নীল বসন্ত পর্ব-৮+৯

0
1
নীলবসন্ত

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_০৮
সময়টা এখন রাত।ঘড়ির কাটা এগারোর ঘরে।বিছানার সফেদ চাদরে রোদেলা শুয়ে আছে।আর তাহসিন লাগেজ গোছাচ্ছে।রোদেলার সাথে কোনো কথাই বলছে না।রোদেলা কতবার চেষ্টা করলো কথা বলতে কিন্তু তাহসিন কথা বলছে না।রোদেলা শুয়ে সেই তখনকার কথা ভাবলো।

রোদেলা যখন সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে হাবুডুবু খেতে খেতে চোখেমুখে ঝাপসা দেখছে ঠিক তখনই সে দেখতে পেল তাহসিন জুতো খুলে শার্ট খুলতে খুলতে দ্রুত এসে সমুদ্রে ঝাপ দিল।যেহেতু আর্মি মানুষ সেহেতু সাঁতার হতে সব কিছুতেই পটু।তবুও সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তাল সামলানোর কথা না।সমুদ্রের পাড় থেকে লোকেরা দড়ি বাড়িয়ে দিয়েছিল।তাহসিন সেই দড়ি ধরে রোদেলাকে নিয়ে পাড়ে এলো।ভাগ্য ভালো ঢেউ রোদেলাকে ওতটাও দূরে নিতে পারে নি।নয়তো রোদেলা আজ বেঁচে ফিরতো কিনা সন্দেহ ছিল।তবুও ততক্ষণে সমুদ্রের অনেকটা পানিই তার পেটে চলে গিয়েছে।তাহসিন পাড়ে এসে রোদেলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।হাত-পা ঘষে দিতে লাগলো।রোদেলা একটুখানি ধাতস্থ হতেই তাহসিন এত লোকমাঝে রোদেলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে চুপ করে বসে রইল।যেন ছাড়লেই রোদেলা পাখির মতো উড়ে যাবে। রোদেলা তাহসিনের বুকে চুপটি করে পড়ে রইল।সে তাহসিনের হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বেশ শুনতে পাচ্ছে।তাহসিন যে মারাত্মক ভয় পেয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই।সমুদ্র পাড়ের থেকে তাহসিন রোদেলাকে কোলে করে নিয়ে রিসোর্টে ফিরেছে।এরপর রুমে এসে লাগেজ থেকে শুকনো জামাকাপড় রোদেলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বুঝালো রোদেলা যেন ফ্রেশ হয়ে নেয়।রোদেলা ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে তাহসিনের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। তাহসিনের চোখ পুরো লাল হয়ে আছে।রোদেলা চুপচাপ বিছানায় এসে বসলো।তাহসিন উঠে যেয়ে ভেজা পোশাক বদলে নিল।অতঃপর রোদেলাকে নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো।রোদেলার যাতে জ্বর না আসে তাই মেডিসিনের জন্যই গেল।এর মধ্যে একটাবারের জন্যও সে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলো না কিভাবে সে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে গিয়েছিল?একটাবারও জানতে চাইলো না সমুদ্রের এতটা কাছাকাছি কেন গিয়েছিল?যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল তখনই ডাক্তার রোদেলার কাছে জানতে চাইলো সমুদ্রের এতটা কাছে কেন গিয়েছে?তখন রোদেলা সবটা বলল।পাশে থাকা তাহসিন সবটাই শুনতে পেল।তবে কিচ্ছু বলল না।বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ঘনিয়েছিল। রোদেলাকে নিয়ে ডিনার করে এলো বাহিরে থেকে।এরপর মেডিসিন খাইয়ে রেস্ট নিতে দিল।এতটাসময় একটা বারের জন্যও তাহসিন রোদেলার সাথে কোনো প্রকার বাক্য ব্যয় করে নি।এমনকি রোদেলার দিকে তেমন তাকায়ও নি। রোদেলা দু’বার সরিও বলেছিল তাতেও কোনো কাজ হয় নি।এই যে তাহসিন এখন লাগেজ গোছাচ্ছে রোদেলা দু’বার জিজ্ঞেসও করেছে কেন লাগেজ গোছাচ্ছে?তাহসিন কোনো প্রকার রাও করে নি।যেন রোদেলার কথা তার কর্ণগোচর হয়ই নি।যেন এই রুমে সে ছাড়া আর কেউই নেই।নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে।রোদেলা তৃতীয় বারের মতো জিজ্ঞেস করলো,

-“লাগেজ গোছাচ্ছেন কেন?”

-“আগামীকাল সকালেই রওনা হচ্ছি।”
কাটকাট জবাব দিল তাহসিন।রোদেলা চুপ করে গেল।সে ভাবছে তার জন্যই এমনটা হলো।এখানে তারা চারদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল।তার এই ভুলের জন্যই এখন একদিন আগেই ফিরতে হবে।কত সুন্দর সময়ই না কাটছিল।অথচ তার একটু ভুলের জন্য কি হয়ে গেল?

