নীল বসন্ত পর্ব-১০+১১

0
2
নীলবসন্ত

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১০
পরেরদিন সকাল ভোরে তাহসিন আর রোদেলা ঘুম থেকে উঠে।দুইজনেই একসাথে নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর তাহসিন যায় মর্নিং ওয়ার্কে আর রোদেলা রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাতে।তাহসিন ফিরে এসে নাস্তা করবে।

রোদেলার নাস্তা বানানো শেষ হতেই তাহসিন ফিরে আসে। তাহসিন রেডি হয়েই টেবিলে আসে।রোদেলা তাহসিনকে নাস্তা প্লেটে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।তাহসিন রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“কি হলো দাঁড়িয়ে কেন?ব্রেকফাস্ট করতে বোসো।”

রোদেলা মৃদুকন্ঠে বলল,
-“আপনি খান না।আমি পরে খাবো।”

-“উঁহু।তুমি এখন এই মুহুর্তেই আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।আদেশ করছি।”

তাহসিনের কড়াকন্ঠের সাথে রোদেলা আর পারলো না। তাহসিনের সাথে নাস্তা সেরে নিল।এরপর তাহসিন তার কর্মস্থলে বেরিয়ে গেল।আর রোদেলা দুপুরের রান্নাবান্না করতে লাগলো।

রোদেলা বিকেলের দিকে ঘুমালো।এক ঘুমে তার বিকেল কেটে সন্ধ্যেও কেটে গেল।ঘুম থেকে উঠে দেখলো তখন রাত নয়টা বাজে।এতটা সময় সে ঘুমিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগছে।উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিল।এরপর একটু হালকা নাস্তা করে উপন্যাসের বই নিয়ে বসলো।এইতো আর এই কয়টাদিনই তো হাতে সময় আছে।এরপর যখন কলেজে ভর্তি হবে তখন একাডেমিক বইয়ের বাহিরে অল্পস্বল্প এই উপন্যাসের বই পড়তে পারবে।কারণ তাহসিন সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে একাডেমিক পড়া ফাঁকি দিয়ে মোটেও উপন্যাসের বই সে পড়তে দিবে না।আগামীকালই তাহসিন রোদেলাকে কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে।কলেজে ভর্তি হলে একদিকে ভালোই হবে।কারণ ক্লাস,পড়াশোনা সব নিয়েই রোদেলার সময় সুন্দরভাবে কেটে যাবে।নয়তো বাসায় একা একা তার সময় কাটতে চায় না।

পরেরদিন রোদেলাকে নিয়ে (****)কলেজে গেল।চট্রগ্রামের নামকরা (****) কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল।এরপর তাহসিন রোদেলাকে ক্যান্টনমেন্টের পুরো এরিয়াটা ঘুরিয়ে দেখালো এবং ক্যাম্প নিয়ে কতশত গল্প বলল।আর্মি সম্পর্কে রোদেলা ততটাও অভিজ্ঞ ছিল না।তাহসিনের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানলো।

কলেজে রোদেলার প্রথম দিন।ভর্তির দিনেই তাহসিন রোদেলাকে কলেজে আসা-যাওয়ার পথ চিনিয়ে দিয়েছে। সেনানিবাস থেকে ওতটাও দূরে নয়।রোদেলা একা একাই যাতায়াত করতে পারবে।তবে সে ভেবেছিল আজ প্রথম দিন তাহসিনের সাথে কলেজে আসবে।কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না।যখন তখন তো ছুটি নেওয়া সম্ভব না তাই না? রোদেলার পড়নে কলেজ ইউনিফর্ম,গলায় আইডিকার্ড ঝুলানো।চুলে লম্বা একটা বেনী বাঁধা।কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কলেজে ছুটলো।নিজের শ্রেনীকক্ষে যেয়ে চুপচাপ বসে রইল।কলেজে আজ তার প্রথম দিন।খুবই আনন্দ সাথে ভয়ও লাগছে।নতুন জায়গা,নতুন পরিবেশ।সকলেই তো অপরিচিত।রোদেলা কি পারবে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে?আগের স্কুলে তো রোদেলার কত বান্ধুবী ছিল।তাদের জন্যই স্কুল কামাই দিত না।তবে এখানেও কি তার নতুন বান্ধুবী জুটবে?

