস্তা হারিয়ে ফেলবে।”
আমি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলাম,
–“হারাব না আমি, আমাকে বাচ্চা লাগে নাকি আপনার? পিছু নেওয়া বন্ধ করুন।”

কিন্তু দেখা গেল আমি আসলেই হারিয়ে গেছিলাম, কোন রাস্তা ধরে যেতে হবে আমি সেটাও ধরতে পারলাম না। অথচ এখন ইন্টারেটের যুগ, ম্যাপের যুগ। আমি ম্যাপ ঘেটেও সহসা ফেরার রাস্তা পেলাম না। তখন আমায় হেল্প করল আফরিদ। না চাইতেও আমি হেল্প নিতে বাধ্য হলাম, আমার এই পরাজয়ে বিশ্বজয়ের হাসি লেপ্টে ছিল তার মুখে। যা আমার আগুন গায়ে আরও কেরাসিন ঢেলে দেবার মতোই ছিল। আফরিদ আমাকে হোটেলের সামনে পৌঁছে দেয়। আমি তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উলটো মুচকি হেসে বলেছিলাম,
–“আই হোপ এটাই আমাদের শেষ দেখা। এই ইহজন্মেও আমাদের আর দেখা না হোক!”

বলেই আমি চলে এসেছিলাম। আফরিদ আমার নাম্বার নিয়ে অবশ্য তার সমস্ত নাম্বারের লিষ্ট হোয়াট’স আপ করেছে, কিন্তু আমি তার মেসেজ আর্কাইভে ফেলে রেখেছি। এতকিছুর পরেও যে আফরিদ আমার ট্যুরে বাম হাত ঢুকিয়ে দিবে কে জানত? আমি চোখ রাঙালাম রিনিকে। আমার এত উপচে পড়া রাগ দেখে রিনি ভড়কে যায়। দ্রুত আমার কানের সামনে মুখ এনে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
–“আমার কিছু করার ছিল না ম্যাম। বড়ো স্যার হুমকি দিলেন যে আফরিদ স্যারকে আমাদের সাথে রাখতে।”

–“খুবই চিপ এক্সপ্লেইন রিনি! তোমাকে বেতন বড়ো স্যার দেয় নাকি আমি দিই?”

রিনি মুখে ঝামটা মেরে বলল,
–“বেতন কাটবেন না ম্যাম, মেয়েকে বলেছিলাম আগামী মাসের বেতন পেলে একটা টয় সেট কিনে দিব। মাকে একটা জামদানি শাড়ি উপহার দিব, কিচেনটাও ভঙ্গুর হয়ে গেছে, ওটার ইন্টেরিয়র ঠিক করাতে হবে, পানির কলেও আজকাল অনেক সমস্যা হচ্ছে। মায়ের চেকআপ খরচ, ওষুধ, মেয়ের স্কুলের বেতন…”

রিনির ফালতু বকবকে আমি অতীষ্ঠ হয়ে ওকে থামালাম। চেঁচিয়ে বললাম, “শাট আপ ইডিয়েট!”

রিনি চুপসে যায়। প্রতিবার ওর বেতন কাটার কথা উঠলে এমন হাজারটা বাহানা দিবে। কী বিরক্তিকর এই মেয়েটা। আমি কী করে এখনো ধৈর্য ধরে এই মেয়েকে সহ্য করছি আল্লাহ ভালো জানেন। অথচ এই মেয়ে লোককে বলে বেড়ায় সে আমাকে অনেক কষ্টে সহ্য করে, বেতনের আশায় এসব সয়ে যায়। মোটকথা, অন্যদের সামনে সে ভিক্টিম সাজে। হায় আল্লাহ।

আমার চিৎকার আফরিদের কান অবধি পৌঁছালেও সে কিছু বলল না। আমাদের সামনে এসে বলল, “চলো যাওয়া যাক?”

আফরিদ আজ সিলভার ডার্ক কালারের একটা টিশার্ট পরেছে, টিশার্টের সাথে হোয়াইট প্যান্ট। কোমরে ডেনিম ব্ল্যাক জ্যাকেট বাঁধা। হালকা বাতাসে তার গোছানো চুলগুলো উড়ছে। সে দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু দাঁড়ি না থাকায় তার সমস্ত সৌন্দর্য ফিঁকে। সহজ ভাষায় ছিলা মুরগীই লাগে, আকর্ষণীয় নয়।
আফরিদ সামনের দিকে হাতের সাহায্যে রাস্তা দেখিয়ে বলল, “যাওয়া যাক?”

