নীল বসন্ত পর্ব-১৪+১৫

0
27
নীলবসন্ত

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১৪
পরেরদিন ভোরে আর রোদেলার ঘুম ভাঙলো না। রোদেলার ঘুম ভাঙলো বেলা করে।পাশ ফিরে জায়গাটি শূন্য দেখলো।ঘড়ির কাটায় সময় তখন দশটা।ক্লাসে যাওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে।এতটা বেলা অব্দি সে ঘুমিয়েছে সেটা ভেবেই হতবাক।আফসোস লাগছে ভোরে ঘুম ভাঙলে তো পাশের জায়গাটি শূন্য না বরং পূর্ণ পেত। পাশে ফিরেই তখন কাংখিত মানুষটিকে দেখতে পেত। অবশ্য যা হয় ভালোর জন্যই হয়।মানুষটির সাথে আজ যে দেখা হয় নি একদিকে ভালোই হলো।নয়তো লজ্জায় মানুষটার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না।মানুষটা তার লজ্জা বাড়িয়ে দিতে আরও কত কী বলে যেত। রোদেলা ধীর পায়ে বিছানা থেকে নামলো।জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই সকালের সূর্যের তেরছা আলো ঘরে প্রবেশ করলো।রোদেলা বাহিরে তাকালো।এই এরিয়াটা বেশ নিরব। মানুষের কোলাহল কিংবা যানবাহনের কোলাহল কোনোটাই এখানে নেই।শুধু থাকে পাক-পাকালির কন্ঠ।বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ।এইজন্যই তো এরিয়াটা রোদেলার দারুণ লাগে।রোদেলা বাহিরে তাকালো।আজ তার জন্মদিনের সকাল।অন্যদিকে বসন্তেরও শুরু আজ থেকে।কি সুন্দর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। হাওয়ার সাথে ফুলের সুবাস আসছে। কাছে কোথাও কোকিল ডাকছে।এক অন্যরকম সৌন্দর্য নিয়ে বসন্ত আগমন করে।রোদেলা মন ভরে শ্বাস টানলো। চোখ বন্ধ করতেই গত রাতের ঘটনাগুলো মানসপটে ভেসে উঠলো।ঠোঁট জুড়ে লজ্জামিশ্রিত হাসি বয়ে গেল।এক অন্যরকম মানবের সঙ্গে যেন পরিচয় হলো গতরাতে।সে মানবটি অষ্টাদশী রোদেলাকে খুবই সতর্কতার সাথে সামলিয়েছে।তার জন্মদিনে কেউ কখনো এভাবে সারপ্রাইজ দেয় নি।কেউ তেমন করে মনেও রাখে নি।অথচ লোকটা কোনোভাবে জেনেছে তার জন্মদিনের তারিখ।ওমনি সারপ্রাইজ দিয়ে দিল।বিয়ে যখন ঠিক হয় তখন তাহসিনের বয়স নিয়ে যদিও কোনো আক্ষেপ ছিল না।তবে ভয় ছিল। সে জেনে এসেছিল সেনাবাহিনীর লোকরা বেশ কাঠখোট্টা হয়।কঠোর হয়।কিন্তু মানুষটার সাথে পরিচয় হয়ে বুঝতে পারলো মানুষটা খুবই কোমল প্রকৃতির।বাহির থেকে তাকে যেমন কঠোর দেখা যাক না কেন ভেতর থেকে মানুষটা খুবই কোমল মনের মানুষ।বিশেষ করে রোদেলার সাথে।এই যে বিয়ের এতগুলো মাস পেরিয়ে গেল অথচ মানুষটা অকারণে রোদেলার সাথে কখনো গলা চড়িয়ে কথা বলে নি।হ্যাঁ একবার বলেছিল।তাও রোদেলাকে হারানোর ভয়ে। সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার ঘটনাটা নিয়ে রাগ দেখিয়েছিল। সেটাই ছিল প্রথম এবং শেষ।এরপর থেকে কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলে নি।বরং খুবই নরম,কোমল কন্ঠে তার সাথে কথা বলে।রোদেলার সবগুলো শখ পূর্ণ করতে চায়। মানুষটাকে পেয়ে রোদেলার জীবনটাই যেন বদলে গেল। মানুষটা রোদেলার জীবনে সুখ হয়েই যেন ধরা দিল।

রোদেলার ভাবনার মাঝে তার ফোন বেজে উঠলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো তাহসিন ফোন করেছে।রোদেলা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাহসিন মিষ্টি স্বরে বলে উঠল,

-“সুপ্রভাত ম্যাডাম।ঘুম ভেঙেছে?”