কাঙ্ক্ষিত সময় হতেই ক্লাসে টিচার এলেন।নিজের পরিচয় দিলেন।অতঃপর একে একে সকলের পরিচয় নিলেন।নাম, বর্তমান ঠিকানা,এসএসসির রেজাল্ট,পূর্বের স্কুলের নাম। এসবই জিজ্ঞেস করলেন।একে একে সকলে সকলের পরিচয় দিল।এভাবে প্রথম দিনের ক্লাস কাটলো।রোদেলার পাশে বসেছিল একটি মেয়ে।রোদেলা যেমন চুপচাপ সে হচ্ছে রোদেলার উল্টো।বেশ চঞ্চল।রোদেলার সাথে সে এমন ভাবে কথা বলছে যেন তারা পূর্ব থেকে কত পরিচিত ছিল।মেয়েটিকে রোদেলার মন্দ লাগে নি।মেয়েটির নাম নিহা।ক্লাস শেষে যখন রোদেলা ক্লাস থেকে বের হবে ঠিক তখনই নিহা মেয়েটি দৌড় দিয়ে এসে রোদেলার সামনে দাঁড়ালো।রোদেলা ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেল।মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল,

-“ভয় পেয়েছো?”

রোদেলা বলল,
-“হুম।”

-“আচ্ছা সরি।শুনো আমরা কিন্তু আজ থেকে বন্ধু ঠিক আছে?”

রোদেলা মাথা নেড়ে বলল,
-“আচ্ছা।”

মেয়েটি রোদেলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“এবার হাত মিলাও।তাহলে বুঝবো তুমি আমার ফ্রেন্ডশিপ এক্সসেপ্ট করেছো।”

রোদেলা মেয়েটির হাতে হাত মিলালো।মেয়েটি ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।যেন রোদেলার সাথে বন্ধুত্ব কর‍তে পেরে সে খুবই খুশি।

রাত তখন আটটা।রোদেলা সময় কাটানোর জন্য উপন্যাস পড়ছে।যেহেতু একাডেমিক বই এখনো কেনা হয় নি সেহেতু বসে বসে উপন্যাস পড়ে সময় কাটানোই শ্রেয়।রোদেলা যখন উপন্যাসের বই পড়ছিল তখনই তার মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ হয়।বই পাশে রেখে রোদেলা মোবাইল হাতে নিল।দেখলো নিহা মেসেজ দিয়েছে।আজ আসার সময়ই আইডিতে এড করে নিয়েছিল।রোদেলা মেসেজের রিপ্লাই দিতেই নিহা কল দিয়েছে।টুকটাক কথার পর নিহা জিজ্ঞেস করল,
-“আচ্ছা রোদেলা আমি তো জানি তোমার নাম মায়মূনা।ইভেন তোমার আইডির নামও মায়মূনা ইসলাম রোদেলা।তাহলে আইডির নামের পাশের নিকনেইমটা মায়মূন দেওয়া কেন হু হু?নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড ডাকে ওই নামে তাই না?”

রোদেলা মুচকি হেসে বলল,
-“আরে না।একটু ভুল বলেছো।আমি বিবাহিত।আমার হাসবেন্ড আমাকে ওই নামে ডাকে।”

নিহা যেন আকাশ থেকে পড়লো।বলল,
-“কি বলো তুমি বিবাহিত?বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”

-“সত্যিই আমি বিবাহিত।দাঁড়াও আমার হাসবেন্ডের ছবি পাঠাচ্ছি।”

রোদেলা সঙ্গে সঙ্গে নিহাকে সমুদ্র সৈকতে যেয়ে তোলা ওদের দুইজনের একসঙ্গের একটা ছবি সেন্ড করলো।নিহা দেখে বলল,
-“তোমার হাসবেন্ডটা দেখতে তো দারুণ হ্যান্ডসাম।কি করেন উনি?”

-“সেনাবাহিনীর মেজর সাহেব উনি।”

-“ও তাহলে তো বোধহয় বেশ কাঠখোট্টা।”

-“না তেমন কিছুই নন।উনাকে বাহির থেকে যেমনটা কঠোর দেখায় উনি আসলে ততটা কঠোর নন।উনি খুবই ভালো একজন মানুষ।যারা উনাকে চিনে তারাই জানে।”

এভাবে নিহার সাথে আরও কিছুক্ষণ ফোনে কথা হলো। এরপর ফোন রেখে রোদেলা চুলায় ভাত বসিয়ে দিল। অতঃপর পুনরায় উপন্যাসের বই নিয়ে বসলো।

