নীল বসন্ত পর্ব-১৮+১৯

0
48
নীলবসন্ত

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১৮
পরেরদিন নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদের ক্যান্টনমেন্টে আসতে আসতে দুপুর গড়ালো।রোদেলা উনাদেরকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি।নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদও রোদেলাকে দেখতে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছেন।রোদেলাকে এত হাসি-খুশি দেখে উনাদের কাছে বেশ ভালো লাগছে।উনারা রোদেলাকে তাহসিনের কাছে পাঠিয়ে মোটেও ভুল করেন নি।বরং খুবই সঠিক কাজ করেছেন।মেয়েটাকে এতটা হাসি-খুশি দেখে উনাদের মন ভরে উঠলো।রোদেলা বলল,
-“মা-বাবা তোমরা ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।আমি খাবার টেবিলে এনে বাড়ছি।তোমরা আসো।আমি যাচ্ছি।”

রোদেলা চলে গেল।নাজমা বেগম বললেন,
-“দেখলে তো মেয়েটা কতটা সুখী আছে এখানে?আমরা মোটেও ভুল করি নি ওকে এখানে পাঠিয়ে।তাই না?”

-“হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছো।আর দেখো আমাদের গুরুগম্ভীর ছেলেটাও এখন কতটা খোশমেজাজি হয়ে গিয়েছে।সত্যিই বউমার কোনো তুলনা নেই।সে পেরেছে আমাদের ছেলেটাকে বদলে দিতে।”

-“তা বলেছো।চলো হাত-মুখ ধুয়ে নাও।বউমায়ের ডাক পড়লো বলে।”

-“তুমি যাও।আমার গোসল করতে হবে।খুবই অস্থির লাগছে।গোসল ছাড়া টিকা সম্ভব না।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আসো।আমি যাই।দেখি যেয়ে মেয়েটা একা হাতে কি করছে।”

নাজমা বেগম চলে গেলেন।

রাত হতেই তাহসিন বাসায় ফিরে।বাবা-মাকে দেখে সে তো বেশ খুশি।খাওয়া-দাওয়া করে সকলে গল্প করতে বসেছে। গল্পের মুখ্য বিষয় হচ্ছে আগামীকাল রোদেলা তার শ্বশুড়-শাশুড়ির সাথে ঘুরতে যাবে।তাহসিন প্রথমেই বলে উঠল,
-“মা তোমার আদরের বউমাকে দেখে রাখবে কিন্তু।উনার কিন্তু সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার রেকর্ড আছে।”

রোদেলা মুখ ফুলিয়ে বলল,
-“মা দেখলে তো সে এই বিষয় নিয়ে আমাকে কেমন খোচায়?আমি কি আর ইচ্ছে করে এমনটা করেছি নাকি?”

তাহসিন বলল,
-“পাকামি না করলে তো আর এমনটা হতো না।তাই না?”

রোদেলা মুখ বেজার করে রইল।নাজমা বেগম বললেন,
-“তাহসিন বাবা এসব কি হ্যাঁ?পূর্বের কথা টেনে এনে বউমাকে কেন রাগাচ্ছিস?”

তাজউদ্দিন সাহেব বললেন,
-“যেটা ঘটার সেটা ঘটে গিয়েছে।সেটা নিয়ে বলে লাভ আছে?”

তাহসিন রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আচ্ছা সরি।তবে আগামীকাল যেখানেই ঘুরতে যাও সাবধানে থাকবে ঠিক আছে?”

রোদেলা একপাশে মাথা নাড়লো।নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদ মুচকি হাসলেন।যে ছেলে হার মানার পাত্র না সে কী সুন্দর বউকে সরি বলে হার মেনে নিল? ওদের এমন খুনসুটিময় সুন্দর সম্পর্ক দেখে উনাদের প্রাণ জুড়ালো।ওদের সম্পর্ক আজীবন এমন মিষ্টি-মধুর থাকুক সেটাই চাওয়া।

পরেরদিন রোদেলা,নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদ মিলে পাহাড়ে গেলেন।পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সবুজ তরুছায়ায় রোদেলার মন জুড়িয়ে গেল।ঝর্ণার পানি বইয়ে যাওয়ার দৃশ্যে সে পুলকিত হলো।সেদিন সারাটাদিনই রোদেলাদের বাহিরে বাহিরে কাটলো।দুপুরের খাবার বাহির থেকেই খেল।বিকেল পর্যন্ত পুরো পাহাড়ি অঞ্চল ঘুরলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হলো।ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলো।এরপর তিনজনেই রেস্ট নিল।রোদেলা রেস্ট নিয়ে রাতের রান্না বসিয়ে দিল।রাতে আবার তাহসিন ফেরার আগ অব্দি তিনজন মিলে লুডু খেলল।তাহসিন ফিরতেই তাহসিন সহ চারজন লুডু খেলল।রোদেলার সময় বেশ দারুণ কাটলো।

রাত তখন বারোটা।নিহা আজ আবার শান্তকে ফোন করলো।বলা বাহুল্য শান্তর সাথে মাঝে দিয়ে একদিন কথা হয় না।কারণ শান্ত তার রিকুয়েষ্ট এক্সসেপ্ট করেছে।সেই সুবাদে একটাদিন শান্তকে রেস্ট দিল।এখন আজকে আবার জ্বালাবে।কল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শান্ত ফোন রিসিভ করেছে।শান্ত বলল,

-“হুম বলো।”

নিহা বলল,
-“আমার ফোন নাম্বার সেইভ করে রেখেছেন বুঝি?”

