#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_২৪
রোদেলা টিপটিপ করে চোখ খুললো।নাকে কেমন মেডিসিন, ক্যামিকেল ইত্যাদির গন্ধ নাকে ঠেকছে।রুমের মধ্যে হালকা আলো জ্বলছে।এই আলোতেই সে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করলো।আশে-পাশে তাকিয়ে দেখলো রুমটা পুরোই ফাঁকা।রোদেলা নিজেকে ধাতস্থ করে তখনকার ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলো।একটুখানি ভাবনাতে ডুবতেই মনে পড়ে গেল গু*লির বিকট শব্দের কথা,অতর্কিত হামলার কথা।আর তাহসিনকে ছেড়ে আসার কথা।সেসব মনে করে রোদেলা কান্না করে উঠলো। আশেপাশে তাকিয়ে তাহসিনকে খুঁজতে লাগলো।তার মাহমুদ সাহেব কোথায়?আর তাকে হসপিটালে কে আনলো?কিছুই সে বুঝতে পারছে না।রোদেলা দুর্বল পায়ে কেবিন থেকে বেরুলে নার্স এসে বলল,
-“এ কী ম্যাডাম আপনি এই শরীরে বেরিয়ে এসেছেন কেন?”
রোদেলা বলল,
-“আমি ঠিক আছি।প্লিজ আমাকে আমার মাহমুদ সাহবের কাছে নিয়ে চলুন।”
নার্স মাথা নিচু করে ফেলল।রোদেলা বলল,
-“কি হলো আপনি চুপ করে আছেন কেন?আচ্ছা আমাকে শুধু বলুন আমার মাহমুদ সাহেব কোথায় আছে?আমি নিজেই চলে যাবো।প্লিজ বলুন।”
-“এক্সচুয়ালি ম্যাম এখন তো স্যারের কাছে যাওয়া যাবে না। আপনি ওয়েট করুন।সময় হলে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে।”
-“কেন যাওয়া যাবে না?আমার মাহমুদ সাহেব ঠিক আছে তো?”
-“হু হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে।”
-“তাহলে দেখা করা যাবে না কেন?”
-“ম্যাম পারমিশন নেই।এখানকার রুলস আছে।আপনি দেখুন কোথায় আছেন আপনি?”
রোদেলা বাহিরে তাকালে বুঝতে পারলো এটা ক্যান্টনমেন্টের হসপিটাল।যেখানে সকল সেনাবাহিনীদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়।নার্স রোদেলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফের কেবিনে নিয়ে গেল।এরপর বলল রেস্ট নিতে।রুম থেকে না বেরুতে।সময় হলে সে এসেই নিয়ে যাবে।রোদেলা কথা শুনলো।সে অপেক্ষা করতে থাকলো।আর চিন্তায় মশগুল হতে থাকলো।সত্যিই কি তার মাহমুদ সাহেব ঠিক আছে?যেমনটা সুস্থ তার মাহমুদ সাহেবকে রেখে এসেছিল তেমনটাই আছে তো?যদি থাকতো তাহলে কেন তার মাহমুদ সাহেব এই রুমে তাকে একা ফেলে গেল?
★
-“মেজর তাহসিন গতরাতে আপনার বাহিরে যাওয়া কি অনুমোদিত ছিল?”