রোদেলা মুচকি হাসলো।বলল,
-“হ্যাঁ ভেঙেছে।”

-“ফ্রেশ হয়েছেন?নাশতা করেছেন?”

-“না।”

-“তাহলে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিন।আপনাকে দশ মিনিট টাইম দিলাম।ঠিক দশ মিনিট বাদেই আমি কোয়ার্টারের সামনে আসবো।নাশতা সেরে নিচে নেমে আসুন।দেখা হচ্ছে।”

-“আচ্ছা।”

রোদেলা সত্যিই দশ মিনিটের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বের হলো।রুম লক করে বাহিরে পা রাখতেই তাহসিনের মেসেজ এলো।রোদেলা চেক করলো,

-“আমি নিচে আছি।এসো তুমি।ফাস্ট।”

রোদেলা সিড়ি ভেঙে দ্রুত নামলো।কোয়ার্টার থেকে বের হতেই দেখলো সামনে তাহসিন দাঁড়িয়ে আছে।রোদেলাকে দেখে ঠোঁট প্রসন্ন হলো।তাহসিনকে দেখতেই রোদেলাকে লজ্জারা তাদের অদৃশ্য চাদরে মুড়িয়ে নিল।রোদেলা মাথা নিচু করেই তাহসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।তাহসিন রোদেলার হাতটা সযত্নে মুঠোতে পুরে সামনে এগিয়ে গেল। একদম ছোট্ট বাঁধানো পদ্মহীনা জলাশয়টির কাছে নিয়ে গেল।সেখানেই যেয়ে বসলো।রোদেলা পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।আর তাহসিন হুট করেই রোদেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।রোদেলা তাহসিনের চুলের ভাঁজে হাতের আঙুল গলিয়ে দিল।আলতো হাতে চুলগুলো টেনে দিল।আরামে তাহসিনের চোখ যেন বুজে আসলো।তাহসিন চোখ বন্ধ করেই বলল,

-“তুমি যেন আমার একপ্রকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছো মায়মূন।এই দেখো না আজ সকালে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে এলাম।অথচ তোমার কন্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে কাজেও যেন মন বসছিল না।তাই তো কিছুক্ষণের জন্য বিরতি পেতেই তোমার কাছে ছুটে আসলাম মায়মূন। কি করে আমাকে এই মায়ার জালে আটকে ফেললে বলো তো।”

রোদেলা মৃদু হাসলো।তাহসিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলল,
-“আপনিও তো আমাকে মায়ার জালে আবদ্ধ করে নিয়েছেন।নয়তো কেন সারাক্ষণ আপনার কথাই আমার মাথায় ঘুরপাক খায় বলতে পারবেন মাহমুদ সাহেব?”

তাহসিন এই পযার্য়ে রোদেলার মুখোপানে তাকালো।তারপর বাঁকা হেসে বলল,
-“হতে পারে তুমি আমায় ভালোবাসো।কারণ,দেখো আমি তোমায় ভালোবাসি বিধায় আমার এমনটা হয়।যদি তুমি ভালো না-ই বা বাসতে তাহলে এমনটা কি হওয়ার কথা?”

রোদেলা ডানে-বামে মাথা নাড়লো।তাহসিন বলল,
-“তাহলে কি দাঁড়ালো।তুমি আমায় ভালোবাসো।কি বাসো না?”