-“তুমি কে এমন?যে তোমার ফোন নাম্বার শান্ত সেইভ করে রাখবে?”

নিহা একপেশে হাসলো।বলল,
-“তাহলে ফোন করার সাথে সাথেই কিভাবে বুঝলেন আমি?আমি তো কথাও বলি নি।তাহলে এমন ভাবে “হুম বলো” বললেন যেন আমাকে চিনেই কথাটা বলেছেন?”

শান্ত বলল,
-“এই সময়ে শান্তকে ফোন করার সাহস তুমি ছাড়া আর কেউ করে না।তাই বুঝলাম এটা তুমিই।”

-“তাহলে স্বীকার করলেন আমার খুব সাহস?”

-“হুম।তবে শান্তর থেকে বেশি না।”

-“বারবার নিজের নাম এমন বড়াই করে উচ্চারণ করছেন কেন?”

-“আমার ইচ্ছা।তোমার কোনো সমস্যা?”

-“না কোনো সমস্যা নেই।তো মিস্টার ভয় পেয়েই কি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সসেপ্ট করলেন নাকি?”

ওপাশ থেকে শান্তর হু হা করে হাসির শব্দ এলো।বলল,
-“শান্ত কিনা তোমাকে ভয় পাবে?হাসালে তুমি।”

-“ওমন করে হাসবেন না।হাসির ঝলকানিটা বুকে এসে বাঁধে।”

শান্ত হাসি বন্ধ করে ফেলল।তারপর বলল,
-“আমার মতো একটা খারাপ ছেলেকে এমন রাত-বিরেতে ফোন করো কেন?”

-“আপনার শরীরের কোথাও লেখা আছে আপনি খারাপ? কই আমি তো দেখতে পেলাম না লেখাটা।”

-“শরীরে লেখা নেই।কিন্তু কাজে-কর্মে তা-ই প্রকাশ পায়।”

-“ধরে নিলাম আপনি খুব খারাপ একটা ছেলে।তো খারাপ ছেলেদের সাথে কি কথা বলা বারণ?”

-“হুম বারণ।কারণ একটা ভালো ফল যদি পচা ফলের সাথে রাখা হয় তবে দিনশেষে দেখা যাবে সে ভালো ফলটাও পচে যাবে।আশা করি বুঝেছো?”

-“আপনি তো ফলের এক্সামপল দিলেন।আর আমি যদি মানুষের এক্সামপল দেই?জানেন তো অনেক সময় ভালো মানুষের সাথে মিশতে মিশতে খারাপ মানুষটাও ভালো হয়ে যায়?তাহলে আপনার ক্ষেত্রেও তাই হোক।আর আপনার পাশে আমি আছি তো।”

-“প্রয়োজন নেই।আমি ভালো হতে চাই না।শুধু শুধু মিথ্যে মরিচীকার পিছনে দৌড়ে নিজের জীবনটা শেষ করো না। অনেক ভালো একটা জীবন পড়ে আছে।শুধু শুধু আমার সাথে মিশে নিজে ধ্বংস হয়ো না।”

নিহা ফোস করে শ্বাস ছাড়লো।বলল,
-“আমি কি আপনার বন্ধু হয়ে থাকতে পারি?”

-“না পারো না।”

-“কেন?”

-“একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারে না।”

-“তাহলে কি হতে পারে?প্রেমিক-প্রেমিকা?”

নিহা কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলল।শান্ত বলল,
-“একদম হাসবে না।”

নিহা হাসি চেপে বলল,
-“আচ্ছা ঠিক আছে হাসবো না।আচ্ছা শান্ত ভাই শুনুন। আপনি আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন আর না করুন আমি কিন্তু আজ থেকে আপনার বন্ধু ঠিক আছে?আমি কিন্তু রোজ আপনার খোঁজ নিব।বন্ধুরা তো তা-ই করে তাই না?আপনি কিন্তু মাইন্ড করবেন না ঠিক আছে?”

-“এই মেয়ে একদম ব্লক মারবো কিন্তু।”

-“পারবেন আমাকে ব্লক মারতে?মারুন না সমস্যা নেই। প্রয়োজনে অনেকগুলো সিম নিজের কাছে রাখবো। তারপর আমিও দেখবো কত ব্লক মারতে পারেন।”

শান্ত হা হুতাশ করে বলল,
-“হায়রে কি দিন-কাল এলো রে।সারাজীবন দেখে এসেছি ছেলেরা মেয়েদের পিছনে এভাবে আঠার মতো লেগে থাকে।এখানে দেখি সম্পূর্ণ উল্টোটা ঘটছে।”

নিহা বলল,
-“যদি হয় আপনার মতো ছেলে তাহলে তো উল্টোটা ঘটারই কথা তাই না শান্ত ভাইইই।”

-“এই মেয়ে এভাবে শান্ত ভাই বলে ডাকবে না।”

-“তাহলে কিভাবে ডাকবো শান্ত ভাইইইই।”

-“এই একদম চুপ।ভাইয়া বলে ডাকবে।বুঝেছো?”

