#নীল_বনের_চাঁদ – [শেষাংশ]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
০৯.
তুর্কির ইস্তানবুল এমন একটি শহর যেটা একই সাথে দুইটি মহাদেশের অংশ। এশিয়া এবং ইউরোপ মিলিয়ে৷ এছাড়াও ইস্তানবুলে ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল, এলাকা কিংবা যেকোনো নিদর্শনই হোক না কেন এই একটি জায়গাতেই সব দেখা যায়। হাতে সময় নিয়ে আসলে তুর্কির সব জায়গা ঘোরা সম্ভব, অল্প সময়ে কিছুতেই এতগুলা স্পট ঘোরা সম্ভব নয়। ক্যারেলিনের বিয়েটা হতে যাচ্ছে এক গির্জায়। গির্জাটি একদম সমুদ্রের কাছ ঘেষে। আমরা ছাড়াও ক্যারেলিন এবং ওর হবু বরের চেনা-জানারাও রয়েছে। গির্জার বাহিরেই এই ছোটোখাটো আয়োজন। ক্যারেলিনের বাবা তুর্কির হলেও তার মা আমেরিকান। সেক্ষেত্রে দুজনের স্বভাব-চরিত্র মিলিয়েই পেয়েছে ক্যারেলিন। নামটাও বোধ হয় তাই ইংরেজী।
আমি কখনো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর বিয়ে স্ব-চক্ষে দেখিনি, ওই দেখার সীমাবদ্ধতা পর্দা অবধিই ছিল। আমি, রিনি এবং আফরিদ একসাথে দাঁড়ানো। আমি লজ্জায় এখনো নিজেকে সামলাতে পারছি না। আফরিদের চোখে চোখ রাখতে পারিনি এখন পর্যন্ত। তার সামনে যেন আমার নাক কাঁটা গিয়েছে। যাকে বিয়ে করব না বলে এত কাণ্ড ঘটাচ্ছি তাকেই আমার সবচেয়ে মূল্যবান চুমুটা দিয়ে বসে আছি! হোক সেটা নিজের অজান্তেই, তবুও তো চুমু তো চুমুই। এখন এই ছেলেটা না চাইতেও বারবার আমার ভাবনায় আসছে। আফরিদ অবশ্য এ নিয়ে টু শব্দটিও করেনি। ক্যারেলিনকেও তখন সেই সামাল দিয়েছে। সে বোধ হয় বুঝতে পেরেছে, ঠিক কতটা অস্বস্তিতে জুবুথুবু আমি। যাক, ছেলের সুবুদ্ধি আছে বলতে হবে। বুঝদারের মতো কাজ করেছে সে। এখনো এমন ভান ধরে আছে যেন কিছুই হয়নি। আমি বারবার চাইছি ওটা দুস্বপ্ন হোক, আমি ভুলে যাই সবটা। কিন্তু ভোলার বদলে চোখে আরও বেশি করে ভাসছে। এ কী বিপদ!
বিয়ে সম্পন্ন হয়। সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে ফাসার চুমু খেতে বললে একে অপরকে চুমু খেতে সময় নেয় না। এমন ঘনিষ্ঠতা দেখে আমি মাথা নুইয়ে ফেললাম। আবারও তার চোখে নিজের করা অঘটন ভেসে উঠেছে। আফরিদ বোধ হয় আমার হাসফাস আচরণ লক্ষ্য করল। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“এত লজ্জা পাবেন না, এগুলা ওদের জন্য নরমাল।”
আমি মাথা তুলে চাইলাম পাশে। তা দেখে আফরিদ আচমকা হেসে বলল,
–“এই ওয়েট, আপনি কী তখনকার কিসের কথা ভাবছিলেন?”
কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে আমার। গাল লাল করে চট করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালাম। আফরিদ ইতিমধ্যেই মজা নিতে শুরু করেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। মনে মনে নিজেকে এক রাম ধমক দিয়ে তাকে এড়িয়ে গেলাম। রিনি হঠাৎ আমাকে টেনে নিয়ে গেল মেয়েদের ভীড়ে। ওরা ব্রাইডের ফুলের তোড়া নিতে চরম আগ্রহী। আমি অনাগ্রহী হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ব্রাইড কিছুটা দূরে উলটো হয়ে দাঁড়াল। পরপর ফুলের তোড়াটা ছুঁড়ে দেয় মেয়েদের ভীড়ে। আমি কী ভেবে তোড়ার দিকে তাকাতেই আমার পিলে চমকে উঠল। এই তোড়া যে আমার দিকেই আসছে। আমি দ্রুত রিনিকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেলাম। যার ফলস্বরূপ তোড়াটা আমার পেছনের জন পেল। এই নিয়ে মেয়েদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন পড়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দূরে তাকাতেই দেখলাম আফরিদ মুখে হাত চেপে হাসছে। তার হাসির দমকে চোখ জোড়াও ছোটো হয়ে গিয়েছে। আশ্চর্য, এখানে হাসির কিছু হয়েছে নাকি?
এই ফুলের তোড়া নিয়েও ওদের নিয়ম আছে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে নতুন বউয়ের হাতের ফুলের তোড়া যেই মেয়ের হাতে যাবে সেই মেয়েরই পরের বিয়েটা হবে। এই বিশ্বাস নিয়ে মেয়েরাও অতি উৎসাহে কিংবা মশকরা করে এই খেলাতে যোগ দেয়। কিন্তু আমাদের ধর্মে এমন কোনো বিশ্বাস নেই। এজন্য ধর্মের জন্য নাকি মনের ভয়— যেকোনো এক কারণে আমি সরে গেছি। মনের ভয়টা বিয়েকে কেন্দ্র করেই। আর প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন, প্রত্যেকের এই বিশ্বাসকে সম্মান দিতে হয়, এটাই আমি সবসময় শিখে এসেছি।
রিনি মুখ ভার করে বলল,
–“আপনি তোড়াটা নিলেন না কেন?”
–“আমার থেকে তোড়ার যার বেশি প্রয়োজন সেই পেয়েছে।”
–“কিন্তু এটা ঠিক না!”
–“বেশি করলে তুমিই নিতে।”
রিনি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“আমার আবার বিয়ে করার একদমই ইচ্ছে নেই।”
রিনি থেমে আবার হো হো করে হেসে উঠে বলল,
–“তবে পরের বিয়ে তো আপনার হবেই, এটা নিশ্চিত থাকুন। সে আপনি ফুলের তোড়া হাতে নিন বা না নিন। চাইলে আমার এই কথাটা আপনি ফোনেও রেকর্ড করে নিতে পারেন। আমি এক কথা হাজারবার রিপিট করতে রাজি।”
আমি চাপা ধমক দিয়ে বললাম,
–“তুমিই না বলেছিলে আফরিদ চৌধুরীকে দেখলে তোমার লুচু লাগে?”
রিনি তৎক্ষনাৎ তওবা করে বলল,
–“নির্ঘাত আমার চোখে ময়লা জমেছিল, এখন চোখ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ম্যাম। বিশ্বাস করুন, আফরিদ স্যার আপনার জন্য পারফেক্ট কেউ হতে যাচ্ছে।”
–“পানি পড়া খাইয়েছে নাকি তোমাকে? এত দ্রুত এত পরিবর্তন?”
রিনি ফিচেল হেসে বলল,
–“পুরুষ মানুষের ব্যক্তিত্বই যথেষ্ট তার পরিচয় পাওয়ার জন্য। সেটা আমি আগে না বুঝলেও এখন হারে হারে বুঝি।”
১০.