সেদিন রাতে তাহসিন রোদেলার সাথে আর একটা কথাও বলে নি।বিছানার এক পাশে রোদেলার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়েছে।সে রাতে আর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে নি মুঠোতে পুরে ঘুমোতে।সারারাত রোদেলার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে ছিল।এমনকি পুরো ট্রেন জার্নির সময়টুকুতেও রোদেলার সাথে একটা কথাও বলে নি।বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়েছিল।ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে খেতে বিকেল শেষ। সন্ধ্যায় একটু রেস্ট নিয়ে তারপর তাহসিন তার মা-বাবাকে জানালো আজই সে ক্যান্টনমেন্টে চলে যাবে।যদিও সে এক সপ্তাহের ছুটিতে এসেছিল।কিন্তু জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় এখন যেতেই হবে।রোদেলা যখন এই খবরটা জানতে পারলো তখন রোদেলা ভেবেছে রোদেলার জন্যই তাহসিন চলে যাচ্ছে।তাই রোদেলা ভাবলো এই ব্যাপারটা নিয়ে তাহসিনের সাথে কথা বলা উচিত।তাহসিন তার এই একটা ভুলের জন্য গতকাল থেকে তার সাথে কথা বলছে না।তাকে এড়িয়ে চলছে।সেটা রোদেলার সহ্য হচ্ছে না।তাহসিনের সাথে কথা বলা অন্তত প্রয়োজন।

তাহসিন তখন রুমে।আর কিছুক্ষণ পরই রওনা হবে।রোদেলা রুমে গিয়ে দরজা আটকালো।ভেতরে ঢুকে দেখলো তাহসিন রেডি হচ্ছে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াচ্ছে।রোদেলা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বলল,

-“আমার জন্যই কি আপনি চলে যাচ্ছেন?”

তাহসিন কিছু বলল না।রোদেলার এবার কাঁদতে ইচ্ছে করলো।সাথে রাগও উঠল।এই মানুষটা শুধু শুধু কেন তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে?রোদেলা রাগ করে বলে উঠল,
-“সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে গেলেই ভালো হতো।কেন শুধু শুধু আমাকে বাঁচিয়েছেন?”

এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাহসিন ধমক দিয়ে উঠল। বলল,
-“আর একটা বাজে কথা বলবে একদম জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো বেয়াদব।”

তাহসিনের ধমকে রোদেলা কেঁপে উঠল।ধমক দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না সে এগিয়ে এসে রোদেলার কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে বলল,
-“কে বলেছিল পাকামি করে সমুদ্রের কাছে যেতে?তোমাকে আমি বলি নি সমুদ্রের কাছে যাবে না?যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানেই থাকবে?কোথাও যাবে না।বলি নি আমি? বলো বলি নি?”

থেমে,
-“পাঁচটা মিনিট।মাত্র পাঁচটা মিনিটের জন্য একটু দূরে গিয়েছিলাম।আর এই সময়টুকুর মধ্যে কত বড় অঘটন ঘড়িয়ে ফেলেছো।তুমি ভাবতে পারছো ঢেউয়ের সাথে অনেকটা দূরে চলে গেলে কি হতো?ভাবতে পারছো তুমি? তোমার কি উচিত ছিল না আমার জন্য অপেক্ষা করা? আমাকে বললে কি আমি তোমাকে নিয়ে যেতাম না হ্যাঁ?”

রোদেলা মাথা নিচু করে ফেললো।চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।তাহসিন ফের ধমকে উঠল,
-“আমার সামনে একদম কান্না করবে না বলে দিলাম।”

তাহসিন রোদেলাকে ছেড়ে বিছানায় যেয়ে বসলো।তারপর মাথা চেপে ধরে জোরে বার কয়েক শ্বাস টানলো। নিজেকে শান্ত করতে চাইছে।কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,
-“গতকাল আমার সিনিয়র অফিসার ফোন করেছিলেন। তার সাথেই তো কথা বলতে গিয়েছিলাম।সপ্তাহ খানিকের ছুটি নিয়ে আসলেও হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় আজই রওনা হতে হবে।এইজন্যই এখনই রওনা দিব। আগামীকাল ভোর থেকে কাজে জয়েন হতে হবে।”

রোদেলা দাঁড়িয়ে এখনও নিঃশব্দে কান্না করছে।তাহসিন উঠে রোদেলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।এরপর হাত বাড়িয়ে রোদেলা মাথা আলতো করে নিজের বুকে চেপে ধরলো। বলল,
-“সরি।মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই রাগ সামলাতে পারি নি।”

রোদেলা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
-“আমি বুঝতে পারি নি এমন কিছু হতে পারে।”

-“হুম হয়েছে।যা হয়েছে ভুলে যাও।আর সামনে থেকে কিছু করার আগে ভালো করে ভেবে তারপর ওই কাজ করবে। মনে থাকবে?”