রোদেলা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টানলো।তারপর চোখ মেলে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মুখ ফুটে বলতে হবে কেন?আপনি কি বুঝেন না ভালোবাসি কিনা?”

-“মাঝে মাঝে ভালোবাসি কথাটা শুনার জন্য সবকিছু বুঝেও না বুঝার মতো করেই থাকতে হয়।কারণ ভালোবাসাটা যেমন সুন্দর তেমনি ভালোবাসি শব্দটা শোনাও অন্যরকম সুন্দর।”

রোদেলা বুঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।তাহসিন বলল,
-“আচ্ছা তুমিই বলো গতরাতে যে আমি ভালোবাসি বলে স্বীকারোক্তি দিলাম সেটা শুনতে কেমন লেগেছে?এতদিনে নিজে থেকে বুঝে এসেছো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার প্রতিটি কাজে আমার ভালোবাসা অনুভব করেছো। কিন্তু গতরাতে যখন নিজ মুখে উচ্চারণ করলাম “ভালোবাসি” তখন কি তোমার ভালো লাগে নি?”

রোদেলা বলল,
-“হ্যাঁ লেগেছে।অনেক সময় আমাদের ধারণা ভুলও হয়ে থাকে।তাই মানুষ যখন নিজ মুখে স্বীকারোক্তি দেয় তখন সিউর হওয়া যায় ধারণা সঠিক নাকি ভুল।স্বীকারোক্তির জন্যই তো নিশ্চিন্তে তাকে কি স্বপ্ন বুনা যায়।”

-“হুম।এত কিছুই যখন বুঝো তাহলে এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি এখন তোমার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি চাইছি।কি বলবে না ভালোবাসি?”

রোদেলার হাত থেমে গেল।সে কথা বলতে বলতেই তাহসিনের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।তাহসিনের কথা শুনে এখন হাত থেমে গেল।সে চুপ করে রইল।সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি দিতে তার লজ্জা লাগছে।কি করবে এখন সে? তার এত দোটানার মাঝেই তাহসিনের বিরতির সময়টুকু শেষ হয়ে গেল।তার এখন ক্যাম্পে যেতে হবে।হাতের ঘড়িটার সময় তো সেটাই জানান দিচ্ছে।তাহসিন উঠে বসলো।রোদেলাকে বলল,
-“মায়মূন ব্রেকটাইম ওভার।যেতে হবে।তুমি কি এখানেই বসে থাকবে?নাকি কোয়ার্টারে ফিরবে?এখানে বসে থাকতে চাইলে বসে থাকো।কোয়ার্টারে সারাক্ষণ একা একা থাকতে নিশ্চয়ই ভালো লাগে না তাই না?”

রোদেলা এখনও ভেবে যাচ্ছে।যার দরুন সে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে।তাহসিনের কথাগুলো তার কর্ণগোচর হয় নি।তাই চুপ করে সে ভাবনায় ব্যস্ত।এইদিকে তাহসিন ভেবেছে রোদেলার হয়তো ইচ্ছে করছে এখানে বসে থাকতে তাই তাহসিন বলল,
-“ঠিক আছে বসে থাকো।কিন্তু সাবধানে হ্যাঁ?প্রয়োজনে ওইতো কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় বসে থাকতে পারো। বেশিক্ষণ থেকো না।আসছি আমি।”

তাহসিন হাঁটা দিল।এইদিকে রোদেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার এবার ধ্যান ভঙ্গ হলো।সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল তাহসিন চলে যাচ্ছে।রোদেলা পিছু থেকে তাহসিনকে ডেকে উঠল,

-“শুনছেন।”

তাহসিন পিছু মুড়ে ভ্রু উচিয়ে বুঝালো “কি”? তখনই রোদেলা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে সশব্দে বলল,

-“বড্ড ভালোবাসি আপনাকে।”

রোদেলা স্বীকারোক্তি শুনে তাহসিনের ঠোঁট প্রসন্ন হলো। তাহসিন জবাবে বলল,
-“আমিও আপনাকে ভালোবাসি মিসেস মাহমুদ।”