এখন শেষ বিকেল৷ গির্জার একপাশে হাতে ড্রিংক্স নিয়ে একাকী সূর্যাস্ত দেখতে ব্যস্ত আমি। রিনি এখানে এসে বান্ধবী জুটিয়েছে, তাদের সাথে বসেই নানান আলাপে ব্যস্ত সে। সমুদ্রের সুন্দর বাতাস আমায় ছুঁয়ে দিছে। পিঠসম চুলগুলো মুক্ত বাতাসে উড়ছে। তাদের মুক্ত রেখেই আমি সৌন্দর্য উপভোগ করছি। কখন যে আফরিদ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি টেরই পাইনি। ধ্যান ভাঙে তার গলা খাঁকারিতে।
–“ক্যারেলিন ফুলের তোড়া কিন্তু ইচ্ছে করেই তোমার দিকে ছুঁড়েছিল।”
আমি চমকে তাকাই আফরিদের দিকে। আফরিদ চাপা হেসে বলল,
–“ও ফিজিক্সে একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। তুমি কোথায় কীভাবে দাঁড়িয়েছ সব হিসাব নিকাশ আগেই করেছে সে। কিন্তু তুমি সরে যাওয়ায়্ ও আপসেট হয়ে যায়।”
–“আমার দিকেই কেন ছুঁড়বে সে?”
–“সম্ভবত তোমার, আমার বিয়ে দেখতে চেয়েছিল, যেভানে কিস করেছিলে আমাকে.. এতে ও ভেবেই নিয়ে আমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড! আমাকে বলেছিল ‘দেখিস, আমার পরে তোরই বিয়ে হবে।”
আফরিদ হো হো করে হেসে উঠল এবার। আমি তখন লজ্জায় কাবু। লজ্জার পাশাপাশি এবার রাগও হলো। আফরিদ যেভাবে বলছে যেন আমি কত ভালোবেসে তাকে চুমুটা দিয়েছি! এই অসভ্যটার ভাব দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। আমি নাক কুঁচকে বললাম,
–“আপনি যেভাবে বলছেন যেন আমি ইচ্ছে করে চুমু দিয়েছি আপনাকে?”
–“ইচ্ছে হোক কিংবা অনিচ্ছায়, চুমুটা তো তুমিই দিয়েছ। রাইট?”
আমার গা শিউরে উঠে আফরিদের শীতল গলা শুনে। আফরিদের চোখে তাকানোর সাধ্যিও আমার হলো না, দ্রুত নিজের নজর লুকালাম। এতক্ষণে সূর্য ডুবে আকাশে কমলা রেশ ফুটেছে। আফরিদ আমার আরও কিছুটা কাছাকাছি দাঁড়াল। লোহার রেলিং এ দু হাত রেখে আওড়াল,
–“এটা আমার ফার্স্ট কিস ছিল মিস মাউস। আগে কখনো কোনো মেয়ে এতটা কাছে আসেনি। না কোনো মেয়েকে আমি চুমু খেয়েছি আর না কোনো মেয়ে আমাকে চুমু দেওয়ার স্পর্ধা করেছে।”
আমার টনক নড়ল। আড়চোখে তাকালাম আফরিদের দিকে। আফরিদের শক্ত চোয়াল, নরম চাহনি অদূরে কোথাও স্থির। আমিও কোথাও না কোথাও গলে গেলাম। আফরিদকে নিয়ে ভাবা সমস্ত নেগেটিভিটি ভুল প্রমাণিত হচ্ছে কেন সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার আবার নজর সরিয়ে নিতেই আফরিদ বলল,
–“আমি দুই ঘণ্টা পরেই চলে যাচ্ছি, আমার ফ্লাইট আছে মাঝরাতে।”
আমি চমকে তাকাই আফরিদের দিকে। হঠাৎ আমার বুকটা কেমন চৈত্রের দুপুরের মতো খা খা করে উঠল। কিছু একটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার। আমি কোনো মতে বললাম, “হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।”
আফরিদ আচমকা আমার লাল নাক ছুঁয়ে বলল,
–“তোমার মুখজুড়ে থাকা লাল রেশ আমার খুব পছন্দ মিস মাউস, সম্ভবত প্রথমবারের মতো কাউকে তীব্রভাবে মিস করতে যাচ্ছি।”
এই কথাটুকুও আমার বুকে এসে বিঁধল। আমরা আর বেশি সময় থাকলাম না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওখান থেকে রওনা হলাম। যেহেতু আফরিদের ফ্লাইট আছে, সেহেতু ক্যারেলিনও আমাদের আর থাকতে জোর করল না। সে আফরিদকে মিস করবে তো বলে তবে তাকে আগেরবারের মতো জড়িয়ে ধরল না। শেষ বিদায়ে ক্যারেলিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছিল,
–“আফরিদ বলেছে তুমি নাকি আমার হাগ করা পছন্দ করো না। এজন্য আফরিদকে যেই হাগটা করতাম সেটা তোমাকে করে পুষিয়ে নিচ্ছি। ভালো হয়েছে না বলো?”