-“হুম।”

-“আমার এখন রওনা হতে হবে।নিজের খেয়াল রেখো।আর ভর্তি কবে?কোন কলেজে ভর্তি হতে চাও।সবটা জানিও।”

তাহসিন রোদেলাকে ছেড়ে দিল।রোদেলা কান্না চোখে তাহসিনের চোখের দিকে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,
-“আপনাকে খুব মিস করবো আমি।”

রোদেলার কথাটা শুনতে পেয়ে তাহসিন রোদেলার দিকে তাকালো।এরপর হুট করে রোদেলার কপাল টেনে নিয়ে কপালে শব্দ করে গাঢ় একটা চুমু খেল।এরপর ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হতে হতে বলল,
-“আসছি।”

রাত হয়তো এখন এগারোটা বাজে।তাহসিন এখনই রওনা হলো।রোদেলা আর রুম থেকে বের হলো না।তাহসিন রুম থেকে যাওয়ার পর কান্না করলো।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল ভেজা চোখে।দেখতে পেল তার স্বামী নামক মানুষটা বাড়ির গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।মা আর বাবা তাকে গেইট অব্দি এগিয়ে দিচ্ছে।তাহসিন চোখের আড়াল হতেই রোদেলা বিছানায় এসে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।সে জানে এই মানুষটা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে খুবই খুশি থাকে, ভালো থাকে।এমন নয় যে মানুষটার মা,বাবা তাকে ভালো রাখে না।উনারা যথেষ্ট ভালো।উনারা রোদেলাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন।কিন্তু তবুও কেন জানি এই মানুষটা সান্নিধ্যে থাকলে রোদেলা অকারণে খুশি থাকে।এই যে মানুষটা দূর শহরে চলে গেল।এখন এই মানুষটার সাথে না চাইতেও তার রাগ হবে,অভিমান জমবে।অভিমানের সাথে দূরত্বও বেড়ে চলবে।রোদেলার রাত কাটবে চোখের অশ্রু দিয়ে বালিশ ভিজেয়ে হাহ।

তাহসিন চলে যাওয়ার চারটেদিন কেটে গিয়েছে।যেদিন চলে গিয়েছে সেদিন রাতে বাসে থাকা অবস্থায় রোদেলাকে ফোন করেছিল।অনেকটা সময় কথা বলেছে।সে রাতে রোদেলার খারাপ লেগেছিল তবে যখন তাহসিন তাকে ফোন করেছে অনেকটা সময় ফোনে কথা বলেছে তখন আর খারাপ লাগে নি।সে রাতে রোদেলা তাহসিনের সাথে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু এই তিনরাত তাহসিন সময় পায় না ফোন করার।সেই আগের মতোই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে।আর রোদেলা সারাক্ষণ তাহসিনের ফোনের অপেক্ষায় থাকে।এই চার দিনে তার শুধু তাহসিনের কথাই মনে পড়ে।যে পাঁচটেদিন তাহসিন তার কাছে ছিল সময় কতই না সুন্দর ভাবে কেটে গিয়েছিল।অথচ এই চারটে দিন যেন চার যুগের মতো কাটছে।রোদেলা নিজের খেয়াল অব্দি রাখছে না।সারাক্ষণই কেমন উদাস হয়ে থাকে।এইতো আজ রাতেও সে অপেক্ষায় আছে তাহসিন কল দিবে।কথা হবে। কিন্তু না।অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পরও যখন তাহসিন কল দিল না।তখন সে কান্না করে দিল।ইদানীং হুটহাটই তার কান্না পাচ্ছে।কিছুক্ষণ পরই পরই ভাবছে তিন আগেও তো তাহসিন তার কাছে ছিল। তাকে কতভাবেই না লজ্জায় ফেলতো।আবার তার খেয়াল রাখতো।সমুদ্র সৈকতে যেয়ে কত সুন্দর সময়ই না কেটেছিল।সেসব মনে করে সে দুঃখ পায়।তাহসিনকে বেশ মিস করে।তখন মনে হয় তাহসিনের কাছে ছুট্টে চলে যেতে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব?তাহসিন কাছে থাকলে কেমন যেন কেয়ারিং হাসবেন্ড হয়ে যায়।তখন যেন মানুষটা রোদেলাকে ছাড়া কিচ্ছুই বুঝে না।অথচ দূরে গেলেই ভুলে যায়? রোদেলার কথা কি তার একটুও মনে পড়ে না?তাহসিনের প্রতি রোদেলার বেশ অভিমান জমে।দূরে গেলে মানুষটা বদলে যায় কেন?আবার ভাবে তাহসিন তো একজন দায়িত্ববান মেজর।তার কত দায়িত্ব আছে।সেসব তো আগে পালন করতে হবে।দেশই তো আসল।দেশের কাছে পরিবার কিছু নাকি?এসব বলেও নিজেকে বুঝায়।নিজের মন মাঝে মাঝে বুঝে আবার মাঝে মাঝে অবুঝ হয়ে যায়।সবসময় কি মনকে মর্জি মতো চালানো যায়?রোদেলা সেসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। উঠে যেয়ে ডায়েরি হাতে নিয়ে বসলো। ডায়েরিতে গুটিগুটি অক্ষরে লিখলো,

