#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_০৬
পরেরদিন ভোরে রোদেলাই প্রথমে ঘুম থেকে উঠলো। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলেও এটাই সত্যি।তাহসিনের আগেই রোদেলার ঘুম ভেঙে গেল।পাশে ফিরতেই তাহসিনকে দেখে রোদেলা নিশ্চুপে তাহসিনকে দেখতে লাগলো।চুল ছোট, ক্লিন সেইভ,চওড়া নাকের মানুষটাকে দেখতে বেশ দারুণ লাগে।মানুষটা জেগে থাকলে রোদেলা সরাসরি তাকাতে লজ্জা পায়।এভাবে দেখার সুযোগ হয় না।এখন ঘুমিয়ে আছে বিধায় মানুষটাকে সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে পারছে। তাহসিনের চিবুকে থাকা ছোট্ট খাঁজটা যেন তাহসিনের সৌর্ন্দর্য আরও ফুটিয়ে তুলেছে।রোদেলা তাহসিনের চিবুকে থাকা সেই খাঁজটার দিকেই তাকিয়ে আছে।এসব খাঁজ মেয়েদের থাকলে বেশি সুন্দর লাগে।অথচ একটা ছেলের সৌন্দর্যও যে বৃদ্ধি করতে পারে তা রোদেলার জানা ছিল না।রোদেলা আনমনে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে রইল।হঠাৎ করেই তার কর্ণগোচর হলো পুরুষালী কন্ঠের কিছু কথা,
-“ঘুমিয়ে আছি বলে আমাকে দেখার সুযোগ লুফে নিচ্ছো? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক কাজ না।এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখলেই তো পারো।আমি কি কিছু মনে করতাম নাকি?”
চোখ বন্ধ করেই তাহসিন কথাগুলো বলে উঠল।হঠাৎ তাহসিনের কথাগুলো শুনে রোদেলা ভড়কে গেল।তাহসিন তো ঘুমিয়ে ছিল তবে কি করে বুঝতে পারলো রোদেলা এতক্ষণ তাহসিনকে দেখছিল?মনের প্রশ্ন মনেই রেখে রোদেলা দ্রুত বিছানা ছাড়লো।অতঃপর ঘর ছাড়লো। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা যাবে না।নয়তো তাহসিন তাকে ভয়াবহ লজ্জায় ফেলবে।ফ্রেশ পরেও হওয়া যাবে। লোকটা রুম থেকে বের হলে তবেই সে রুমে যাবে।এটাই সে পণ করলো।
★
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে তাজউদ্দিন সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“কতদিনের ছুটিতে এসেছো?”
তাহসিন রুটি মুখে পুরতে পুরতে বলল,
-“এক সপ্তাহ।”
-“তাহলে এক কাজ করো বউমাকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে এসো।”
পাশ থেকে নাজমা বেগম বলে উঠলেন,
-“হ্যাঁ বাবা তোর বাবা ঠিকই বলেছে।মেয়েটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়।মেয়েটা বাসায় একা একা থাকতে থাকতে বোরিং হয়ে যাচ্ছে।ঘুরতে গেলে মেয়েটার মনটা ভালো থাকবে।”
পাশ থেকে রোদেলা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।কোনো কথা বলছে না।তাহসিন বলল,
-“হুম আমিও ভেবেছি এবার আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো?”
নাজমা বেগম বললেন,
-“সবাই মানে?”
-“সবাই মানে তুমি,বাবা,মায়মূন আর আমি সবাই মিলে যাবো।”
তাজউদ্দিন সাহেব বাঁধ সেধে বললেন,
-“না রে বাবা তা হবে না।আমার ছুটি হবে না।তোরা যা আনন্দ কর।তাতেই আমরা খুশি।আর এই বয়সে এসে এসব ঘুরতে মন চায় না।”
তাহসিন বলল,
-“বাবা তোমাকে তো আমি বলছিই তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।তোমার চাকরি করা লাগবে না।তাও কেন কথা শুনছো না?”