কর্নেল ওসমান তাহসিনের উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন। তাহসিন বেডে আধসোয়া হয়ে বসে মাথা নিচু করেই বলল,
-“নো স্যার।”
-“আপনার মতো দায়িত্বশীল মেজরের থেকে এমন অবিবেচক সিদ্ধান্ত মোটেও আশা করি নি তাহসিন।”
-“সরি স্যার।”
কর্নেল ওসমান কঠোর কন্ঠে বললেন,
-“কিসের সরি?আপনি ভাবতে পারছেন সঠিক সময়ে আপনার টিম সেখানে না পৌঁছালে কি হতে পারতো? আপনার স্ত্রী আপনার সাথে ছিল।দুইজনেরই ভয়বহ বিপদ হতে পারতো।এমন বোকামিটা কি করে করলেন আপনি? আপনি একজন দায়িত্ববান মেজর।আপনার থেকে এটা আশা করা যায় না তাহসিন।”
কর্নেল ওসমান গটগট পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।কর্নেল যাওয়ার পর তাহসিন ফোস করে শ্বাস ছাড়লো।আসলেই কতবড় বিপদ হতে পারতো।তার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঢেকিয়ে রাখলো।তখনকার কথা সে ভাবলো।যখন ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে।চার চারটে পি*স্তল তার মাথায় ঢেকিয়ে কাউন্ট করা হচ্ছিল তখন তাহসিন চোখ বন্ধ করে নেয়।সে ভেবেছিল সেখানেই হয়তোবা তার পথচলার সমাপ্তি ঘটবে।চোখ বন্ধ করে রোদেলার কান্নামাখা চেহারাটা মনে করলো।মনে করলো তার আগত সন্তানের কথা।মনে করলো তার মা-বাবার কথা।আর হয়তো তাদের কারোর সাথেই দেখা হবে না।মৃ*ত্যুর দোর ঘরে সে পৌঁছে গিয়েছে। কিছু সেকেন্ডের মাথাতেই হয়তো সে শেষ হয়ে যাবে।সে যখন চোখ বন্ধ করে মৃ*ত্যুর প্রহর গুনছিল ঠিক সে সময়েই পরপর অনেকগুলো গু*লির শব্দ পাওয়া যায়।কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে গু*লির শব্দ পেল অথচ তার কিচ্ছু হলো না।উলটো তার সামনে যেন কয়েকটা গলার স্বর একসাথে আর্তনাদ করে উঠলো।তাহসিন ঝট করে চোখ মেলল।আর দেখলো ওই চারজন হাত চেপে চিৎকার করে যাচ্ছে।হাত ফুড়ে তাদের র*ক্তক্ষরণ হচ্ছে।তাহসিন পাশে তাকাতেই দেখলো ওদের রেসকিউ টিম চলে এসেছে।ওই চারজনকে আগে গে*ফতার করা হলো এরপর তাহসিনকে গাড়িতে তুলতে গেলে তাহসিন খোড়াতে খোড়াতে আগে সেই পরিত্যক্ত বাড়িটির ভেতরে গেল।ভেতরে যেয়ে দেখলো রোদেলা অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে।তাহসিনের পা থেকেও সমানে র*ক্তক্ষরণ হচ্ছিল।এই পা নিয়েই খুব কষ্টেই রোদেলাকে কোলে তুলে নিল।খোড়াতে খোড়াতে গাড়ির কাছে এলো।ওদের এই অবস্থা দেখে সকলে ধরাধরি করে ওদের দুইজনকে তাহসিনের কালো গাড়িটিতে তুললো।তাহসিন আর রোদেলা পিছনে বসলো।যেহেতু তাহসিন ড্রাইভ করার অবস্থায় নেই তাই ড্রাইভ করার জন্য টিম মেম্বারের একজন এসে বসলো।তাহসিনের গাড়ি চলতে শুরু করলে ওদের গাড়ির পেছনে পেছনে সেনাবাহিনীর গাড়ি যেতে লাগলো।পিছনের সিটে তাহসিন রোদেলাকে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো।অতিরিক্ত র*ক্ত ক্ষরণে তাহসিন একসময় নিজেও চেতনা হারালো।এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে ক্যান্টনমেন্টের হসপিটালের এই বেডে আবিষ্কার করলো।গু*লি বিদ্ধ পা তার ব্যান্ডেজে মোড়ানো।পা নাড়াতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে।জ্ঞান ফিরতেই দেখলো তার রুমের সামনে দুইজন জুনিয়র অফিসার দাঁড়িয়ে।ওদের থেকেই জানতে পারলো রোদেলা পাশের কেবিনে আছে।তাকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে।তাই এখনো ঘুমোচ্ছে।কিছুক্ষণ পরেই তাহসিনের সিনিয়র অফিসার কর্ণেল ওসমান ওর কেবিনে আসেন। আর তার সাথেই কথা বলছিল বিধায় নার্স রোদেলাকে তাহসিনের কাছে নিয়ে আসে নি।এখন তাহসিনের কেবিনের ভেতরে তার জুনিয়র দুই অফিসার বসে আছে।সাথে আছে তার বিশস্ত ড্রাইভার সাকিব।তাহসিন সাকিবের উদ্দেশ্যে বলল,