-“জনাব,
আমার এই চক্ষু জোড়া সারাটাক্ষন আপনারে খুঁজিয়া বেড়ায়।আপনারে দেখিয়া তাহারা তাহাদের তৃষ্ণা মিটাইবার চায়।যদিও আপনারে দেখিবার তৃষ্ণা ইহজীবনেও মিটবে না।তবুও আপনারে দেখিয়া এই চক্ষু জোড়া শান্তি মিলাইবার চায়।”

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_০৯
আরও কিছুদিন বাদের কথা।রোদেলা আনমনে তরকারি কা*টছিল।অন্যমনস্ক থাকায় হাতটা কে*টে ফেলল।নাজমা বেগম চুলায় তখন মাছ ভাজছিলেন।রোদেলার এই কান্ড দেখে চুলা অফ করে ছুটে এলেন।ব*টি দূরে সরিয়ে রোদেলাকে নিয়ে হলরুমে বসালেন।তারপর মেকী ধমক দিয়ে বললেন,

-“মন কোথায় থাকে তোর?দেখলি তো হাতটা কিভাবে কে*টে গেল?ইয়া আল্লাহ।আমি এইজন্যই তোকে বলেছি কাজ করা লাগবে না।তাও তোর কাজ করা চাই।”

রোদেলা বলল,
-“মা এতটা ঘাবড়িয়ো না।ঠিক হয়ে যাবে।”

-“কিচ্ছু ঠিক হবে না।তুই বোস।আমি আসছি।”

নাজমা বেগম ঘর থেকে যেয়ে হেক্সিসল আর সাথে তুলা নিয়ে আসলেন।এসে রোদেলার হাতে খুব যত্ন করে লাগিয়ে দিলেন।রোদেলা দেখলো হাত কে*টেছে তার অথচ মা কষ্ট পাচ্ছে।এটাই বুঝি মা?রোদেলার যে আক্ষেপ ছিল সে আক্ষেপ তার শাশুড়ী মাকে পেয়ে মিটে গিয়েছে।মেয়ের মতো আগলে রাখেন তিনি।রোদেলা ধন্য এমন শ্বশুড়-শাশুড়ি পেয়ে।

ডানহাতটাই কা*টা গেল।যার জন্য নাজমা বেগম নিজ হাতে রোদেলাকে খাইয়ে দিলেন।সন্ধ্যার এক ফাঁকে ছেলে যখন কল দিল তখন ছেলেকে এক গাদা বকা শুনালেন।মেয়েটার কষ্ট তো দেখছেন তিনি।ছেলেটা কি পারে না মেয়েটাকে একটু সময় দিতে?কিন্তু তাহসিন কি করে তার মাকে বুঝাবে তাহসিন কতটা ব্যস্ত থাকে।খাওয়ার সময়টুকু অব্দি পায় না।যখন তার একটু সময় হয় তখন রোদেলার ঘুমানোর সময়।ওত রাতে ফোনে কথা বলা যায় নাকি?তারপরেও তো দুই দিন যা-ই কল দিয়েছিল।হাতে গুনে মিনিট দুয়েক কথা বলতো।এতটা অল্প সময় রোদেলা মানতে চায় না। রোদেলার যে কত কথা জমে থাকতো।সেসব কি এই দুই মিনিটে শেষ করা সম্ভব?তাই তো গত কয়টা দিন তাহসিনের সাথে অভিমান করে তাহসিনের ফোনই ধরে না।আর তাহসিনের কাজের চাপ থাকায় রোদেলার অভিমান ভাঙাতে পারে না।তার কিচ্ছুই করার নেই।রোদেলার বুঝতে হবে।সে যদি এসব না বুঝে তাহলে তাহসিনের আর কি করার আছে?এখানে তাহসিনের দোষ কোথায়?নাজমা বেগম কারোই দোষ-গুন হিসেব করতে চান না।শুধু তিনি বেশ বুঝতে পারছেন এভাবে ওরা দুইজন দুইজনের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।এভাবে কি আদৌ সংসার হবে?বিয়ের চারদিনের মাথায় ছেলে কর্মস্থলে গিয়েছে।এরপর তিন মাস পর যা-ই এসেছিল।পাঁচদিনের মাথায় আবার চলে গিয়েছে। এরপর থেকে ওদের ঠিক করে কথাও হয় না।এইদিকে রোদেলাও সারাক্ষণ মুখ বেজার করে থাকে।ঠোঁটে টেনেটুনে হাসি আনে।মেয়েটা যে ভালো নেই সেটা নাজমা বেগম বেশ ভালোই বুঝতে পারেন।আর কত এভাবে চলবে?দেখতে দেখতে তো মাস পেরিয়ে গেল।ছেলে যে দীর্ঘ সময়ের আগে বাড়ি ফিরতে পারবে না তা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। তাই বলে মেয়েটাকে তো দুঃখে রাখতে পারেন না। মান-অভিমানের পাল্লা ছেলে আর ছেলে-বউয়ের মাঝে বেড়েই চলেছে।এটা আর কমার নয়।উনারই কিছু একটা করতে হবে।তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।তাজউদ্দীন সাহেব বাসায় ফিরতেই বললেন,