আমি সিনক্রিয়েট করলাম না, করলে উলটো নিজের ইমেজ খারাপ হবে। আমি রিনির উপর বিরক্ত হয়েই হাঁটতে লাগলাম আগে আগে। আমরা টেক্সি নিলাম না। হোটেল থেকে সমুদ্র কাছেই। এজন্য ফুটপাত ধরেই হাঁটতে শুরু করি। আমি আগে আগে আর রিনি, আফরিদ পেছনে। আফরিদ রিনিকে জিজ্ঞেস করল,
–“আপনি কী ওনার সেক্রেটারি?”
–“জি।”
–“আপনার বস তো দেখছি বেশ বদরাগী!”

রিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“আমার বলবেন না, উঠতে বসতে শাট আপ ইডিয়েট, এটা কেন করেছ ওটা কেন করেছ। বেতন বন্ধ যা-তা বলে পাগল করে দেয়। যা চাপের মধ্যে রাখে। আমার খাবার দাবারে এমনেই অরুচি, এনার ধমক শুনলে পেট আরও ভরে থাকে। এভাবে চলা যায় বলুন?”
–“তাই তো!”
–“একটা সত্যি কথা বলব?”
–“জি, জি। শিওর।”
–“আমার বসটা আস্ত এক জল্লাদ।”

আমি হঠাৎ থেমে পিছে ফিরে তাকালাম। রিনি আমার চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া নজর দেখে শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত আমার কাছে এগিয়ে আসে।
–“কী বদনাম করছিলে আমার নামে?”
রিনি গালে তওবা করার ভঙ্গিতে বলল,
–“নাউজুবিল্লাহ। আপনার অন্য খাই আমি ম্যাম, আপনার নামে আমি বদনাম করব? কী যে বলেন না!”
–“একটা প্রবাদ বাক্য আছে জানো? ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’।”
আমার কাঠ কাঠ গলায় রিনি চুপসে যায়।

০৬.
রিনি মানুষটা একটু খোলামেলা, চঞ্চল। এই চঞ্চল মেয়েটাই আচমকা এক বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে গেল। চঞ্চলতা খুইয়ে সে বাঁচার আকাঙ্খাই হারিয়ে ফেলে। সেই দুর্বল থেকে টেনে উঠিয়ে এনেছি আমি, নিজ হাতে। রিনির এই চঞ্চলতা ফিরিয়ে আনতে বেশ সময় লেগেছিল অবশ্য। এখন সে সিঙ্গেল মাদার। মেয়ে এবং মাকে ঘিরেই তার পৃথিবী। সম্ভবত আমিও ওর পৃথিবীর একটা অংশ হয়ে গেছি। আমাদের খুনশুটি সবসময়ই চলমান, ওকে আমি ভালোবেসেই বকা দিই। তবে মাঝেমধ্যে রিনির কাণ্ড দেখলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে পালায়। এবারও আমার ভালোবাসা আসছে না রিনির প্রতি। ইচ্ছে করছে একে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে দিতে, আমি শুনেছি রিনির ফিসফিসানি।

আমার হঠাৎ কী মনে হতেই রিনিকে জিজ্ঞেস করলাম,
–“আফরিদ কী জানে ওর বাড়ি থেকে আমার জন্য প্রস্তাব এসেছে?”

রিনি ঝট করে উত্তর দেয়,
–“না ম্যাম। আপনার শর্তানুসারে বড়ো স্যার আফরিদ স্যারের বাবাকে এগুলো বলতে নিষেধ করেছেন। তাই তিনি সব শুনে নিজের মতো পন্থা অবলম্বন করেছেন।”

আমি স্বস্তি পেলাম। নয়তো এখন যেভাবে আফরিদের সাথে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছি, আফরিদ জানলে আমার জন্য ঠিক ততটাই অস্বস্তির হত।
আমি বললাম,
–“তবে আফরিদ আমার সম্বন্ধে কী জানে?”
–“আপনি আফরিদ স্যারের বাবার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। আফরিদ স্যার যেহেতু আগেও তুর্কি ঘুরে গিয়েছে সেজন্য স্যার ওনাকে আপনাকে ঘুরানোর আদেশ দিয়েছেন।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
–“শিওর?”

রিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
–“লিখে রাখেন আমার কথা।”
আমি রেকর্ডার অন করে বললাম,
–“আবার রিপিট করো।”
রিনির মুখ ছোটো হয়ে যায়। ফ্যাকাশে মুখে বলল,
–“আপনি এতটাও হার্ড হতে পারেন না ম্যাম।”
–“আমি হতে পারি। নিজের এই অভ্যাসগুলা বদলাও, নয়তো তোমার এই সমস্ত কাজের কারণে আমার তোমার মেয়ের জন্য চিন্তা হয়। মায়ের বাতাস মেয়ের গায়ে লাগলে আবার বিপদ।”

রিনি এবার মিষ্টি করে হাসল। আচমকা আমার এক হাত জড়িয়ে নিয়ে বলল,
–“আমার মেয়ে আমার মতো না হলেও আপনার মতো ঠিকই হবে ম্যাম। আমার জারা আমার মতো নরম হবে না কখনো।”