-“কাজ ছাড়া থাকতে পারি না যে বাবা।কি করবো বল?”
নাজমা বেগম বললেন,
-“শুন না বাবা।আমাদের কথা ছাড়।তোরা যা।রোদেলা মাকে নিয়ে তো তুই এই পর্যন্ত কোথাও যাস নি।আমরা সহ তো অনেক ঘুরেছি কিন্তু তুই তো ছিলিস না।তুই এবার মেয়েটাকে নিয়ে একা সময় কাটিয়ে আয়।”
রোদেলা বলল,
-“মা,বাবা তোমরা গেলে আমি অনেক খুশি হবো তোমরাও চলো না প্লিজ।”
-“না রে মা।আমাদের সাথে তো অনেক ঘুরলি।এবার না হয় তাহসিনের সাথে একটু ঘুরে আয়।”
-“কিন্তু…।”
-“কোনো কিন্তু না মা।যা বলেছি সেটাই কর।”
তাজউদ্দিন সাহেব তাহসিনের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তাহলে আগামীকালই রওনা হও।”
তাহসিন বলল,
-“হুম বাবা আগামীকালই রওনা হবো।”
নাজমা বেগম বললেন,
-“তাহলে আজ সন্ধ্যায়ই রোদেলাকে নিয়ে একটু বেরোস বাবা।ওর প্রয়োজনীয় কি কি লাগে সব কিনে দিস।ঘুরতে যাচ্ছিস।টুকটাক শপিং তো করতেই হবে তাই না?”
তাহসিন মাথা নেড়ে বলল,
-“হুম মা।”
★
সময়টা এখন রাত।খাওয়া-দাওয়া শেষে রোদেলা আর তাহসিন জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে।সন্ধ্যার পরেই তাহসিন রোদেলাকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়েছিল।প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হলো।তারপর খাওয়া-দাওয়া করে এখন লাগেজ গুছাতে শুরু করলো। আগামীকাল তারা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। ব্যাগ-পত্র গুছানোর পর তাহসিন বলল,
-“এখন ঘুমিয়ে পড়ো।সকাল সকাল উঠে আবার রেডি হয়ে আবার রওনা হতে হবে।”
রোদেলা বলল,
-“জানেন,আমার না স্বপ্ন ছিল কক্সবাজারে যাওয়ার।সমুদ্র দেখার।অবশেষে সে স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলেছে।”
তাহসিন ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
-“একে একে তোমার সকল স্বপ্ন আমি পূরণ করবো মায়মূন।সে দায়িত্ব আমার।”
★
পরের দিন সকাল সকাল রোদেলা আর তাহসিন বেরিয়ে পড়লো।তাহসিনকে নাজমা বেগম বারবার করে বলে দিয়েছেন রোদেলাকে যেন সবসময় দেখে রাখে।ওর খেয়াল রাখে যেন।রোদেলার হাত যেন না ছাড়ে।আর দুইজনেই যেন সাবধানে থাকে।তাহসিন মাকে আশ্বাস দিয়েছে রোদেলার খেয়াল রাখবে।মা যেন চিন্তা না করে।মা,বাবাকে বলে ওরা রওনা হয়।রোদেলা বাসে চড়তে পারে না।তাই ট্রেনে করেই যাবে।এই প্রথমবার রোদেলা ট্রেন জার্নি করবে। এইজন্য রোদেলা খুবই এক্সসাইটেড।