সে রাতে তাহসিন ফিরতে ফিরতে একটুখানি লেইট হলো। তাহসিন ফিরলে দুইজন একসাথে রাতের ভোজন সেরে ঘুমোতে এলো।লাইট বন্ধ করে ঢিম লাইট জ্বালিয়ে যখন রোদেলা নিজের বালিশে এসে মাথা রাখলো।ঠিক তখনই তাহসিন রোদেলার দিকে কাত হয়ে শুয়ে দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“আজ আর বলবো না হাতের আঙুল কিংবা হাত মুঠো করে ধরো।আজ তোমার জন্য এই বুকটা উন্মুক্ত করে দিলাম।আসো আমার বুকে।জড়িয়ে নিব তোমাকে।”

রোদেলা লজ্জা পেল।ফোস করে শ্বাস ছাড়লো।আস্তে আস্তে করে নিজের বালিশ ছেড়ে তাহসিনের দিকে গেল। তাহসিনের কাছে আসতেই তাহসিন তাকে দুইহাতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।একদম বুকের মাঝে মিশিয়ে নিল।কপালে গাঢ় একটা চুমু খেল।বলল,

-“তোমাকে ছোট্ট পাখির ছানার ন্যায় সারাজীবন আমার এই বক্ষ-মাঝে লুকিয়ে রাখবো।ভালোবাসায় আবৃত করে আগলে রাখবো।থাকবে তো আমার বক্ষের মধ্যিখানে?”

-“আপনার বক্ষ-মাঝেই তো আমার সকল সুখ,শান্তি নিহিত। তাহলে না থাকার প্রশ্নই আসে না।আমি নির্বিঘ্নে,নির্দ্বিধায় জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আপনার বক্ষ-মাঝে আশ্রয় চাই।মাথা রেখে নিশ্চিন্তে শত রজনী পাড় করতে চাই। আপনার বক্ষ-মাঝে থেকেই পৃথিবীর সবটুকু সুখ খুঁজে নিতে চাই।”

রোদেলার কথা শুনে তাহসিন তৃপ্তিময় হাসলো।ডেকে উঠল আহ্লাদ করে,

-“ও মায়মূন।”

রোদেলা ছোট্ট করে বলে উঠল,
-“হু।”

-“তুমি এত ভালো কেন?”

-“কারণ আপনি ভালো।”

-“ভালোবাসি মায়মূন।”

রোদেলা হেসে বলল,
-“আমিও ভালোবাসি।”

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১৫
পরের দিন আর রোদেলা ক্লাস মিস দিল না।সময়মতো ক্লাসে চলে গেল।নিহাও এলো।নিহার সাথে এই কয়দিনে তার ভালোই সখ্যতা গড়েছে।নিহা এখনো শান্তর ঘটনাটা জানে না।আসলে রোদেলা ভুলেই গিয়েছিল শান্তর ঘটনাটা নিহাকে বলতে।ওইদিনের পর থেকে শান্তর সাথে তার দেখা হয় না।আজ ক্লাস শেষে নিহা বায়না ধরলো ফুচকা খাবে। তার মতে কলেজের গেইটের বাহিরে যে ফুচকাওয়ালা আছেন ওইখানেই খাবে।কারণ ওইখানকার ফুচকা বেশি মজা হয়।বান্ধুবীর আবদার না রেখে পারলো না।রোদেলা আর নিহা চললো সেখানে ফুচকা খেতে।ফুচকা খাওয়া শেষে যখন নিহা আর রোদেলা দুইজনেই রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ঠিক তখনই কয়েকটা ছেলে পাশ দিয়ে যেতে যেতে ওদের উদ্দেশ্যে আজেবাজে কথা বলছিল।এতটাই নোংরা কথা ছিল যে রোদেলা আর নিহার দুইজনেরই রাগ উঠে যায়।নিহা তো রাগের বশে বলেই উঠল,

-“এই বেয়াদবরা।তোদের বাসায় মা,বোন নেই রে?অসভ্য কোথাকার।”