তাহসিন ফিরলে দু’জন একসাথে খেতে বসলো।খেতে খেতে তাহসিন জানতে চাইলো কেমন কেটেছে কলেজের প্রথম দিন?রোদেলা সব গল্প করলো।এমনকি নতুন একটা বান্ধুবী হয়েছে সেটাও জানাতে ভুললো না যেন।

পরের দিন নিহা রোদেলার আগেই ক্লাসে এসে পড়লো। রোদেলা আসতেই দুইজন গল্প করলো।ক্লাসে টিচার এলে মন দিয়ে ক্লাস করলো।ক্লাস শেষে যখন রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে যাবে যাবে তখনই লম্বা ফর্সা একটা ছেলে পাশ কাটিয়ে গেল।এমনভাবে পাশ কাটালো রোদেলা ওপাশে চাপতে যেয়ে পড়ে যেতে যেতে বাঁচলো।শান্ত রোদেলার রাগে কপালে ভাজ পড়লো।তবে কিচ্ছুটি বলল না।কিন্তু পাশে থাকা নিহা চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-“এই ছেলে এই চোখে দেখতে পান না নাকি?আর একটু হলে তো আমার বান্ধুবী পড়ে যেত।ফাজিল কোথাকার।”

ছেলেটা হাঁটা থামিয়ে পিছু ঘুরে তাকালো।হঠাৎ রোদেলার দিকে নজর যেতেই ছেলেটা থমকে গেল।রোদেলার ফর্সা ফোলা ফোলা গাল কি দারুণ দেখতে মেয়েটা।ছেলেটা কাছে যেন প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল।ছেলেটা আস্তে করে বলল,
-“সরি।”

রোদেলা বলল,
-“নেক্সট থেকে সাবধানে চলাফেরা করবেন।যেন আপনার জন্য অন্যকেউ বিপদে না পড়ে।”

কথাটুকু বলেই রোদেলা ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে এলো। রোদেলার সাথে নিহাও এসে পড়লো।কিন্তু ছেলেটা দাঁড়িয়েই রইল যতক্ষণ অব্দি না রোদেলা চোখের আড়াল হয়।

ছেলেটা কলেজের সিনিয়র স্টুডেন্ট।অনার্স করছে।এই কলেজে তার বেশ নাম-ডাক আছে।ভালো স্টুডেন্টের জন্য নাম-ডাক কুড়ায় নি।তার নাম-ডাক হয়েছে মা*রামা*রি, ঝামেলা এসব কিছুতেই।সবাই এক নামে চিনে।শান্ত ভাই। কিন্তু নামের সাথে তার কাজের কোনো মিলই নেই।নামটা শান্ত হলেও কাজ করে সব অশান্তময়।

রোদেলা যাওয়ার পর শান্ত নামের ছেলেটি রোদেলার সম্পর্কে খবর নিল।যেহেতু রোদেলার সাথে তেমন কারো পরিচয় নেই তাই শুধু নামটুকুই জানতে পারলো।কোথায় থাকে না থাকে কিছুই আর জানা হলো না।

কে*টে গিয়েছে কয়েকটিদিন।এই কয়েকদিনে রোদেলা প্রতিদিনই ক্লাসে আসতো।ক্লাস করতো।নিহার সাথে গল্প করতো।তার সময় বেশ দারুণভাবে কেটে যেত।এইদিকে শান্ত নামের ছেলেটা রোদেলাকে রোজ একবার দেখতে রোদেলার ক্লাসের সামনে ঘুরঘুর করতো।রোদেলার অজান্তেই রোদেলাকে দেখে চলে যেত।আজকে নিহাও আসে নি।রোদেলা ক্লাস শেষে যখন মাঠ পেরোবে তখনই কোথা থেকে যেন ছেলেটি সামনে এসে পড়লো।ছেলেটিকে দেখে রোদেলার ভ্রু গুটিয়ে এলো।শান্ত আস্তে করে রোদেলার হাতে একটা গোলাপ ফুল গুঁজে দিয়ে ছোট্ট করে বলল,

-“আই লাভ ইয়্যু।যেহেতু তোমাকে আমি ভালোবাসি সেহেতু তোমাকে আমার চাই-ই চাই।তুমি আমাকে এক্সসেপ্ট করো বা না করো আই ডোন্ট কেয়ার।আমি তোমাকে ভালোবাসি এতেই চলবে।খুব শীগ্রই তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব রাখবো।মেনে নিলে ভালো আর না মানলেও সমস্যা নেই। তুলে নিয়ে আসবো।আমার নাম শান্ত।তবে কাজ করি সব অশান্ত।”