আমার কে জানে তখন কী হয়েছিল, ক্যারেলিনের সরল বাক্যগুলো শুনে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। আফরিদ নিজ দায়িত্বে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তবেই গেল। রিনি তো তা দেখে অবাক হয়ে বলল,
–“এত দায়িত্বশীল ছেলে।”
এক ঘণ্টা পর আমি যখন আমার রুমে শুয়ে রেস্ট করছিলাম তখন আচমকাই আফরিদের মেসেজ এলো। আমি সাথে সাথেই চেক করলাম। আফরিদ লিখেছে,
–“এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। আবার একা একা বেরিয়ে হারিয়ে যেয়ো না যেন। এবার হারালে আমাকে পাবে না কিন্তু।”
আমার জানা নেই কেন, তবে বুকে কিছু একটা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। এই সমস্ত জাহানে নিজেকে কেমন একলা একলা লাগছে, শূন্য অনুভব হচ্ছে। যেন আমার আশেপাশে কেউ নেই। একটা দিনে আফরিদ বুঝি আমাকে জাদু করে গেল। আমি কেন তবে নিজেকে সামলে নিতে এতটা ব্যর্থ? মনমরা হয়ে আমি আজকের তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। একটা ছবি দেখে চট করে উঠে বসলাম আমি। এ কী, আফরিদ এবং আমার একসাথে তোলা ছবি। আমি মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে রাখলেও আফরিদ দুই আঙুল তুলে ভিক্টোর পোজ করা আর মুখে তার তীক্ষ্ণ হাসি। আমার মাথায় পুরোদিনের স্মৃতি খেলে গেল। সম্ভবত আজকের দিনে ইস্তানবুলে দারুণ সময় কাটিয়েছি।
পরের দুইদিন ট্যুরিস্ট স্পষ্টগুলিতে গেলেও উৎফুল্ল হতে পারিনি। আফরিদকে ছাড়া এসমস্ত জায়গা ঘুরে কিছুতেই মজা পাইনি। এমনও নয় যে গতদিনে আফরিদ বিভিন্ন জায়গা সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছে। সে চুপ করে থাকলেও আমাদের ঢাল হয়ে ছিল, অন্তত— সে ছিল আমার পাশে। কিন্তু আজ সে নেই। কোথাও নেই, তুর্কিতেই সে নেই।
১১.
দেশে ফিরেও আমি কাজে বিশেষ ধ্যান দিতে পারছিলাম না। শূন্যতা যেন আমার মন-মস্তিষ্কে ঘাপটি মেরে বসেছে। আফরিদের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি, দেখাও হয়নি। কিন্তু আমি আফরিদের দেওয়া শেষ মেসেজ, বিদেশি নাম্বারগুলোতে প্রতিদিন চোখ বুলাই। আর ছবিটা তো আমার না চাইতেও প্রিয় হয়ে গিয়েছে। কতবার ভেবেছিলাম ওটা ফ্রেম করে আমার অফিসে টেবিলের ওপর রাখব। কিন্তু লাজ-লজ্জা ভুলে ও কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। রিনির কাছে আফিরিদ আমায় একটি উপহার দিয়েছিল। একটা সুন্দর লকেট। ওটা আমি রোজ পরে চলি যা রিনিও কখনো টের পায়নি। এভাবেই শূন্যতার এক মাস কেটে যায়। কোথাও এক অস্বস্তির চক্করে আমি আজও আফরিদকে কল দিইনি৷ কল তো দূর একটা ছোটো মেসেজও করিনি৷ কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে আফরিদের কল এলো। আফরিদের কল পেয়ে রীতিমতো আমার বুক কাঁপছিল। আমি কোনোরকমে কলটা রিসিভ করতেই আফরিদ ওপাশ থেকে বলে ওঠে,
–“তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এটা আমাকে আগে কখনো বলোনি কেন?”