-“শুনো আমার মনে হয় বউমাকে তাহসিনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।বউমার ওর কাছে থাকাই উচিত।নইলে দিনদিন ওদের মাঝে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে,এ দূরত্ব যে আর মেটার নয়।”

তাজউদ্দীন সাহেব বললেন,
-“কিন্তু তোমার ছেলে কি তা মেনে নিবে?তাকে তো আগে জানাতে হবে।”

-“না জানানো যাবে না।জানালেই নাকোচ করবে।তুমি না জানিয়েই বউমাকে নিয়ে দিয়ে আসবে।তারপর আমিও দেখবো বউমাকে তার কাছে না রেখে কোথায় যায়।এত বড় একটা কোয়ার্টারে সে তো একাই থাকে।বউমা গেলে নিশ্চয়ই থাকার কষ্ট হবে না তাই না?বরং ওদের মাঝে দূরত্ব কমবে।মেয়েটা সারাক্ষণ মন ম*রা হয়ে থাকে।ওকে এমন দেখতে যে আমার ভালো লাগে না।মেয়েটার বয়স কম।এই সময়টা তো স্বামীর কাছাকাছি ঘুরঘুর করার সময়।অথচ দেখো বিয়ের চার দিনের মাথাতেই স্বামী দূরে চলে গিয়েছে। এরপর কয়েক মাস পরে এসেছে।ফের পাঁচদিনের মাথায় চলে গিয়েছে।এইদিকে ওদের ঠিক মতো কথাও হয় না। এভাবে আর কদ্দিন বলো?নেহাৎ মেয়েটা ভালো বলে কিচ্ছুটি বলছে না।অন্য কোনো মেয়ে হলে তোমার ছেলের এই কান্ড সহ্য করতো না হুহ?আমি বাপু কিছু জানি না।তুমি আগামীকালই মেয়েটাকে তাহসিনের কাছে রেখে আসবে।”

-“তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।ঠিক আছে তবে তুমি বউমাকে আজই জানিয়ে দাও।গোছগাছেরও তো ব্যাপার আছে তাই না?”

-“হুম।আমি এখনই যাচ্ছি।”

নাজমা বেগম রোদেলাকে যেয়ে জানায় সবটা।রোদেলাকে ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে বলেন।ওর শ্বশুড়ের সাথে সকালেই রওনা হবে।রোদেলা নাকোচ করে।সে এখানেই থাকবে।তার শ্বশুড়-শাশুড়ির সাথেই থাকবে।উনাদের ছেড়ে দূরে যাবে না।কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদ অনেক বুঝিয়ে রোদেলাকে রাজি করায়।রোদেলার বাবাকেও জানিয়ে রাখে আগামীকালই রোদেলা চট্রগ্রামে চলে যাবে।রোদেলার বাবা জানান আগামীকাল সকালের দিকেই এসে মেয়ের সাথে একবার দেখা করে যাবেন।রোদেলা তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয় সাথে নেয় উপন্যাসের বইগুলোও।আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। কারণ যেহেতু চট্রগ্রামে সিফট হচ্ছে সেহেতু সেখানেই কলেজে ভর্তি হতে হবে।

তখন অনেক রাত।খাওয়া-দাওয়া শেষে রোদেলা নিজের রুমে এসে ডায়েরিটা নিয়ে বসেছে সবে।এতদিনে টুকটাক অনেক লেখাই লিখেছে।আজও লেখতে বসল।ডায়েরির সাদা পাতায় কলমের আঁচড় কাটলো।লিখতে থাকলো,

-“মাহমুদ সাহেব,
আগামীকাল আপনার সাথে দেখা হচ্ছে।আচ্ছা আমাকে দেখার পর আপনার কেমন অনুভূতি হবে?আমাকে দেখে আপনি কি চমকে যাবেন না?আপনার ভালো লাগবে নাকি জেদ উঠবে?আপনি কি খুশি হবেন না?তবে যা-ই বলুন আমি কিন্তু অনেক খুশি হবো।যদিও প্রথমে ভেবেছিলাম যাবো না কারণ মা আর বাবাকে ছাড়া কি করে থাকবো? পরে আবার আপনাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।আর এখানে আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।রাত হলে বেশ ভয়ও লাগে।তাই রাজি হয়ে গেলাম।আর মা-বাবা যেহেতু এতটা জোর করলেন তাই উনাদের কথার উপর আর কিছু বলতে পারলাম না।সকাল হওয়ার অপেক্ষা।তারপরই প্রায় এক মাস পর আপনার সাথে দেখা হতে চলেছে।আমি তো খুব খুশি।আর আপনি?”