ট্রেনের টিকিট তাহসিন অনলাইনেই কে*টে রেখেছিল।রোদেলা ট্রেনে উঠতে যেয়ে পড়নের শাড়ি পা থেকে সরে কিছুটা উপরে উঠে যায়। তাহসিন চট জলদি রোদেলার পিছু যেয়ে দাঁড়ায়।নিজের বলিষ্ঠ কায়া দিয়ে রোদেলাকে ঢাকার প্রয়াস।রোদেলা ট্রেনে উঠার পর তাহসিন উঠে।ওদের সিট খুঁজে বসে পড়ে।ট্রেনে আরও অনেক যাত্রী আছে।কেউ বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে।তো কেউ গল্প-গুজবে মত্ত আছে।মোট কথা যে যার মতো ব্যস্ত আছে।রোদেলা জানালার পাশের সিটে বসেছে। রোদেলার পাশের সিটেই বসেছে তাহসিন।আর তাদের বিপরীত দিকের দুই সিটে বসেছে দুটো মেয়ে।ওদের ডান পাশের দুই দিকের চারটে সিটে বসেছে ওই দুটো মেয়ের চারটে বন্ধু।ওদের এই ছয় জনের বন্ধুমহলকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তারা কোনো ফাংশনে যাচ্ছে।কারণ সকলের হাতে হাতে গানের সরঞ্জাম।ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে।অনেকে শেষ মুহুর্তে তাড়াহুড়ো করে উঠছে।ঝক ঝকা ঝক শব্দ তুলে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।ট্রেন ছাড়ার পর পরই ছয় জনের ওই বন্ধু মহলটা গান গাওয়া শুরু করেছে।কেউ গিটারের সুর তুলছে।কেউ গলা ছেড়ে গান গাচ্ছে।রোদেলা মুগ্ধ চোখে সেসব দেখছে।তাহসিন ফোনে কি যেন একটা কাজ করছিল।কাজ শেষে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলো রোদেলা ওদের গান কি সুন্দর মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর উপভোগ করছে।তাহসিনও বন্ধুমহলের গান শুনলো।ওদের কন্ঠ বেশ দারুণ।রোদেলা বলল,
-“কি দারুণ গান গাইছে তাই না?”
তাহসিন বলল,
-“হ্যাঁ।”
রোদেলা ওদিক আবারও মনোযোগ দিল।তাহসিনের কেন যেন মনে হলো রোদেলাও গান গাইতে চাইছে।তার সিক্সথ সেন্স বলছে।তাহসিন বলল,
-“গান গাইবে নাকি?”
রোদেলা মাথা দুই দিকে নাড়িয় বলল,
-“ধ্যাত না।”
-“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমিও গান গাইতে চাইছো?”
রোদেলা জানালার বাহিরে নজর দিল।ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে নজর ঘুরিয়ে নিল।তাহসিন রোদেলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
-“যদি আমি গিটার বাজাই,তবে কি গাইবে তুমি?”
রোদেলা তাহসিনের দিকে ফিরলো।অবাক হওয়ার কন্ঠে বলল,
-“আপনি গিটারে সুর তুলতে পারেন?”