আমি চমকে যাই, আফরিদের গলায় রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। এতদিন পর কল দিয়ে সে আমাকে ধমক দিল? বেশ অভিমান হলো আমার। সম্ভবত অভিমানের ভারেই আমি রুড হয়ে বললাম,
–“তাতে কী?”
–“তুর্কিতে এজন্যই আমার এত কাছাকাছি থেকেছিলে? আগে জানাও নি কেন? এন্সা মি ইধিরা!”
–“আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না কখনোই। তাই তুর্কিতে কী হয়েছে সেটা দেখার বিষয় না, আপনার কাছেও যাইনি আমি। তাই বিয়ে নিয়ে যদি আপনার এতই সমস্যা হয় তবে বিয়ে ভেঙে দিন। আমি কখনোই আপনার জীবন খারাপের কারণ হতে চাই না।”
আমি এসব বলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিলাম। কেন যেন আমার খুব কান্না পেল। টেবিলে মুখ গুজে আমি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম। আমি এখন পঁচিশ বছর বয়সী যুবতী হওয়া সত্ত্বেও কিশোরী বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকলাম। এত বড়ো হওয়া সত্ত্বেও এসব আহ্লাদীপনা আমায় মানায় না, নিব্বিদের মতো রাগ-অভিমানও না। তবুও আমি কেন আফরিদের বেলায় এমন আবেগী, আহ্লাদী হয়ে পড়লাম? কেন না চাইতেও মনে সেই ছিলা মুরগীটাকেই জায়গা দিয়ে ফেললাম? আমি তো আফরিদকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারতাম না। আমার জীবনের এই কাল বুঝি তুর্কি যাওয়ার সাথেই নেমে এসেছে? বড্ড এলোমেলো, বেপরোয়া লাগছে আমার।
রিনি আমার কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার অনুমতি চাচ্ছে। আমি গলা উঁচিয়ে শক্ত হয়ে বললাম, “লিভ মি এলোন। পরে এসো।”,
অফিসে আমার চরম অস্বস্তি লাগল। এজন্য আজকের সমস্ত বিজি শিডিউলকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ঢাকা-শহর এলোমেলো ঘুরে বেড়ালাম। গতকালই আমি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড়ো এওয়ার্ড পেয়েছি, এই এওয়ার্ড শো টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে। আমার এত খুশির সময়েও আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেই বুঝি ভালোবাসায় পোড়া বলে?
আমার এই ক্যারিয়ার গড়া মোটেও সহজ ছিল না। বাবা মারা যাওয়ার পর মামারা মাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেন। মায়ের বিয়েতে শর্তই ছিল সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে থাকতে চান। আমার সৎ বাবা রাজি হন। মা নিয়ে যায় আমাকে সম্পূর্ণ নতুন এক সংসারে। কলেজ পঁড়ুয়া আমার জন্য সবকিছু এতটা সহজ ছিল না। শুরু থেকেই বুঝতাম সৎ বাবা আমাকে কখনোই পছন্দ করেননি। শুধু বাবা হওয়ার দায়ভার থেকে আমার দায়িত্বগুলো পূরণ করে গেছেন। তিনি বেশ বড়োলোক, তাই আমাকে পড়ার খরচা দিতেও কখনো কার্পণ্য করেননি। খুব দরকার না হলে আমার মুখোমুখিও হতেন না। মাও এই লোকটার উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে যায় এতদিনে, তাই তো তিনি যা বলেন তাই মেনে নেন আমার মা। আমার ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে ক্রেভিংস ছিল, এজন্য দেশের ভালো একটা প্রতিষ্ঠান থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়া শুরু করলাম। তখন থেকেই আমার মূল লক্ষ্য ছিল সফল হবো। বেশিদিন এই লোকের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকব না। এরপর পড়াশোনার পাশাপাশি কঠিন পরিশ্রম, অধ্যাবসায় সব মিলিয়ে দিনগুলো সহজ ছিল না। সফলতার মুখ দেখতে শুরু করলাম পড়াশোনা শেষের পরপরই। এখন আমার নিজের একটা ব্যান্ড আছে। আমি এখন দেশের সফল নারীদের মধ্যে একজন। রিনি ছিল আমার ভার্সিটির