চারটে ছেলেই দাঁড়িয়ে গেল।তারপর ওরা পিছু হটে নিহা আর রোদেলার সামনে এলো।একটা ছেলে চোখ টিপ্পনী কেটে বলল,
-“দেখতে যেমন আগুন সুন্দরী মুখের ভাষাও দেখি তেমনি আগুনের উল্কার মতোই।”

বাকি ছেলে গুলোও হু হা করে হাসতে লাগলো।রোদেলা নিহার হাত টেনে বলল,
-“নিহা এসো।কুকুর কামড়ালে কি আমরাও কুকুরকে কামড়াবো নাকি?এসো তো।এদের মতো বেয়াদবদের সাথে কথা বলে লাভ নেই।”

একটা ছেলে রোদেলার দিকে তেড়ে এসে বলল,
-“এই শা*লী এই কি বললি তুই?”

কথাটা বলতেই ছেলেটির নাক বরাবর কেউ একজন ঘুষি মা*রলো।ঘটনাটায় রোদেলা আর নিহা দুইজনেই হকচকিয়ে গেল।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো শান্ত।শান্তকে দেখে তো নিহা হা হয়ে গেল।এতদিন কলেজে এই ছেলের সম্পর্কে মোটামুটি সবই জেনে এসেছে।ততটাও ভালো না।তবে আজ ওদের বিপদে সাহায্য করেছে ভেবেই মনে হলো ছেলেটা ওতটাও খারাপ নয়।

শান্ত ওই ছেলেটিকে একটা ঘুষি মে*রেই ক্ষ্যান্ত হলো না। পরপর কয়েকটা ঘুষি লাগিয়ে দিল।এমনকি পাশের তিনটাকেও বেদরম পিটালো।রাস্তার কেউই এগিয়ে আসলো না ওদের বাঁচাতে।ছেলে চারটে হাত জোর করে বলল,
-“শান্ত ভাই মাফ চাই।ভাই জানে বাঁচতে চাই।”

শান্ত হিসহিসিয়ে বলল,
-“যাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস তাদের কাছে মাফ চা হা*রামজাদা।”

ছেলে চারটে রোদেলা আর নিহার সামনে হাটু মুড়ে বসে হাত জোর করে বলল,
-“আপুরা আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে।আমাদেরকে মাফ করে দেন।নয়তো শান্ত ভাই আমাদেরকে আজ মে*রেই ফেলবে।”

রোদেলা বলল,
-“নেক্সট থেকে মেয়েদেরকে নোংরা কথা বলার আগে মনে রাখবেন আপনাদের জন্মও কিন্তু একজন নারীর গর্ব থেকেই হয়েছে।তাই নারীজাতকে অপমান করার কোনো রাইট-ই আপনাদের নেই।”

ছেলেগুলো বলল,
-“মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে আপু।আর এমনটা হবে না।”

ছেলেগুলো মাফ চেয়ে চলে গেল।এইদিকে ছেলেগুলোকে মারতে যেয়ে শান্তর হাত কিছুটা থেতলে গিয়েছে।সে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে রোদেলার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আসসালামু আলাইকুম ভাবী।ভালো আছেন তো?”

রোদেলা সালামের জবাব নিয়ে বলল,
-“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”

এইদিকে নিহার ওদের কথায় কোনো হুস নেই।সে তো শান্তর থেতলে যাওয়া হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।

শান্ত রোদেলাকে বলল,
-“রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন তাই না?একটু অপেক্ষা করেন ভাবী আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।”

রোদেলা বলল,
-“না না লাগবে না।আমরাই পারবো।”

-“না ভাবী আমি ডেকে দিচ্ছি।আর ভাবী ভাইকে বইলেন আমি কিন্তু আপনাকে এখন মায়ের চোখে দেখি।মনে করে বলবেন কিন্তু।ঠিক আছে?”