-“না বুঝিনি।আমার ভাইয়া শুধু একজন।সেটা হচ্ছে আমার মায়ের পেটের আপন বড় ভাইয়া।এছাড়া আমার আর কোনো ভাইয়া নেই।তাই আপনাকে ভাইইই বলেই ডাকবো। বুঝেছেন শান্ত ভাইইই।”

-“আর একবার ভাইইই বলে টেনে ডাকলে কিন্তু ব্লক মারবো।”

-“ভুলেও সে কাজ করতে যাবেন না।নয়তো এখন কি ডিস্টার্ব করছি এর থেকে দ্বিগুন ডিস্টার্ব করবো।আর আশা করি এতদিনে নিহাকে চিনে গিয়েছেন।নিহা যেটা বলে সেটাই করে থাকে হুহ।”

-“নিজের নামের বড়াই কত হুহ।”

-“ওইতো আপনার থেকেই শেখা।যাই হোক শান্ত ভাই একটা কথা।আপনার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?”

-“না নেই।”

-“এক্স?”

-“না তাও নেই।”

-“যাক বাঁচা গেল।”

শান্ত বলল,
-“আমার মতো ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড,এক্স থাকে নাকি?”

-“কে বলেছে থাকে না?”

-“সো কলড্ ভালো ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড থাকে।আমাদের মতো খারাপ ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড থাকে না।”

-“পৃথিবীতে কি একা আপনিই খারাপ?আর কি কোনো খারাপ ছেলে নেই?শুনুন শান্ত ভাই।আপনাদের মতো খারাপ ছেলেদেরকে ভালোবেসে সুপথে নিয়ে আসার জন্যই নিহাদের জন্ম হয় বুঝেছেন?”

-“শুধু শুধু কেন মিথ্যে মায়া বাড়াচ্ছো?কেন জেনে-শুনে আগুনে ঝাপ দিতে চাইছো?এখনও সময় আছে সরে যাও।”

-“আমি অলরেডি আপনার দহনে পুড়ছি শান্ত ভাই।সরে যাওয়ার জন্য তো এগোইনি।”

-“তুমি আবেগের বশেই এমনটা করছো।আবগে কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মস্তিষ্ক থেকে শান্ত নামটাও মুছে যাবে।”

-“ভুল বলেছেন শান্ত ভাই।এটা আবেগ নয়।এটাকে মায়া বলতে পারেন।মায়া একবার জন্মানো শুরু করলে সে মায়া কখনোই কাটার নয়।বরং দিন যাওয়ার সাথে সাথে মায়াও বাড়তে থাকে।সে মায়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে ভালোবাসায় রূপ নেয়।তাই এই মায়া কাটারও নয়।আর শান্ত নামটাও মুছার নয়।কারণ শান্ত নামটা আমার মস্তিষ্কের সাথে সাথে হৃদয়েও গেঁথে রয়েছে।তাই এই নাম মৃত্যুর আগ অব্দি কাটবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

নিহা নিজের মনের কথাগুলো বলে গিয়েছে।কিন্তু শান্ত যে এসব কিছুই শুনে নি সেটা নিহার বোধগম্য হয় নি।শান্ত নিজের কথাটা শেষ করেই লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সেটা নিহা বুঝতে পারে নি।নিহার যখন কথা বলা শেষ হলো তখনই নিহা বুঝতে পারলো শান্ত অনেক আগেই লাইন বিচ্ছিন্ন করেছে।নিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এই বখে যাওয়া মানবটার ভালোবাসা পেতে তার যে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে সেটা সে বেশ বুঝতে পারলো।তবে এই মানবটার মনে যে ভালোবাসা নামক একটা হৃদয় আছে সেটাও নিহা বুঝতে পারলো।সময় লাগবে এই মানুষটার ভালোবাসা পেতে।তবে সমস্যা নেই।নিহা এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত।নিহা জানে তার এই অপেক্ষার প্রহর একদিন না একদিন ঠিকই ফুড়োবে আর এই মানবটা তার ভালোবাসা নিয়ে নিহার দোরে ফিরবেই।শুধু সময়ের অপেক্ষা।যে মানুষ ভালোবাসতে জানে সে মানুষ অপেক্ষাও করতে জানে।ভালোবাসা বাড়ার সাথে সাথে অপেক্ষা করার ধৈর্য্যটুকুও বেড়ে যায়।এই অপেক্ষা ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষা,এই অপেক্ষা ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের নামে পাওয়ার অপেক্ষা।তাই এই অপেক্ষা করতে মোটেও ক্লান্তি আসে না।নিহা অপেক্ষা করবে।এই মানুষটার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে।মানুষটা ফিরবে।ঠিক ফিরবে এই আস্থা নিয়েই নিহা অপেক্ষার প্রহর গুনবে।