জুনিয়র, সেই থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। তবে রিনি যাই করুক, সে ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আজ অবধি অনেক সাহায্য করেছে সে। বিজনেসে অনেক আইডিয়া দিয়েও পাশে ছিল সে। এমনই নয়, সে আমার সুখ-দুঃখেও সমান তালে পাশে থেকেছে, আমাকে ভরসা জুগিয়েছে। এরকম কাউকে পাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্য ছিল, এই সৌভাগ্যকে কখনোই অস্বীকার করিনি আমি সারাদিন নিজের মতো করে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মোবাইল বন্ধ ছিল বিধায় সবার থেকেই একপ্রকার যোগাযোগ ছিন্ন ছিল আমার। তাই বাড়িতে আমার জন্য কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল আমি ভাবতেই পারিনি। বাড়িতে ফিরেই দেখলাম আফরিদসহ তার পুরো পরিবার এসেছে। শুধু আফরিদই নয়— রিনি, জারা এমনকি রিনির মাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত। ওদের সবাইকে একসাথে দেখে আমার মাথা ভনভন করে উঠল, কী হচ্ছে এখানে? আমি আফরিদের দিকে তাকালাম, মুহূর্তের মধ্যেই বুকটা ধ্ক করে উঠল। আফরিদের ক্লিন শেভিং মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি জন্মেছে। তাকে এখন আর ‘ছিলা মুরগী’ বলার কোনো অবকাশই নেই। ছেলেটা যেন একদম তৈরি হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি অবাক সুরে বললাম,
–“আপনারা?”
আফরিদ বলে উঠল,
–“আমরাই শুধু আসিনি, কাজিও এনেছি সঙ্গে করে।”
আমার পিলে চমকে উঠল। বললাম,
–“মানে কী? আপনি না বিয়েতে রাজি ছিলেন না?”
–“পাগল মেয়ে, পুরো কথা না শুনে এত হাইপার হও কেন? আমি যদি আগে জানতাম তোমার আমার বিয়ে ঠিক আগে থেকেই.. তবে তুর্কিতেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলতাম। ক্যারেলিনের সাথেই। শুধু শুধু এতগুলো দিন বিরহের নামে নষ্ট করলাম।”
আমি তখনো হতভম্ভ। আমার কান অবধি যেন পৌঁছাচ্ছে না কোনো কথা। আমি তবুও নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নাকচ করে বললাম,
–“আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
আফরিদ হাসল।
–“ভাঙবে তবু মচকাবে না, রাইট? তুমি কী ভুলে যাও ইধিরা, আমি তোমার চোখের ভাষা পড়তে পারি? তবে খামাখা কেন মিথ্যে বলো?”
আমি চুপসে গেলাম। আমার কাছে সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। আমাকে এবার সবাই মিলে রাজি করানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমার মা বারবার বললেন,
–“আফরিদ ভালো ছেলে মা, আর দেরী করিস না। ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। আমার মন বলছে এই ছেলে তোকে ভালো রাখবে। আর বারণ করিস না, নিজের মনের কথা তো এবার শুন।”
অবশেষে, প্রকাণ্ড ঝড়ের বেগে আমার আর আফরিদের বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের কথা-বার্তা বাবাদের পার্টনারশিপের একটা শর্তের ভিত্তিতে ঘটলেও, আফরিদের ভালোবাসার চক্করে সেই শর্তটা ভেঙেচুরে যায়। যার ফলস্বরূপ আমাদের বিয়েটাও আর পাঁচটা সাধারণ বিয়ের মতোই ভালোবাসার সাথে সম্পন্ন হয়। আফরিদ তো সকলের অলক্ষ্যে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–“আমার জীবনের ফার্স্ট কিসটা তুমিই পেলে, মিসেস মাউস।”
পরিশিষ্ট—
–“মি. কেবিনক্রু! এদিকে আসুন তো।”
কেবিনক্রু আফরিদ চৌধুরী এগিয়ে আসল তার বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে। অভিনয় করে বললেন,
–“বলুন ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
আমি মুখে হাসি লেপ্টে বললাম,
–“আলোটা ভীষণ চোখে লাগছে, একটু বন্ধ করে দিন তো!”