আমি অপলক চেয়ে রইলাম রিনির দিকে। মেয়েটার হাসির পেছনে যে দুঃখের রেশটা আছে তা বোধ হয় আমি টের পেলাম। মেয়েটা এত নিখুঁত অভিনয় করতে জানে? প্রতিনিয়ত সে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করে।

০৭.
আমরা যখন বোটে করে পুরাতন শহরে যাচ্ছিলাম তখন আচমকা আমার ফোনে জারার ভিডিও কল এলো। আমরা কথা বললাম বেশ হাসি-খুশি। আফরিদ তখন অবাক হয়ে আমাকেই দেখছিল টের পাচ্ছিলাম। বেচারা বোধ হয় ভাবতে পারেনি আমিও এতটা মনখুলে, হেসে কারো সাথে কথা বলতে পারি? ব্যাপারটা হচ্ছে জারার জন্য আমার সাত খু* মাফ। ওকে ঘিরে আমি মা হওয়ার অনুভূতি পাই। রিনিটা আমাকে জারার আরেক মা বানিয়ে দিয়েছে যেন। জারাও আমাকে মামনি সম্বোধন করে।

আমাদের কথা শেষ হতেই আফরিদ আমাকে জিজ্ঞেস করল,
–“তুমি বিবাহিত আর মেয়েও আছে? এমন হলে আমি তোমার সঙ্গে ঘুরছি কেন?”

রিনি চট করে হেসে দিয়ে বলল,
–“ওটা আমার মেয়ে।”

আফরিদ যেন আরও অবাক হলো। রিনির মুখটা কেমন বাচ্চা বাচ্চা, সেই বাচ্চা মেয়ের নাকি নার্সারি পঁড়ুয়া বাচ্চা আছে? অবিশ্বাস্য! আফরিদ বলল,
–“তুমি ম্যারিড?”
–“ছিলাম একসময়, এখন সিঙ্গেল মাদার।”

রিনির মুখাবয়ব দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সে আবারও গল্প জুড়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আমি এবার ক্ষেপে গিয়ে বললাম,
–“রিনি, আ’ম ওয়ার্নিং ইউ। আর একবারও যদি আমি তোমার মুখ থেকে কোনো সাউন্ড পাই তবে এই মুহূর্তে বোট থেকে সমুদ্রে ফেলে দিব।”

রিনি এবার চুপ করে বসে রইলো। আমি পিছে ফিরে আফরিদের উদ্দেশে বললাম,
–“এই শর্ত আপনার জন্যেও প্রযোজ্য!”

রেগে গেলে আমার নাক লাল হয়। সেটা আফরিদ লক্ষ্য করেই হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল, “কবুল হে।”

রিনি আফরিদের দিকে কিছুটা এগিয়ে বলল,
–“আপনাকে সাধে কী আর বলেছি আমার বস জল্লাদ? দ্যাখেন, কীভাবে জারার মাকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।”
–“জারা কে?”
–“আমার মেয়ে। আমিই হচ্ছি জারার একমাত্র নরম মা।”

০৮.
বিকাল অবধি আমাদের ঘোরাঘুরি হলো। এই জার্নিতে আফরিদ বেশ ভাবসাব নিয়ে দু পকেটে হাত পুরে আমাদের পেছন পেছন ঘুরেছে। সে একবারও এটা ওটা দেখিয়ে কিছু বলেনি। আমাদের তিনজনের এই অঘোষিত ট্যুরে রিনি বাদে দুজনেই নীরব ছিলাম। আমি মাঝেমধ্যে ওই রিনিকে ধমক দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলাম। আর আফরিদ চৌধুরী আমার মতিগতি লক্ষ্য করে গেছে পুরোটা সময়। যখন বিকাল, আকাশটা একটু মেঘলা হয়ে এসেছে তখনই আমাদের সামনে এক গাড়ি এসে থামল, আমরা তখন সবে “সুলতান আহমেদ মসজিদ” থেকে বেরিয়েছি। দারুণ সৌন্দর্যের এক প্রতীক এই মসজিদ। একে নীল মসজিদও বলা হয়ে থাকে।

গাড়ি থেকে নামল ওয়েস্টার্ন পরা সেই মেয়েটা, যার সাথে কিনা আফরিদকে হোটেলে দেখেছি। মেয়েটা উল্লাসের সাথে আচমকা আফরিদকে জড়িয়ে ধরল। এতে সম্ভবত আফরিদও অপ্রস্তুত হয়। কিন্তু আমার নাক সুড়সুড় করে উঠল ঘেন্নায়। বারবার আফরিদের চরিত্রহীনের ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ওয়েস্টার্ন পরা মেয়েটাকে আফরিদ দ্রুত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রিনি তো অবাক হয়ে বলল,
–“এইটা সেই মেয়ে না যার সাথে আপনি রুম ডেট করেছিলেন?”