#চলবে

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_১৯
চারদিন পরের কথা।আজ সকালেই নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন সাহেব চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন নিজেদের বাসভবনে উদ্দেশ্যে।উনারা চলে যাওয়ার পর থেকেই রোদেলার খুব মন খারাপ লাগছে।বাসাটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল।তাহসিনও বাসায় নেই।এই খালি বাসায় যেন তার দম বন্ধ লাগছে।নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন সাহেব যাওয়ার পর রোদেলার কাজে কাজেই সময় কেটে যায়।এরপর গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুম দেয়।ঘুম থেকে উঠে রাতে।ঘুম থেকে উঠার পরেই তার আর ভালো লাগছে না। উপন্যাসের বই নিয়ে বসেছিল।কিন্তু বই পড়াতেও মন বসছে না।কোনো কিছু না পেয়ে কান্না করা শুরু করলো।তার মনটা কেমন যেন ভারী লাগছে।কান্না করে মনটা হালকা করতে চাইছে।কান্না করতে করতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।একা বাসায় তাকে সামলানোরও কেউ নেই।অনেকক্ষণ যাবৎ কান্না করার ফলে এখন তার নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে।সে কান্নাভেজা চোখে বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে।মনে পড়ছে রুহির কথা আর তার বাবার কথা। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ছাড়া খুব ভালো আছেন?এখানে আসার পর থেকে তার বাবা তার কোনো খোঁজই নেন না। রোদেলাই দুই-তিনদিন ফোন করে খোঁজ নিয়েছে।যখন বুঝতে পারলো এতে তার বাবা বিরক্ত হন তখন থেকে সেও আর ফোন করে খোঁজ নেয় নি।বাবা তাকে ছাড়া নিশ্চয়ই খুব শান্তিতে আছেন।তার যে একটা মেয়ে আছে সেটা নিশ্চয়ই ভুলে বসেছেন?রোদেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“মা তুমি কেন চলে গেলে?তুমি না গেলে তো আমি আমার বাবার আদর থেকে আর বঞ্চিত হতাম না।সৎ মা-টা বাবার জীবনে এসে আমাকে দূরে সরিয়ে দিল।তুমি থাকলে তো আর এমনটা হতো না।কেন চলে গেলে তুমি?বলো না মা কেন চলে গেলে?”

থেমে,
-“অবশ্য তোমাদের আদর থেকে বঞ্চিত হবো দেখেই সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে ওমন শ্বশুড়-শাশুড়ি দিয়েছেন। তারা কখনোই বুঝতে দেন না আমি তাদের র*ক্তের সম্পর্কের কেউ নই।আমাকে জানো তো খুব স্নেহ করেন। একদম নিজের সন্তানের মতো।ভাগ্য করে ওমন শ্বশুড়-শাশুড়ি পেয়েছি।আল্লাহ উনাদেরকে ভালো রাখুক।”

রোদেলা অনেকটা সময় বারান্দায় সময় কাটালো।একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে বারান্দার মেঝেতেই হাত-পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।তাহসিন ফিরে রোদেলার এই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো।ওর লালচে আর ফোলা চোখ দেখে তাহসিনের বুকটা যেন মোচড়ে উঠলো।রোদেলার এই অবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো রোদেলার মায়ের কথা মনে পড়েছে।আর তাছাড়াও তার শ্বশুড় শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর বাসাটা ফাঁকা থাকায় এতটা কষ্ট লেগেছে।তাহসিন ওর কথা শুনে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।তাহসিন রোদেলাকে হাত-মুখ ধুইয়ে দিয়ে নিজের হাতে যত্ন করে খাইয়ে দিল এবং নিজেও খেল। এরপর রুমে এসে রোদেলার মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করলে তোমার মন ভালো হবে?”

রোদেলা একটু ভাবলো।তারপর বলল,
-“এই রাতের সেনা নিবাসটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। বাহিরের হাওয়া গায়ে মাখাতে চাই।আমাকে পুরো সেনানিবাসে ঘুরাবেন মাহমুদ সাহেব?”

তাহসিন একটু ভাবলো।তারপর হাত বাড়িয়ে বলল,
-“তাহলে তা-ই হোক।চলো তবে।”

রোদেলা তাহসিনের হাতের উপর হাত রাখলে তাহসিন রোদেলার নরম হাতখানা মুঠোতে পুরে হাটা শুরু করল। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে পুরো ক্যান্টনমেন্ট আলোকিত হয়ে আছে।মাঝে মাঝে গাছের পাতা নড়ে শীতল হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে।শীতল হাওয়া ওদের দুইজনের শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে।এই নিরব,নিস্তব্ধতা ঘেরা জায়গাটিতে মোটেও রোদেলার ভয় করছে না।কারণ তার সাথে যে তার মাহমুদ সাহেব আছে।রোদেলার হাত এখনো তাহসিনের হাতের মুঠোতে।রোদেলা খুব শান্তি পাচ্ছে।এক নিমিষেই যেন রোদেলার মন ভালো হয়ে গেল।অবশেষে রোদেলা রিয়েলাইজড করতে পারলো তার শত মন খারাপও এই মানুষটার কাছে টিকে থাকার নয়।এই মানুষটার সান্নিধ্যে মন খারাপরা যেন লেজ গুটিয়ে পালায়।এই মানুষটাই যেন তার মন খারাপের ঔষধ।