রোদেলা বোকা বনে গেল।তার বয়সের থেকেও বড় এই ছেলে কিনা বলছে তাকে মায়ের চোখে দেখে?রোদেলা মনে মনে বেশ হাসলো।শান্ত তাহসিনকে বেশ ভয় পেয়েছে তা সে বেশ বুঝতে পারলো।শান্ত দুটো রিকশা দাঁড় করালো। রোদেলা নিহাকে বলল,
-“নিহা এসো।”

নিহা বলল,
-“এক মিনিট।”

নিহা শান্তকে বলল,
-“আপনার হাত..”

শান্ত নিজের হাতের দিকে তাকালো।তারপর বলল,
-“ও কিছু না।সেরে যাবে।”

নিহা বলল,
-“এক মিনিট দাঁড়ান।”

নিহা ব্যাগের থেকে পানির বোতল বের করে শান্তর হাতের থেতলে যাওয়া অংশটাতে পানি ঢাললো।এতে শুকনো র*ক্ত গুলো সরে গেল।নিহা পানির বোতল ব্যাগে রেখে ব্যাগ থেকে তার রুমালটা বের করলো।যত্ন করে শান্তর হাতে পেচিয়ে দিয়ে বলল,
-“মনে করে ডক্টরের কাছে যাবেন।ডক্টর ব্যান্ডেজ করে দিলে আর সমস্যা হবে না।আসছি হ্যাঁ?”

নিহা রোদেলার থেকে বিদায় নিয়ে রিকশাতে উঠলো। এইদিকে শান্ত আর রোদেলা দুইজনেই হা হয়ে নিহার কান্ড দেখলো।রোদেলা অলরেডি রিকশাতেই উঠে বসেছিল। নিহার রিকশা চলতেই রোদেলার রিকশাও বিপরীত দিকে চলতে শুরু করলো।দুই বান্ধুবী দুই রাস্তা দিয়ে নিজেদের বাসায় পৌঁছাতে লাগলো।এইদিকে ওরা যাওয়ার পর শান্ত একবার নিজের হাতের দিকে তাকালো পরপরই নিহার চলন্ত রিকশাটার দিকে তাকিয়ে ফোস করে শ্বাস ফেলেই পাশের টং-এর দোকানে গেল।

টংয়ের দোকানেই শান্ত এবং তার বন্ধুরা বসা ছিল।ওই দোকান থেকেই ছেলেদের ওসব কথা শুনেই শান্ত এগিয়ে গিয়েছিল এবং ওদেরকে যেয়ে মে*রেছিল।পুনরায় দোকানে ফিরতেই শান্তর বন্ধুরা বলল,

-“কিরে শান্ত তুই না ওই মেয়েটাকে প্রপোজ করেছিলি? তাহলে কেন ওই মেয়েটাকেই ভাবী ভাবী বলে ডাকলি?”

শান্ত চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল,
-“প্রপোজ তো করেছিলাম না জেনে।আসলে ওকে ভালোলেগেছিল তাই প্রপোজ করেছিলাম।পরে জানতে পারলাম ও মেরিড।হাসবেন্ড একজন মেজর।তাই সরে এলাম।কারণ বিবাহিত মেয়ের সাথে লাইন মারতে যাবো কোন দুঃখে?দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি হ্যাঁ? বিশ্বাস কর যদি মেয়েটা মেরিড না হতো তাহলে আমি যে করেই হোক মেয়েটাকে বিয়ে করতামই করতাম।কিন্তু এখন যেহেতু জানলাম মেরিড তাই সরে এলাম।দুনিয়াতে আরও অনেক মেয়ে আছে।বিয়ে করার সময় হলে ঠিক একটা না একটাকে পেয়েই যাবো।”

শান্তর আরেক বন্ধু দুষ্টামি করে বলল,
-“তবে চান্স আরেকটা নিতে পারিস।ক্রাশকে পাস নি তো কি হয়েছে?ক্রাশের বান্ধুবীটাও কিন্তু দেখতে সেই।”

-“ধুর এসব বলিস না তো।এসবে আমি আপাতত নাই। একটা ধোকা খেতে খেতেও বেঁচে গিয়েছি।না জেনে শুনে অন্যের বউকে প্রপোজ করেছি।ছিহ:ছিহ।কি লজ্জাজনক ঘটনা।”

-“আরে শুন বন্ধু।ওইটা তো না জেনে করেছিস।দেখলি না ওই মেয়েটার বান্ধুবী কত যত্ন করে তোর হাতে রুমাল বেঁধে দিল।নিশ্চয়ই মেয়েটিরও তোকে ভালো লেগেছে।নয়তো ওমন যত্ন করে কেনই বা হাতে রুমাল বেঁধে দিবে তুই-ই বল?”