-“সাকিব তোমার ম্যাডামের কেবিনে যেয়ে খবর নাও, তোমার ম্যাডাম ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।”
-“ওকে স্যার।”
সাকিব কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স থেকে খবর নিয়ে এলো রোদেলা তাহসিনের জন্য অপেক্ষা করছে।তাহসিন ফের সাকিবকে পাঠালো রোদেলাকে নিয়ে আসার জন্য।রোদেলা এলেই তাহসিন রুমে থাকা দুই আর্মির দিকে তাকালে ওরা রুম ত্যাগ করলো।সাকিব রোদেলাকে রুমে দিয়ে সেও চলে যেতে নিলে তাহসিন বলল,
-“সাকিব বাইরে থেকে দরজাটা লক করে যেও।আর সবাইকে বলো আগামী দুই ঘন্টা এই রুমে যেন কেউ না আসে।”
-“ওকে স্যার।”
সাকিব বাহির থেকে দরজা আটকে দিল।এইদিকে রোদেলা তাহসিনের ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ফেলছে।সে অনুশোচনায় ভোগছে।তার জন্যই আজ এত কিছু হলো।রোদেলাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহসিন বলল,
-“মায়মূন কাছে এসো।”
রোদেলা মাথা তুলে তাহসিনের দিকে একবার তাকালো। অতঃপর গুটিগুটি পায়ে তাহসিনের দিকে এগিয়ে গেল। তাহসিনের কেবিনের বেডটা বড় আছে।দুইজন অনায়াসেই শোয়া যাবে।রোদেলা কাছে যেতেই তাহসিন হাত দুই দিকে বাড়িয়ে বলল,
-“বুকে আসো মায়মূন।আমার এখন তোমাকে প্রয়োজন।”
রোদেলা তাহসিনের বুকে যেয়ে মাথা রাখলো।তাহসিন দুইহাতে রোদেলাকে আগলে নিল।রোদেলা তাহসিনকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।তাহসিন রোদেলার চুলে চুমু খেতে খেতে বলল,
-“কান্না করে না।যা হয়েছে দুঃস্বপ্ন ভেবে সব ভুলে যাও।”
রোদেলা কান্না করতে করতে বলল,
-“আ..আমার জন্যই সবটা হলো।আমি যদি ওমন আবদার না করতাম তাহলে তো এসব কিছুই হতো না।”
-“হুসস।কোনো কথা না।এটা আমাদের নিয়তিতে ছিল।তাই এটাতে নিজেকে একদম দোষারোপ করবে না।আর এমন অনেক পরিস্থিতির সাথেই সাক্ষী হয়েছি আমি।তাই এসব আমার কাছে নতুন না।আমি পৃথিবীতে যতদিনের আয়ু নিয়ে এসেছি ততদিনই বাঁচবো।তাই এসব নিয়ে ভয় পাবে না।আর দেখো আয়ু ছিল দেখেই তো গতরাতের এতবড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি তাই না?”
রোদেলা বলল,
-“আপনার পায়ে কি হয়েছে?ওরা আপনাকে মে*রেছে?”
-“তেমন কিছু না।দুটো বু*লেট লেগেছে।”
রোদেলা আঁতকে উঠল।মাথা তুলে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“দ দুটো?”
তাহসিন মাথা নিচু করে রোদেলার দিকে তাকালো।বলল,
-“বললাম না এসবে ঘাবড়াবে না।এসব সাবজেক্ট এখন বাদ দাও মায়মূন।এসব আর মনে করো না।বরং শুকরিয়া আদায় করো আমরা এত বড় বিপদ থেকে ফিরে এসেছি।”
রোদেলা নিচুস্বরে বলল,
-“জানেন মাহমুদ সাহেব আপনাকে তখন একা রেখে আসতে আমার বড্ড কষ্ট হয়েছে।শুধুমাত্র আপনার আদেশ অমান্য করতে পারবো না বলে আপনাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম।আচ্ছা মেজর,আপনি না বলেছিলেন সুখে-দুঃখে,বিপদে-আপদে সবসময় আমরা দুইজন একসাথে থাকবো?তাহলে ওত বড় বিপদে কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিলেন?”