পুরো ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে তাহসিন রোদেলাকে নিয়ে ছোট্ট জলাশয়টার কাছে এলো।এই জলাশয় এখন পদ্মফুলে ভরে আছে।পদ্মবিলটার পানির উপর চাঁদের আলো পড়ছে। বাতাসে পানির ঢেউ দোলার সাথে সাথে চাঁদের আলোও ঝলমলাচ্ছে।দেখতে দারুণ লাগছে।রোদেলা পদ্মবিলে পা ডুবিয়ে বসলো।তার দেখা দেখি তাহসিনও পা ডুবিয়ে বসলো।দুইজন দুইজনের হাত ধরেই বসে আছে।রোদেলা তাহসিনের কাঁধে মাথা রেখে পদ্মফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।আর তাহসিন চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল।দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।অবশেষে নিরবতা ভাঙিয়ে কথা বলল রোদেলা।সে তাহসিনের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-“জানেন তো মাহমুদ সাহেব আমার এই ঠুনকো জীবনে আমি কখনো আশা করি নি আপনার মতো একজন মানুষকে পাবো।মা ম*রে যাওয়ার পর কখনো সুখ জিনিসটার কথা ভাবিই নি।ভাবার সময়ই পাই নি।যখন আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো তখন বিয়ে সম্পর্কে ওতটাও ধারণা ছিল না।যেটুকু ধারণা পেয়েছি সবটাই ছিল ভয়ার্ত।সব মিলিয়ে নিজেই কেমন গুটিয়ে গেলাম।বিয়ের দিন যখন হইচই হলো যে আমার নাকি বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। আমার নাকি আর বিয়ে হবে না,আমার কপাল পুড়লো। তখনো আমি ছিলাম শান্ত নির্জীব।অথচ এর আগেই কিন্তু কাজী সাহেব আমাকে দিয়ে কবুল বলিয়ে তবেই আপনার কাছে গিয়েছিলেন।কবুল বলে আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলামও।বলতে গেলে অর্ধেক বিয়ে তখনই হয়ে গিয়েছিল।এমন একটা পরিস্থিতিতেও আমি কেমন চুপ হয়ে ছিলাম।অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তোবা তখনই কান্না করে দিত।অথচ আমার যেন কোনো অনুভূতিই কাজ করছিল না।কি করা উচিত আমি নিজেই ভেবে উঠতে পারছিলাম না।এতসব ভাবনার মাঝেই শুনলাম সকলের “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দ।খুশির হুঙ্কার।বর নাকি “কবুল” বলেছে।বিয়ে নাকি ভাঙে নি।বিয়ে হয়ে গিয়েছে।কেউ কেউ এসে আমাকে মিষ্টিও খাইয়ে গেল।অথচ যাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিলাম তাকে কিন্তু তখনও দেখি নি।না দেখেই বিয়ে করে নিলাম।বিয়ের দিন যখন আপনি আমাকে রেখেই বাসায় চলে এলেন তখন কেউ কেউ বললেন স্বামীর সুখ নাকি আমার ভাগ্যে নেই।আরও অনেক ধরনের কথাই শুনিয়েছে।আমিও আমার নিয়তি বলেই মেনে নিলাম হাহ।”

এইটুকু বলে একটু থামলো।এরপর আবার বলা শুরু করলো,
-“বিয়ের প্রথম রাতে যখন আপনি ঘরে এলেন।আমার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বললেন আমার ধারণা কিছুটা বদলে গেল।মনে হলো মানুষটা ওতটাও খারাপ নয়।মাত্র চারদিনের পরিচয়ে আপনি আবার দূরে চলে গেলেন।এই চারদিনের পরিচয়ের মানুষটার জন্য আমার মন যে কতটা পুড়েছে সেটা বলে বুঝাতে পারবো না।যখন অভিমান করে আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি প্রতিটি রাতেই আমি কান্না করেছি।এরপর যে রাতে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে আপনি বাসায় ফিরলেন।বিশ্বাস করেন মেজর আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।এতটা খুশি আমি হয়তোবা কখনোই হয় নি।সমুদ্রে যেয়ে আমার প্রতি আপনার এতটা যত্নে আমি ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হতাম।সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার মূহুর্তে আপনি নিজের কথা না ভেবে আমাকে বাঁচাতে সমুদে ঝাপ দিলেন। এরপর আমাকে পাড়ে এনে শক্ত করে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে রাখলেন।যেন ছাড়লেই আমি হারিয়ে যাবো। আমাকে হারানোর এতটা ভয় পেলেন।আমি তখনই বুঝে গিয়েছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।আমার ভালোবাসাটুকু তখনও আমি টের পাই নি।টের পেলাম যেদিন আপনি ফের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসেন।আর আমার অন্তর যেন পুড়ে যায়।এরপর দিন থেকে কিছুক্ষণ বাদে বাদেই আপনাকে খুঁজতাম।আপনার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো মনে করে কাঁদতাম।আপনার হাতটা একটু ধরতে চাইতাম।হুট হাট আমাকে লজ্জায় ফেলার কথাগুলো ভেবে কখনো হেসে ফেলতাম।এই হাসির মাঝেই আবার কেঁদে উঠতাম।কখনো কখনো কাঁদতে কাঁদতে রাত কেটে যেত।মন চাইতো আপনার কাছে ছুট্টে যাই।নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল মনে হতো।তখনই আমি একটু একটু করে বুঝতে পারি আমি হয়তোবা আপনাকে ভালোবাসি।
এইরকম করে প্রায় একটা মাস কাটলো।এরপর তো মা আর বাবার জন্যই আপনার কাছে আসা।এখানে এসে আস্তে আস্তে আপনাকে চেনা।তারপর বন্ধুত্ব।এরপর ভালোবাসা।অবশ্য এখানে এসেই আমি পুরোপুরি সিউর হই আমি যে আপনাকে কি পরিমাণ ভালোবেসে ফেলেছি। সেদিন যখন রাতে আপনি বাসায় ফিরলেন না।আপনাকে হারানোর ভয় আমাকে ঝেঁকে ধরেছিল।সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছি এই রোদেলা তার মেজরকে ভয়াবহ ভালোবেসে ফেলেছে।সেদিনই বুঝে গিয়েছি আপনাকে ছাড়া আমি একটা রাতও কাটাতে পারবো না।আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