কথাগুলো বলেই ছেলেটি চলে গেল।রোদেলাকে কিছু বলার সময়টুকুও দিল না।রোদেলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।কি ঘটে গেল সে যেন বুঝে উঠতে পারলো না।রোদেলার যখন হুস এলো তখন হাতের গোলাপটা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ফেলে দিল।তবে ওর পাশেই একটা মেয়ে এসে বলল,

-“শান্ত ভাইয়ের নজর খুবই খারাপ।যেহেতু তোমার উপর নজর পড়েছে সেহেতু তোমাকে না পাওয়া অব্দি তোমার পিছু ছাড়বে না।”

রোদেলার কায়া কেঁপে উঠল।রোদেলা সবসময়ই শান্তিপ্রিয় মানুষ।হুট করে এইরকম ঝামেলায় কি করে জড়িয়ে গেল? রোদেলার মনে ভয় চাপলো।এটা নিয়ে কি তার মেজর সাহেবের সাথে আলাপ করা উচিত হবে?আচ্ছা মেজর সাহেব তাকে ভুল বুঝবে না তো?রোদেলা চিন্তায় পড়ে গেল।এই কোন উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো সে? এটার পরিনতি কোথায়?রোদেলা সেসব চিন্তা করতে করতেই বাসার পথ ধরলো।

বাসায় এসে কাঁধের ব্যাগটা রেখে কান্না করলো।রোদেলার এই স্বভাবটা গেল না।রাস্তায় কেউ কিছু বললে সে বাসায় এসে সবার আড়ালে কান্না করতো।আজ যখন ছেলেটা ওসব বললো আশেপাশে কতগুলো ছেলে-মেয়ে কেমন করে যেন তাকিয়েছিল।আর সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে সে তো তার মেজর সাহেবের স্ত্রী তবে কেন তার মেজর সাহেব ছাড়া অন্য কেউ তার দিকে তাকালো।কেন অন্য পুরুষ তাকে পছন্দ করবে?সেসব ভেবেই কান্না করলো।তারপর কান্না মুছে সিদ্ধান্ত নিল তার মেজর সাহেবকে কথাটা জানাবে।

রাতে যখন তাহসিন ফিরলো রোদেলা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে তাহসিনকে জানানোর।কিন্তু সে বুঝতে পারলো তাহসিন তার কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত আছে।বাসায় ফিরেও ল্যাপটপ নিয়ে কি কি যেন করলো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ চিন্তিত।তাই রোদেলা কথাটুকু বলার আর সাহস পেল না। রোদেলা ভাবলো এই সমস্যাটা সে নিজেই সমাধান করবে। তাহসিনকে বাড়তি চিন্তার মধ্যে ফেলবে না বলেই ভেবে নিল।তাই তাহসিনকে আর কিছুই জানালো না।রোদেলা ভাবলো আগামীকাল যেয়েই ছেলেটাকে সে বলবে সে যে বিবাহিত।তার হাসবেন্ড আছে।তার দিকে যেন ভুল করেও না তাকায়।নইলে তার মেজর সাহেব তার খবর নিয়ে ছাড়বে।তার মায়মূনকে ডিস্টার্ব করা মোটেও মেজর সাহেব বরদাস্ত করবে না।

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১১
পরেরদিন রোদেলা সাহস করে কলেজে গেল।সেদিনও নিহা এলো না।শুনেছে,নিহা তার বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে গিয়েছে।কবে আসবে রোদেলা জানে না।রোদেলা ক্লাস শেষে ছেলেটাকে খোঁজলো,তবে পেল না।সেদিনের মতো রোদেলার সাথে শান্তর দেখা হলো না।রোদেলারও জানানো হলো না সে যে বিবাহিত।মাঠ পেরিয়ে গেইট দিয়ে যখন বেরোতে যাবে তখনই রোদেলার পা থেমে গেল।গেইটের সামনে তাহসিন দাঁড়িয়ে আছে।তার জন্যই কি তবে অপেক্ষা করছে?হঠাৎ তাহসিনকে এখানে দেখে তার বোধগম্য হলো না।তাহসিনের পড়নে মর্যাদাপূর্ণ ইউনিফর্ম।ক্যাম্প থেকে সোজা এখানে এসেছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।রোদেলা গুটিগুটি পায়ে তাহসিনের দিকে এগিয়ে গেল।তাহসিন মুচকি হেসে বলল,
-“কি?কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”

রোদেলা বলল,
-“আপনি এখানে যে?মানে হঠাৎ?”