তাহসিন শ্বাস ফেলল।তারপর বলল,
-“তাছাড়া কি আর কোনো উপায় ছিল বলো?আমি কি করে এত বড় বিপদের সামনে তোমায় নিয়ে দাঁড়াতাম?ওই সময়ে শুধু তোমার কথা আর আমাদের আগত সন্তানের কথা মাথায় ছিল।কি করে তোমাদেরকে একটু সেইফ জায়গায় রেখে আমি ওদের সাথে ফাইট করতে পারি।তাই তো ওইসময় তোমাকে সেইফ জোনে পাঠিয়ে দিলাম।যাতে আমার কিছু হয়ে গেলেও তোমরা সেইফ থাকো।”
রোদেলা তাহসিনের বুকের বাম পাশের শার্ট খামচে ধরে বলল,
-“আপনাকে ছাড়া ভালো থাকবো কি করে মাহমুদ সাহেব? যেখানে আমার ভালো থাকার একমাত্র কারণই আপনি। সেখানে আপনাকে ছাড়া আদৌ কি ভালো থাকা সম্ভব?”
তাহসিন রোদেলার হাত ঠোঁটের কাছে এনে চুমু খেল। রোদেলাকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো।যেন সুযোগ থাকলে তার বুকের ভেতরে রোদেলাকে সযত্নে লুকিয়ে রাখতো।তাহসিন বলল,
-“মায়মূন জানো তো আমার বুকের মাঝে তোমাকে আগলে রাখতে আমার খুব শান্তি লাগে।এই যে এতক্ষণ কতটা অশান্তি লাগছিল,কতটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।অথচ দেখো তোমাকে পেয়ে আমার সব অশান্তি,সব দুশ্চিন্তা এক নিমিষেই ভ্যানিশ।তাহলে বুঝো শুধু আমিই না।তুমিও আমার ভালো থাকার কারণ।অর্থাৎ আমরা দুইজনই একে অপরের ভালো থাকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি।এইজন্যই বুঝি বলা হয়, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক?”
#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_২৫
তাহসিন হসপিটালে ছিল চারদিন।আজ বাসায় ফিরেছে। এই চারদিন রোদেলাও তাহসিনের সাথে সাথেই ছিল।এক মূহুর্তের জন্যও তাহসিনের কাছ ছাড়া হয় নি।এর মাঝে তাহসিনের নিষেধাজ্ঞায় রোদেলা নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন সাহেবকেও খবরটা জানায় নি।কারণ উনারা চিন্তা করবেন।তাহসিন জানে তার মা এই খবর জানলে কান্নাকাটি করবেন।এমনকি তাকে এই চাকরি ছেড়ে দিতে বলবেন।কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব?সবটা চিন্তা করেই উনাদেরকে জানালো হলো না।
রোদেলা বাসায় ফিরে ঘর দোর সব পরিষ্কার করে তাহসিনকে সকালের খাবার খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল।অতিরিক্ত হাটাহাটি তাহসিনের নিষেধ।রোদেলা তাহসিনকে অপ্রয়োজনে বিছানা থেকে নামতে দেয় না।এই চারদিনে রোদেলা যেন দায়িত্ববান স্ত্রী হয়ে উঠেছে।সবসময় তাহসিনের খেয়াল রাখা,যত্ন করা,সময় মতো ঔষধ খাইয়ে দেয়া সবটা নিজ হাতে সামলাচ্ছে।তাহসিন মেয়েটাকে দেখে শুধু অবাকই হয়।যে মেয়েটি কিনা গত তিন মাসে হুটহাট বাহনা করতো,মুড সুইং হতো,বাচ্চামো করতো অথচ পরিস্থিতির চাপে পড়ে সে মেয়েটার মাঝেই কেমন ম্যাচুরিটি এসে পড়েছে।নিজের অসুস্থতা ভুলে তাহসিনের সেবায় ব্রত হয়েছে।তাহসিন আফসোসের স্বরে বলল,
-“যেখানে এখন তোমার সেবা করার কথা আমার,
সেখানে তুমি আমার সেবায় নিয়োজিত হলে।”
রোদেলা বলল,
-“আমার জন্যই তো এমনটা হলো মাহমুদ সাহেব।নয়তো সবই তো ঠিক ছিল।”
তাহসিন মেকী ধমক দিয়ে বলল,
-“মায়মূন একবার বলেছি না নিজেকে দোষারোপ করবে না।”
রোদেলা কিছু বলল না।চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো।কাজের মাঝেই কিছু একটা মনে পড়লো তার।সে তাহসিনের উদ্দেশ্যে বলল,
-“আজ নিহা আর শান্ত ভাইয়া আসবেন।”
তাহসিন শুধালো,
-“কখন আসবে?”