থেমে,
-“আমাদের এই প্রায় এক বছরের সংসার জীবনে এসে আজ আমার বলতে ইচ্ছে করছে আমি ভাগ্য করে আপনাকে পেয়েছি।নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজ করেছি যার ফলে আপনাকে পেয়েছি।এইতো আর ক’টা দিন বাদেই আমাদের বিবাহের এক বছর পূর্ণ হয়ে যাবে।এই এক বছরে আমাদের মাঝে কত রাগ-অভিমান হয়েছে।যদিও আমিই বেশি অভিমান করেছি।তাও আপনার থেকে দূরে থাকা অবস্থাতে।এইখানে এসে তো রাগ-অভিমান কোনোটাই হয় নি।সে যাই হোক রাগ-অভিমান,ভালোবাসা সব মিলিয়েই তো সংসার তাই না?আপনি আমার জীবনে না এলে আমি বুঝতেই পারতাম না সুখ কি জিনিস।আর না পেতাম ভাগ্য করে ওমন শ্বশুড়-শাশুড়ি।বিয়ের আগে ভাবতাম আমার মতো হতভাগীনি আর দুটো হয়তো নেই। অথচ আপনাকে পেয়ে মনে হলো আমার মতো ভাগ্যবতী কয়জন আছে? আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানবী মনে হয়। অবশ্যই আমি সুখী মানবী।যে মেয়ের স্বামী তার সুখ-দুঃখের সাথী,ইচ্ছাপূরণের সাথী সে মেয়ে ভাগ্যবতী না হয়ে পারে কি হুহ?”

রোদেলা থামলো।এতক্ষণ পদ্মফুলের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলেছে।আর তাহসিন চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় কথাগুলো শুনছিল।রোদেলা এবার তাহসিনের দিকে সরাসরি তাকালো।বলল,
-“জনাব মাহমুদ আপনার মায়মূন আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।নিজের থেকেও বেশি।আপনি মানুষটা সবসময় আপনার মায়মূনের পাশে থেকে যায়েন।আপনি বিহীন আপনার মায়মূন কখনোই যে ভালো থাকবে না।কষ্ট করে হলেও সবসময় তাকে ভালোবেসে যায়েন।”

তাহসিন দুই হাতের আঁজলে রোদেলার গাল টেনে এনে কপালে চুমু খেল।তারপর বলল,
-“তোমার জনাবও যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসে এবং সে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোমাকে ভালোবেসে তোমার পাশে থেকে যাবে মায়মূন।”