আফরিদও বোধ হয় আকাশ থেকে পড়ল! সে অস্ফুট স্বরে চেঁচাল,
–“হোয়াট?”

আমি রিনিকে চুপ থাকতে ইশারা করলাম। মেয়েটাকে দূর থেকে ওইদিন বাঙালি লাগলেও এখন বুঝলাম সে ভিনদেশী। সে কেমন বেকুবের মতো চেয়ে আছে আমাদের দিকে। রিনির কথা যেন সে বুঝতেই পারেনি। আফরিদ কপালে দুই আঙুলের বিচরণ চালিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করল। লম্বা এক নিঃশ্বাস টেনে বলল,
–“ও ক্যারেলিন! আমার ফ্রেন্ড, তুর্কির সিটিজেন।”

আমি আপনমনে আওড়ালাম, সিটিজেন পাওয়ার শর্টকাট। কিন্তু ক্যারেলিন নামের মেয়েটা আচমকাই আমাদের সাথে পরিচিত হতে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি অবশ্য দোনোমোনো না করে হাত মেলালাম, পরিচিত হলাম। মেয়েটা যখন শুনল আমি একজন ফেমাস ফ্যাশন ডিজাইনার সে অবাক হয়ে যায়। এমনকি আমার থেকে সে ড্রেস ডিজাইন করার জন্য ব্যাকুল হয়। আমি বুঝলাম, মেয়েটা বেশ সুন্দর মনের। মেয়েটা তখনই আচমকা আমাদের তার বিয়েতে ইনভাইট করে বসল। আফরিদ জানাল, ক্যারেলিন আজ বিয়ে করতে যাচ্ছে ওর বয়ফ্রেন্ডকে। এই বিয়েতে ক্যারেলিনের বাবা-মা রাজি নয় ছেলে মধ্যবিত্ত বলে। কিন্তু ওরা একে অপরকে খুব ভালোবাসে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমাদের দেশের মতো বুঝি সব দেশেই এমন হিটলার বাপ থাকে? টিপিক্যাল কাহিনী গুলা বুঝি সব দেশেই হয়? হুদাই নিজেকে এতদিন বাঙালি বলে দোষারোপ করতাম, অথচ এসব সমস্ত দুনিয়ার নিয়ম।

আমি ক্যারেলিনের ইনভিটেশন গ্রহণ করলাম। ক্যারেলিন খুশি হয়ে তার ছাদ খোলা গাড়িতে আমন্ত্রণ করল। রিনি আগে আগে গিয়ে ফন্ট সিটে বসে পড়ে, আর আমাকে আফরিদকে পেছনে বসার ইশারা করে। রিনির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেও এখন আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চলে গেছে। আফরিদ যে খারাপ নয় সেটা সে বুঝে গেছে যেন। কিন্তু রিনির চাইতে দুনিয়া আমি বেশি দেখেছি, আফরিদকে এত সহজে আমি মানব না। তবে এই মুহূর্তে রিনিকে চোখ রাঙানো ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। আফরিদ বসল আমার পাশে, খুব কাছে। আমি তাই সরে জানালার দিকে চলে গেলাম। ক্যারেলিনকে আজ বেশ খুশি লাগছে। সে দ্রুত গলায় ইংরেজি আওড়ে স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ ব্যালেন্স হারিয়ে আফরিদ একবার আমার ওপর তো আরেকবার আমি ওর উপর গিয়ে পড়ছি। পরমুহূর্তে নিজেদের সামলানোর সুযোগটা অবধি পাচ্ছি না। রিনি অবশ্য এই স্পিড দারুণ উপভোগ করছে। এক সময় ঝাকুনিতে একটা বিরাট ঝামেলা পেকে গেল। আমি গিয়ে আফরিদের উপর পড়লাম। আমার ঠোঁট তখন আফরিদের ঠোঁটের অনেকটা কাছে গিয়ে লেগেছে। মুহূর্তেই হতভম্ভ হয়ে দ্রুত সরে গেলাম। মুখে হাত চেপে চোখ কপালে তুলে আফরিদের দিকে তাকালাম। আফরিদও অপ্রস্তুত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে, সে নিজেও এরকম কাণ্ড আশা করেনি। আমার চুমু, আমার জীবনের প্রথম চুমু এই ছিলা মুরগীকে দিয়েছি? ছি! ছি! লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে আমার। ক্যারেলিন আচমকা গাড়ি থামিয়ে পেছনে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–“গাইজ, হ্যাভ ইউ কিসড ইচ আদার রাইট নাও?”

চলবে—