-“হুম পারি।যদি তুমি গান গাও তবেই আমি গিটার বাজাবো।”
রোদেলা রাজি হলো।ততক্ষণে ওদের গান গাওয়া শেষ। তাহসিন ডান দিকে বসা ছেলেদের থেকে গিটার নিল। গিটারে টুংটাং করে শব্দ তুললো।পাশে রোদেলাকে ইশারা করলো।রোদেলা মিষ্টি কন্ঠে গান গাইতে শুরু করলো,
❝আজ এক নাম না জানা কোনো পাখি,
ডাক দিল ঠোঁটে নিয়ে খড়কুটো
আজ এলো কোন অজানা বিকেল
গান দিল গোধূলি এক মুঠো।
তুমি যাবে কি?বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে ডাকলো কেউ।
তুমি পাবে কি?পা পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ……।❞
রোদেলা তার সুরেলা কন্ঠে মনের আনন্দে পুরো গানটি গাইতে থাকলো।আর অন্যদিকে তাহসিন সহ বাকি সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনতে লাগলো।রোদেলার এই প্রতিভাটার কথা তাহসিনের জানা ছিল না।এত সুন্দর সুরেলা কন্ঠ যে রোদেলার আছে তা তাহসিনের অজানাই ছিল।গান শেষে সবাই হাতে তালি দিল।তাহসিন বলল,
-“বাহ!চমৎকার গান করো তো তুমি।আমি জানতাম না তো।”
রোদেলা বলল,
-“অনেক মাস পরে গান গাইলাম।আগে রোজ বান্ধুবীদের সাথে গাইতাম।”
ওই ছয় বন্ধু বলল,
-“বাহ।তোমার কন্ঠ সত্যিই দারুণ।”
রোদেলার গান শুনে যেন ওরা রোদেলার ফ্যান হয়ে গেল। এক কথায় দুই কথায় রোদেলার সাথে যেন ভান হয়ে গেল। বাকিটা সময় রোদেলা ওদের সাথে বেশ গল্প করতে করতে সময় কাটালো।তার প্রথমবারের ট্রেন জার্নিটা বেশ ভালো কাটলো।যা রোদেলা সারাজীবন মনে রাখবে।
#চলবে
#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_০৭
সময়টা এখন বিকেল।তাহসিন আর রোদেলা সমুদ্রের কাছে এসেছে।ওরা কক্সবাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে ছিল।এরপর আগে থেকেই বুকিং করে রাখা রিসোর্টে যেয়ে উঠে।অতঃপর শাওয়ার নিয়ে দুপুরের ভোজন সেরে রেস্ট নেয়।এখন বিকেল হতেই দুইজন রেডি হয়ে সমুদ্র পাড়ে আসে।তাহসিনের পড়নে হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট।হাতে সুন্দর একটা ওয়াচ।চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা।অন্যদিকে রোদেলার পড়নে স্কাই ব্লু কালারের শাড়ি। চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দেওয়া।সমুদ্র পাড়ে এই আকাশী রঙা শাড়ি পরিহিত মানবীকে বেশ দারুণ লাগছে।নীল সমুদ্র,নীল আকাশ সাথে এই নীল মানবী।সবটা মিলিয়ে দারুণ লাগছে।সমুদ্র পাড়ের হাওয়ায় রোদেলার চুল আর শাড়ির আঁচল সামলাতে বেগ পোহাতে হচ্ছে।রোদেলা চুলগুলো বারবার কানের পিঠে গুজে দিচ্ছে।দেখতে বেশ লাগছে।তাহসিন রোদেলাকে যত দেখছে ততই যেন মুগ্ধ হচ্ছে।চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে।নির্ঘাত রোদেলা লজ্জা পাবে তাই তাহসিন ভালো করে তাকাতেও পারছে না।তাহসিন বলল,
-“চলো সমুদ্রের কাছে যাই।”
রোদেলা বলল,
-“আমার ভয় লাগে।”
-“আমি আছি না?ভয় কিসের?”
এইটুকু কথাতে কি ছিল রোদেলার জানা নেই।তবে তাহসিনের এই কথাতে রোদেলা ভরসা পেল।তাহসিন রোদেলার দিকে হাত বাড়ালো।রোদেলা নিজের হাত এগিয়ে তাহসিনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের হাত রাখলো। অতঃপর দুইজন সমুদ্রের কাছে যেতে লাগলো।সমুদ্রের পানিতে পা ভেজালো।সময়টা তাদের অনেক ভালো কাটছে।রোদেলা এত সামনে থেকে সমুদ্র দেখতে পেয়ে তো দারুণ খুশি।তার খুশি আর একটু বাড়িয়ে দিতে হাওয়াই মিঠাই কিনে তাহসিন রোদেলার হাতে দিল।রোদেলা খুশিমনে খেতে লাগলো।তাহসিনকে সাধতেও ভুললো না। তবে তাহসিন এসব খায় না বিধায় নাকোচ করলো।এখানে আরও কত শত মানুষ আছে।সবাই সবার মতো আনন্দ করছে।সবাই ওদের মতো সমুদ্র দেখতে এসেছে।কেউ কেউ সমুদ্রের পানিতে গা ভেজাচ্ছে।রোদেলাও রোদেলার মতো আনন্দ করছে।এক হাতে হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে তো অপর হাত দিয়ে সামনে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিচ্ছে।আর তাহসিন এত সুন্দর মুহুর্তটা ঝটপট ক্যামেরা বন্দি করে নিল।রোদেলা টেরও পেল না তার মাহমুদ সাহেব তার অজান্তে তার কত সুন্দর ফটো ক্যাপচার করে নিয়েছে।
★
রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ওরা রিসোর্টে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে দুইজনে ঘুমাতে এলো।অনেকক্ষণ ধরে এপাশ-ওপাশ করে যখন কারো চোখেই ঘুম ধরা দিল না তখন তাহসিন বলল,
-“মায়মূন ঘুমিয়ে পড়েছো?”