থেমে,
-“জানো তো মায়মূন আমিও কিন্তু বিয়ের আগে তোমাকে দেখি নি।মায়ের উপরই সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছিলাম।মায়ের পছন্দের পাত্রী ছিলে তুমি।এরপর যেদিন বিয়ে করতে গেলাম সেদিন শুনলাম তোমার আঠারো বছর হয় নি।এটা শুনে নিজের রাগ সামলাতে পারলাম না।আমি একজন মেজর হয়ে কি করে বাল্যবিবাহ করি?আর আমার সাথে তোমার বয়সের ডিফারেন্স ছিল গুনে গুনে বারো বছরের। বেশ ছোট তুমি আমার থেকে।সবটা ভেবেই আমি ওই মূহুর্তে জানাই বিয়ে করবো না।এরপর মা আমাক অনেক বুঝিয়ে রাজি করান।বিয়ে করার পর পরই উপরমহল থেকে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ পড়ে যায়।যার দরূন তোমাকে রেখেই আমার আগে ফিরতে হয়।আমার উচিত ছিল তোমাকে জানিয়ে ফিরা।বাট সেই মুহুর্তে মাথায় রাগ ছিল।বলতে গেলে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেয়েই বিয়েটা করি।তাই ওতশত না ভেবেই বাসায় চলে আসি।এবার বিয়ের প্রথম রাতে যখন রুমে ঢুকে তোমাকে দেখি তখনই কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করে।এরপর যখন তুমি আমার হাতের আঙুলটা আঁকড়ে ধরে ঘুমালে তখন কিন্তু আমি জেগেই ছিলাম তুমি বুঝতে পারো নি।যে মেয়েটা আমাকে এভাবে আঁকড়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তাকে কি করে ভালো না বেসে থাকা যায় বলো?সে রাতেই আমি বুঝে ফেলি এই ছোট্ট কিশোরীই আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিবে।জানো তো তোমাকে রেখে যখন এখানে চলে আসি তখন আমার নিজের কাছেও বেশ কষ্ট লাগছিল।কিন্তু কিছুই যে করার ছিল না।তোমার অভিমান ছিল তোমার সাথে আমি কথা বলতাম না কেন?কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার সাথে কথা বললেই আমার কষ্ট হতো।এর উপর তুমি যখন কাঁদতে আরও বেশি খারাপ লাগতো।মন চাইতো সব ছেড়ে ছুড়ে তোমার কাছে ছুট্টে যাই।কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না।তোমার সাথে কথা বললে নিজেকে আমি সামলাতে পারতাম না।এইজন্যই আমি কথা বলতাম না।আর সময়ও তো পেতাম না।জানো তো তোমাকে যেদিন সারপ্রাইজ দিতে যাই সেদিন তুমি ঘুমাচ্ছিলে।আমি মন ভরে ওই আবছা আলোতে আমার মায়মূনের মায়াবী চেহারাটা দেখি। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময়টাও ছিল দারুণ।কিন্তু যখন তুমি সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে বাঁচার যুদ্ধ করছিলে সেটা দেখেই যেন আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।তাই তো ওমন করে তোমাকে জড়িয়ে রাখা।এরপর রাগ,জেদ দেখানো দুইটাই ছিল মাথা গরমের ফল।আর বিশেষ করে যেন সেকেন্ড টাইম যেন এমন ভুল না করো।সেদিন যখন তুমি নিজের মুখে বললে “তুমি আমাকে মিস করো।”বিশ্বাস করো ওই মূহুর্তে আমার মনে হয়েছিল আমি তোমার কাছেই থেকে যাই।আমার নিজের মনের বিরুদ্ধে কতটা যুদ্ধ করে এখানে ফিরে আসলাম সেটা একমাত্র আমিই জানি।সেদিন প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিল আমি এই প্রফেশনে না আসলেই ভালো হতো।অন্তত আমাদের সম্পর্কে দূরত্বের এই বেড়াজালটা থাকতো না।এখানে আসার পর যখনই একটু সময় পেতাম তখনই সমুদ্র সৈকতে তোলা আমাদের সেই ছবিগুলো দেখতাম,তোমার একার ছবিগুলোও দেখতাম আর খুবই মিস করতাম।”

থেমে,
-“জানো তো বাবা যেদিন তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে সেদিন আমি খুবই খুশি হয়েছি।এতটাই খুশি হয়েছি যে সেদিন আমার ঠোঁট থেকে একটাবারের জন্য হাসি সরে নি।এমন হাসি-খুশি চেহারা আমার সাথের সৈনিকরাও কখনোই দেখে নি।আমার অবস্থা দেখে তারা নিতান্তই অবাক হয়েছে।আমি নিজের অনূভুতিটা লুকাতে চেয়েও পারি নি।তাহলে ভাবো কতটা খুশি হয়েছিলাম?বাবা আর মাকে তো অনেক ধন্যবাদ।তারা যদি এই উদ্যোগটা না নিত তবে আমার আর তোমার মাঝে দূরত্বের এই দেয়ালটা থেকেই যেত।না হতো দুইজন-দুইজনকে চেনা।আর না এতটা কাছাকাছি আসা হতো।”

রোদেলা চুপটি করে তাহসিনের কাঁধেই মাথা রেখে বসে রইল।তাহসিন বলল,
-“চলো মায়মূন রুমে চলো।অনেক রাত হয়েছে।”

রোদেলা বলল,
-“যেতে ভালো লাগছে না।এভাবেই একটু থাকি?”

তাহসিন রোদেলাকে ভয় দেখাতে বলল,
-“সাপ এসে পায়ে কামড় দিলে আমি কিন্তু কিছু জানি না হুহ।”

রোদেলা ভাব নিয়ে বলল,
-“শুনুন।আমি গ্রামের মেয়ে।ওইসব সাপ-টাপকে ভয় পাই না হুহ।”

তাহসিন অবাক হয়ে বলল,
-“সত্যিই পাও না?”

রোদেলা বলল,
-“সাপ আবার ভয় পায় না এমন কেউ আছে নাকি?খুব ভয় পাই।কিন্তু এখন আপনি আছেন বলে ভয় পাচ্ছি না।আর আপনি যে রুমে যাওয়ার জন্যই এমনটা বললেন সেটা কি আমি বুঝি নি হুহ?”