-“তোমাকে নিতে এলাম।কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে এলাম। সময়ের জন্য তোমাকে নিয়ে তো বেরও হতে পারি নি। তোমার বই কিনতে হবে তো।এইজন্য ভাবলাম আজই যাই। তোমাকেও নিয়ে আসি আর বইও কিনে দেই।খুশি হও নি?”

রোদেলা মৃদু হেসে বলল,
-“হু।”

তাহসিন তীক্ষ্ণ চোখে রোদেলাকে পরোখ করলো।তারপর বলল,
-“তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

রোদেলা অন্যদিকে তাকিয়ে ডানে-বামে মাথা নেড়ে মেকী হেসে বলল,
-“না না।”

তাহসিনের চোখের দিকে তাকালো না।নইলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যেত।রোদেলা যখন তাহসিনের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখনই কোথা থেকে যেন শান্ত নামের ছেলেটির উদ্ভব হলো। সে রোদেলার সামনে এসে বলল,
-“হ্যাই রোদ পাখি।কেমন আছো?”

শান্তকে দেখে রোদেলার গলা শুকিয়ে গেল।একেতে তো তাহসিন সামনে দাঁড়িয়ে আর দুইয়েতে শান্ত তার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে যেন তারা খুব ভালো বন্ধু।রোদেলা এবার ভয় পেল।তাহসিন তাকে ভুল বুঝবে না তো?অন্যদিকে তাহসিন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো।এরপর রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“উনি কে?”

রোদেলার গলা ফুড়ে কথা বের হচ্ছে না।রোদেলা তোতলানো শুরু করলো।ছেলেটা এবার তাহসিনের দিকে তাকালো।তাহসিনের পড়নের পোশাক দেখেই সে বুঝে গেল তাহসিন যে আর্মির লোক।ছেলেটি তাহসিনের নেইম প্লেটের দিকে তাকালো।যেখানে লেখা “মেজর তাহসিন মাহমুদ”। তা দেখে ছেলেটি ঢোক গিলল।আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও এটা সত্যি যে শান্তর ভয়ে সবাই গুটিয়ে থাকে সে শান্ত তাহসিনকে দেখে ভয়ে গলা শুকাচ্ছে।তবুও মনে সাহস আনলো।ভাবলো তাহসিন হয়তো রোদেলার ভাই।তাই গলা খাকারি দিয়ে বলল,
-“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।আমি শান্ত।রোদেলার ফ্রেন্ড।”

শান্তর কথা শুনে রোদেলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এইদিকে তাহসিনের কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। তাহসিনের জানামতে রোদেলার একটা ফ্রেন্ডই আছে।সে হচ্ছে নিহা।রোদেলা কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব পাতায় নি তাও এমন বখাটে ছেলেপুলের সাথে প্রশ্নই উঠে না।শান্তর কথাটা তাহসিনের বিশ্বাস হলো না।তাও সে রোদেলাকে শুধালো,

-“এটা তোমার ফ্রেন্ড?”

রোদেলা ডানে-বামে মাথা নাড়লো।যারা অর্থ “না”।শান্ত হেসে বলল,
-“আরে ভয় পাচ্ছো কেন?আচ্ছা আমি ভাইজানকে বুঝিয়ে বলছি।ভাইজান আসলে আমি রোদকে ভালোবাসি। বলতে পারেন আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি।সোজা কথা হলো আমি আপনার বোনকে বিয়ে করতে চাই।আপনি ভাই হিসেবে জানার অধিকার রাখেন তাই আপনাকে আগে জানিয়ে দিলাম।আপনি চাইলে আমার ফ্যামিলির সাথেও আপনাকে কথা বলিয়ে দেব।তবুও আপনার বোনকে আমার চাই-ই চাই ভাইজান।”

শান্তর কথা শুনে রোদেলার চোখ যেন কোঠর থেকে বেরিয়ে যাবে।শেষে কিনা তাহসিনকে তার ভাই বানিয়ে দিল? রোদেলা ভয়ার্ত চোখে তাহসিনের দিকে তাকালো।দেখলো তাহসিন পকেটে হাত গুজে ছেলেটির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রোদেলা মনে মনে ছেলেটিকে বলল,

-“ওরে হাদারাম তুই ভুল করছিস।এটা আমার ভাই না। আমার বর।”

কিন্তু মুখে কিছু বলল না।তাহসিন ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল,
-“তোমাকে যে ‘ও’ ভালোবাসে তা কি ‘ও’ নিজ মুখে বলেছে?”