-“বিকেলে।ভেতরে আসার পারমিশনের ব্যবস্থা করে দিয়েন।”
-“চিন্তা নেই।ক্যান্টনমেন্টের সামনে এসে ফোন করতে বলো। আমি ম্যানেজ করে দিব নি।”
★
সময়টা এখন বিকেল।শান্ত কলেজ রোডের সামনেই নিহার জন্য অপেক্ষা করছে।দুইজন একসাথেই তাহসিনের ক্যান্টনমেন্টে যাবে।শান্ত প্রায় আধঘন্টা হলো নিহার জন্য অপেক্ষা করছে।এই অব্দি দুইবার নিহাকে ফোনও দিয়ে ফেলেছে।দুইবারই নিহা বলছে এই তো পাঁচ মিনিট আসছি। অথচ নিহার আসার এখনো খবর নেই।শান্ত সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে।তার কপালের রগ যেন রা*গে ফুটে উঠছে।আজ নিহা আসুক।কয়েকটা কড়া কথা ঠিক শুনিয়ে দেবে।শান্ত ফোস করে শ্বাস ছেড়ে নিহার নম্বরে তৃতীয় বারের মতো ফোন দিতে দিতে বলল,
-“মেয়ে মানুষের সাথে কোনো ভালো মানুষ কোথাও যাওয়ার নাম নেয়?”
-“আপনি তো ভালো মানুষ নন।তাই তো আপনি আমার সাথে যাওয়ার নাম নিলেন।”
কথাটা শুনেই শান্ত বুঝে ফেলল নিহার কন্ঠ।সে ফোন কান থেকে নামিয়ে রাগী চোখে পিছু ঘুরলো।আর নিহাকে দেখেই তার ঠোঁট জোড়া ফাঁকা হয়ে গেল।সে চোখ বড় বড় করে নিহাকে দেখছে।যেন এই প্রথম কোনো নারীকে দেখছে। নিহা দুই হাত বুকে আড়া আড়িভাবে ভাঁজ করে ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
-“এভাবে কি দেখছেন?কখনো কি মেয়ে মানুষ দেখেন নি?”
শান্ত ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-“মেয়ে মানুষ তো দেখেছিই।কিন্তু শাড়ি পড়া মেয়ে মানুষ এতো কাছ থেকে আগে কখনো দেখি নি।”
-“যাক তাহলে তো ভালোই হলো।এবার তাহলে প্রাণ ভরে দেখুন।আমি কিছু মনে করবো না।”
শান্তর হুস ফিরলো।গলা খাকারি দিয়ে চুল পিছনের দিকে বুলাতে বুলাতে নিচু কন্ঠে বলল,
-“এত লেইট কেন হয়েছে?অনেকক্ষণ ধরে তো ওয়েট করছিলাম।”
নিহা শাড়ির কুচি ধরে বলল,
-“কি করবো বলুন জীবনে প্রথমবার শাড়ি পড়লাম।তাই শাড়ি পড়তে খুবই বেগ পোহাতে হলো।জানি সুন্দর হয় নি।”
শান্ত আনমনে বলে উঠলো,
-“না খুব সুন্দর হয়েছে।”
নিহা শান্তর দিকে তাকিয়ে খুশিমনে বলল,
-“সত্যি?”