আমি আজও বিজনেস ক্লাসে, তুর্কিতেই যাচ্ছি। তবে আগেরবারের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এবারের টিকিটের পেমেন্ট আফরিদ করেছে। সে আমার কথাতে হেসে বলল,
–“ওকে ম্যাম, যেমন আপনি চান।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো জায়গাটার তীক্ষ্ণ আলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, সব পেসেঞ্জারের সম্মতিতেই। তবে হালকা নীল আলো জ্বলছে সর্বত্র, এই আলো অন্তত চোখে লাগছে না। আফরিদ সমস্ত ব্যবস্থা করে আবার এগিয়ে আসল আমার কাছে। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে আমার খুব কাছে চলে আসল, এতে আমি অপ্রস্তুত হলাম। আফরিদের বুকে ধাক্কা দিয়ে কিছু বলতে যাব ওমনি সে আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসল। মুহূর্তেই আমার গা কেমন শিরশির করে উঠল। আফরিদের বুকে চড় মে*%রে বললাম,
–“অসভ্য, আমরা প্লেনে আছি এখন।”
আফরিদ দায় সারা গলায় বলল, “সো হোয়াট?”
–“কতৃপক্ষের কাছে কমপ্লেইন করে দিব, তখন কিন্তু আর তোমার চাকরি থাকবে না।”
আফরিদ হাসল। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঠোঁট ছুঁইছুঁই করে বলল,
–“বলো গিয়ে, আমিও বলব আমার বউ তুমি। বউকে চুমু দিলে চাকরি যাবে না এটলিষ্ট!”
আমি ভিষণ লজ্জা পেলাম। লজ্জায় মুখ লুকানোর প্রচেষ্টায় আমি। এটা দেখে আফরিদ হেসে দিয়ে আমার গায়ে গরম কম্বলটা টেনে দিল। আমার কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুছিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল,
–“ঘুমাও তুমি, সারা রাতের জার্নি হবে। কিছু লাগলে ডাক দিও আমাকে।”
থেমে আফরিদ আবারও চুমু দেয় আমার কপালে। আমার নাক চেপে ধরে বলল, “ভালোবাসি মিসেস মাউস, আমার একমাত্র বউ।”
আমি লাজুক হাসলাম। আফরিদ নিজের রোমান্টিক খোলশ ছেড়ে আবারও নিজের প্রফেশনে ফিরে যায়। আমি না ঘুমিয়ে আফরিদের চলাফেরা, আচার-আচরণ হাসি মুখে লক্ষ্য করতে লাগলাম। আফরিদ অন্যান্য পেসেঞ্জারদের দেখার পাশাপাশি আমারও খেয়াল রাখছে। আফরিদের আর আমার বিয়ের আজ তিন মাস পূরণ হয়েছে। আফরিদের ওই রোমান্টিক বায়ো দেওয়ার কারণ অন্যরকম ছিল, বন্ধুরা ডেয়ার দিয়েছিল তাকে ওরকম বায়ো দেওয়ার জন্য। এর স্থায়িত্ব ৪৮ ঘণ্টাই ছিল, আর ওই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই আমি তার আইডি চেক করেছিলাম।
আফরিদ আচমকাই ইস্তানবুলের টিকিট কেটে আমাকে সারপ্রাইজ দেয়। সে বেশ ভালোই ছুটি নেয় আমাকে নিয়ে তুর্কিতে ঘুরার জন্য। এবার আর আগের মতো আমাকে একা ফেলে আসবে না। আমার এখনো ভাবতে অবাক লাগে, চরিত্রহীন কেবিনক্রু এখন লয়্যাল হাসবেন্ড হয়ে গিয়েছে। যাকে বিয়ে করব না বলে পণ করেছিলাম তাকে ঘিরেই এখন আমার দুনিয়া। এগুলো সত্যি নাকি আদৌ ভ্রম? ভ্রম হোক কিংবা না হোক, আফরিদ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। যাকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
সমাপ্ত।