রোদেলা ছোট্ট করে বলল,
-“না।ঘুম আসছে না।”
তাহসিন উঠে বসল।বলল,
-“চলো বারান্দায় যেয়ে বসি।”
রোদেলাও উঠে বসলো।শাড়ি ঠিক করে বিছানা থেকে নামলো।তারপর তাহসিনের পিছু পিছু বারান্দায় গেল। ওদের রুমের সাথে এই বারান্দাটা বেশ সুন্দর এবং খোলামেলা।ছোট্ট একটা ছাদের মতো বারান্দাটা।বারান্দায় এসে দাঁড়াতে হাওয়ায় রোদেলার চুল উড়তে থাকে।এত শীতল হাওয়া রোদেলার শরীরে হিম ধরিয়ে দেয়।এখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে সাথে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। রিসোর্টের কৃত্রিম আলোয় পুরো রিসোর্টটি আলোকিত হয়ে আছে।রাতের পরিবেশটা বেশ দারুণ লাগছে।এই মনোরম পরিবেশেই তাহসিন আবদার জুড়ে বসে।বলল,
-“একটা গান গাইবে মায়মূন?”
রোদেলা মাথা নাড়লো।মানে সে গাইবে।তাহসিন বারান্দার বেতের চেয়ারে যেয়ে বসলো।পাশে রোদেলাকেও বসতে বলল।রোদেলা যেয়ে বসলো।এরপর গান শুরু করলো,
-“Yeh raaten ye mausam,
nadi ka kinara yah chanchal hawya.
kaha di dilon ne
ke milkar kabi hum,na honge juda.
Yeh raaten yeh mausam
Nadi ka kinara yah chanchal hawya..”
রোদেলা চোখ বন্ধ করে সম্পূর্ণ গানটি গাইলো।আর তাহসিন মুগ্ধ চোখে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইল।গান শেষ হতেই তাহসিন বলল,
-“বাহ!চমৎকার।”
অথচ মনে মনে বলল,
-“বউ আমার রোমান্টিক গানও জানে।অথচ ভালোবাসাটাই জানে না।কবে যে ভালোবাসাটা বুঝবে কে জানে?”
★
সমুদ্র সৈকতে রোদেলা আর তাহসিনের তৃতীয় দিনের কথা। মাঝে দিয়ে গত হয়েছে একটিদিন।গতকাল ওরা ইনানী বিচ আর হিমছড়িতে যেয়ে ঘুরে এসেছিল।প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যে রোদেলা ক্ষণে ক্ষণে শুধু মুগ্ধই হয়েছে।ইনানী বিচের পাথুরে সৈকত আর হিমছড়িতে পাহাড় থেকে সমুদ্রের অসাধারণ ভিউতে রোদেলার চোখ যেন জুড়িয়ে এসেছে।আজ সকালে গিয়েছিল টেকনাফে।দুপুর অব্দি সেখানে ঘুরাঘুরি করে নিজেদের রিসোর্টে ফিরে এসেছে। এখন বিকেল।এখন দুইজনেই রেডি হচ্ছে কলাতলীর ওপাশটা ঘুরে দেখবে।রোদেলা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় তাহসিন ডেকে উঠল,
-“মায়মূন।”
রোদেলা পিছু মুড়ে তাকালো।তাহসিন বলল,
-“একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে?”