শান্ত উপর-নীচ মাথা নাড়লো।যার অর্থ হ্যাঁ।শান্ত খেয়াল করলো নিহা আসার আগ অব্দি নিহার উপরে সে বেশ চটে ছিল।অথচ নিহা সামনে আসতেই সে চেয়েও নিহার উপর রাগ ফলাতে পারছে না।তার চোখ ঘুরেফিরে নিহার দিকেই যাচ্ছে।শান্ত আজ রিয়েলাইজড করছে মেয়েদের শাড়ি পড়লে অন্যরকম সুন্দর লাগে।শান্তর মনে হচ্ছে “শাড়িতেই নারী’ কথাটি বোধহয় নিহার জন্যই লেখা হয়েছে।নিহার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে।শান্ত নিজেকে মনে মনে ধমকাচ্ছে।বেহায়ার মতো নিহার দিকে না তাকাতে।অথচ ঘুরেফিরে তার চোখ সেই নিহার দিকেই যাচ্ছে।শান্ত বিরক্ত হলো নিজের উপর।শান্ত নিহার উদ্দেশ্যে বলল,
-“বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছো নাকি?এতটা সেজেগুজে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল?”
নিহা বলল,
-“অবশ্যই প্রয়োজন ছিল।কারণ জীবনের প্রথমবারের মতো ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি।আমার কত শখ ছিল ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে দেখার।কিন্তু সে সৌভাগ্য হয়ে উঠে নি।অবশেষে আজ সে সৌভাগ্য হতে চলেছে।তাই তো শাড়ি পড়ে এসেছি।পুরো ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে দেখবো,ছবি তুলবো।অনেক মজা করবো।”
শান্ত চোখমুখ কুচকে বলল,
-“যেভাবে আনন্দে লাফালাফি করছো যেন ক্যান্টনমেন্টে বিয়ে করতে যাচ্ছো।এতই যখন শখ ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে দেখার তাহলে বাবা-মাকে বলে সেনাবাহিনীর কাউকে বিয়ে করে নাও।তাহলেই তো শুধু ঘুরার না থাকারও সুযোগ পাবে।”
নিহা ঠোঁট উলটে বলল,
-“আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি বকছেন।যাই হোক শান্ত শুনেন তো।আমাকে কেমন লাগছে?”
শেষাক্তো কথাটি নিহার লাজুক হেসে জিজ্ঞাসা করলো।শান্ত ভাবলেশহীন বলল,
-“যেমন লাগার তেমনই লাগছে।”
কথাটা শুনে নিহার ঠোঁট থেকে হাসি সরে গেল।তার আননে মন খারাপ এসে ভিড় করলো।এত কষ্ট করে তো এই মানুষটার জন্যই সে আজ শাড়ি পড়ছে।এই যে কালো রঙা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়েছে।শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো চুড়ি,কালো ঝুমকো পড়েছে।হালকা প্রসাধনী দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে।যেখানে কিনা নিহা সবসময় এই সাজগোছ থেকে দূরে রাখতো নিজেকে,এমনকি বড় হওয়ার পর কখনো সে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দেখেনি সে মেয়েটিই আজ প্রথম নিজেকে শাড়িতে জড়িয়েছে।শুধুমাত্র তো এই মানুষটার জন্যই।অথচ এই মানুষটা তার একটু প্রশংসাও করলো না?তবে কি নিহাকে ভালো দেখাচ্ছে না?নিহার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।মনে ভিড়লো চাপা রাগ,অভিমান, কষ্ট।অথচ নিহা যদি জানতো শান্তর চোখ নিহার দিক থেকে সরতেই চাইছে না তার জন্যই শান্ত নিজের উপর বিরক্ত তাহলে নিহা কি করতো?নিহার খুশিতে কি আত্মহারা হতো না?
নিহার মন খারাপ দেখে শান্তর কাছেও খারাপ লাগলো বটে। শান্ত বলল,
-“নিহা।”
নিহা শান্তর দিকে চোখ তুলে তাকালো।ছোট্ট করে সারা দিল,
-“হু।”
-“তোমাকে শাড়িতে আজ খুবই সুন্দর লাগছে।শুধুমাত্র বন্ধু হিসেবে বলেছি অন্যভাবে নিও না।”
কথাটা বলেই শান্ত সামনে এগিয়ে গেল রিকশা আনতে। আর এইদিকে নিহার পৃথিবী যেন দুলছে।শান্ত তার প্রশংসা করেছে?নিহা এই আনন্দ কিভাবে প্রকাশ করবে?নিহার মন চাইছে খুশিতে চিৎকার করে সবাইকে জানাতে,
-“এই তোমরা শুনেছো শান্ত ভাই বলেছে হ্যাঁ শান্ত ভাই বলেছে আমাকে নাকি শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে।শান্ত ভাই আমার প্রশংসা করেছে।শুনেছে সবাই?খুশিতে আমার যেন ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে।এতটা খুশি কেন লাগছে?”