শান্ত হাতের রুমালের দিকে একবার তাকালো।তারপর ভাবলো এভাবে কেউ কখনো তাকে যত্ন করে নি।সবাই শুধু তাকে খারাপ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করে গিয়েছে।তার শরীরের আঘাত কেউ দেখেও দেখে নি।অথচ ক্ষ*ত হয়েছে তার কিন্তু মেয়েটি যেন ব্যাথা পেয়েছে।এমন করেই তার হাতে নিজের রুমালটা বেঁধে দিল।শান্তর বন্ধু পাশ থেকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,
-“কি রে কি ভাবছিস?”

শান্তর হুস ফিরলো।সে মনে মনে নিজেকে নিজে বকা দিল। তাকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।সে যে খারাপ।খারাপ মানুষকে কি কখনো কেউ ভালোবাসে নাকি?খারাপকে সকলে দূরছাই দূরছাই করে।হয়তো ওদের বিপদে সাহায্য করেছে বিধায় মেয়েটি করুণা করেই এমনটা করেছে। মোটেও এখানে ভালোবাসার কোনো সংযোগ নেই।

তখন রাত্রি আটটা বাজে।রোদেলা কলেজের হোম ওয়ার্কগুলো করছে।এমন সময় নিহা রোদেলাকে ফোন করলো।রোদেলা ফোন রিসিভ করলে নিহা শুধালো,
-“কি করছো রোদ?”

-“ক্লাসের হোম ওয়ার্কগুলো করছি।তুমি?”

-“আমিও।একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”

-“হুম বলো।”

-“আচ্ছা শান্ত না যেন কি নাম সে কেন তোমাকে ভাবী ভাবী বলে ডাকলো?এমন ভাবে ডেকেছে যেন তোমার হাসবেন্ড তার আপন মায়ের পেটের ভাই।”

নিহার কথায় রোদেলা শব্দ করে হেসে ফেললো।বলল,
-“আমার হাসবেন্ডের কোনো ভাই-বোন নেই।এখানে অন্য ঘটনা আছে।যেটা তোমার অজানা।”

-“কি ঘটনা?”

রোদেলা সবটা জানালো।শান্ত তাকে প্রপোজাল দিয়েছিল। এরপর তাহসিনের সাথে কথা সবটুকু জানালো।নিহা তো পুরো অবাক।নিহা শব্দ করে হেসে বলল,
-“শেষ মেশ কিনা তোমার হাসবেন্ডকে ভাই বানিয়ে ছাড়লো?”

রোদেলাও হেসে বলল,
-“হ্যাঁ।আচ্ছা নিহা সত্যি করে বলো তো তুমি কি শুধুমাত্র আমাকে কেন ভাবী বলে ডেকেছে সেটা জানার জন্য ফোন করেছো নাকি অন্য কারণে?”

নিহা আমতা আমতা করে বলল,
-“তুমি তো আমার বেস্টফ্রেন্ড।তোমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ আছে?তোমার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্যই ফোন করা।”

-“হুম বলো।শুনে দেখি কোনো পরামর্শ দিতে পারি কিনা।”

-“আসলে ছেলেটাকে না আমার ভালো লেগে গিয়েছে।মানে সে যতই মা*রামারি করে না কেন দেখো আজ আমাদের বিপদে সে এসে আমাদের সাহায্য করেছে।সে যদি না আসতো কি হতো ভেবে দেখেছো?”