শান্ত কনফিডেন্সের সাথে বলল,
-“না ভাইজান।আসলে রোদ তো..”

এইটুকু বলতেই তাহসিন গমগমে কন্ঠে বলল,
-“এই ছেলে ওর নাম রোদেলা।রোদেলা বলে ডাকতে পারলে ডাকো নয়তো ডেকো না।রোদ শব্দটা যেন তোমার মুখে আর একবারও না শুনি।”

শান্ত ধমক খেয়ে ভয়ে মাথা নাড়লো।আমতা আমতা করে বলল,
-“আসলে ভাইজান রোদ না মানে রোদেলা তো খুব লাজুক তাই ভালোবাসি কথাটা বলে নি।কিন্তু আমি ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি।আর আমি জানি ‘ও’ আমাকে ফেরাবে না।”

তাহসিন বুঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।রোদেলার দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
-“মায়মূন তুমি তোমার মনের কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে দাও তো।নইলে অনেকে ভুলভাল ভেবে স্বপ্ন বুনবে।”

রোদেলা এবার সাহস পেল।স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
-“আমার কি খেয়ে-ধেয়ে কাজ নেই আপনাকে ভালোবাসতে যাবো?একবারও বলেছি নাকি হু?আপনি গতকাল প্রপোজাল দিয়েই উধাও।আমাকে তো কিছু বলার সময় অব্দি দেন নি।এখন আবার ভুলভাল কথা বলতে আসছেন।”

রোদেলার কথা শুনে শান্ত খিটমিট করতে লাগলো।যেন রোদেলাকে একা পেলে দেখে নিবে।তাহসিন ধমকে উঠে বলল,
-“এই ছেলে কার সামনে কাকে চোখ রাঙাচ্ছো?জানো ও কে?”

তাহসিনের ধমক খেয়ে শান্ত চুপসে গেল।তাহসিন আলতো হাতে ছেলেটির উঁচানো শার্টের কলার নামিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“যাকে ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুললে সে আসলে মেরিড।”

শান্ত অবাক চোখে তাহসিনের দিকে তাকালো।তাহসিন ময়লা ঝাড়ার মতো হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
-“স্যি ইজ মাই ওয়াইফ।”

শান্ত অবাক হয়ে বলল,
-“সিরিয়েসলি?”

তাহসিন বলল,
-“ইয়েস।নেক্সট টাইম থেকে আগে কারো সম্পর্কে ভালোভাবে জানবে তারপর তাকে প্রপোজাল দিতে যাবে ঠিক আছে ছোট ভাইয়া?”

এবার রোদেলা বলল,
-“গতকাল আপনি আমাকে কিছুই বলার সুযোগ দেন নি। সেজন্যই আমি আজ আপনাকে খুঁজছিলাম সবটা জানানোর জন্য।আপনার যে ভুল হচ্ছে তা জানানোর জন্য। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাই নি।”

তাহসিন শান্তর উদ্দেশ্যে বলল,
-“ভুলটা না জেনে করেছো তাই কিছু বললাম না।এখন তো জানো মায়মূন ঠিক কার ওয়াইফ?আশা করি এবার থেকে মায়মূনের দিকে চোখ তুলে তাকাতে একশবার ভাববে।আর যদি এরপরও ওকে কোনো প্রকার ডিস্টার্ব করতে আসো তবে এর ফল ভালো হবে না।সে তুমি কলেজে যতই বখাটেপনা করে বেরাও না কেন।আই থিংক আমি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি।কি?পারি নি?”