নিহা যেন আনন্দের তোপে অন্যরাজ্যে প্রবেশ করেছে। এইদিকে যে রিকশায় বসে শান্ত সেই কখন থেকে তাকে ডেকে যাচ্ছে সেদিকে তার কোনো ধ্যান নেই।শান্ত শেষে বিরক্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে এলো।এরপর কিছু না বলেই নিহার হাত ধরে রিকশার কাছে নিয়ে গেল।এইদিকে শান্ত নিহার হাত ধরতেই নিহার হুস ফিরলো।নিহা একবার হাতের দিকে তো একবার শান্তর দিকে তাকালো।তার কোটর থেকে যেন চোখ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।নিহা অবাক হয়ে বলল,
-“কী হয়েছে?”
শান্ত রিকশার কাছে যেয়ে নিহার হাত ছেড়ে বলল,
-“সেই কখন থেকে চেঁচাচ্ছি।অথচ তোমার কোনো হুস নেই। উঠো রিকশায়।দেরি হয়ে যাচ্ছে।ফিরতে হবে আবার।”
নিহা বিনাবাক্যে রিকশায় উঠলো।নিহা উঠার পর শান্তও উঠলো।নিহার পাশে বসল।নিহা কেমন যেন লজ্জা পেল। এতদিনের পরিচয়ে এতটা কাছে কি তারা কখনো এসেছিল?এই যে রিকশার এইটুকুনি জায়গায় দুইজন বসছে।প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বাহন হচ্ছে রিকশা।কারণ তারা একে অপরের হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে কত সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে শহর পাড়ি দেয়।ইশ,নিহা যদি শান্তর প্রেমিকা হতো তবে এই জার্নিটা কতটাই না উপভোগ্য হতো।নিহা কতশত গল্প করতো।শান্তর কাঁধে মাথা রেখে পুরো শহরটা পাড়ি দিত।এই যে এই রিকশায় উঠে কি আর তাদের চুপচাপ সময় কাটাতে হতো? নিহার ভাবনার মাঝেই রিকশার ঝাকুনিতে নিহা কিছুটা সামনে হেলে পড়তেই শান্ত খপ করে নিহার হাত ধরে ফেলে। কপালে ভাজ ফেলে শুধায়,
-“কোন দুনিয়ায় থাকো?দুনিয়ার সব ভাবনা এখনোই ভাবতে হবে?ঠিক করে বসো নয়তো পড়ে যাবে।”
নিহা মাথা দুলালো।কিন্তু চুপ রইল।এইদিকে শান্ত নিহাকে সাবধান করেছে ঠিকই তবে নিহার হাতটা ছাড়ে নি।নিহার হাত ধরেই বসে আছে।এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই যদি পড়ে যায়?শান্তর দৃষ্টি রাস্তার দিকে।কিন্তু হাত নিহার হাতের আঙুলের ভাঁজে।আর এই দিকে নিহার দৃষ্টি হাতের ভাঁজের দিকে।সে শান্তর ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।তার বলতে ইচ্ছে করছে,
-“চলুন না শান্ত ভাই আজই আমরা একে অপরের নামে প্রেম নিবেদন করে ফেলি।”
কিন্তু নিহা বলতে পারলো না।কারণ শান্ত আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছিল সে বন্ধু হয়ে থাকতে চায়।নিহা যেন ভালোবাসা বাসি এসব কথা না বলে।তাই সেদিনের পর থেকে নিহা তার ভালোবাসাটা মনের মাঝেই পুষে রাখে।ঠোঁট ফুড়ে আর সে ভালোবাসা প্রকাশ করার সাহস পায় না।যদি শান্ত এই বন্ধুত্বটার ইতি ঘটিয়ে দেয় তখন?তাই নিহা আর সাহস করে না।থাক না তার ভালোবাসাটা বন্ধুরূপে।তাতে ক্ষ*তি কি?
#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।