-“জ্বি বলুন।”
-“তুমি আজ পিংক কালার শাড়িটা পড়ো।”
রোদেলা ছোট্ট করে বলল,
-“আচ্ছা।”
রোদেলা তাহসিনের দিকে নজর বুলালো।তাহসিন আজ পিংক কালারের শার্ট পড়েছে।রোদেলা বুঝতে পারলো তাহসিন চাইছে দুইজনে এক রঙা পোশাক পড়তে।ব্যাপারটা ভেবে রোদেলা মুচকি হাসলো।রুমে এসে হাতের শাড়িটা লাগেজে রেখে লাগেজ থেকে গোলাপি রঙা শাড়ি সাথে শুভ্র রঙা ব্লাউজ নিল।কারণ গোলাপি রঙার সাথে শুভ্র রঙটাই বেশি মানায় সেটা রোদেলা জানে।রোদেলা ফের ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে শাড়িটা সুন্দর করে গায়ে জড়ালো।তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।মুখে সামান্য প্রসাধনী মেখে মোটা কাজল টানলো।ঠোঁটে গোলাপি রঙা লিপস্টিক লেপে দিল।অতঃপর নিজের চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে পিঠে ছড়িয়ে রাখলো।টানা ঝুমকো কানে লাগালো।হাতে মুঠো ভর্তি চুড়ি পড়লো।ব্যাস সে এখন রেডি।আর রোদেলার এই রেডি হওয়ার সম্পূর্ণ সময়টুকু তাহসিন বিছানায় বসে আড়চোখে দেখলো।যা রোদেলা টের পেলেও কিচ্ছু বলল না।রোদেলার রেডি হওয়া হলে তাহসিন সশব্দে বলে উঠল,
-“অপূর্ব।”
রোদেলা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।তাহসিন বলল,
-“চলুন ম্যাডাম।লেইট হচ্ছে।”
রোদেলা রুম থেকে বের হলো।তাহসিন যেতে যেতে আস্তে করে বলল,
-“এই নারীটি যেন শপথ করেছে তাহসিন মাহমুদকে ঘায়েল করেই ছাড়বে।নিজেকে কন্ট্রোল করা দায় হয়ে পড়ছে।”
★
গোধূলি বিকেলের আলোতে সমুদ্রের পানি কি সুন্দর চকচক করছে।দেখতে সুন্দর লাগছে।তাহসিন রোদেলাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে ঝিলমিলি বেলুন কিনে দিল।এরপর রোদেলার কয়েকটা ছবিও তুলে দিল।একটা ছেলেকে দিয়ে নিজেরদের কাপল পিক ক্যাপচার করালো।রোদেলার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে তাহসিন ক্যামেরার দিকে তাকালো আর রোদেলা আনমনেই তাহসিনের দিকে তাকালো।তখনই ছেলেটা ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিল।ছবিগুলো দারুণ উঠেছে।রোদেলা তাহসিনের হাতে ঝিলিমিলি বেলুন আর হাতে থাকা মোবাইলটা দিয়ে সে ঝিনুক কুড়াতে লাগলো। নুইয়ে ঝিনুক কুড়াতে নিলেই রোদেলার চুল তার টানা ঝুমকোতে আটকে গেল।রোদেলা তার থেকে চুল ছাড়াতে যেয়েও পারছে না।সেটা তাহসিনের খেয়াল হতেই তাহসিন এগিয়ে গেল।যেয়ে আলতো হাতে ঝুমকো থেকে চুল ছাড়িয়ে দিল।আর রোদেলা মুগ্ধ চোখে তাহসিনকে দেখতে লাগলো।এই মানুষটা এতটা কেয়ারিং কেন?দুল থেকে চুল ছাড়িয়ে তাহসিন বলল,
-“সাবধানে হ্যাঁ?”