শান্ত তোতলিয়ে বলল,
-“জ..জ্বি ভাইয়া।”

রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“সরি ভাবী।আমি আসলে বুঝতে পারি নি।মাফ করে দিবেন।”

রোদেলা পুরো হা হয়ে গেল।যে ছেলে কিনা পুরো কলেজে দাপট নিয়ে চলে সে এমন ভয় পেল?শান্ত তাহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“ভাইয়া আমি আসলেই সরি।আমি বুঝতে পারি নি।ভুল হইছে।আর কখনোই ভাবীর দিকে চোখ তুলে তাকাবো না। ভাবী তো মায়ের সমান তাই না?আমি উনাকে আজ থেকে মায়ের মতো সম্মান করবো।আসি ভাইয়া।আসসালামু আলাইকুম।”

শান্ত চলে গেল।সে আসলে বেশ ভয় পেয়েছে।শান্ত জানে সেনাবাহিনীর লোকরা কতটা কঠোর।এই মেজরের সামনে তো সে চুনোপুঁটি।তাহসিন চাইলেই তার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে করতে পারবে।শুধু শুধু সেনাবাহিনীর লোকেদের সাথে না লাগাই ভালো।এখন থেকে যত পারবে সে রোদেলার থেকে দূরে থাকবে।যদি ভুলক্রমে দেখাও হয়ে যায় মাথা নিচু করে রাখবে।

শান্ত যাওয়ার পর তাহসিন রোদেলার দিকে তাকালো।বলল,
-“এত কিছু হয়েছে তুমি আমাকে কিচ্ছু জানালে না কেন?”

রোদেলা মাথা নিচু করে বলল,
-“আসলে আমি ভেবেছি আপনাকে জানাবো।গত রাতেই জানাতাম।কিন্তু গতরাতে আমি দেখলাম আপনি কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলেন।তাই জানাতে পারি নি।আর আমার ভয়ও করছিল আপনাকে জানালে যদি আমাকে ভুল বুঝেন।”

তাহসিন রোদেলার হাত ধরে বলল,
-“এতদিনে তুমি আমাকে এই চিনলে?ভুল বুঝবো কেন? তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে মায়মূন।তাই যখনই যেখানে যা-ই ঘটুক না কেন তুমি নির্দ্বিয়ায় আমাকে জানাবে।সে আমি যতই ব্যস্ত থাকি না কেন?মাথায় রাখবে তোমার মাহমুদ সাহেব অলয়েজ তোমার পাশে আছে এবং থাকবে।বুঝাতে পেরেছি?”

রোদেলা উপর-নীচ মাথা নাড়লো।যার অর্থ “হ্যাঁ”।সে মুগ্ধ চোখে তাহসিনের দিকে তাকালো।আর ভাবলো কতটা ভাগ্য করে সে এইরকম একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।তাহসিন বলল,
-“হয়েছে,এবার চলো।এইরকম পাবলিক প্লেসে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না।বাসায় গেলে যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ তাকিয়ে থেকো আমি মাইন্ড করবো না।”

রোদেলা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।তাহসিনও হাসলো।

তাহসিন রোদেলাকে এখানকারই একটা লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল।রোদেলার একাডেমিক বই কিনে তারপর দুটো উপন্যাসের বইও কিনে দিল।রোদেলার শ্বশুড় মশাই যে উপন্যাসের বইগুলো কিনে দিয়েছিলেন ওইগুলো পড়া শেষ।তাই তাহসিন এখন দুটো কিনে দিল।বেশি কিনে দিলে পড়া রেখে রোদেলা উপন্যাসের বই-ই পড়তে থাকবে তাই দুটো কিনে দিল।ফেরার সময় রোদেলাকে আইসক্রিম পার্লার থেকে আইসক্রিম কিনে দিতেও ভুললো না। রোদেলাকে কোয়ার্টারে রেখে এসে সে রোদেলার কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে ফোনে কথা বলল।শান্ত নামের ছেলেটার নামে কমপ্লেইন ঠুকলো।স্যার তাহসিনকে আশ্বাস দিলেন রোদেলাকে ওই ছেলে আর কোনো ডিস্টার্ব করবে না।সে দায়িত্ব উনার।তাহসিন যেন নিশ্চিন্তে থাকে।কথা সেরে তাহসিন সিনিয়র অফিসারের রুমে গেল।জরুরি মিটিংয়ে এক্সেকিউট করতে হবে।কারণ কয়েকদিন বাদেই মিশন আছে।বেশ ব্যস্ততায় দিন কাটবে আগামী কয়েকটি দিন।তবে ভাগ্য ভালো মায়মূন এখন তার কাছে আছে। অন্তত রাতে একবার হলেও তো তাকে দেখবে।দুটো কথা বলার সুযোগ পাবে।নয়তো দূরে থাকলে সে তো এই ব্যস্ততা নিয়ে কতই না অভিমান করতো তা বলার ইয়ত্তা নেই।

#চলবে

[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।