রোদেলা লেখা শেষ করে ডায়েরিটাও ব্যাগ পুরে রাখলো। ব্যাস,ব্যাগ গুছানো শেষ,এবার শুধু যাওয়ার পালা।

পরেরদিন সকাল সকাল রোদেলার বাবা আর তার ছোট বোনটা রোদেলাকে বিদায় জানাতে এলো।যাওয়ার পূর্বে রোদেলা নাজমা বেগমকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল।এই মানুষটা তাকে মায়ের মতো এতটা দিন স্নেহ দিয়েছেন, ভালোবেসেন।এই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে তার খুব কষ্ট হবে যে।একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রোদেলা তার শ্বশুড়ের সাথে চললো তার জনাবের কাছে।এবার দেখার পালা তার জনাব তাকে দেখে খুশি হয় নাকি দুটো ধমক লাগায়।

তাহসিন থাকে চট্রগ্রাম ক্যান্টমেন্টে।সেখানেরই একদম শেষ প্রান্তের কোয়ার্টারে থাকে সে।অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা।তার কর্মস্থল থেকেই কোয়ার্টারটা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাকেই না।তাদের সেনাপ্রধানের সকলের জন্য থাকার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়।মেজর তাহসিন মাহমুদের কোয়ার্টারটা ছিল সেনানিবাসের দোতলা ভবনের উপরের তলায়।দুটো বড় বড় রুম।একটা রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাও আছে।দোতলা এই ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোনার ঘরটাই মেজর তাহসিন মাহমুদের।

অনেক জার্নি করে অবশেষে তাজউদ্দিন আর রোদেলা চট্রগ্রামে এসে পৌঁছান।আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে যায়। উনারা একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের ভোজন সেরে নেন। এরপর রোদেলাকে নিয়ে তাহসিনের কোয়ার্টারের কাছাকাছি এসে তাহসিনকে ফোন দিলেন।এই সময়ে ছেলে ক্যাম্পে আছে সেটা তিনি ভালো করেই জানেন।তাই তো তিনি তাহসিনের কোয়ার্টারের কাছাকাছি এসে তাহসিনকে ফোন করেন।জানান তিনি এসেছেন সে যেন দেখা করে। তাহসিন অল্পকিছুক্ষণের জন্য ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিয়ে আসে।আর এসে যখন রোদেলাকেও দেখে তখন সে যেন আকাশ থেকে পড়ে।হুট করে তার বাবা আর বউয়ের আগমন তার বোধগম্য হলো না।এইদিকে প্রায় এক মাস পর পর তাহসিনকে দেখে রোদেলা ভিতর ভিতর আনন্দে লাফিয়ে উঠে।তবে ভয়ে কিছুটা গুটিয়েও যায়।মনে পড়ে এতদিন কি করে তাহসিনকে সে ইগনোর করতো,সুযোগ পেয়ে দুইদিন তাহসিনকে কথাও শুনিয়ে দিয়েছিল।এরপর তো অভিমান করে আর কথাই বলে নি।সেসব ভেবেই যেন এখন লজ্জা লাগছে।তাহসিন একবার রোদেলার দিকে তাকিয়ে তারপর তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“তোমরা হঠাৎ এলে যে?”

তাজউদ্দিন মাহমুদ গম্ভীর গলায় বললেন,
-“বউমাকে দিতে এসেছি।”

তাহসিন ভ্রু কুচকে বলল,
-“মানে?”

-“মানে আর কি?বউমা এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবে। ওকে এখানেই কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবে।”

-“কিসব বলছো বাবা?এটা আমার কর্মস্থল ভুলে গেলে? আর জানো না এখানে কতটা রিস্ক নিয়ে থাকতে হয়?এতটা রিস্ক নিয়ে ওকে এখানে রাখবো মানে?আমি তো ঠিক মতো বাসায়ও থাকি না।ও তখন কোথায় থাকবে বলো?”

-“কেন তোমার বাসায়?ঠিক মতো বাসায় থাকো না কিন্তু রাতে তো অন্তত বাসায় ফিরো তাই না?তখন তো একবার হলেও মেয়েটা তোমাকে দেখতে পারবে।কথা বলতে পারবে। এভাবে সংসার হয় না।মেয়েটা আমাদের চোখের সামনে মন খারাপ করে থাকে সেসব দেখতে ভালো লাগে না।এত কথা বুঝি না তুমি ওকে তোমার কাছেই রাখবে।আমার জানা মতে তুমি আগে থেকেই ফ্যামিলি থাকার রেজিষ্ট্রেশন করে রেখেছিলে এমনকি বিয়ের পর পর স্ত্রীর নামও অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলে।কি ভুল বলেছি কিছু?”