রোদেলা মাথা একপাশে নেড়ে বলল,
-“ঠিক আছে।”
তাহসিন ফের আগের জায়গায় যেয়ে দাঁড়ালো।রোদেলা নিঃসংকোচে ঝিনুক কুড়াতে লাগলো।আর তাহসিন তখন রোদেলার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।বিয়ে করে নিজের মাঝে এতটা পরিবর্তনে তাহসিন নিজেই অবাক হচ্ছে।আগে এসব ছবি তোলা কিংবা কাউকে তুলে দেওয়া এসব বেশ বিরক্ত মনে হতো।অথচ তার বউকে নিয়ে এই সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসার পর সে যে কত শত ফটো ক্যাপচার করেছে তার কোনো হিসেব নেই।এমন না নিজের তুলেছে?সবই তার মায়মূনের তুলেছে।কিছু কিছু মায়মূনকে অবগতে আবার কিছু কিছু মায়মূনের অজান্তেই।মায়মূনের অজান্তে যেই ছবিগুলো তুলেছে সেসব দারুণ উঠেছে।কোনোটাতে তার মায়মূন সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাতে ভেজাতে হাসছে। কোনোটাতে আনমনে সমুদ্র দেখছে।অথবা ঝিনুক কুড়াচ্ছে কিংবা হাওয়াই মিঠাই খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে।আবার ইনানি বিচের শ্বেত পাথরে হাত বুলাচ্ছে কিংবা হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়া থেকে অবাক চোখে সমুদ্রের অসাধারণ ভিউ দেখছে। আর তাহসিন সেই সুযোগ গুলোই লুফে নিয়েছে।ফটাফট ফটো ক্যাপচার করে রেখেছে।যখন সে তার মায়মূনের থেকে দূরে থাকবে তখন এই পিকগুলো দেখে শান্তি মিলাবে।রোদেলা যখন ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত তখন তাহসিন মুগ্ধ চোখে রোদেলাকে দেখতে ব্যস্ত।তার দেখার ব্যাঘাত ঘটায় তার ফোন সশব্দে বেজে উঠে।তাহসিন বিরক্ত হয়ে ‘’চ’’ সূচক শব্দ করে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো।ফোনের স্ক্রিনে তার সিনিয়র অফিসারের নাম ভেসে উঠেছে।তাহসিন বুঝতে পারলো ইম্পর্ট্যান্ট কল এসেছে তাই সে রোদেলাকে ডাকলো,
-“মায়মূন।”
রোদেলা জবাবে বলল,
-“জ্বি।”
-“আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল এসেছে।কথা বলে আসছি। তুমি যেখানে আছো সেখানেই কিন্তু থাকবে।দূরে যাবে না। আমি এই সামনেই আছি।ঠিক আছে?”