-“কিন্তু আমার জানা মতে ছেলেটা তো ওতটাও ভালো না। চরিত্রের গ্যারান্টিও দিতে পারছি না।দেখো আমাদের এসে সাহায্য করেছে।কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখো সে এবং তার বন্ধুরাও অন্য মেয়েদের এভাবে টিজ করে।তাহলে তুমিই বলো,এইরকম ক্যারেক্টরলেস ছেলেকে জীবনসঙ্গীর স্থানটা যে দেবে সে কি আসলেই স্থানটা পাওয়ার যোগ্য?”

নিহা বলল,
-“আমি জানি সে কেমন।দেখো মানুষকে সুযোগ দিতে হয়। সে সুযোগে যদি নিজেকে বদলে ফেলে তাহলে তো ভালোই। সব মানুষের অতীত ভালো হয় না।এখন অতীতের কথা ভেবে যদি তাকে আমরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি তাহলে কি করে হয়?মানুষ হুট করেই খারাপ হয়ে যায় না।এই খারাপ হওয়ার পিছনেও অনেক কারণ থাকে।হয়তো তারও আছে। আমার মতে,একজন জীবনসঙ্গীই পারে তার মানুষটাকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে।আমিও জানি আমি চেষ্টা করলেই পারবো।ওকে একটা চান্স দিতে চাইছি।একটু চেষ্টা করে দেখিই না কি বলো?”

-“তুমি যেটা বলেছো ঠিক বলেছো।কিন্তু চান্স দিতে যেয়ে যদি তুমি তাকে ভয়াবহ ভালোবেসে ফেলো তখন কি করবে?তখন যদি ওই মানুষটাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে না আনতে পারো তখন তো নিজে তার দহনে পুড়বে।না পারবে থেকে যেতে আর না পারবে ছেড়ে আসতে।নিজের জীবনটাই তখন বৃথা মনে হবে।কি দরকার জেনে শুনে আগুনের গর্তে পা রাখার?”

ওপাশ থেকে নিহার দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ শুনা গেল।নিহা বলল,
-“আমি আজকের রাতটুকু ভেবে দেখতে চাই।”

-“ঠিক আছে।ভেবে-চিন্তে দেখো যেটাতে তোমার মন সায় দেয় সেটাই করিও।আমি তোমার পাশে আছি নিহা।”

-“থ্যাংক ইয়্যু রোদপাখি।”

কথা শেষে রোদেলা ফের পড়তে বসলো।অন্যদিকে নিহা কলম দিয়ে খাতায় আকুলিবিকুলি করতে থাকলো।তার মন বারবার বলছে শান্ত ছেলেটা ওতটাও খারাপ নয়।তাকে জীবনসঙ্গীর স্থানে বসালে মন্দ হবে না।আবার নিজের ফ্যামিলির কথাও ভাবলো।তার ফ্যামিলি মানবে তো?সে তো ছেলেটার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছুই জানে না।এভাবে কিছু না জেনে-শুনে আগানো কি ঠিক হবে?পরক্ষণেই ভাবলো ভালোবাসা কি এতকিছু ভেবে-চিন্তে হয়? ভালোবাসলে মেনে নিতে কিংবা মানিয়ে নিতে শিখতে হয়।কোনো মানুষই নিখুঁত হয় না।সবার মাঝেই কিছু না কিছু খুঁত থাকেই।সে খুঁত নিয়েই তাকে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসা দিয়ে তাকে নিখুঁত করে নিতে হয়।নিহা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।সে এই ছেলেটিকেই ভালোবাসবে। ভালোবেসে তাকে সুপথে নিয়ে আসবে।তবেই না সে বলতে পারবে তার ভালোবাসার মানুষটির সফলতার পিছনে সে ছিল।প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে নাকি একজন নারীর অবদান থাকে।তাহলে তা-ই হোক।তার অসফল পুরুষটার সফলতার পিছনে না হয় সে-ই থাকবে।তাকে ভালোবেসে সুপথে এনে গর্বের সাথে বলবে “এই সফল পুরুষটার পিছনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি তো আমিই ছিলাম।”

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]