তাহসিন ফোস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“তার মানে তুমি রুমে যাবে না?”

রোদেলা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-“নাহ। যাবো না।”

-“লাস্ট বারের মতো জিজ্ঞেস করছি।যাবে না তুমি?”

রোদেলা এবারও ডানে-বামে মাথা নাড়লো।সে যাবে না। তাহসিন জলাশয় থেকে পা উঠিয়ে হাটুর কাছে উঠানো ট্রাউজার পা অব্দি নামিয়ে নিল।এরপর পড়নের টি-শার্টটা টেনে-টুনে ঠিক করে নিল।রোদেলা কপালে ভাজ ফেলে বলল,
-“এ কী আপনি উঠে গেলেন কেন?আপনি কি আমাকে রেখেই চলে যাবেন নাকি?”

তাহসিন বলল,
-“আজ্ঞে না ম্যাডাম।আপনাকে নিয়েই যাবো।”

-“কিন্তু আমি তো যাবো..”

আর কিছু বলতে পারলো না।তার আগেই তাহসিন নুইয়ে রোদেলাকে পাজাকোলে করে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় রোদেলা বোকা বনে গেল।হুস ফিরতেই তাহসিনের বুকে আলতো কিল-ঘুষি মেরে হাত পা ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
-“অসভ্য লোক কোথাকার।এভাবে না বলে কোলে তুলে নিল।নামান আমাকে নামান।কেউ দেখলে কি ভাববে ছিহ।”

-“কেউ দেখছে না মায়মূন।আর দেখলেই বা কি?তাহসিন মাহমুদ তার বাচ্চা বউকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে।এখানে ভাবা-ভাবির কি আছে?”

-“আমি মোটেও বাচ্চা না।আমার আঠারো বছর হয়ে গেছে।”

-“তাতে কি?আমার কাছে তো বাচ্চাই।আমার থেকে বারো বছরের ছোট তুমি।”

-“ইশ!আসছে রে বয়সের বড়াই করতে।বড় ভাই যেন।”

তাহসিন দাঁড়িয়ে গেল।মাথা নিচু করে রোদেলার চোখে চোখ রেখে বলল,
-“কি বললে তুমি?”

-“বড় ভাই।”

-“আর একবার এই কথাটা উচ্চারণ করলে কিন্তু কোল থেকে ফেলে দিব।”

রোদেলা খিল খিল করে হেসে ফেলল।বলল,
-“লোকে তখন বলবে মেজরের বউয়ের কোমড় ভাঙা। শুনতে ভালো লাগবে?”

-“বললে বলুক।আমার বউ আমি বুঝে নিব।”

রোদেলা এবারও হাসল।হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“তাহলে ফেলে দিন।আমিও দেখি সেই সাহস আছে নাকি।”

তাহসিন রোদেলাকে ভয় দেখাতে ঝাঁকি মারলে রোদেলা খিলখিল করে হেসে ফেলল।বলল,
-“জানতাম তো আপনি পারবেন না।ওইটুকু সাহস আপনার নেই।”

এবার তাহসিনও হেসে ফেলল।ফের হাঁটা দিল।বলল,
-“কেউ কি নিজের হৃদয়ের অংশটুকুকে এভাবে ফেলে দিতে পারে হুহ?”

-“হুম জানি তো।সেজন্যই তো ভয় পেলাম না।”

-“বুদ্ধিমতী নারী।”

রোদেলা হাসলো।কোলে থাকা অবস্থাতেই তাহসিনের গলা জড়িয়ে বলল,
-“এই বড় বেলায় এসে কোলে চড়তে খুব একটা খারাপ লাগছে না।মনে হচ্ছে যেন আমি সেই ছোট্টই আছি।”

-“তাহলে তো সকাল-বিকাল এভাবেই তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে।একদিকে যেমন তুমি ছোট্ট বেলার ফিল পাবে। অন্যদিকে আমার আর কষ্ট করে ব্যায়াম করতে হবে না। তোমাকে কোলে নিয়ে দুই পাক দিলেই ব্যায়াম হয়ে যাবে। কি বলো ভালো হবে না?”

তাহসিনের কথা শুনে রোদেলা হেসে ফেলল।বলল,
-“তাহলে তো মন্দ হয় না।”

তাহসিনও হেসে ফেলল।রোদেলার মনে হলে মূহুর্তটা এখানেই থেমে গেলে মন্দ হয় না।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তের মধ্যে এই মূহুর্তটা অন্যতম সুন্দর।যখন প্রিয় মানুষ দুইজনেই একসঙ্গে হাসে।দুইজনেরই ঠোঁট জুড়ে হাসির ঝলকানি বয়ে যায়।এরচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত দ্বিতীয়টি কি আছে?এই রকম মূহুর্তটা যে এতটা সুন্দর হয় সেটা রোদেলার অজানা ছিল।আজ এইরকম মূহুর্তের সাথে পরিচিত হতে পেরে সে বিমুগ্ধ এবং খুবই আনন্দিত।

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।