রোদেলা বলল,
-“আচ্ছা।”
এপাশে একটু ভিড় দেখে তাহসিন ভিড় ছাড়িয়ে একটু সামনে নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে কল রিসিভ করে তার স্যারের সাথে কথা বলছিল।এইদিকে রোদেলা মনের আনন্দে ঝিনুক কুড়াচ্ছে।সবসময় ভিডিওতে দেখে এসেছে সমুদ্রের পাড়ে এত সুন্দর সুন্দর ঝিনুক থাকতে।আজ সে নিজের চোখে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারছে না।এই ঝিনুকগুলো সে বাসায় নিয়ে যাবে।তার রুমে নিয়ে সাজিয়ে রাখবে।তার বোন রুহিকেও দিবে।রুহি নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।অবশ্য সে রুহিসহ সবার জন্যই অনেক অনেক গিফট কিনেছে।নিজের জন্যও কিনেছে।তাহসিনই পছন্দ করে সব কিছু কিনে দিয়েছে।গত কাল ঘুরে এসে তারপর রাতে এখানকার দোকানগুলোতে ঘুরেছে আর যা যা পছন্দ হয়েছে কিনেছে।
প্রথমদিন এসেই অনেকগুলো ঝিনুক সে জমিয়েছে সেসব হোটেলে আছে।এখন এগুলোও নিয়ে যাবে।পরশু ওরা ফিরে যাবে।কক্সবাজারে আগামীকালই ওদের শেষ দিন। ঝিনুক কুড়ানো শেষে রোদেলার খেয়াল হলো তার শাড়ির নিচের দিকটা বালিতে ভরে গিয়েছে।এমনকি হাতে থাকা ঝিনুকগুলোতেও বালি আছে।সে ভাবলো সমুদ্রের পানি দিয়েই সে ধুয়ে নিবে।পিছু ঘুরে তাকালে দেখতে পেল তাহসিন কিছুটা দূরে গিয়ে তার দিকে পিঠ দিয়ে ফোনে কথা বলছে।রোদেলা ভাবলো শাড়ি আর ঝিনুকগুলো ধুয়ে সে তাহসিনের কাছে চলে যাবে।জুতো গুলো এখানেই খুলে রেখে গেল।কারণ আজকে সে হাই হিল পড়েছে।তাই সমুদ্রের নরম বালিতে এই জুতো ডেবে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।রোদেলার ভয় কেটে গিয়েছে এই দুইদিনেই।প্রথম দিনেই তাহসিন সমুদ্রের পানির কাছে নিয়ে তার ভয় কাটিয়ে দিয়েছে।তাই এখন আর একটুও ভয় করছে না। রোদেলা জুতো খুলে সমুদের পানির দিকে এগিয়ে গেল। সমুদ্রের পানিতে ঝিনুকগুলো সুন্দর করে ধুয়ে নিল।এরপর নিজের শাড়িটা ধুতে আর একটুখানি সামনে গেল।আর তখনই ঘটে গেল বিপত্তি।রোদেলা যেই মুহুর্তে একটু এগোলে শাড়ি ধুতে তখনই সমুদ্রের একটা ঢেউ আছড়ে পড়লো।রোদেলা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।পরপর দুটো উতাল ঢেউ এলো আর সে বেগ সামলাতে না পেরে ঢেউয়ের সাথে সাথে কিছুটা মাঝে চলে গেল।এখনও ঢেউ তাকে ততটা দূরেও নিতে পারে নি।সে পাড়ে আসতে চাইছে। কিন্তু একেতে তো শাড়ি পড়া আর দুইয়েতে সমুদ্রের উতাল ঢেউয়ের সাথে সে পেরে উঠছে না।সে যখন সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তেই কিছু মানুষ চেঁচিয়ে উঠল,
-“এই মেয়েটাকে কেউ বাঁচাও।ভেসে যাচ্ছে।ভেসে যাচ্ছে।”
মানুষের চেঁচামেচিতে তাহসিন এইদিক ঘুরলো।মুহুর্তেই মানুষের হালকা একটা ভিড় জমে গিয়েছে।তাহসিন মানুষের কথা শুনে আগে রোদেলার দাঁড়ানো জায়গাটিতে নজর দিল।আর দেখতে পেল সে জায়গাটি শূন্য।রোদেলার জুতো জোড়া পড়ে আছে কিন্তু রোদেলা নেই।তাহসিন দৌড়ে এলো।সমুদ্রের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তার মায়মূন সমুদ্রের ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।এটা দেখে তাহসিনের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল।তাহসিন চিৎকার দিয়ে উঠল,
-“মায়মূন।”
#চলবে