-“না বাবা।”

-“তাহলে তো আর সমস্যা থাকার কথা না।যাই হোক,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।ফিরতি ট্রেনে আবার ফিরতে হবে আমায়।”

-“বাবা শুনো।”

-“আর কোনো কথা না।যা বলেছি তা-ই।”

ছেলেকে আর কিছু বলার মতো সুযোগ অব্দি দিলেন না। তাজউদ্দিন সাহেব রোদেলার মাথায় স্নেহমাখা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“ঠিক ঠাক মতো থাকিস মা।নিজের খেয়াল রাখিস।আর মন খারাপ হলেই আমাদেরকে ফোন দিবি।আমাদের সাথে কথা বললে তোর মন এমনি ভালো হয়ে যাবে।আসি রে।”

রোদেলা বলল,
-“বাবা দোয়া করবেন।আপনি আপনার ঔষধগুলো ঠিক মতো খাবেন।মাকেও দেখে রাখবেন।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে মা।চিন্তা করিস না।”

ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“ওকে নিয়ে বাসায় যাও।আসছি আমি।”

তাজউদ্দিন সাহেব আর দাঁড়ালেন না।জিড়োলেনও না।চলে গেলেন।এইদিকে তাহসিন একবার রোদেলার দিকে তাকালো।তারপর গমগমে কন্ঠে বলল,
-“এসো।”

রোদেলা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তাহসিন কি রাগ করলো নাকি খুশি হলো?তাহসিনের মুখাবয়ব দেখে ঠিক আঁচ করা যাচ্ছে না।রোদেলাকে তাহসিন কোয়ার্টারে নিয়ে গেল।কোয়ার্টারে এনে রোদেলাকে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে তারপর সে আবার তার কর্মে ফিরে গেল।তার হাতে যে বেশি সময় নেই।এইদিকে রোদেলা তার ব্যাগ থেকে জামাকাপড় গুলো বের করে তাহসিনের ওয়ারড্রবে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো।তাহসিন বেশ পরিচ্ছন্ন মানুষ সেটা তার রুম দেখেই বুঝা যাচ্ছে।একা মানুষ থাকে তবুও কি সুন্দর করে পুরো রুম খানা ক্লিন করে রেখেছে।তবুও রোদেলার হাতে কোনো কাজ নেই বিধায় রুমটা আরও ভালো করে গুছিয়ে নিল।একদম পরিপাটি করে রাখলো। পুরো দুইরুম,রান্নাঘর,বারান্দা হতে সবটা নিজের হাতে সুন্দর করে সাজালো।তারপর রান্নাঘরে যেয়ে ভাত বসিয়ে দিয়ে তরকারি কা*টতে লাগলো।শুনেছে তাহসিন দুপুরের খাবার বাহিরে খেয়েছে।হয়তো রাতে বাসায় ফিরে রান্না করতো।কিন্তু এখন যেহেতু রোদেলা আছে তাই কোনো চিন্তা নেই।রোদেলাই কাজ সব এগিয়ে রাখলো।বিয়ের আগের থেকেই সে রান্নায় একদম পাকা।তাই কোনো ঝামেলাই হলো না।রান্নাবান্না করতে শুরু করে দিল।সবকিছু শেষ করতে করতে রাত হলো।হাতের সব কাজ শেষ করে লম্বা একটা শাওয়ার দিল।এরপর বেগুনি রঙা একটা শাড়ি জড়ালো গায়ে।তার এখনো সেদিনের কথা মনে আছে যেদিন তাহসিন তাকে বলেছিল তাহসিনের সামনে যেন সে শাড়ি পড়ে থাকে।শাড়িতে রোদেলাকে নাকি বেশ সুন্দর লাগে।সে কথা ভেবেই রোদেলা মুচকি হাসলো।তাহসিনের বলা কথার পর থেকে রোদেলা সবসময় শাড়ি পড়ে শাড়িতে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে সে কথা কি তাহসিন জানে? উহু জানে না।জানবে কি করে?রোদেলা তো জানায়ই নি। সে যাই হোক।রোদেলা বেগুনি রঙা শাড়ি পড়ে তার সাথে সাদা রঙা ব্লাউজ পড়লো।এরপর চোখে মোটা কাজল টানলো।আর ঠোঁটে লিপবামের আস্তরণ দিল।চুল ভেজা তাই আঁচড়ে চুলগুলো খোলাই রাখলো।এরপর তাহসিনের জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগলো।তাহসিনের রুমের বারান্দায় দাঁড়ালে ছোট্ট খনন করা একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছে।যেটার চারপাশ সুন্দর করে বাঁধানো।যেখানে পদ্মফুলের পাতা আছে।বুঝাই যাচ্ছে এখানে পদ্ম ফোটে। এখন তো পদ্ম ফুলের সিজন নয়।বর্ষা থেকে শরতে পানি টইটম্বুর হয়ে থাকে আর ফোটে অসংখ্য পদ্ম।পদ্মশূন্য জলাশয়টাতে কি সুন্দর করে চাঁদ তার রুপোলী আলো ছড়াচ্ছে।এক অন্যরকম সুন্দর লাগছে।চাঁদের আলোয় জলাশয়ের পানি ঝলমল করছে।চাঁদের ছায়া পানিতে পড়ছে।বেশ দারুণ লাগছে।রোদেলা সেটাই মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো।

হঠাৎ কারো কাশির আওয়াজ পেতেই রোদেলা ধড়ফড়িয়ে উঠে পিছু ঘুরলো।আর দেখতে পেল তাহসিন আড়াআড়ি ভাবে বুকে হাত গুজে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা বুকে থু থু দিয়ে বলল,

-“আ..আপনি কি করে এলেন?”

কোনো ভনিতা ছাড়াই তাহসিন জবাব দিল,
-“ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে।তো এতটা মনোযোগ দিয়ে কি দেখছিলে?”

-“ওই তো পদ্মবিলের উপরের চাঁদের ঝলমলে আলো।”

তাহসিন বারান্দার বাহিরে দৃষ্টি দিল।দেখতে পেল আসলেই বেশ সুন্দর লাগছে।এতদিন এই সৌন্দর্যটা খেয়াল করা হয় নি।অথচ আজ রোদেলার জন্যই তা চোখে পড়ল।তাহসিন বলল,
-“ডিনার করেছো?”

রোদেলা দুই দিকে মাথা নাড়লো।যার অর্থ না।তাহসিন বলল,
-“এতক্ষণ না খেয়ে অপেক্ষা করছিলে কেন?আমার ফিরতে ফিরতে অনেক লেইট হয়।আর কখনো যেন এমনটা না হয় মাথায় রেখো।চলো ডিনার করবে।”

রোদেলা রান্নাঘরের দিকে গেল।খাবার টেবিলে এনে রাখলো।তাহসিন ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসলো।রোদেলাও বসলো।তাহসিন খেতে খেতে বলল,
-“বাহ!তোমার রান্নার হাত দেখছি খুবই ভালো।”

রোদেলা আস্তে করে বলল,
-“ধন্যবাদ।”

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রোদেলা সবকিছু গুছিয়ে রেখে রুমে এলো।রুমে এসে দেখলো তাহসিন বিছানা ঝাড়ছে। বিছানা রেডি করা শেষে তাহসিন একপাশে যেয়ে শরীর এলিয়ে দিল।সারাদিনের ক্লান্তি এসে যেন এখন তাকে ভর করেছে।এইদিকে রোদেলা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়েই রইল। তার কেমন যেন লজ্জা লাগছে।রোদেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহসিন শুধালো,
-“কি হলো মায়মূন?দাঁড়িয়ে কেন?”

রোদেলা মুগ্ধ হয়ে তাহসিনের দিকে কিছুপল তাকিয়ে রইল। কত্তগুলো দিন পর তাহসিনের মুখে এই নামটা শুনতে পেরেছে সে।রোদেলা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো।লাইট অফ করে বিছানার পাশের হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। তারপর এক কোনায় চুপটি করে শুয়ে থাকলো।এতদিন তাহসিন ছিল না বিধায় তাহসিনের বালিশ জড়িয়ে ঘুম দিয়েছে।কিন্তু আজ তো তাহসিন পাশে আছে।তাহসিনের হাত ধরে ঘুমানো উচিত।কিন্তু তার যে বড় লজ্জা লাগছে। ওইদিকে তাহসিন রোদেলার উদ্দেশ্যে বলল,
-“কি হলো ঘুম আসছে না বুঝি?হাত দিব?হাত ধরে ঘুমাবে?”

তাহসিনের এই কথাটা শুনে রোদেলা জ্বিভ কাটলো।ধরা পড়ে যে গেল সে।লজ্জায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। তাহসিন ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“অভিমানী কন্যার লজ্জা দেখি এখনও কাটে নি।অভিমান করার সময় এই লজ্জা কোথায় থাকে?ফোনে তো খুব কথা শুনাও।এখন তাহলে চুপ কেন ম্যাডাম?এখন এত লজ্জারা কোথা থেকে উঁকি দিয়েছে শুনি?”

এই কথাটা শুনে রোদেলা লজ্জায় চুপ করে রইল।লোকটা সুযোগ বুঝে ঠিক জায়গাতে খোচাটা দিল।সমস্যা নেই রোদেলাও কোনো এক সময় এটার শোধ নিবে।রোদেলাকে সময় দিত না বিধায় তো সে এমন করতো।নয়তো রোদেলা এমন নাকি হুহ? শুধু এই লোকটার সামনে এলে তার কন্ঠরোধ হয়ে পড়ে বিধায় বলতে পারলো না,

-“আপনিও তো কাছে থাকলে আমায় ছাড়া কিচ্ছু বুঝেন না অথচ দূরে চলে এলে আমাকে ভুলেই যান।নিজের দোষের জন্য আমার কাছ থেকে কথা শুনেছেন।নেহাৎ রোদেলা ভদ্র মেয়ে বিধায় মুখের উপর জবাব দিল না মাহমুদ সাহেব। নয়তো এমন জবাব দিত যেন আপনি নিজেই লজ্জায় পড়ে যেতেন হুহ।”

রোদেলা মনে মনে বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে।তাই আজ জলদিই ঘুম তার চোখে হানা দিল।তবে হ্যাঁ তাহসিনের হাত মুঠোতে পুড়তে ভুললো না।রোদেলা তাহসিনের পাশে ফিরে চোখ বন্ধ করেই তাহসিনের হাত মুঠোতে পুড়লো।যাতে তাহসিনের চোখে চোখ পড়ে ফের লজ্জা পেতে না হয়। রোদেলার কান্ড দেখে তাহসিন ঠোঁট চেপে হাসলো।শান্তিময় একটা শ্বাস টেনে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।